অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো পনেরো





“অনাবাধ” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো—যা কখনও বাধিত বা নিবারিত হয় না। ‘আবাধ’ মানে বাধ বা খণ্ডন; ‘অন’ উপসর্গ যুক্ত হলে অর্থ দাঁড়ায়—অবাধিত, অখণ্ডিত, চিরস্থায়ী।


বেদান্তে সত্য নির্ণয়ের প্রধান মানদণ্ডই হলো অনাবাধতা। যা তিন কালে—অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—কখনও নিবারিত হয় না, সেটিই সত্য। এই কারণেই বলা হয়—ত্রিকালাবাধিতম্‌ সৎ। যে-বস্তু বা জ্ঞান কখনও খণ্ডিত হয় না, সেই অনাবাধ; আর যা কোনো পর্যায়ে ভ্রান্ত বা নিবারিত হয়, তা মিথ্যা।


যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ভুল হওয়া একপ্রকার ভ্রম। সেই সাপ-জ্ঞান পরে দড়ি-জ্ঞান দ্বারা বাধিত হয়। কিন্তু দড়ি-জ্ঞান নিজে আর কোনো উচ্চতর জ্ঞানে নিবারিত হয় না, তাই সেটি অনাবাধ। আবার একইভাবে, জাগতিক জ্ঞান বা ব্যাবহারিক প্রতীতি ব্রহ্মজ্ঞানে বাধিত হয়—কারণ ব্রহ্ম উপলব্ধ হলে জগৎ-জ্ঞান মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান নিজে কখনও বাধিত হয় না, কারণ তার ঊর্ধ্বে আর কোনো জ্ঞান নেই।


অতএব, অনাবাধ মানে এমন সত্য, যা কোনো অবস্থায়, কোনো কালে, কোনো প্রমাণে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় না। এটি চিরসত্য, ত্রিকালাবাধিত। যেভাবে মিথ্যা বস্তুর সত্যতা এক পর্যায়ে নাকচ হয়, অনাবাধ বস্তুর সত্যতা তেমন নাকচ হয় না।


যা একবার জানা হয়ে গেলে আর কখনও ভুল প্রমাণিত হয় না, সেটাই অনাবাধ। ব্রহ্ম, আত্মা বা চেতনা অনাবাধ; কারণ তাদের জ্ঞানে কোনো পরবর্তী জ্ঞান বাধ সৃষ্টি করতে পারে না। এইভাবে বেদান্তে “অনাবাধ” শব্দটি সর্বোচ্চ সত্য বা পরমার্থিক বাস্তবতার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


“ত্রিকালাবাধিতম্‌ সৎ” কথাটি কোনো নির্দিষ্ট উপনিষদ বা শাস্ত্রের শ্লোক নয়, বরং বেদান্তে সত্যের একটি দার্শনিক সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞা প্রথম স্পষ্টভাবে শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যায় প্রকাশ পায় এবং পরবর্তী আচার্যরা একে সূত্ররূপে গ্রহণ করেন। এর অর্থ হলো—যে-বস্তু তিন কালে, অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে কখনও বাধিত বা খণ্ডিত হয় না, সেটিই সত্য।


এর মূল ধারণা গীতার ২.১৬ শ্লোকে নিহিত আছে—“নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাভো বিদ্যতে সতঃ”—অসতের অস্তিত্ব নেই, আর সতের অনস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ সত্য বস্তু কখনও অদৃশ্য বা মিথ্যা হয় না, আর মিথ্যা বস্তু কখনও সত্য হয়ে ওঠে না। এই নীতিই পরে শঙ্কর ও অদ্বৈতাচার্যদের আলোচনায় “ত্রিকালাবাধিতম্‌ সৎ” হিসেবে সংক্ষেপে প্রকাশ পায়।


