অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো আঠারো



“এ ঘরে ঘড়া নেই” জানার যা যা শর্ত: ঘর আলোকিত, দূরত্ব ও দিক উপযুক্ত, দৃষ্টিবাধা নেই, ইন্দ্রিয় সচল—সব ‘উপলব্ধি-যোগ্যতা’ উপস্থিত। তবু ঘড়া দেখা গেল না—এ থেকে ‘ঘড়া-অভাব’ জ্ঞান হয়। কিন্তু যদি অন্ধকার থাকে বা দৃষ্টি-আবরণ থাকে, তখন ‘না-দেখা’ থেকে ‘নেই’ বলা যাবে না—কারণ ‘উপলব্ধি-যোগ্যতা’ ভঙ্গ হয়েছে। ন্যায় এই সতর্কতা জোর দিয়ে শেখায়, যাতে “না-দেখা মানে নেই”—এই তড়িঘড়ি ভ্রান্তি এড়ানো যায়।

অদ্বৈতের সঙ্গে সেতুবন্ধ: অদ্বৈত ন্যায়ের “অত্যন্ত‌অভাব” পরিভাষা ধার নিয়ে মিথ্যা-বস্তুর প্রকৃতি আরও পরিষ্কার করে। “নিজ আধারে চিরকালীন অনুপস্থিতি”—এটাই অত্যন্ত‌অভাব। দড়িতে সাপ, শুক্তিতে রুপা, মরুভূমিতে মায়াজল—এই সবের নিজ নিজ আধারে তিন কালে কখনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট আধারে ওই প্রতিযোগীর অত্যন্ত‌অভাব।

অদ্বৈত কিন্তু এখানেই থামে না; তারা বলে—মিথ্যা-বস্তুর বিশেষত্ব দ্বিমুখী: (ক) নিজের আধারে ত্রিকালীন অনুপস্থিতি (অত্যন্ত‌অভাব), তবু (খ) চেতনায় প্রতীতি ঘটে। এই দ্বিমুখী অবস্থান—“ত্রিকালীন অনুপস্থিতি” সত্ত্বেও “প্রতীতি-সাপেক্ষ উপস্থিতি”—মিথ্যাত্বের চিহ্ন। তাই দড়িতে “সাপ নেই”—এটা অত্যন্ত‌অভাব; কিন্তু “সাপ দেখা”—এটা প্রতীতি। নিবারণ হলে প্রতীতির “সত্যতার দাবি” কেবল বাতিল হয়; “প্রতীতি ঘটেছিল”, এই ঐতিহাসিক বা অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য মুছে যায় না।

এখান থেকে সত্য-মিথ্যা-অসৎ পার্থক্য স্পষ্ট হয়। সত্য: যা তিন কালে অনাবাধ (ব্রহ্ম—অনাবাধ সত্য)। অসৎ: যা কখনোই প্রতীয়মানও নয়, কোথাও কোনো কালে নেই (শশশৃঙ্গ)—নির্বিশেষ অনুপস্থিতি, শুধু চিন্তা-নির্ভর কাল্পনিক বচন। মিথ্যা: যা প্রতীয়মান হয়, কিন্তু নিজের আধারে ত্রিকালেই অনুপস্থিত—সদসদ্বিলক্ষণ; প্রতীতি আছে, অনাবাধতা নেই।

এই আলোচনার দার্শনিক ফল দুটি।

প্রথমত, যদি “অভাব”-কে জ্ঞানতত্ত্বের অংশ হিসেবে না ধরা হয়, তাহলে “নেই”-বাচক জ্ঞান—অর্থাৎ “এখানে কিছু নেই” এই ধরনের জ্ঞান—ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে যায়। তাই ন্যায় দর্শনের অবদান এখানে মৌলিক; তারা অভাবকে জ্ঞানযোগ্য বাস্তব রূপে মেনে “অভাব-জ্ঞান”-এর জন্য যুক্তিসম্মত ভিত্তি তৈরি করেছে।

