অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো নয়



পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ (Ultimate Reality): তবে, পারমার্থিক বা চূড়ান্ত সত্যের দিক থেকে বিচার করলে—অবিদ্যার আশ্রয় জীবও নয়, ব্রহ্মও নয়। কারণ অবিদ্যার সত্তাই তো অনির্বচনীয় (indefinable)। অবিদ্যা সৎও নয়, অসৎও নয়; সতের থেকে বিলক্ষণ, অসতের থেকে বিলক্ষণ। এটি মায়া বা মিথ্যা। মিথ্যা বস্তুর কোনো পারমার্থিক আশ্রয় থাকতে পারে না। যখন জ্ঞান উদিত হয়, তখন অবিদ্যা তার কার্য-সহ বিলুপ্ত হয়ে যায়, যেমন দড়িতে সাপের ভ্রম জ্ঞান দ্বারা বিলুপ্ত হয়। তাই পারমার্থিকভাবে অবিদ্যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব বা আশ্রয় নেই।

মায়া ও অবিদ্যার পার্থক্য: 'মায়া' আর 'অবিদ্যা' ভিন্ন দৃষ্টি বা উপাধিকে নির্দেশ করে:

ঈশ্বর-দেহে মায়া: ঈশ্বর হলেন চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মের মায়া-উপাধিক প্রতিবিম্ব। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং জগৎকর্তা। ঈশ্বর তাঁর উপাধি মায়াকে আশ্রয় করে জগৎ সৃষ্টি করেন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই মায়া সমষ্টিগত এবং তা ব্রহ্মের শক্তি। তাই ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত অজ্ঞানকে 'মায়া' বলা হয়। মায়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণ প্রধান।

জীব-দেহে অবিদ্যা: জীব হলো চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মের অবিদ্যা-উপাধিক প্রতিবিম্ব। জীব অজ্ঞান, অল্পজ্ঞ এবং দুঃখী। জীব তার উপাধি অবিদ্যাকে আশ্রয় করে সংসারচক্রে আবর্তিত হয়। এই অবিদ্যা ব্যষ্টিগত এবং তা জীবের বন্ধনের কারণ। তাই জীবের সাথে সম্পর্কিত অজ্ঞানকে 'অবিদ্যা' বলা হয়। অবিদ্যা মলিন সত্ত্বগুণ প্রধান, যেখানে রজঃ ও তমঃ গুণের প্রভাব বেশি।

মায়া ও অবিদ্যা উভয়ই ব্রহ্ম-প্রতিবিম্বে উপাধি মাত্র—যেমন জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব হয়, কিন্তু বিম্ব (সূর্য) অস্পৃষ্টই থাকে। তেমনি, ব্রহ্ম এই উপাধিদ্বারা প্রভাবিত হন না। ব্রহ্ম নিত্যশুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত। মায়া ও অবিদ্যা উভয়ই মিথ্যা এবং জ্ঞান দ্বারা তাদের নিবৃত্তি হয়। এই বিশ্লেষণ অদ্বৈত বেদান্তের অবিদ্যার জটিল ধারণাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে এবং জীব ও ঈশ্বরের স্বরূপকে ব্যাখ্যা করে।

এই সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টিতে বিবর্ত-বাদও নিজের চূড়ান্ত স্থান পায়, যেখানে ব্রহ্মের অবিকৃততা এবং সৃষ্টির আপাত বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ব্রহ্ম নিজে কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তরের অধীন নন; তিনি চিরকালই এক ও অদ্বিতীয়। তবে, উপাধি-মাধ্যমে প্রতিফলনের কারণে এই এক ব্রহ্মকেই ‘বহু’ বলে মনে হয়। এই ধারণাটি এক সুন্দর উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়: যেমন একটি স্বচ্ছ স্ফটিকের পাশে একটি লাল ফুল রাখলে স্ফটিকটিকে লাল দেখায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ফটিকটি নিজে লাল হয় না, কেবল ফুলের লালিমা তাতে প্রতিফলিত হয়। ঠিক তেমনি, ব্রহ্মের উপর অবিদ্যার উপাধি আরোপিত হওয়ায় সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের এই জগৎপ্রপঞ্চকে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, যদিও ব্রহ্ম স্বয়ং এই সমস্ত পরিবর্তন থেকে মুক্ত।