শঙ্করভাষ্যের বিভিন্ন স্থানে এই ভাবটি বারবার এসেছে। তিনি বলেন—যা তিন কালে কখনও নিবারিত হয় না, সেটাই সত্য। তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভাষ্যে, ছান্দোগ্য উপনিষদ ভাষ্যে এবং ব্রহ্মসূত্রভাষ্যের নানা অংশে এই ভাব উপস্থিত। শঙ্করের মতে, ব্রহ্মই একমাত্র অনাবাধ সত্য—কারণ তা কখনও পরিবর্তিত বা নিবারিত হয় না; অন্য সব বস্তু তার তুলনায় আপেক্ষিক।


এই ধারণাই পরবর্তী অদ্বৈত গ্রন্থে স্পষ্ট সংজ্ঞায় রূপ নেয়। “তত্ত্ববোধ”, “বেদান্তসার”, “পঞ্চদশী” প্রভৃতি গ্রন্থে শুরুতেই বলা হয়েছে—“সত্যম্‌ যদ্‌ ত্রিকালাবাধিতম্‌ তদ্‌ সত্যম্‌।” অর্থাৎ, যা তিন কালে নিবারিত হয় না, সেটিই সত্য। এটি পরে অদ্বৈত শিক্ষার মৌল ভিত্তি হয়ে ওঠে।


এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, সত্য, মিথ্যা ও অসৎ—এই তিন শ্রেণির পার্থক্য নির্ধারিত হয়। সত্য হলো ত্রিকালাবাধিত, যা কখনও নিবারিত হয় না—যেমন ব্রহ্ম। মিথ্যা হলো যা একপর্যায়ে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু পরে নিবারিত হয়—যেমন দড়িতে সাপ বা স্বপ্নের জগৎ। অসৎ হলো যা কখনও প্রতীয়মানই হয় না—যেমন শশশৃঙ্গ বা আকাশপুষ্প।


“ত্রিকালাবাধিতম্‌ সৎ” বেদান্তে সত্যের সর্বোচ্চ মানদণ্ড। যা কখনও নিবারিত হয় না, সেই অনাবাধ সত্তাই পারমার্থিক বাস্তবতা; অন্য সব জ্ঞান বা প্রতীতি সেই পরম সত্যের তুলনায় সীমিত, এবং শেষে ব্রহ্মজ্ঞানে নিবারিত।


ব্রহ্মজ্ঞানের এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ হলো ব্যাবহারিক প্রতীতির সীমাবদ্ধতা এবং অধিষ্ঠান-চৈতন্যে অনাবাধ স্থিতির উপলব্ধি। এই স্তরে এসে সাধক বুঝতে পারেন যে, জাগতিক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, যা আমরা সাধারণত সত্য বলে মনে করি, তা আসলে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। ব্যাবহারিক জগতে আমরা যা-কিছু দেখি, শুনি, অনুভব করি, তা সবই মায়ার আবরণ দ্বারা আবৃত এবং অবিদ্যা-প্রসূত। এই প্রতীতিগুলি ততক্ষণই সত্য বলে মনে হয়, যতক্ষণ না আমরা পারমার্থিক সত্যের সম্মুখীন হই।


যখন ব্রহ্মজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে জাগ্রত হয়, তখন এই ব্যাবহারিক সত্যের দাবি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহ, জাগতিক সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি—এগুলির গুরুত্ব গৌণ হয়ে আসে। সাধক উপলব্ধি করেন যে, এগুলি ক্ষণস্থায়ী এবং অনিত্য। তখন তাঁর দৃষ্টি পারমার্থিক সত্যের দিকে নিবদ্ধ হয়, যেখানে কোনো প্রকার দ্বৈততা বা বিভেদ নেই।


এই উচ্চতর স্তরে 'অধিষ্ঠান-চৈতন্য' সম্পূর্ণভাবে অনাবাধ হয়ে ওঠে। অধিষ্ঠান-চৈতন্য বলতে বোঝায় সেই মূল, অপরিবর্তনীয় এবং স্বয়ম্ভূ সত্তা, যা সমস্ত কিছুর আধার। এটিই ব্রহ্ম, যা সকল সৃষ্টির মূলে বিদ্যমান। যখন এই চৈতন্য অনাবাধ হয়, তখন তার উপর কোনো রকম জাগতিক বন্ধন, মায়ার প্রভাব বা অজ্ঞানতার আবরণ থাকে না। এটি তার স্বরূপে, তার অখণ্ড মহিমায় প্রকাশিত হয়।


