অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো পাঁচ



এই দ্বাদশ নিদান (বারোটি কারণের সূত্র) ব্যাখ্যা করে, কীভাবে অজ্ঞতা থেকে শুরু হয়ে একের পর এক শর্ত জন্ম দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত দুঃখ ও মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি ঘটে।

দ্বাদশ নিদান বা বারোটি কারণধর্ম পরস্পরনির্ভরভাবে পরপর এইভাবে সাজানো—
অবিদ্যা—অজ্ঞান; সত্যকে না জানা, অনিত্য ও অনাত্মা সম্পর্কে অজ্ঞতা।
সংখার—ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া বা সংস্কার; অবিদ্যা দ্বারা চালিত কর্ম।
বিজ্ঞান—চেতনা; কর্মফলের বীজরূপে নতুন জীবনের চৈতন্য উদ্ভব।
নামরূপ—মন ও দেহের সমন্বয়; মানসিক ও ভৌত উপাদান একত্রে।
ষড়ায়তন—ছয় ইন্দ্রিয়ক্ষেত্র; চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, দেহ ও মন।
স্পর্শ—ইন্দ্রিয়, বস্তু ও চেতনার সংযোগ; অভিজ্ঞতার সৃষ্টি।
বেদনা—অনুভূতি; সুখ, দুঃখ বা নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা।
তৃষ্ণা—আকাঙ্ক্ষা; আনন্দকর অভিজ্ঞতার প্রতি লালসা ও আসক্তি।
উপাদান—আঁকড়ে ধরা; তৃষ্ণার গভীর আসক্তিতে পরিণতি।
ভাব—অস্তিত্ব বা সত্তার গঠন; কর্মফলের শক্তিতে নতুন জন্মের প্রস্তুতি।
জাতি—জন্ম; নতুন দেহ বা জীবনের আরম্ভ।
জরা-মরণ—বার্ধক্য ও মৃত্যু; এবং তার সঙ্গে শোক, দুঃখ, বিষাদ ও বিলাপ।

অবিদ্যা থেকে সংস্কার, সংস্কার থেকে চেতনা, এভাবে একে একে পুরো বারো ধাপেই সংসারের চক্র গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন অবিদ্যা নিঃশেষ হয়, তখন এই চক্র ভেঙে যায়—অবিদ্যা নেই তো সংস্কার নেই, তাহলে জন্ম-মৃত্যুও নেই, ফলে দুঃখও নেই। এই দ্বাদশ নিদান বুদ্ধের “পটিচ্চসমুৎপাদ” তত্ত্বের মূলে—যা শেখায়, সমস্ত অস্তিত্বই শর্তনির্ভর, এবং সেই শর্ত ভাঙলেই মুক্তি বা নির্বাণ।

সংক্ষেপে, পুনর্জন্মের চক্র মানে—অবিদ্যা ও তৃষ্ণা দ্বারা চালিত কর্মফলের ধারাবাহিকতা, যার ফলে জীব বার বার জন্ম নেয়, দুঃখ ভোগ করে ও মৃত্যুবরণ করে। যখন জ্ঞান (প্রজ্ঞা) উদিত হয়ে তৃষ্ণা ও অবিদ্যা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়, তখন এই চক্র থেমে যায়। এই চক্রের অবসানই হলো নিব্বান (নির্বাণ)—চূড়ান্ত মুক্তি, যেখানে আর কোনো জন্ম, দুঃখ বা মৃত্যু অবশিষ্ট থাকে না।

বুদ্ধ দুঃখ-নিরোধের উপায় হিসেবে যে-পথ নির্দেশ করেছেন, সেটিই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Ariya Aṭṭhaṅgika Magga)—মুক্তির জন্য বাস্তব ও নৈতিক অনুশাসনের পূর্ণাঙ্গ পথ।

এই পথের আটটি অঙ্গ হলো—

১. সম্যক দর্শন (Sammā-diṭṭhi)—বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধি। অর্থাৎ, চার আর্যসত্য, অনিত্যতা, অনাত্মা ও কর্মফলের সত্য জ্ঞান।