দ্বিতীয়ত, অদ্বৈত দর্শনে “অত্যন্ত-অভাব” ধারণা মেনে নিলে মিথ্যাত্ব-তত্ত্ব আরও সূক্ষ্মভাবে বোঝা যায়। এখানে মিথ্যা কোনো বাস্তব বা ধনাত্মক সত্তা নয়, কিন্তু তা প্রতীতিতে ধরা পড়ে। অর্থাৎ, এটি দেখা যায় বা অনুভূত হয়, কিন্তু এর কোনো অস্তিত্ব ভিত্তি-স্তরে (অধিষ্ঠানে) নেই। তার বাস্তবতা কেবল প্রতীতির স্তরে সীমিত, চূড়ান্ত সত্যে নয়।

নিবারণ মানে ধ্বংস নয়—বোধ-সংশোধন। দড়িতে সাপ-প্রতীতি নিবারিত হলে “সাপ”-অর্থের দাবি সরে যায়; “এটা”—অর্থাৎ অধিষ্ঠান-বোধ টিকে থেকে “এটা দড়ি” জ্ঞানে স্থিত হয়। প্রাতিভাসিক প্রতীতি ব্যাবহারিকে, ব্যাবহারিক প্রতীতি ব্রহ্মজ্ঞানে বাধিত—কিন্তু প্রতিটি বাধের পেছনে পূর্ব-প্রতীতির উপস্থিতি অপরিহার্য। যা কখনও প্রতীয়মানই হয়নি—তার আবার “বাধ” কীসের? এই প্রশ্নেই অভাব-তত্ত্ব, মিথ্যাত্ব-তত্ত্ব এবং ত্রিস্তর-বাস্তবতার প্রকৃত সংযোগ ধরা পড়ে।

ন্যায়-মতে, অভাবও প্রত্যক্ষযোগ্য; “এখানে ঘট নেই” এই জ্ঞান সরাসরি হয়, কারণ মন বিশেষভাবে অভাব ধারণ করে। তাই অভাবকে তারা বাস্তব সত্তা হিসেবে মেনে নেয়, যদিও এটি অস্তিত্বের নেতিবাচক রূপ।

অদ্বৈত বেদান্ত ন্যায়ের মতো অভাবকে স্বতন্ত্র পদার্থ বলে মানে না, তবে অত্যন্তঅভাবের ধারণা ব্যবহার করে মিথ্যাত্ব বোঝায়। দড়িতে সাপ, শুক্তিতে রুপা, মরুভূমিতে মায়াজল—সব ক্ষেত্রেই মিথ্যা-বস্তু নিজের আধারে ত্রিকালে অনুপস্থিত। কিন্তু সেই আধারের উপরই আপাতভাবে প্রতীয়মান হয়। এই তত্ত্বেই অদ্বৈত বলে—যা আধারে চিরকাল নেই, অথচ তাতে প্রতীয়মান, সেটিই মিথ্যা।

ন্যায়ের অভাব তত্ত্ব বলে, অস্তিত্বের বিপরীত অবস্থাও বাস্তব, এবং অদ্বৈত এই ধারণাকে রূপান্তরিত করে বলে—অধিষ্ঠান ব্যতীত কোনো প্রতীতি সত্য নয়। যা ত্রিকালে অবাধিত, সেটিই সত্য; যা ত্রিকালে বাধিত, সেটি অসত্য; আর যা আধারে প্রতীয়মান অথচ উচ্চতর জ্ঞানে বিলীন, সেটিই মিথ্যা।

অদ্বৈতের বিরুদ্ধে এক সাধারণ আপত্তি হলো—যদি জগৎ মিথ্যা হয়, তবে এই জগতে বিধি, নীতি, বিজ্ঞান, কারণ-কার্য বা দায়িত্ববোধের কোনো অর্থই বা থাকে কীভাবে? কিন্তু এর উত্তরও অদ্বৈত দেয় স্তরভেদে—ব্যাবহারিক সত্যের (vyāvahārika-sattā) মধ্যেই এই নিয়ম, নীতি ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণ কার্যকর।

