শঙ্করাচার্যের মতে, যখন এই তুরীয়-দৃষ্টি জাগ্রত জীবনে অবিচল থাকে, তখনই হয় জীবন্মুক্তি। জ্ঞান উঠলে “আমি কর্তা” ভাব লুপ্ত হয়, কিন্তু দেহ-মন প্রারব্ধ কর্মে কিছুদিন চলে। সেই চলা আর ব্যক্তিগত নয়, লীলা-রূপে ঘটে। তিনি বলেন—অহংকার তখন “পোড়া দড়ির মতো”—রূপ আছে, শক্তি নেই। জ্ঞানীর দেহ-মন কর্ম করে, কিন্তু আত্মা থাকে নির্বিকার; তিনি অনাসক্ত থেকেও লোকসংগ্রহের (পরোপকারের) জন্য কাজ করেন—“লোকহিতার্থং গুরুণা চরণীযম্।” (শঙ্করাচার্যের গীতাভাষ্যে, ভগবদ্গীতা: ৩.২৫) এ অবস্থায় নীতিশাস্ত্র কোনো বাহ্য বাধ্যবাধকতা নয়; ধর্ম স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে, কারণ জ্ঞানীর অন্তরে আর কর্তা নেই।
গীতায় “লোকসংগ্রহ” শব্দটি এসেছে তৃতীয় অধ্যায়ে, কর্মযোগের ব্যাখ্যার অংশে। কৃষ্ণ সেখানে অর্জুনকে বলেন, জ্ঞানী ব্যক্তি যদি নিজে মুক্তও হন, তবু তাঁকে কর্ম করতে হবে—সমাজের মঙ্গল ও স্থিতির জন্য। লোকসংগ্রহ মানে মানুষকে একত্র করা নয়, বরং লোকদের হিতার্থে তাদের সঠিক পথে স্থাপন করা।
“লোক” অর্থ জনগণ বা সমাজ, আর “সংগ্রহ” মানে ধারণ, রক্ষা, সংরক্ষণ। তাই লোকসংগ্রহ মানে সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, মানুষের নৈতিক ও কর্মজীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা। গীতার ভাষায়—“জনকাদয়ঃ লোকসংগ্রহমেবাপি সম্পশ্যন্ কর্তুমর্হসি” (গীতা, ৩.২০)—অর্থাৎ, রাজর্ষি জনক প্রমুখেরা নিজ মুক্তির জন্য নয়, সমাজের কল্যাণের জন্যই কর্ম করতেন; তুমিও তা-ই করো।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যেমন অজ্ঞানীরা ফলের আসক্তিতে কর্ম করে, তেমনি জ্ঞানীও কর্ম করবে, কিন্তু অনাসক্তভাবে, যেন সাধারণ মানুষ তাঁর উদাহরণ দেখে পথভ্রষ্ট না হয়—“সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংশো যথা কুর্যুর্জনার্দন, তথাকর্তুম বিদ্বান্ তথা অসক্তঃ চিন্তন লোকসংগ্রহম্।” (গীতা, ৩.২৫) জ্ঞানীর কাজ তাই শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার মাধ্যম; তাঁর কর্ম সমাজে নৈতিক ভারসাম্য আনে। অজ্ঞানীরা আসক্তি নিয়ে কর্ম করে; তেমনি জ্ঞানীও কর্ম করবেন, তবে অনাসক্ত হয়ে, লোকসংগ্রহ অর্থাৎ সমাজের মঙ্গলের জন্য। এই শ্লোকের ওপরই শঙ্করাচার্যের ভাষ্যে আছে সেই বিখ্যাত মন্তব্য—“লোকহিতার্থং গুরুণা চরণীয়ম্”, অর্থাৎ, জ্ঞানীর জন্যও কর্ম পালনীয়, তবে তা নিজের প্রয়োজনে নয়, লোকহিতার্থে।