এই গভীর উপলব্ধির প্রেক্ষিতে, সৃষ্টির এই প্রবাহ এবং জগতের লীলা জ্ঞানী ব্যক্তির দৃষ্টিতে আর বন্ধনের কারণ থাকে না। তাঁর কাছে জগৎ কেবল একটি ব্যাবহারিক বাস্তবতা, যেখানে কর্ম চলতে থাকে, কিন্তু কোনো বন্ধন সৃষ্টি হয় না। তাঁর ‘আমি কর্তা’—এই অহংবোধ সম্পূর্ণভাবে নিভে যায়। কর্ম তখন কেবল প্রারব্ধের ধোঁয়া-টানের মতো হয়ে থাকে, যা শেষ হলেই দেহ ঝরে পড়ে, এবং তিনি লাভ করেন বিদেহমুক্তি।

এই অবস্থায় যে সামান্য অবিদ্যা-লেশ অবশিষ্ট থাকে, তা কোনো বন্ধনের কারণ নয়; বরং তা পোড়া দড়ির ছায়া-রূপ—যার অস্তিত্ব থাকলেও কোনো ফল বা সংশ্রব নেই। পোড়া দড়ি দেখতে দড়ির মতোই লাগে, কিন্তু তা দিয়ে আর কোনো কিছু বাঁধা যায় না। ঠিক তেমনি, এই অবিদ্যা-লেশ কেবল পূর্বসংস্কারের ক্ষীণ প্রতিচ্ছবি, যা নতুন করে কোনো কর্মফল উৎপন্ন করতে পারে না এবং আত্মাকে আর বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে না। এটি একটি নিষ্ক্রিয় অবস্থা, যেখানে কর্মের গতি থাকলেও তা মুক্তির পথে বাধা হয় না, বরং তা লীলার অংশ হয়ে ওঠে।

বিবর্তবাদ (vivartavāda) মতে, জগৎ ব্রহ্মের কোনো বাস্তব রূপান্তর নয়; ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয়, কিন্তু মায়ার প্রক্ষেপণে আপাত-পরিবর্তিত বলে প্রতীয়মান। যেমন দড়ি অপরিবর্তিত থেকেও অন্ধকারে সাপ বলে মনে হয়, তেমনি ব্রহ্ম অপরিবর্তিত থেকেও মায়ার কারণে জগৎরূপে প্রকাশিত। এখানে পরিবর্তন মায়াজাত, ব্রহ্ম তাতে অচল ও নিস্পৃহ। তাই জগৎ ব্রহ্মের “বিবর্ত”—অর্থাৎ, অনির্বচনীয় প্রতীতি—বাস্তব “পরিণাম” নয়।

পরিণামবাদ (pariṇāmavāda)-এ কারণ নিজেই পরিবর্তিত হয়ে কার্য হয়; যেমন দুধ থেকে দই। কিন্তু বিবর্তবাদ বলে, ব্রহ্ম পরিবর্তিত হয় না—পরিবর্তিত হয় কেবল মায়া বা অবিদ্যা। ব্রহ্ম যদি পরিবর্তিত হতো, তবে তার চিরন্তনতা ও অপরিবর্তনীয়তা নষ্ট হতো। তাই জগৎ কেবল প্রক্ষেপিত মায়া-রূপে প্রতীয়মান, ব্রহ্ম তাতে অপরিবর্তিত থাকে।