ব্যাবহারিক স্তরে, যতক্ষণ পর্যন্ত মায়া সক্রিয়, ততক্ষণ সকল জীব একই সম্মিলিত প্রতীতির মধ্যে বাস করে। এটাই সাধারণ মায়া-নিয়ন্ত্রিত জগৎ-অভিজ্ঞতা—যেখানে দিন-রাত্রি, কারণ-কার্য, নীতি-অনীতি, সুখ-দুঃখ—সবই প্রায় সকলের কাছে অভিন্নভাবে প্রতীয়মান—তাই এই স্তরে বিধি, নীতি, বিজ্ঞান, কর্তব্য, দায়িত্ব সবই অর্থবহ ও কার্যকর। যেমন স্বপ্নে আমরা যে-জগৎ দেখি, সেখানে কাজ, কথা, নীতি, সুখ-দুঃখ—সবই স্বপ্নের অভ্যন্তরীণ যুক্তি অনুযায়ী চলে; তেমনি জাগ্রত অবস্থায়ও ব্যাবহারিক যুক্তি, নৈতিক শৃঙ্খলা ও বৈজ্ঞানিক কারণবাদ সবই যথাস্থানে কার্যকর।

তবে এই ব্যাবহারিকতারও সীমা আছে—এটি বাধযোগ্য, অর্থাৎ, উচ্চতর জ্ঞানে অতিক্রমণযোগ্য। যেমন জাগরণের আলোয় “স্বপ্ন মিথ্যা” প্রমাণিত হয়, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে জাগতিক বাস্তবতার দাবিও নিঃশেষে টিকে থাকে না। কিন্তু এখানে মিথ্যা মানে ধ্বংস নয়; বরং পুনর্নির্ধারণ—নিম্নতর আলোর সামনে উচ্চতর আলোর উদয় হলে নিম্নতর আলোকের সীমা জানা যায়, তা পুরোপুরি অস্বীকৃত হয় না।

এই কারণেই জ্ঞানীর জীবনে করুণা, ধর্ম, কর্তব্য সবই থাকে, কিন্তু আর বাঁধন-রূপে নয়, লীলা-রূপে। তিনি জগতে আচরণ করেন, কিন্তু তাতে তাঁর অহং নেই, ফলের আসক্তি নেই, ভয়ের কারণ নেই। জ্ঞানীর জন্য কর্মের ক্ষেত্র থাকে, কিন্তু তার মধ্যে আর কর্তা-ভাব থাকে না—তিনি জানেন, “সব কিছু ব্রহ্মের মধ্যেই ঘটছে, আমি কেবল তার সাক্ষী”।

জগৎ মিথ্যা হলেও, তার ব্যাবহারিক স্তর কার্যকর, নীতি ও বিজ্ঞান অর্থপূর্ণ, কারণ মায়া-নিয়ন্ত্রিত এই সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা সকলের জন্য একইরূপ। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে দেখা যায়—এই সমস্ত কার্যকারিতা কেবল আপাত, ব্রহ্মের আলোর প্রতিবিম্বমাত্র। তখন জীবন হয়ে ওঠে লীলা, মুক্ত কর্মের ক্ষেত্র; যেখানে সব কিছু থাকে, কিন্তু বাঁধে না—কারণ জ্ঞানী জানেন, “যা আছে, তা একমাত্র চেতনারই প্রকাশ”।

অদ্বৈত বেদান্তে মিথ্যাত্বকে অনির্বচনীয় বলা হয়, কারণ একে “সত্য” বললে জ্ঞান-বাধার সঙ্গে বিরোধ ঘটে, আর “অসত্য” বললে বর্তমান প্রতীতির সঙ্গে বিরোধ ঘটে। অর্থাৎ, যদি জগৎ সত্য হয়, তবে জ্ঞান উদিত হয়েও তা কেন লুপ্ত হয়? আর যদি সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়, তবে তা কেন প্রতীয়মান? এই দুই বিপরীত অবস্থার মাঝামাঝি যে সূক্ষ্ম অবস্থা—যেখানে জগৎ দেখা যায়, কিন্তু সত্য নয়—সেই অনির্বচনীয় অবস্থাই মিথ্যাত্ব।

এই মধ্যস্থতা অদ্বৈতের মৌল সমাধান—এটি নিছক নৈরাশ্য নয়, আবার নিছক বাস্তবতাও নয়। এটি এক শিক্ষণ-উপায়, এক অভিজ্ঞতার মানচিত্র, যা মানুষকে ধাপে ধাপে মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। মিথ্যাত্ব এখানে কোনো দার্শনিক নৈরাজ্য নয়; বরং তর্ক-সেতু, যা ব্যাবহারিক জগত থেকে পরমার্থে উত্তরণের পথ তৈরি করে।