২. সম্যক সংকল্প (Sammā-saṅkappa)—শুদ্ধ সংকল্প বা সঠিক চিন্তা। অর্থাৎ, অনাক্রমণ, অনাসক্তি ও করুণাময় মনোভাবের বিকাশ।

৩. সম্যক বাক (Sammā-vācā)—সত্য ও মধুর বাক্যপ্রয়োগ। মিথ্যা, কটু, অপবাদ ও অনর্থক বাক্য থেকে বিরত থাকা।

৪. সম্যক কর্ম (Sammā-kammanta)—সঠিক আচরণ বা নৈতিক কার্য। অর্থাৎ, হত্যা, চুরি ও কুকর্ম থেকে বিরত থাকা, এবং সৎ, অহিংস জীবনযাপন।

৫. সম্যক আজীবিকা (Sammā-ājīva)—সৎ জীবিকা বা ন্যায়সঙ্গত উপার্জন। অর্থাৎ, এমন পেশা অবলম্বন না করা যা অন্যের ক্ষতি করে।

৬. সম্যক ব্যয়াম (Sammā-vāyāma)—সঠিক প্রয়াস বা অধ্যবসায়। অর্থাৎ, দুষ্ট চিন্তা দূর করা, সদ্‌গুণ জাগানো, এবং সেগুলো লালন করা।

৭. সম্যক স্মৃতি (Sammā-sati)—সচেতন উপস্থিতি বা মনোযোগ। অর্থাৎ, দেহ, অনুভূতি, মন ও ভাবনা—সবকিছুর প্রতি নিরবচ্ছিন্ন সজাগতা বজায় রাখা।

৮. সম্যক সমাধি (Sammā-samādhi)—গভীর মনসংযোগ বা ধ্যানস্থিতি। অর্থাৎ, চিত্তকে একাগ্র করে শান্ত, নির্মল ও জ্ঞান-উদিত অবস্থায় স্থিত করা।

এই আটটি ধাপ একত্রে দুঃখ-নিরোধের পূর্ণাঙ্গ পথ। নৈতিক শুদ্ধতা (শীল), মননশীলতা (সমাধি) ও প্রজ্ঞা (পন্না)—এই তিন অংশে এর সম্পূর্ণ কাঠামো বিভক্ত।

আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো এমন এক সমন্বিত জীবনপথ, যেখানে সঠিক দৃষ্টি, চিন্তা, বাক, আচরণ, জীবিকা, প্রচেষ্টা, স্মৃতি ও ধ্যান মিলেই দুঃখ থেকে মুক্তি এবং নির্বাণে পৌঁছানোর উপায় সৃষ্টি করে।

বুদ্ধের ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্তে (সংযুক্ত নিকায়, ৫৬.১১) তৃতীয় আর্যসত্যের নাম দুঃখ-নিরোধ আর্যসত্য (Dukkha-nirodha Ariya-sacca)। এই সুত্তে বুদ্ধ বলেন—“ইদং খো পন, ভিকখবে, দুঃখনিরোধং আর্যসচ্চং—যো তস্যায়ে তান্হায়ে আসেসবিরাগনিরোধো, চাগো, পত্তিনিস্সগ্গো, মুত্তি, অনালয়ো।”

অর্থাৎ, “হে ভিক্ষুগণ, দুঃখের নিরোধ সম্পর্কিত আর্যসত্য এই যে—তৃষ্ণার সম্পূর্ণ বিরাগ, নিঃশেষ ও ক্ষয়ই নির্বাণ; এটি ত্যাগ, পরিত্যাগ, মুক্তি ও আসক্তিহীনতার অবস্থা।”

এখানে তৃষ্ণা (taṇhā) হলো জন্ম, আসক্তি ও পুনর্জন্মের মূল কারণ। যখন এই তৃষ্ণা জ্ঞানও অনাসক্তির দ্বারা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়, তখন দুঃখের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হয়—এটিই নিরোধ।

নির্বাণ কোনো স্থান বা বস্তু নয়, বরং এক অবস্থা—যেখানে সমস্ত আসক্তি, দ্বেষ, মোহ নিস্তব্ধ হয়; চিত্ত শান্ত হয় এবং কর্মফল আর জন্মের বন্ধন সৃষ্টি করে না।