তখন সাধক নিজেকে এই অসীম চৈতন্যে বিলীন দেখেন, যেখানে 'আমি' এবং 'ব্রহ্ম' অভিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থাটিই মোক্ষ বা আত্মোপলব্ধির চরম পর্যায়। এই উপলব্ধি কেবল জ্ঞানগত নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ অস্তিত্বগত রূপান্তর, যেখানে ব্যক্তির সীমাবদ্ধ চেতনা বিশ্বব্যাপী অসীম চৈতন্যে প্রসারিত হয়।


এই বিশ্লেষণকে প্রসারিত করলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, কোনো অংশবিশিষ্ট গঠন বা সমগ্র রূপ আসলে নিজের উপাদান ছাড়া স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল নয়। কাপড় সুতোর অতিরিক্ত কিছু নয়; ঘট মাটির অতিরিক্ত নয়; গহনা সোনার অতিরিক্ত নয়; তরঙ্গ জলের অতিরিক্ত নয়। এরা প্রত্যেকেই তাদের উপাদানের উপর নির্ভর করে প্রতীয়মান হয়—অর্থাৎ, এদের অস্তিত্ব উপাদান-অধিষ্ঠান-নির্ভর।


যদি উপাদানকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে সেই গঠনের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা থাকে না। কাপড়ে সুতোর ‘অত্যন্ত অভাব’ স্থির, কারণ সুতোর বাইরে কাপড়ের কোনো বাস্তব সত্তা নেই; একইভাবে ঘট মাটি ছাড়া, গহনা সোনা ছাড়া, তরঙ্গ জল ছাড়া কোনো সময়েই—অতীতে, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে—অস্তিত্বশীল নয়। একেই বলা হয় অত্যন্ত-অভাব-প্রতিযোগিতা, অর্থাৎ, ত্রিকালেই স্বতন্ত্র সত্তার অনুপস্থিতি।


তবু উপাদানের উপর এদের প্রতীতি জাগে, ব্যবহারে কার্যকর থাকে—আমরা কাপড় পরি, ঘট দিয়ে জল তুলি, গহনা পরি, তরঙ্গ দেখি। এই কার্যক্ষমতা কেবল ব্যাবহারিক স্তরে; উপাদান-বিচারে এদের আলাদা সত্তা নেই। তাই অদ্বৈতের ভাষায় এদের বলা হয় না সত্য না মিথ্যা, বরং সদসদ্বিলক্ষণ, অর্থাৎ, এমন এক অনির্বচনীয় অবস্থান, যা নির্ভরশীল এবং পরবর্তীতে বাধিত।


এই স্তরধর্ম বা সত্য-বিভাগ সর্বত্র একইভাবে কাজ করে। স্বপ্নে-দেখা হাতি প্রাতিভাসিক স্তরের—মনের প্রক্ষেপণ; জাগ্রত অবস্থায় দেখা হাতি ব্যাবহারিক স্তরের—ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা; কিন্তু ব্রহ্ম-জ্ঞানোদয়ের পর উভয়ই একইভাবে বাধিত হয়। স্বপ্নের হাতি জাগরণের জ্ঞানে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়, আর জাগ্রতের হাতি আত্ম-জ্ঞানে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়।


অতএব, অদ্বৈতের দৃষ্টিতে প্রতিটি আপাত রূপ—যা অংশবিশিষ্ট, উপাদান-নির্ভর ও পরিবর্তনশীল—তার নিজস্ব স্তরে সত্য বলে মনে হলেও চূড়ান্ত বিচারে মিথ্যা, কারণ তা অধিষ্ঠান ব্যতীত স্থিত হতে পারে না। আর যে-চৈতন্যে এই সমস্ত প্রতীতি ঘটে, সেটিই একমাত্র অধিষ্ঠান, অপরিবর্তনীয় ও সত্য—ব্রহ্ম।