এই শিক্ষণপদ্ধতি স্পষ্টভাবে দেখা যায় অধ্যারোপ-অপবাদ নীতিতে। শাস্ত্র প্রথমে জ্ঞানার্থীর বুদ্ধির উপযোগী করার জন্য ব্রহ্মে গুণ আরোপ করে—তাকে বলা হয় স্রষ্টা, ধারক, সংহারক। এতে মন স্থির হয়, চিন্তার দিশা পায়। পরে যখন মন প্রস্তুত হয়, তখন একই শাস্ত্র অপবাদ দ্বারা বলে—ব্রহ্ম কোনো গুণবিশিষ্ট সত্তা নয়, তিনি নির্গুণ, নির্বিকার, অদ্বৈত। এভাবেই অদ্বৈত বুদ্ধিকে এক ধারণা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, তারপর সেই ধারণাটিই মুছে দেয়।

যে-গ্রন্থ শেখায়, সেই গ্রন্থই শেষমেশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে; যে-মই উপরে তোলে, সেটিকেই ফেলে দিতে হয়। এই ভাবনা বেদান্তে “পরাবিদ্যা” ও “অপরাবিদ্যা” ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, যা গীতা ও উপনিষদে স্পষ্টভাবে প্রতিপাদিত হয়েছে।

মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে—“দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে, পরা চৈবাপরা চ।” (মুণ্ডক ১.১.৪)
অর্থাৎ, জানার বিষয় দুই প্রকার—পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা।

এরপর উপনিষদ বলে—“তত্র অপরা—ঋগ্বেদঃ যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অথর্ববেদঃ, শিক্ষা, কল্পঃ, ব্যাকরণম্‌, নিরুক্তম্‌, ছন্দঃ, জ্যোতিষম্‌। অথ পরা—যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।” (মুণ্ডক ১.১.৫)
অর্থাৎ, অপরাবিদ্যা হলো সমস্ত বেদ, শাস্ত্র, মন্ত্র, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতিষ ইত্যাদি—সব বাহ্যিক জ্ঞানের রূপ; আর পরাবিদ্যা হলো সেই জ্ঞান, যার দ্বারা অক্ষর ব্রহ্মকে জানা যায়। অপরাবিদ্যা মানুষকে জ্ঞানের পথে প্রস্তুত করে, কিন্তু মুক্তি দেয় না। এটি মায়া ও সীমাবদ্ধতার প্রকৃতি বোঝায়, যাতে মন সত্যের দিকে ফিরে আসে। তবে এটি এখনও দ্বৈত—এখানে জানার চেষ্টা, তত্ত্ব, যুক্তি, বিশ্লেষণ—সবই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের বিভাজনের মধ্যে আবদ্ধ।

মুণ্ডক উপনিষদ (১.২.৭)-এ অপরাবিদ্যার সীমা বোঝাতে বলা হয়েছে—“প্লবা হ্যেতে অধৃতা যজ্ঞরূপাঃ অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম।”
অর্থাৎ, যজ্ঞরূপ কর্মগুলো অস্থির নৌকার মতো; এরা মুক্তির পার পার করতে পারে না—শুধু পথের সূচনা দেয়।

এই ভাব থেকেই বলা যায়—যেমন নৌকা পার করিয়ে দেয়, কিন্তু পরে ছেড়ে দিতে হয়, তেমনি জ্ঞান উদিত হলে শাস্ত্র, তত্ত্ব ও কর্মের নৌকাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। তৎ স্বয়ং যোগসংশিদ্ধঃ কালে নাত্মনি বিন্দতি॥” (গীতা ৪.৩৮)
অর্থাৎ, এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্র কিছু নেই; যোগে সিদ্ধ ব্যক্তি কালক্রমে সেই জ্ঞান আত্মার মধ্যে অনুভব করে।

