অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো তেরো



অদ্বৈত বেদান্তে “প্রতীতি ও নিবারণ পরস্পরের বিরোধী নয়”, এই ধারণাটি আসলে অজ্ঞান ও জ্ঞান—অথবা অধ্যাস (ভ্রম) ও অপবাদ (নিবারণ)—এর আন্তঃসম্পর্ক বোঝায়। এটিকে বোঝাতে উপনিষদীয় দৃষ্টান্ত, যুক্তি ও অভিজ্ঞতার একাধিক স্তর একত্রে দেখা যায়।

প্রথমত, প্রতীতি মানে কোনো বস্তুর প্রতীয়মান হওয়া—অর্থাৎ “আমি এটা দেখছি”, “এটা আছে”—এই জ্ঞান। নিবারণ মানে, পরবর্তী উচ্চতর জ্ঞানে সেই প্রতীতির ভ্রান্ততা প্রকাশ পাওয়া—অর্থাৎ “এটা, যা মনে হয়েছিল, তা নয়”—এই উপলব্ধি। এখন এই দুই অভিজ্ঞতা—দেখা ও ভ্রান্তি-নিবারণ—একই “আধার”-এ ঘটে; একই চৈতন্যে। চেতনা একবার কোনো রূপ ধারণ করে, পরে সেই রূপের ভ্রান্ততা প্রকাশ করে। কিন্তু চেতনা নিজে কখনও পরিবর্তিত হয় না। তাই অদ্বৈত বলে—প্রতীতি ও নিবারণ বিরোধী নয়; বরং একেই দুই স্তরে প্রকাশ।

দড়ি-সাপ উদাহরণটি এ কথার স্পষ্ট প্রকাশ। অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হলে, প্রথম বোধ হলো “এটা সাপ”—এটি প্রতীতি। পরে আলো জ্বলে দেখা গেল—“এটা দড়ি”—এটি নিবারণ। এখানে তুমি অস্বীকার করছ না যে, “এটা”—এই বস্তুটি কিছুক্ষণ আগে প্রতীয়মান হয়েছিল। বরং, তোমার চেতনার গভীরে সেই একই “এই” অব্যাহত থাকে; শুধু তার অর্থবোধ বদলে যায়—‘সাপ’ থেকে ‘দড়ি’-তে। সুতরাং, “বাধ্য” (যা নিবারিত হয়—সাপ) ও “বাধক” (যা নিবারণ করে—দড়ি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান) একই আধারে অবস্থান করে। প্রতীতি ও নিবারণ তাই বিপরীত নয়; একই আধারে ভিন্ন স্তরে দেখা। এই দুই অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান একে অপরকে নাকচ করে না; বরং একই চেতনার ধারায় ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পায়, যেখানে একটির পরিপূর্ণতা অন্যটির মধ্যে নিহিত।

এটা বোঝাতে আমাদের “বিরোধ” শব্দটার অর্থই আগে পরিষ্কার করতে হবে। বিরোধ তখনই হয়, যখন দুটি ঘটনা বা ধারণা একই বিষয়ে, একই সময়ে, একই স্তরে পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়। যেমন “এ বস্তু একসাথে গরম ও ঠান্ডা”—এটি অসম্ভব, কারণ একই স্তরে বিপরীত ধর্ম আরোপ করা যায় না।

কিন্তু প্রতীতি ও নিবারণ একই স্তরে ঘটে না; তারা একই চেতনার ধারাবাহিক রূপান্তর, একটিতে প্রক্ষেপ (āropa), অন্যটিতে প্রত্যাহার (apavāda)। তাই তারা বিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। এরা চূড়ান্ত চেতনার একত্বে পৌঁছানোর দুটি ধাপ।

অদ্বৈতের মতে, চেতনা বা আত্মা সর্বদা এক ও অব্যাহত। প্রতীতি ও নিবারণ দুটোই সেই এক চেতনারই ক্রিয়া।