অদ্বৈতের দৃষ্টিতে সত্য, অসত্য এবং মিথ্যার বিভাজন নিছক শব্দগত নয়, এটি ত্রিকাল-মানদণ্ডে (তিন কালের বিচারে) নির্ধারিত। যা ত্রিকালে—অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে—অবাধিত, অর্থাৎ, কোনো অবস্থায় নিবার্য নয়, সেটিই সত্য; যেমন ব্রহ্ম, যা কখনও নষ্ট হয় না। যা ত্রিকালে বাধিত, অর্থাৎ, কোনো কালেই, কোনো অবস্থাতেই প্রতীয়মান নয়—যেমন শশশৃঙ্গ (খরগোশের শিং)—সেটি অসত্য। আর যা বর্তমানে প্রতীয়মান, কিন্তু উচ্চতর জ্ঞানোদয়ে বাধিত হয়—অর্থাৎ, জ্ঞানে বিলুপ্ত হয়—সেটিই মিথ্যা।


অদ্বৈত তাই বলে, মিথ্যা মানে অস্বীকারযোগ্য নয়, বরং নির্ভরশীল প্রতীতি। মিথ্যা জগৎকে উপেক্ষা করা যায় না, কারণ প্রাতিভাসিক বা ব্যাবহারিক স্তরে এটি কার্যকর—আমরা জগতে কাজ করি, নীতি-অনীতি বিচার করি, সুখ-দুঃখ অনুভব করি। তবু একে চূড়ান্ত বলা যায় না, কারণ মহাবাক্য-বোধ বা অপরোক্ষ-অনুভূতির আলোয় এর বাস্তব-দাবি লোপ পায়। তাই মিথ্যাত্ব আসলে ‘অস্বীকার’ নয়, বরং ‘নির্ভরতা’—অধিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল প্রতীতি।


এই নির্ভরতার যুক্তিশৃঙ্খলা দুই স্তরে কাজ করে। মনস্তাত্ত্বিক স্তরে (psychological level) ঘটে অধ্যাস (adhyāsa)—আত্মা ও অনাত্মার ভুল সম্বন্ধে প্রতীতি জাগে। যেমন, “আমি দেহ” বা “আমি সুখী” এই ধারণাগুলো আত্মা-চেতনার উপর অনাত্ম উপাধির প্রক্ষেপণ। এই অধ্যাস থেকেই বন্ধন, কর্তা-ভোক্তা ভাব এবং জগৎ-চেতনার বিভাজন জন্ম নেয়।


অধিবিদ্যাগত স্তরে (metaphysical level) ঘটে বিবর্ত (vivarta)—এখানে অধিষ্ঠান (substratum) অপরিবর্তিত থাকে, বদলায় শুধু নাম-রূপের ভঙ্গি। যেমন দড়ি অপরিবর্তিত, কিন্তু বিভ্রমে সাপ বলে প্রতীয়মান। একইভাবে ব্রহ্ম অপরিবর্তিত, কিন্তু মায়ার বিভ্রমে জগৎ-রূপে দেখা যায়।


ফলে ‘আমি দেহ’ ধরনের আবরণ-বোধই জগৎ-প্রক্ষেপণের মূল; আর যখন জ্ঞানে আবরণ ভাঙে—‘আমি ব্রহ্ম’ বোধে—তখন প্রক্ষেপণের গতি থেমে যায়। এইখানেই মিথ্যাত্বের দুই লক্ষণ একসূত্রে বাঁধা পড়ে—প্রতীতি থাকায় ব্যবহার চলে, আর বাধ-যোগ্য বলে মুক্তি ঘটে।