যেভাবে দড়ির জ্ঞান উদিত হলে সাপ বিলুপ্ত হয়, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে জগতের মিথ্যাত্ব প্রকাশ পায়। তাই বিবর্তবাদ বলে—জগৎ সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়, না সত্য, না মিথ্যা; এটি ব্রহ্মের উপর মায়ার প্রক্ষেপণমাত্র। জগৎ, যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে, ততক্ষণ বাস্তবের মতো দেখা যায়, কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে বোঝা যায়—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ তারই মায়াজাত ছায়া।

অতএব, বিবর্তবাদ সেই তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—ব্রহ্ম অপরিবর্তিত, অবিকৃত, একমাত্র সত্য; জগৎ তার কোনো রূপান্তর নয়, বরং অনির্বচনীয় প্রতীয়মান, মায়াজাত প্রকাশ। তাই অদ্বৈতের সারবাক্য: “ব্রহ্ম সত্যম্‌, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”।

মুক্তি বা আত্মজ্ঞান কোনো নতুন বস্তুপ্রাপ্তি নয়, কারণ ব্রহ্ম বা আত্মা কখনোই অনুপস্থিত ছিল না। মানুষ ভুলে গিয়েছিল নিজের প্রকৃত সত্তাকে, তাই জ্ঞান মানে কোনো নতুন কিছু লাভ করা নয়, বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপে ফিরে আসা—একটি প্রত্যভিজ্ঞা, যা বলে ওঠে “এ তো আমিই, আহম্ ব্রহ্মাস্মি”। দড়ি-সাপ, ঝিনুক-রুপো, ঘটাকাশ, আয়নায় প্রতিবিম্ব—এসব উপমা মায়া ও অবিদ্যার বিভ্রম বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হলেও আলো জ্বলতেই বোঝা যায়, সাপ কখনও ছিল না, তেমনি জগৎ ও দেহ-মনকে আমরা সত্য বলে ধরি, কিন্তু জ্ঞানের আলোয় দেখা যায়, এগুলি কখনোই সত্য ছিল না; একমাত্র আত্মাই সত্য।

যখন সত্য প্রকাশ পায়, তখন এই উপমাগুলিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়; তাদের কর্তব্য শেষ হয়। জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থাও তখন বিলীন হয়ে যায় এবং মানুষ স্থিত হয় তুরীয়ে—যেখানে কোনো গতি, পরিবর্তন বা ভেদ নেই, কেবল নিস্তরঙ্গ, অখণ্ড চৈতন্য।

সত্য উপলব্ধির জন্য মানুষ যেসব প্রমাণ ব্যবহার করে—প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ—সেগুলি কেবল পথপ্রদর্শক, মইয়ের মতো। মই ধরে উপরে ওঠার পর মইটির আর প্রয়োজন থাকে না; তেমনি আত্মজ্ঞান জাগলে প্রমাণগুলিও বিলীন হয়ে যায়। তখন জ্ঞান আর কোনো জ্ঞাতার ক্রিয়া নয়, বরং এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই তিনের ভেদ মুছে যায়। কেবল থাকে জ্ঞান, আর সেই জ্ঞানই জ্ঞেয়—জ্ঞানম্ এব জ্ঞেয়ম্।

অবিদ্যা অনাদি, অর্থাৎ, এর শুরু নেই, কিন্তু অনন্ত নয়; জ্ঞানের উদয়ে এটি স্বয়ং বিলীন হয়। যেমন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার অদৃশ্য হয়, তেমনি আত্মজ্ঞান উদিত হলেই অবিদ্যার অনির্বচনীয় ছায়া লুপ্ত হয়ে যায়। তখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না—থাকে কেবল নিস্তরঙ্গ, অদ্বিতীয়, চিরপ্রকাশমান আত্মা, যা সর্বদা ছিল, আছে, এবং থাকবে—ব্রহ্ম একমেবাদ্বিতীয়ম্।