শঙ্করাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ী, “লোকসংগ্রহ” মানে “লোকানাম্ অনাবসাদঃ” (গীতার ৩.২৪ ভাষ্যাংশে)—সাধারণ মানুষ যেন বিভ্রান্ত না হয়, অলস না হয়, বা কর্মত্যাগের ভ্রান্তিতে না পড়ে। যদি জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম ত্যাগ করেন, তাহলে অজ্ঞানীরা ভাববে কর্ম অর্থহীন, সমাজের গতিও থেমে যাবে। তাই জ্ঞানীর কর্মের উদ্দেশ্য আত্মমোক্ষ নয়, অন্যের মঙ্গল; তিনি নিজে মুক্ত, কিন্তু সমাজের মঙ্গলের জন্য কর্ম চালিয়ে যান। জ্ঞানীও কর্ম করেন অন্যদের অধঃপতন রোধের জন্য।
এই ধারণার দার্শনিক অর্থ হলো, লোকসংগ্রহ কর্মের এক যোগ-উদ্দেশ্য। জ্ঞানী যখন কর্ম করেন, তখন তা নিজের ফলের জন্য নয়; তিনি ফল–আসক্ত নন। তাঁর কর্ম নিঃস্বার্থ, কল্যাণমুখী, ও শিক্ষামূলক। তাঁর জীবনই শাস্ত্রের উদাহরণ হয়ে ওঠে।
গীতায় লোকসংগ্রহ মানে—জ্ঞানী ব্যক্তি মুক্তি প্রাপ্ত হলেও সমাজের মঙ্গলার্থে কর্ম করে যান, যেন অন্যরা ন্যায় ও ধর্মপথে স্থিত থাকে। এটি অদ্বৈত জ্ঞানীর কর্মের সামাজিক প্রকাশ—যেখানে কর্তা নেই, তবু কর্ম ঘটে; কর্মের মধ্য দিয়েই ব্রহ্ম প্রকাশ পায়।
গৌড়পাদাচার্য মাণ্ডূক্য-কারিকায় বলেন—“নৈব জায়তে কশ্চিদ্দ্রষ্টা” (মাণ্ডূক্য কারিকা, ৪.৭২)—কেউ জন্মায় না, কেউ মরে না; সৃষ্টি আসলে কখনও ঘটে না। এই তত্ত্বকে বলা হয় অজাতিবাদ—অর্থাৎ, সব কিছুই অজন্ম, অবিকৃত, চিরস্থিত চেতনার প্রকাশমাত্র। যা সৃষ্টি বলে মনে হয়, তা মায়ার দ্বারা প্রতীয়মান নাম-রূপের খেলা। ব্রহ্ম কোনো সৃষ্টি করেন না; জগৎ কেবল তাঁর চেতনার প্রতিবিম্ব। অজাতিবাদের দৃষ্টিতে মুক্তি বা বন্ধনও বাস্তব নয়—সবই মায়ার ধারণা। জ্ঞান মানে এই মায়াবোধের অবসান, যেখানে জানা যায় যে, কখনও কিছুর সৃষ্টি বা বিনাশ ঘটেনি—“অজং নিত্যং শুদ্ধমেকং চ তৎ তুরীয়ম্।” (মাণ্ডূক্য কারিকা, ৩.৪৮)
অদ্বৈতের এই চার ধাপে একধরনের ধারাবাহিকতা আছে। গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ হলো সেই চেতনার ব্যাবহারিক প্রকাশ—কর্মে থেকেও অচঞ্চল থাকা। মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয় সেই চেতনার সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থান—যা তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে। শঙ্করাচার্যের জীবন্মুক্তি হল তুরীয় চেতনার জীবনে বাস্তব স্থিতি। আর গৌড়পাদাচার্যের অজাতিবাদ সেই চেতনার চূড়ান্ত উপলব্ধি—যেখানে সৃষ্টি, মুক্তি, বন্ধন—সবই স্বপ্নসদৃশ, কেবল ব্রহ্মই একমাত্র সত্য।