এখানে “জ্ঞান” মানে সেই পরাবিদ্যা—যা আর কোনো মাধ্যম নয়, যা নিজেই মুক্তি। এই জ্ঞান কোনো তথ্য নয়, কোনো চিন্তা নয়—এটি আত্মসাক্ষাৎ। যখন সেই পরাবিদ্যা উদিত হয়, তখন ভাষা, মন, এমনকি বেদনাও তার সীমায় পৌঁছাতে পারে না।

কেন উপনিষদে (১.৩) বলা হয়েছে—“ন তত্র ভাষা গচ্ছতি, ন মনঃ, ন চক্ষুঃ; ন বিদ্মো, ন বিজানীমঃ।”
অর্থাৎ, সেই পরাবিদ্যায় ভাষা পৌঁছায় না, মনও নয়, চোখও নয়; আমরা তা জানি না, কীভাবে জানব, তা-ও জানি না। কারণ এখানে জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার সব ভেদ লুপ্ত—চেতনা কেবল নিজের মধ্যেই অবস্থান করে।

গীতায় আবার শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“জ্ঞানোপমতৃপ্তচেতাঃ।” (গীতা ৬.৮)
অর্থাৎ, যে আত্মজ্ঞানেই তৃপ্ত, নিজের মধ্যেই পরিতৃপ্ত—সেই প্রকৃত যোগী।

এই অবস্থায় জ্ঞান আর উপায় নয়; এটি নিজেই ব্রহ্মরূপ—চেতনার স্বপ্রকাশ। এই পর্যায়ে শাস্ত্র, তত্ত্ব, যুক্তি—সবই সত্যে পৌঁছানোর উপায়, কিন্তু সত্য নয়। যখন পরাবিদ্যা উদিত হয়, তখন অপরাবিদ্যা নিজের কাজ শেষ করে বিলীন হয় সেই চেতনার মধ্যে, যার আলোয় তারা প্রতীয়মান ছিল।

গীতার শেষাংশে, শ্রীকৃষ্ণ এই চূড়ান্ত অবস্থাকেই ব্যাখ্যা করেন—“এষা ব্রাহ্মী স্থিতি পার্থ, নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি। স্থিত্বাস্যামন্তকালে’পি ব্রহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি॥” (গীতা ২.৭২)
অর্থাৎ, এই ব্রহ্মস্থিতি একবার লাভ করলে আর কোনো বিভ্রম থাকে না; যে-ব্যক্তি মৃত্যুকালেও এতে স্থিত থাকে, সে ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করে। এই অবস্থায় মিথ্যা, তত্ত্ব, বা কোনো জ্ঞানপথ আর অবশিষ্ট থাকে না। সব লীন হয় সেই নীরব স্বপ্রকাশ চেতনার মধ্যে, যেখানে শাস্ত্র, যুক্তি, ও মিথ্যাত্ব—সবই নিজের উৎসে ফিরে যায়।

যে-গ্রন্থ শেখায়, সেই গ্রন্থই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে; যে-মই উপরে তোলে, সেটিকেই শেষে ফেলে দিতে হয়। কারণ শাস্ত্র, যুক্তি, তত্ত্ব—সবই সত্যে পৌঁছানোর উপায় মাত্র। সত্য প্রকাশিত হলে এই উপায়গুলো নিজেই বিলীন হয়ে যায়, আর যা থাকে, তার আলোয় মিথ্যাত্বও নিজের ব্যাখ্যা খুঁজে পায়, এবং শেষে নিজেই বিলীন হয়ে যায়।

পরাবিদ্যা হলো সেই জ্ঞান, যা মুক্তির পরিণতি; আর অপরাবিদ্যা সেই পথ, যা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। অপরাবিদ্যা নিজের কাজ শেষ হলে মুছে যায়, ঠিক যেমন নৌকা তীরে পৌঁছে ছেড়ে দেওয়া হয়। যা অবশিষ্ট থাকে, তা কেবল সেই নির্ভেদ, নীরব, আত্মপ্রকাশমান চেতনা—যার মধ্যে মিথ্যাত্ব, তত্ত্ব ও শাস্ত্র—সব নিজের ব্যাখ্যা পেয়ে অবশেষে লীন হয়ে যায়।