মূলাবিদ্যা হলো সেই অনাদি অজ্ঞানতার বীজ, যেখান থেকে সমগ্র প্রপঞ্চ ও নাম-রূপের জাল বোনা হয়েছে। এটি কেবল অনুপস্থিতি নয়; এটি ভাবরূপা, অর্থাৎ, একটি ইতিবাচক শক্তি—যা কার্যক্ষম। এটি চেতনার উপর আচ্ছাদন ফেলে এবং দ্বৈততা সৃষ্টি করে। ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয়, কিন্তু আমরা জগৎকে পরিবর্তনশীল দেখি; তাই এই অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে একটি অনির্বচনীয়, না সত্য না মিথ্যা, কারণের প্রয়োজন হয়—এই কারণই মূলাবিদ্যা।

এটি অনাদি, কারণ এর কোনো শুরু নেই, কিন্তু অনন্ত নয়, কারণ জ্ঞান হলে এটি বিলুপ্ত হয়। এর দুটি শক্তি—আবরণ, যা আত্মাকে আচ্ছন্ন করে, এবং বিক্ষেপ, যা নাম-রূপের প্রক্ষেপণ ঘটায়। এভাবে মূলাবিদ্যা জগতের প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করে, অথচ পরমার্থত এটি কখনোই সত্য নয়; এটি ব্যাবহারিক স্তরে স্বীকৃত, জ্ঞানে নিবার্য।

অবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে দর্শনে এক দীর্ঘ বিতর্ক আছে—অবিদ্যা কার? জীবের, না ব্রহ্মের? ভামতী ধারা বলে, অবিদ্যা জীবাশ্রিতা, কারণ প্রত্যেকের অজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে দূর হয়; আমার অজ্ঞান আমার জ্ঞানে দূর হয়।

এতে সাধনায় সুবিধা আছে, কিন্তু তখন প্রশ্ন ওঠে, জীব তো নিজেই অবিদ্যা-ফল; তবে অবিদ্যা আগে, না জীব আগে? বিবরণ ধারা বলে, অবিদ্যা ব্রহ্মাশ্রিতা, কারণ চেতনার বাইরে কিছুই অস্তিত্ব পায় না—চেতনা বা সাক্ষী ছাড়া বিভ্রম সম্ভব নয়; কিন্তু এতে ব্রহ্মের উপর কিছু আরোপ হয় বলে আপত্তি আসে। তাই বলা হয় আশ্রয়টি আভাসিক, অর্থাৎ শিক্ষণগতভাবে ধরা।

এই দুই বিপরীত মতের মধ্যে একটি মধ্যপন্থা হলো আশ্রয়-অনির্ণয়-বাদ। এই মত অনুসারে, অবিদ্যার আশ্রয় প্রশ্নটি একাধিক স্তরে ভিন্নভাবে বোঝা যায়।

সাধনার স্তরে অবিদ্যা জীবাশ্রিত ধরা যুক্তিসঙ্গত, কারণ এখানেই তার প্রভাব অনুভূত হয়—অজ্ঞানতা, আসক্তি, মোহ, বন্ধনের সব অনুভব ব্যক্তিগত চিত্তেই প্রকাশিত। তাই সাধক হিসেবে অবিদ্যা “আমার অজ্ঞতা”—এভাবেই অনুশীলন শুরু হয়।

তত্ত্বের স্তরে দেখা যায়, অবিদ্যা স্বাধীন কোনো সত্তা নয়, বরং চেতনারই আচ্ছন্ন অবস্থা। যা-কিছু দেখা, জানা বা অনুভব করা যায়, তা চেতনার মধ্যেই ঘটে। তাই তত্ত্বে অবিদ্যার ভিত্তি ধরা হয় চেতনা নিজেই—অর্থাৎ এটি চেতনার পটভূমিতে উদ্‌ভূত এক অজ্ঞাত অবস্থা।