প্রথমে চেতনা কোনো বস্তুতে “এটা”—এই বোধে অর্থ আরোপ করে (প্রতীতি)। পরে সেই একই চেতনা জেনে ফেলে, “এটা”—যা মনে হয়েছিল—আসলে তা নয় (নিবারণ)। কিন্তু এখানে চেতনা কখনও বিরোধে পড়ে না; কেবল তার বোধের পরিসর বিস্তৃত হয়।

অর্থাৎ, প্রথমে আংশিক সত্য ধরা পড়ে, পরে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ পায়। যেমন—অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে “এটা সাপ”—এই বোধ প্রথমে ভুল, কিন্তু একেবারে মিথ্যা নয়; কারণ সেই ‘এটা’ বা ‘এই’-এর প্রতীতি সত্য ছিল। পরে যখন দেখা গেল—“এটা দড়ি”—তখন আগের প্রতীতি বিলুপ্ত নয়, সংশোধিত। তাই নিবারণ প্রতীতির সঙ্গে বিরোধে যায় না, বরং তার সীমা স্পষ্ট করে দেয়।

দড়ি-সাপ উদাহরণে তিনটি স্তর কাজ করছে—
“এটা”—এই চেতনা অব্যাহত;
“সাপ”—অবিদ্যা-জনিত আরোপ;
“দড়ি”—বিদ্যা-জনিত প্রকাশ।

দুই বোধই (সাপ-জ্ঞানে ও দড়ি-জ্ঞানে) একই আধারে ঘটে। দ্বিতীয় জ্ঞান প্রথমটিকে ধ্বংস করে না, বরং প্রকাশ করে যে, প্রথম বোধ ছিল সীমিত। এই প্রতীতি ভুল ছিল না যে, ‘কিছু আছে’—ভুল ছিল ‘কী আছে’, সেটা। তাই নিবারণ প্রতীতিকে মুছে দেয় না, কেবল সংশোধন করে।

এই দৃষ্টান্তেই অদ্বৈত “অধ্যাস–অপবাদ” সূত্র রচনা করেছে। প্রথম জ্ঞানে অবিদ্যা-জনিত আরোপ ঘটে—অর্থাৎ বাস্তব অধিষ্ঠান (দড়ি)-এর উপর অনর্থক রূপ (সাপ) চাপানো। দ্বিতীয় জ্ঞানে বিদ্যা-জনিত অপবাদ ঘটে—অর্থাৎ সেই আরোপিত রূপ মুছে অধিষ্ঠান উন্মোচিত হয়। প্রথমটি প্রতীতি, দ্বিতীয়টি নিবারণ; দুই বোধই একই “এই”-এর ক্ষেত্র, কিন্তু তাদের গতি বিপরীত। তাই বেদান্ত বলে—প্রতীতি উচ্চতর নিবারণের পূর্বশর্ত; নিবারণ প্রতীতিকে অস্বীকার করে না, বরং তার সীমা নির্ধারণ করে। যদি প্রতীতি না ঘটত, নিবারণেরও কোনো অর্থ থাকত না।

এই যুক্তি আরও গভীরভাবে বোঝাতে উপনিষদে মৃৎ-ঘট উদাহরণ দেয়া হয়েছে। মাটির পাত্র দেখা যায়, তাই আমরা বলি “এটা ঘট (হাঁড়ি)”; কিন্তু পরে জানা যায় “এটা আসলে মাটিই”—মৃৎ। ঘট-রূপের প্রতীতি মাটির অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। তাই মাটিই সত্য, ঘটের নামরূপ মিথ্যা। এখানে “ঘট আছে” বলে প্রতীতি, এবং “ঘট আসলে মাটিই”—এই নিবারণ। কিন্তু উভয় অভিজ্ঞতা একই বস্তুর উপর ঘটে। প্রতীতি মাটির আভাস দেয় নাম ও রূপের আচ্ছাদনে; নিবারণ সেই আচ্ছাদন সরিয়ে মাটির সত্য প্রকাশ করে। আবারও দেখা যায়, নিবারণ প্রতীতিকে মুছে দেয় না, বরং তা সংশোধন করে।