এই চার তত্ত্ব মূলত একে অপরের ধারাবাহিক রূপ। স্থিতপ্রজ্ঞ চেতনা তুরীয়ে স্থিত হয়, তুরীয়ে স্থিত হলে মানুষ জীবন্মুক্ত হয়, আর জীবন্মুক্তির চূড়ান্ত জ্ঞান অজাতিবাদ—যেখানে জানা যায়, কিছুই কখনও ঘটেনি, কিছুই কখনও হারায়নি, সবই চির-অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মের মধ্যেই স্থিত।
এই চারটি ধারা মিলিত হয়ে অদ্বৈত সত্যের পূর্ণ চিত্র আঁকে—স্থিতপ্রজ্ঞ হলো তুরীয়ের মানবজীবনে প্রকাশ, জীবন্মুক্তি হল তুরীয়ে স্থিত জীবনের বাস্তব রূপ, আর অজাতিবাদ সেই চেতনার চূড়ান্ত দৃষ্টি—যেখানে সৃষ্টি ও মুক্তি, জগৎ ও ব্রহ্ম—সব এক অবিভক্ত চৈতন্যস্বরূপ।
জ্ঞানীর মন কৃত্রিমভাবে কঠিন নয়, আবার ভোগে নরমও নয়—সে স্বচ্ছ। গীতার ভাষায় তিনি “দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ” (গীতা, ২.৫৬)—যিনি দুঃখে উদ্বিগ্ন হন না, সুখে আসক্ত হন না, যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত—তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ, তিনিই মুনি (জ্ঞানী) নামে পরিচিত। শঙ্করাচার্য বলেন, এটি দমন নয়, বরং স্বরূপ-স্থিতি; মন আর ইন্দ্রিয়বৃত্তির হাতে বন্দি নয়, আবার ত্যাগের ভানেও আপ্লুত নয়। মন তখন স্বচ্ছ জলের মতো—ঢেউ ওঠে, নামেও, কিন্তু গভীরের নিস্তরঙ্গতা অক্ষত থাকে। এই শ্লোকেই গীতায় স্থিতপ্রজ্ঞের বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়েছে, যেখানে মন সমস্ত দ্বন্দ্বে অবিচল ও শান্ত থাকে—এটাই জ্ঞানের বাস্তব প্রকাশ, যাকে বেদান্তে বলা হয় চেতনার স্থিতি তুরীয়ে।
আনন্দ ও দুঃখ তখন ঘটনা-মাত্র। তারা আসে, ছোঁয়, মিলিয়ে যায়, কিন্তু ‘আমি’-মুদ্রা পড়ে না। গৌড়পাদাচার্যের মাণ্ডূক্য–কারিকা বলে, “আনন্দাঃ দুঃখাশ্চ সর্বে বিকারাঃ সংকল্পজাতয়ঃ” (অষ্টাবক্রগীতা, ১.৬ ও যোগবাশিষ্ঠ-এর বহু স্থানে থাকা মন-সঙ্কল্প-উৎপন্ন সুখ-দুঃখ/বিকারের শিক্ষার সংক্ষিপ্ত, জনপ্রিয় রূপান্তর)—সুখ ও দুঃখ উভয়ই কল্পনাজাত। চেতনা-স্বরূপ আত্মা এসব পরিবর্তনের সাক্ষী, অংশগ্রাহী নয়। তাই জ্ঞানীর চেতনা আয়নার মতো—প্রতিফলন আসে, যায়, কিন্তু কোনো ছাপ রাখে না।
জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থা তুরীয়ের উপর ঢেউ-মাত্র। মাণ্ডূক্য উপনিষদের মন্ত্র ৭ বলে, “না বহিঃ প্রজ্ঞম্ না অন্তঃ প্রজ্ঞম্… স আত্মা স বিজ্ঞানীয়ঃ”—তুরীয় কোনো নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা নয়; এটি সেই চেতনা, যার পটভূমিতে জাগ্রত, স্বপ্ন ও নিদ্রা ওঠানামা করে। গৌড়পাদাচার্য এই অবস্থাকে বলেন অস্পর্শযোগ—চেতনার এমন যোগ, যেখানে কোনো স্পর্শ নেই, কেবল নিঃস্পন্দ জাগ্রতি।