এখানে জ্ঞান ধ্বংসাত্মক নয়, উন্মোচনমূলক; দড়িকে চিনলে সাপকে মারার প্রয়োজন হয় না। “সাপ ছিল”, এই ধারণা নিজেই বিলীন হয়ে যায়। তেমনি জ্ঞান জাগলে জগৎকে বিলোপ করতে হয় না; তার প্রতীতি নিজে থেকেই লুপ্ত হয়, কারণ যে-চেতনা ছিল, আছে এবং থাকবে—সেই ব্রহ্মের মধ্যেই সব প্রতীতি ঘটছে, আর সেই ব্রহ্ম কখনও বাধিত হয় না।


ন্যায়-দর্শনে “অভাব” বা অনুপস্থিতিকে একটি স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে ধরা হয়। তারা বলে, অস্তিত্ব যেমন একটি বাস্তব অবস্থা, তেমনি অনস্তিত্ব বা অভাবও বাস্তব এবং তা চার প্রকার—প্রাগ্‌অভাব, প্রধ্বংসাভাব, অত্যন্তাভাব ও অন্যোন্যাভাব। প্রাগ্‌অভাব মানে কোনো বস্তু সৃষ্টি হওয়ার আগে তার অনুপস্থিতি; প্রধ্বংসাভাব মানে ধ্বংসের পর তার অনুপস্থিতি; অন্যোন্যাভাব মানে দুটি ভিন্ন বস্তুর পারস্পরিক অস্বীকৃতি; আর অত্যন্তাভাব মানে এমন এক অনুপস্থিতি, যা সব কালে, সব অবস্থায় থাকে।


অদ্বৈত বেদান্ত ন্যায়ের মতো অভাবকে আলাদা পদার্থ হিসেবে গ্রহণ করে না, কিন্তু যুক্তির স্বচ্ছতার জন্য এই পরিভাষা ধার করে। অদ্বৈত বলে, “অত্যন্ত-অভাব” মানে কোনো বস্তুর নিজের আধারে চিরকালীন অনুপস্থিতি। এই ধারণা দিয়ে তারা মিথ্যা-বস্তুর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। দড়িতে সাপের অত্যন্ত-অভাব আছে—অর্থাৎ দড়ির আধারে কোনো কালেই সত্যিকারের সাপ ছিল না। শুক্তিতে রুপার অভাবও ত্রিকালে আছে; কখনও সেখানে বাস্তব রূপা থাকে না। আকাশে গন্ধর্বনগর বা মরুভূমিতে মায়াজলও একইভাবে চিরকাল অনুপস্থিত।


এখন প্রশ্ন ওঠে—যদি এদের বাস্তব অস্তিত্ব কখনও না থাকে, তবে এরা প্রতীয়মান হয় কীভাবে? এখানেই আসে মিথ্যাত্বের বেদান্তীয় ব্যাখ্যা। বেদান্ত বলে, মিথ্যা তা-ই, যা প্রতীয়মান হয়, কিন্তু তিন কালের কোনোটিতেই অনাবাধ নয়। অর্থাৎ, এমন কিছু, যা চেতনায় উপস্থিত হয়, কিন্তু পরবর্তী জ্ঞানে বাধিত হয়। দড়িতে সাপ দেখা যায়, কিন্তু পরে জানা যায়, এটি দড়ি; তাই সাপ-বোধ মিথ্যা। শুক্তিতে রুপা দেখা যায়, কিন্তু পরে জানা যায় এটি রুপা নয়; সেই রুপা-বোধও মিথ্যা।


অদ্বৈতের মতে, মিথ্যা-বস্তুর অত্যন্ত-অভাব আছে, অর্থাৎ তা কখনও সত্যভাবে বিদ্যমান নয়, কিন্তু তার প্রতীতি আছে—চেতনায় তা দেখা যায়। এই দুই অবস্থার সমন্বয়েই মিথ্যাত্বের প্রকৃতি স্থির হয়। একদিকে ত্রিকালীন অনুপস্থিতি, অন্যদিকে সাময়িক প্রতীতি—এই বিরোধাভাসই মিথ্যা-বস্তুর লক্ষণ।