একই ধারা স্বপ্ন–জাগরণ উদাহরণেও দেখা যায়। স্বপ্নে বাঘ দেখা মানে প্রতীতি, কিন্তু জাগরণের পর জানা যায় “ওটা স্বপ্ন ছিল”—নিবারণ। জাগরণ স্বপ্নকে পুরোপুরি অস্বীকার করে না; বরং বলে—স্বপ্ন তার নিজ স্তরে সত্য ছিল, এখন সেই স্তর বিলুপ্ত। অর্থাৎ স্বপ্নে বাঘ ‘ছিল’, কিন্তু ছিল না প্রকৃতার্থে। তাই স্বপ্নবোধ ও জাগ্রত বোধের বিরোধ নেই, বরং স্তরভেদে একটিকে অন্যটি সীমিত করে।

এই যুক্তি জগৎ ও ব্রহ্ম সম্পর্কেও একইভাবে প্রযোজ্য। জগৎ প্রতীয়মান—এটাই প্রতীতি। ব্রহ্মজ্ঞানে বোঝা যায়—“এ জগৎ ব্রহ্মই”—এটাই নিবারণ। জগৎকে মিথ্যা বলা মানে জগৎকে শূন্য বলা নয়, বরং তার পারমার্থিক সত্যতার সীমা নির্ধারণ। তাই নিবারণ জগতের প্রতীতিকে অস্বীকার করে না; বরং বলে—“ব্যবহারে হ্যাঁ, পরমে (চূড়ান্তে) না।” জগৎ এই অর্থে রজ্জুতে দেখা সাপের মতো; দেখা যায়, কিন্তু টেকে না।

অদ্বৈতের ত্রিস্তরীয় সত্যতত্ত্বে এই যুক্তি ধাপে ধাপে চলে—প্রাতিভাসিক স্তরে স্বপ্নের প্রতীতি ব্যাবহারিক জ্ঞানে নিবারিত হয়, ব্যাবহারিক স্তরের জগৎ-প্রতীতি ব্রহ্মজ্ঞানে নিবারিত হয়। প্রতিটি নিবারণের পূর্বে প্রতীতি থাকে; আর প্রতিটি নিবারণ প্রতীতিকে অস্বীকার না করে তার সীমা নির্দেশ করে। তাই প্রতীতি ও নিবারণ পরস্পরের বিরোধী নয়, বরং সত্য-অনুসন্ধানের ধারাবাহিক দুই ধাপ—প্রথমে চেতনার প্রক্ষেপ, পরে চেতনার প্রত্যাহার।

এইভাবে দেখা যায়, যে-চৈতন্যে ভ্রান্ত প্রতীতি ঘটে, সেই চৈতন্যেই নিবারণ ঘটে। প্রতীতি চেতনার আবরণ, নিবারণ চেতনার উন্মোচন। দুটি ভিন্ন ক্রিয়া হলেও উভয়ই এক অভিন্ন চেতনার মধ্যে সংঘটিত। অদ্বৈতের পরিভাষায় বলা যায়—অবিদ্যা চেতনারই এক প্রক্ষেপ, বিদ্যা সেই প্রক্ষেপের নিবারণ। তাই বলা হয়—প্রতীতি ও নিবারণ একই চেতনার দুই গতিপ্রকৃতি, বিরোধ নয়, পরিপূরকতা; মায়া থেকে ব্রহ্মের দিকে যাত্রার স্বাভাবিক রূপ।

এই একই আধারে দুটি বিপরীত অভিজ্ঞতার উপস্থিতিই ‘মিথ্যা’-র অনির্বচনীয়তা প্রকাশ করে। অদ্বৈত দর্শন অনুসারে, মিথ্যা বলতে এমন কিছু বোঝায়, যা সৎ (চিরন্তন সত্য) নয় এবং অসৎ (একেবারেই অস্তিত্বহীন) নয়। দড়িকে সাপ বলে ভ্রমের ক্ষেত্রে, সাপের ধারণাটি পুরোপুরি অসৎ নয়, কারণ এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে উপলব্ধ হয়েছিল। আবার এটি সৎও নয়, কারণ পরে তা দড়ি হিসাবে নিবারিত হয়েছে। বস্তুটি না সম্পূর্ণ সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা; বরং ‘অনির্বচনীয়’—কারণ একেই আমরা প্রথমে এক রূপে দেখি এবং পরে যথার্থ জ্ঞান লাভের পর জেনে নিই যে, তা অন্যরূপ। এই অনির্বচনীয়তাই মিথ্যা জগতের স্বরূপ।