নিঃস্পন্দ জাগ্রতি অদ্বৈত বেদান্তে চেতনার এক বিশেষ অবস্থা, যেখানে মন সম্পূর্ণ স্থির, কিন্তু চেতনা নিভে যায় না। ‘নিঃস্পন্দ’ মানে যেখানে কোনো কম্পন নেই, আর ‘জাগ্রতি’ মানে চেতনার জেগে থাকা। এই দুই একত্র হলে অর্থ দাঁড়ায়—স্থির অথচ জাগ্রত থাকা, এমন এক অবস্থা, যেখানে কোনো মানসিক দোলন নেই, কিন্তু সচেতনতার দীপ্তি অক্ষত।
গৌড়পাদাচার্য মাণ্ডূক্য-কারিকায় (৩.৩৫) এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে লিখেছেন—“নৈষা নন্দা ন তন্দ্রা চ, নৈষা স্বপ্নো ন চৈতনম্। নিঃস্পন্দো জাগরূপোয়ং, ব্রহ্ম স্থিতিপরায়ণঃ।।”—এই অবস্থা না ঘুম, না জাগরণ, না স্বপ্ন; এটি এক নিঃস্পন্দ জাগ্রতি, যেখানে ব্রহ্মচেতনা নিজের মধ্যেই স্থিত।
এই অবস্থায় মন আর কোনো ভাব, ইচ্ছা বা প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলিত হয় না। চিন্তার ওঠানামা থেমে গেছে, কিন্তু চেতনা জেগে আছে। এটি ঘুম নয়, কারণ সেখানে অচেতনা নেই; এটি জাগরণও নয়, কারণ এখানে দ্বৈত অভিজ্ঞতা নেই। এই নিস্তরঙ্গ চেতনা-জাগরণই তুরীয়াবস্থা।
শঙ্করাচার্য এই অবস্থা ব্যাখ্যা করতে বলেন—যখন মন চেতনার স্বরূপে বিশ্রাম নেয়, তখন সেটিই জীবন্মুক্তির অবস্থা। সেখানে মন নিভে যায় না, কিন্তু তার সব গতি থেমে যায়। মন চেতনার মধ্যেই বিলীন, চেতনা সেখানে নিজের আলোয় স্বয়ংপ্রকাশ।
নিঃস্পন্দ জাগ্রত অবস্থায় ব্যক্তি ঘুমন্ত নন, বরং অন্তরে জেগে আছেন—চেতন, কিন্তু নিস্পন্দ। তিনি দেখেন, কিন্তু দেখা কোনো ভেদ আনে না; শোনেন, কিন্তু শব্দে প্রতিক্রিয়া হয় না। চেতনা সব কিছুকে ধারণ করে, কিন্তু কিছুতেই জড়ায় না।
এই অবস্থা মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয়েরই আরেক নাম—যেখানে জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—সব তিনটি অবস্থার পটভূমি অতিক্রম করে চেতনা নিজের মধ্যেই স্থিত হয়। গৌড়পাদাচার্য বলেন, “মনঃপ্রশমো হ্যেষ ব্রহ্মাভেদন অবস্থিতিঃ” (মাণ্ডূক্য–কারিকা, ৩.৩৪)—মনের সমস্ত স্পন্দন থেমে যাওয়াই ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদ অবস্থান।
নিঃস্পন্দ জাগ্রতি মানে সেই জাগরণ, যা ঘুমের মতো স্থির, কিন্তু জাগরণের মতো সচেতন। চেতনা সেখানে নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত, যেখানে কোনো বিকার নেই, কোনো প্রক্ষেপ নেই, শুধু নিঃস্পন্দ প্রজ্ঞা।
এই অবস্থায় নীরবতা নিস্তব্ধ নয়, বরং জীবন্ত। এটি এমন এক গভীর সুর, যেখানে সব আন্দোলন থেমে গেছে, কিন্তু চেতনার সংগীত বাজছে অন্তরে। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি এই নিঃস্পন্দ জাগ্রত অবস্থায় থাকেন—চলছেন, বলছেন, কাজ করছেন, অথচ অন্তরে নিস্তরঙ্গ ও অবিকৃত। চেতনা সর্বদা জেগে থাকে, কিন্তু কোনো তরঙ্গ তোলে না—যেমন নিস্তরঙ্গ হ্রদের উপর চাঁদের প্রতিচ্ছবি কাঁপে না, তেমনি।