অতএব, তৃতীয় আর্যসত্যের মূল বক্তব্য হলো—তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিঃশেষই দুঃখের নিরোধ, এবং সেই নিরোধই নির্বাণ, যা পরম শান্তি ও চূড়ান্ত মুক্তির অবস্থা।

সাংখ্য ও যোগে—“কৈবল্য” মানে পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ, যেখানে চেতনা আর কোনো গুণ-ক্রিয়ায় জড়িত নয়; দ্রষ্টা নিজের স্বরূপে অবস্থান করে।

ন্যায় ও বৈশেষিকে—“অপবর্গ” মানে দুঃখের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি; ক্লেশ ও দুঃখের সমস্ত কারণ নাশ হলে চূড়ান্ত শান্তি লাভ হয়।

বৌদ্ধ দর্শনে — “নির্বাণ” মানে তৃষ্ণা ও অজ্ঞান সম্পূর্ণ নিঃশেষ; কারণ-শৃঙ্খল ভেঙে জন্ম-মৃত্যুর চক্রের সমাপ্তি।

সাংখ্য-যোগ মতে, মুক্তি বা কৈবল্য হল আত্মবাদী উপলব্ধি—এখানে আত্মা বা পুরুষ স্বতন্ত্র ও চিরন্তন; তিনি প্রকৃতির ক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। মুক্তি মানে সেই জ্ঞান, যেখানে পুরুষ বুঝতে পারে যে, সে কখনও প্রকৃতির দাস ছিল না।

বৌদ্ধ মতে, নির্বাণ অনাত্মবাদী—এখানে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই। “আমি”, “আমার” ইত্যাদি ধারণা কেবল ভ্রান্ত অনুবন্ধ। দুঃখের কারণ তৃষ্ণা ও অবিদ্যা; যখন তা নিঃশেষ হয়, তখন প্রপঞ্চও নিঃশেষ—এটাই নির্বাণ।

ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অপবর্গ আত্মবাদী হলেও অভিজ্ঞাত্মক—আত্মা চিরন্তন, কিন্তু দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগে দুঃখে আবদ্ধ। জ্ঞান ও ধর্মাচরণের মাধ্যমে সেই দুঃখের সম্পূর্ণ নিবৃত্তিই মুক্তি।

তিনটি ভিন্ন পথ তিন রকম দর্শনে প্রতিষ্ঠিত হলেও, চূড়ান্ত লক্ষ্য এক—দুঃখের স্থায়ী অবসান, চির শান্তি ও স্বাধীনতা। তফাৎ কেবল দার্শনিক ব্যাকরণে—কে বা কী মুক্ত হয়, আত্মা আছে কি নেই, এবং মুক্তির প্রকৃতি কী—এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই পার্থক্য, উদ্দেশ্যে নয়।

পথ আলাদা—একদিকে চেতনার বিশুদ্ধ অবস্থায় স্থিতি, অন্যদিকে কারণ-নাশে চক্রভঙ্গ—কিন্তু গন্তব্য এক: বন্ধনচক্রের অবসান ও মুক্তি। তাই যোগসূত্রের কৈবল্য, সাংখ্যকারিকার কৈবল্য, ন্যায়-বৈশেষিক অপবর্গ ও বৌদ্ধ আর্যসত্যের নির্বাণ—সবই এক মুক্তিতত্ত্বের পৃথক ভাষ্য, এক পরম পুরুষার্থের ভিন্ন ব্যাকরণ।

নানা দর্শন পরম পুরুষার্থকে নানা নামে ডাকে—কৈবল্য/অপবর্গ/নির্বাণ—কিন্তু সকলেই “দুঃখ-নিবারণ ও শান্তি-স্থিতি”-কেই মানবজীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধি মেনে নেয়; পার্থক্য মূলত পথ ও পরিকাঠামোয়, লক্ষ্যবোধে নয়।