এই দার্শনিক উপলব্ধি জগৎ এবং ব্রহ্মের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতেও ব্যবহৃত হয়। জগৎ ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি মিথ্যা প্রতীতি। যেমন দড়িই সাপ রূপে প্রতীয়মান হয়, তেমনি ব্রহ্মই জগৎ রূপে প্রতীয়মান হন। যখন অজ্ঞানতা দূর হয় এবং আত্মজ্ঞান লাভ হয়, তখন জগতের এই প্রতীতি নিবারিত হয় এবং ব্রহ্মের একত্ব উপলব্ধি হয়। জগৎ তখন অসৎ হয়ে যায় না, বরং তার আরোপিত রূপটি বিলীন হয়ে যায়, যেমন সাপ ভ্রান্ত ধারণা বিলীন হয়ে দড়ির প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়। এটিই অদ্বৈত বেদান্তের মূল শিক্ষা—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মৈব নাপরঃ (জীব ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়)। ‘জগৎ মিথ্যা’ মানে, ‘জগৎ অবাস্তব’, তা নয়, বরং জগৎকে উচ্চতর জ্ঞান ‘ব্রহ্ম’ দ্বারা বাধিত করা যায়।

ব্রহ্ম ও মিথ্যার বিভাজন ধরতে হলে প্রথমে মাপদণ্ডটা স্পষ্ট করতে হয়: যে-বস্তু একবার জ্ঞাত হলে আর কখনও বাধিত হয় না, সেটাই সত্য; যে কখনোই প্রতীয়মান হয় না, সেটাই অসত্ত্ব; আর যে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু উচ্চতর জ্ঞানে নিবারিত হয়, সেটিই মিথ্যা। এই মাপদণ্ডই বেদান্তে বাধ-লক্ষণ—বোধের মধ্যে নিবারণ উপস্থিত হলেই জানা যায়, আগের প্রতীতি নিম্নস্তরের ছিল।

ব্রহ্ম কখনও বাধিত হয় না। কারণ ব্রহ্ম-জ্ঞানে যে ‘আমি-স্বরূপ চেতনা’ উপলব্ধ হয়, তাকে আর কোনো পরবর্তী প্রমাণ নিবারণ করতে পারে না। এই অনবাধিতাই পারমার্থিক সত্যতার লক্ষণ। শূন্যতা বা বর্গচক্র কখনোই প্রতীয়মান হয় না; এদের কোনো স্তরেই অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়—তাই এরা অসত্ত্ব। মায়াজগৎ প্রতীয়মান হয়, কার্য-কারণ, লেনদেন, নীতি-নৈতিকতা সবই চলে; কিন্তু ব্রহ্ম-সাক্ষাতে সে প্রতীতি নিজের সীমা মেনে নেয়—“ব্যবহারে আছে, পরমে নেই”—এই বলে নিবারিত হয়। তাই মিথ্যা মানে শূন্য নয়, বরং অনির্বচনীয়: না একেবারে সত্য, না একেবারে অস্থিত—প্রতীয়মান মাত্র, পরমে নিবার্য।

এই অনির্বচনীয়তার বোধটা ওঠে বাধ–সামানাধিকরণ্য থেকে। যে-চৈতন্যে প্রথমে ভ্রম-প্রতীতি ওঠে, সেই একই চৈতন্যেই নিবারণও ঘটে; “এই”—এই অধিষ্ঠান অপরিবর্তিত, বদলায় কেবল ‘আরোপিত অর্থ’।