নিদিধ্যাসনের তাপে স্মৃতি, সংস্কার ও প্রেরণা ধীরে ধীরে আলগা হয়। গৌড়পাদাচার্যের মাণ্ডূক্য কারিকা, ৩.৩৪—“মনঃপ্রশমো হ্যেষ ব্রহ্মাভেদন অবস্থিতিঃ …”—নিদিধ্যাসনে স্থিরচিত্ত ব্রহ্ম-অভেদের স্থিতি; নিবৃত্ত মনই মুক্তিস্থান। অর্থাৎ, তত্ত্ব-নিশ্চয়ে মনকে স্থাপন করাই নিদিধ্যাসন—নিদিধ্যাসন মানে বুদ্ধিকে স্থির করা, যাতে ব্রহ্মজ্ঞান অবিচল থাকে। জীবন্মুক্তির এই স্থিতি কোনো নতুন অর্জন নয়; এটি আবরণ-ভঙ্গ—যা ছিল, তা-ই প্রকাশ পায়। গীতার ভাষায়, “যদা তে মোহ–কলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি…”(গীতা, ২.৫২)—যখন মায়ার কুয়াশা কেটে যায়, তখন জ্ঞান স্থিত হয়।
যত গভীর হয় এই স্থিতি, তত কমে প্রতিক্রিয়া। বাইরে যা-ই ঘটুক, তা আর ভেতরে ঢেউ তোলে না। গীতার ৫.৮–এ বলা হয়েছে, “নৈব কিন্চিত্ করোমি”—জ্ঞানী জানেন, আমি কিছুই করি না; কর্ম ঘটে, আমি শুধু সাক্ষী। তাই তাঁর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার বদলে বোঝা আসে, আর বোঝার মধ্যেই কর্ম স্বতঃসিদ্ধভাবে ঘটে।
এই নীরবতা নিস্ক্রিয় নয়; এটি ব্রহ্মচেতনার সৃজনশীল নীরবতা। মাণ্ডূক্য, ৭-এর “শান্তং…স আত্মা” ও কারিকা ৩.৩৪-৩.৩৫-এর “নির্বিকল্প, প্রশমিত মন ব্রহ্ম-অভেদে স্থিত”—এই দুই স্রোতের একটি ভাব-সংমিশ্রণ/পারাফ্রেজ প্রচলিত—“শান্তঃ প্রজ্ঞাত্মা”—জ্ঞানীর মন শান্ত, কিন্তু জাগ্রত। কর্ম, চিন্তা, বচন—সবই তাঁর মধ্যে ঘটে, কিন্তু কোথাও কোনো বাঁধন নেই। তাঁর মধ্যে নীরবতা এমন, যেন বচনের ভিতরে সুর বাজছে।
এই অবস্থায় জীবন্মুক্ত ব্যক্তি তুরীয়-চেতনায় স্থিত থেকেও জাগতিকভাবে কার্যরত। গৌড়পাদাচার্য একে বলেন অজাতি—কিছু সৃষ্টি হয় না, কিছু ধ্বংসও হয় না; সবই চেতনার অনন্ত প্রতিফলন। গীতার ভাষায়, “ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ” (গীতা, ৫.১০)—জ্ঞানী কর্ম করেন, কিন্তু ব্রহ্মে অবলম্বিত হয়ে, ফলের আসক্তি ছাড়া।
জীবন্মুক্ত অবস্থা তাই সেই সমন্বিত জাগ্রতি, যেখানে কর্মে কর্ম নেই, চিন্তায় দোলন নেই, নীরবতায় স্থবিরতা নেই। মন সেখানে না কঠিন, না নরম—বরং নির্মল ও স্বচ্ছ। ভিতরে নিস্তরঙ্গ চৈতন্য, বাইরে স্বতঃসিদ্ধ কর্মপ্রবাহ। জীবন সেখানে মুক্তিরই প্রকাশ; নীরবতা ও কর্ম একাকার হয়ে থাকে। জীবন্মুক্ত ব্যক্তির মধ্যে তখন ব্রহ্ম ও জগৎ এক অখণ্ড প্রতিধ্বনি—চলমান চৈতন্যের নিত্য নৃত্য।