পরমার্থে, অর্থাৎ জ্ঞান উদিত হলে, আশ্রয়-প্রশ্নই আর টেকে না। কারণ তখন অবিদ্যা নেই, আর যা নেই, তার আশ্রয় কীভাবে নির্ণীত হবে? যেমন জাগরণের পরে “স্বপ্ন কোথায় ছিল” প্রশ্নের কোনো মানে থাকে না, তেমনি জ্ঞানজাগরণে অবিদ্যা ও তার আশ্রয় উভয়ই অপবাদে বিলীন হয়।

অতএব, আশ্রয়-অনির্ণয়-বাদ একাধিক স্তরে সত্য ধারণ করে—সাধনায় অবিদ্যা আমার, অনুসন্ধানে তার ভিত্তি চেতনা, আর জ্ঞানে বোঝা যায়, প্রশ্নটাই অবিদ্যার সৃষ্টি। অবিদ্যা নিঃশেষে জ্ঞান প্রকাশিত হলে, আশ্রয়, আবরণ বা প্রক্ষেপ—সবই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, কারণ একমাত্র আত্ম-চৈতন্যই তখন স্বপ্রভায় অবশিষ্ট থাকে।

অবিদ্যার বিলোপও দুই স্তরে ঘটে—আংশিক ও সামষ্টিক। ব্যক্তিগত স্তরে আত্ম-আবরণ ভাঙে, যখন জ্ঞান জাগে—“আমি দেহ-মন নই, আমি চৈতন্য”—এটাই অপরোক্ষ জ্ঞান। তখন আবরণ-নিবৃত্তি তাৎক্ষণিক হয়। কিন্তু বিক্ষেপ বা প্রক্ষেপণ তৎক্ষণাৎ যায় না; প্রারব্ধ-কর্মের টান, বাসনা ও অভ্যাসের ঢেউ থেকে যায়।

জ্ঞানী জানেন “সবই মিথ্যা”, তবু জগৎ প্রতীয়মান থাকে; দগ্ধ-বীজের মতো, জড়তা থাকে, কার্যক্ষমতা থাকে না। এই বিক্ষেপ-নিবৃত্তি ধীরে ধীরে ঘটে জ্ঞাননিষ্ঠা ও নিধিধ্যাসনের মাধ্যমে—নিরন্তর আত্মাভ্যাস, শম, দম, তিতিক্ষা, শ্রদ্ধা, সমাধান প্রভৃতি চিত্তশুদ্ধির ফলে বাসনা ক্ষয় হয়, মনো-নাশ ঘটে, এবং দ্বৈত প্রতীতি নিস্তরঙ্গ হয়। এতে দেখা যায়, আবরণ-নিবৃত্তি তাৎক্ষণিক, বিক্ষেপ-নিবৃত্তি ক্রমগত। আত্ম-আবরণ সম্পূর্ণ ভাঙে, অনাত্ম-আবরণ ধীরে ধীরে ক্ষয় পায়।

অবিদ্যাকে ধরার প্রয়োজনও এখানেই—এটি না ধরলে জগৎ ও অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা হয় না, কিন্তু এটিকে বাস্তব করলে ব্রহ্মের অদ্বৈততা ভেঙে যায়। তাই অদ্বৈত এর অনির্বচনীয় মর্যাদা দেয়—না সত্য, না মিথ্যা। জ্ঞানের কাজ এখানে নতুন কিছু সৃষ্টি করা নয়; এটি কেবল আচ্ছাদন সরায়। এই নিবর্তন-শক্তি দ্বারা অবিদ্যা নিবারিত হয়। তাই অবিদ্যা শিক্ষণ-উপকরণ হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু জ্ঞানে নিজেই অপবাদে লীন হয়।

অদ্বৈতের শিক্ষণপদ্ধতি অধ্যারোপ-অপবাদ এই কারণেই প্রয়োজনীয়। প্রথমে শাস্ত্র বুদ্ধিকে ধরিয়ে দেয়—জগৎ, ঈশ্বর, সৃষ্টি, কর্ম—এগুলো সত্যের সিঁড়ি হিসেবে মেনে নিতে হয়। পরে সেই সিঁড়িটিই সরিয়ে নিতে হয়।