রজ্জু-সাপে প্রথমে “এই” তথা “সাপ” দেখা দিল, পরে “এই” তথা “রজ্জু” প্রকাশ পেল। বাধ্য (সাপ-বোধ) ও বাধক (রজ্জু-বোধ) একই আধারে থাকা বলেই নিবারণ প্রতীতিকে অস্বীকার নয়, সংশোধন করে; প্রতীতি সত্য ছিল ‘এই’-পর্যন্ত, ‘সাপ’-পর্যন্ত ছিল না। শুক্তি-রৌপ্য দৃষ্টান্তেও তা-ই—শুক্তির উপর রুপোলি ঝিলিককে তা ‘রুপো’ বলে ধরা পড়া প্রথমে প্রতীতি; পরে শুক্তি-জ্ঞান সেই রৌপ্য-আরোপ প্রত্যাহার করে। মরীচিকা-জলে দূর থেকে “জল” দেখা প্রতীতি; কাছে গিয়ে বালির উপর দ্যুতি বুঝে নেওয়া নিবারণ। মৃৎ-ঘটে “এটা ঘট”—প্রতীতি, “এটা আসলে মাটি”—নিবারণ; ঘট-নাম-রূপ মাটির উপর নির্ভরশীল বলে ঘটের সত্য-দাবি সীমাবদ্ধ। প্রতিটি দৃষ্টান্তে অধিষ্ঠান অপরিবর্তিত—চৈতন্য/শুক্তি/মাটি—আরোপিত রূপই নিবারণের বিষয়।

এই যুক্তির ফলে বাস্তবতার তিন স্তর ভেদ পায়। প্রাতিভাসিক স্তরে স্বপ্ন-বোধ জাগ্রত-জ্ঞানে বাধিত হয়; ব্যাবহারিক স্তরে জাগতিক-বোধ ব্রহ্ম-জ্ঞানে বাধিত হয়; পারমার্থিক স্তরে ব্রহ্ম-বোধ অনবাধ্য। প্রতিটি নিম্নস্তরের জ্ঞান তার নিজ পরিসরে যথার্থ—স্বপ্নের বাঘ স্বপ্নে যথার্থ, জাগতিক বস্তু জাগ্রতে যথার্থ; কিন্তু পরমে পৌঁছালে সেই যথার্থতাকে সীমিত বলে ঘোষণা হয়। তাই মিথ্যাত্ব কোনো নৈতিক প্রতারণা নয়; এটি অস্তিত্বের স্তরভেদের জ্ঞানোন্মুখ প্রকাশ—এক স্তরে মান্য, ঊর্ধ্বস্তরে নিবার্য।

এখানেই “মিথ্যা সেই, যা দেখা যায়, কিন্তু স্থায়ী নয়”—উক্তির সার। ‘দেখা যায়’—কারণ প্রতীতি আছে; ‘স্থায়ী নয়’—কারণ ব্রহ্ম-জ্ঞানে এর বাধ ঘটে। যা কখনও দেখা যায়ই না, তাকে মিথ্যা নয়, অসত্ত্ব বলতে হয়, কারণ মিথ্যাত্বেরও শর্ত প্রতীতি। আর ব্রহ্মকে মিথ্যা বলা চলে না, কারণ তাকে নিবারণ করার মতো আর কোনো প্রমাণ বা স্তর নেই—অনবাধিতা সেখানে স্বরূপধর্ম।

ফলে সিদ্ধান্তটি নিরবচ্ছিন্নভাবে দাঁড়ায়। চেতনা—স্বয়ং এক অধিষ্ঠান; সেই একের মধ্যেই প্রতীতি ও নিবারণ পরপর ঘটে। প্রতীতি যতদিন সীমাবদ্ধ জ্ঞানে থাকে, ততদিন সত্যের ছায়া; ব্রহ্ম-জ্ঞানে পৌঁছালে ছায়া মিলিয়ে যায়। মিথ্যাত্ব তাই অনির্বচনীয়: অভিজ্ঞতায় আছে, পারমার্থে নেই। ভ্রমও চৈতন্যেরই খেলায় ওঠা-নামা করা প্রতিবিম্ব; কিন্তু প্রতিবিম্বের ওঠা-নামা ব্রহ্ম-চৈতন্যকে ছোঁয় না—সেটিই চূড়ান্ত বিভাজনের কারণ ও প্রমাণ।