পরম পুরুষার্থ এমন এক অবস্থা, যেখানে কোনো অভাব, আকাঙ্ক্ষা বা ভয় নেই; সব সাধনা, সব জ্ঞান ও সব কর্মের পরিণতি একবিন্দুতে এসে মিশে যায় নিজের অন্তর্নিহিত অদ্বিতীয় আত্মা-স্বরূপে—যেখানে কেবল ব্রহ্মই সত্য, আর অন্য কিছু নয়।

ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তে, ভ্রান্তির স্বরূপ নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে। কীভাবে আমরা যা দেখি, তা কখনও কখনও প্রকৃত অর্থেই ভ্রান্ত হয়, এবং এই ভ্রান্তির অন্তর্নিহিত কারণ কী—তা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে। এই তত্ত্বগুলো শুধুমাত্র দার্শনিক বিতর্কের জন্য নয়, বরং আমাদের জ্ঞান, বাস্তবতা এবং মুক্তির ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

বিভিন্ন খ্যাতিবাদ ও তাদের সীমাবদ্ধতা:

১. অনির্বচনীয়-খ্যাতি: এই মতবাদ অনুসারে, ভ্রান্ত বস্তুটি ‘সৎ’ (বিদ্যমান) নয়, আবার ‘অসৎ’ (অবিদ্যমান)ও নয়; এটি অনির্বচনীয়। এটি উপস্থিতির স্তরে প্রতীয়মান হয়, অর্থাৎ, আমরা এটিকে প্রত্যক্ষ করি, যেমন শুক্তিকে রুপা হিসেবে দেখি। কিন্তু উচ্চতর জ্ঞানে এটি বাধিত হয়—যখন শুক্তিকে শুক্তি হিসেবে চিনে ফেলি, তখন রুপার প্রতীতি বিলুপ্ত হয়। এই বাধাযোগ্যতাই তার মিথ্যাত্বের চিহ্ন। এই মতবাদ অদ্বৈত বেদান্তের মূল ভিত্তি। এর প্রধান সুবিধা হলো, এটি ভ্রান্তিকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার না করে তার একটি ব্যাবহারিক বাস্তবতা প্রদান করে, যা পরবর্তীকালে উচ্চতর জ্ঞানে তিরোহিত হয়।

২. আত্ম-খ্যাতি: এই মতবাদ (বিশেষত যোগাচার বৌদ্ধদের) বলে যে, আমরা যা দেখি, তা আসলে চিত্তেরই স্ব-উৎপাদ প্রতীতি। অর্থাৎ, বাইরের কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, যা-কিছু আমরা অনুভব করি, তা সবই আমাদের মনের প্রক্ষেপণ। এর সীমাবদ্ধতা হলো, এটি বহির্বস্তুর সাধারণ অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী সংশোধনকে দুর্বল করে। যদি সবই মনের সৃষ্টি হয়, তবে কেন আমাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে মেলে, বা কেন আমরা ভুল শুধরে নিতে পারি—তার ব্যাখ্যা দুর্বল হয়ে যায়।

৩. অসৎ-খ্যাতি: এটি বলে যে, যা ধরা পড়ল, তা আসলে অবিদ্যমান। যেমন, আকাশে নীলের ধারণা—নীল বলে কিছু নেই, তবুও আমরা তা দেখি। এর সীমা হলো, একেবারে অবিদ্যমান জিনিসের অভিজ্ঞতা-প্রসঙ্গ কীভাবে সম্ভব, তা বোঝানো যায় না। যা সম্পূর্ণ অসৎ, তার প্রতীতি কীভাবে জাগে, তা এক দুরূহ প্রশ্ন।

৪. অন্যথা-খ্যাতি: এই মতবাদ (ন্যায়-বৈশেষিক) অনুসারে, এক বস্তুর জ্ঞান অন্য বস্তুর ওপর আরোপ করা হয়। যেমন, শুক্তিতে রুপার জ্ঞান। এখানে শুক্তি আছে, রুপাও আছে, কিন্তু রুপা আছে অন্য কোথাও, যার স্মৃতি শুক্তির ওপর আরোপিত হয়। এর সীমাবদ্ধতা হলো, শুক্তিতে রুপার “এইখানে-এখন” অনুভূতিকে কেবল স্মৃতি-সংমিশ্রণ বলেই শেষ করা যায় না। স্মৃতি অতীতের বিষয়, কিন্তু ভ্রান্তি বর্তমানের প্রত্যক্ষের মতো অনুভূত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের বিশেষ ব্যাখ্যা:

অদ্বৈত বেদান্ত এই পূর্বোক্ত মতবাদগুলোর সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দেয়, যা অনির্বচনীয়-খ্যাতিরই সম্প্রসারণ। অদ্বৈত বলে—ভুলটি “অন্যত্র থেকে আনা” নয় (যেমন অন্যথা-খ্যাতিতে বলা হয়), “শূন্যও” নয় (যেমন অসৎ-খ্যাতি বা আত্ম-খ্যাতিতে বোঝানো যেতে পারে)। এটা অধিষ্ঠান-বস্তুর (যেমন শুক্তি বা দড়ি) ওপর অবিদ্যার কারণে আরোপ (অধ্যাস) মাত্র।

এখানে মূল ধারণা হলো, আমাদের অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা একটি বিদ্যমান বস্তুর ওপর এমন কিছুকে আরোপ করে, যা সেখানে নেই। এই আরোপের ফলে ভ্রান্ত বস্তুটি নৈঃসত্ত্ব (সম্পূর্ণ অসৎ) নয়, আবার স্বতঃসিদ্ধ সৎও নয়—এটি অনির্বচনীয়। এটি উপস্থিত হয়, কিন্তু জ্ঞানের আলোয় এটি বাধিত হয়, অর্থাৎ, বিলুপ্ত হয়।

শুক্তিকে রুপা দেখার ভ্রান্তির ধাপগুলো অদ্বৈত বেদান্ত এইভাবে ব্যাখ্যা করে:

১. আংশিক আলোক: প্রথমে এমন একটি পরিস্থিতি থাকে, যেখানে জ্ঞানের পূর্ণতা নেই, যেমন স্বল্প আলো বা মনের চঞ্চলতা।
২. অধিষ্ঠান অচিন্তিত (আবরণ): এই অবস্থায় অধিষ্ঠান বস্তুর (শুক্তির) স্বরূপ ঢাকা পড়ে থাকে, অর্থাৎ, তার প্রকৃত রূপ অনবগত থাকে। এটি অবিদ্যার 'আবরণ' শক্তি।
৩. চিত্ত “রুপা” প্রক্ষেপ করে (বিক্ষেপ): অবিদ্যা তখন চিত্তকে প্রভাবিত করে এবং রুপার ধারণাটি শুক্তির ওপর প্রক্ষেপ করে। এটি অবিদ্যার 'বিক্ষেপ' শক্তি।
৪. নিকট-প্রভায় “শুক্তি” নিঃসংশয়ে প্রকাশ পায়: যখন জ্ঞান লাভ হয়, যেমন পর্যাপ্ত আলো আসে বা মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, তখন অধিষ্ঠান বস্তু (শুক্তি) তার স্বরূপে প্রকাশিত হয়।
৫. ফলাফল: “রুপা” বিলুপ্ত হয়—এটাই বাধা: শুক্তিকে চিনে ফেলার সাথে সাথেই রুপার ধারণা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এটিই 'বাধা'—যেখানে পূর্বের প্রতীতি বর্তমান জ্ঞান দ্বারা অপসারিত হয়।

প্রমাণের স্তরভেদ ও ব্রহ্মজ্ঞান:

অদ্বৈত বেদান্ত প্রমাণ বা জ্ঞানের উৎসকে দুটি স্তরে ভাগ করে:

১. জাগতিক ব্যাবহারিক সত্তায়: আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রত্যক্ষ (সরাসরি দেখা), অনুমান (লজিক্যাল ইনফারেন্স) এবং শব্দ (শাস্ত্রীয় প্রমাণ বা নির্ভরযোগ্য উক্তি)—এসবই বৈধ প্রমাণের উৎস। এই স্তরে জগতের ব্যাবহারিক বাস্তবতা স্বীকৃত।