কৈবল্যের লক্ষণ পতঞ্জলির যোগসূত্রে একাধিক স্থানে ছড়িয়ে আছে।
সমাধি-পাদে বলা হয়েছে—“চিত্তবৃত্তি নিরোধই যোগ” (১.২); এই অবস্থায় “দ্রষ্টা নিজের স্বরূপে অবস্থান করেন” (১.৩)। অর্থাৎ যখন মনো-বৃত্তি স্থগিত হয়, তখন প্রথমবার আত্মার স্ব-স্থিতি অনুভূত হয়।
দ্রষ্টা নিজে অবিকৃত ও শুদ্ধ, কিন্তু বোধ-বস্তুর অনুসরণে যেন আবদ্ধ মনে হয় (২.২০)। যখন এই আসক্তি বা সংযোগ জ্ঞানে লুপ্ত হয়, তখনই প্রকৃতি বা গুণত্রয় তাদের কাজ ফুরিয়ে নিজের উৎসে ফিরে যায়।
চতুর্থ অধ্যায়ে পতঞ্জলি বলেছেন—“পুরুষার্থশূন্য গুণদের প্রতিপ্রসবই কৈবল্য”—অর্থাৎ যখন গুণত্রয় আর দ্রষ্টার জন্য কোনো কার্য করে না, তখন তারা স্বয়ং লীন হয়। এটিই চিতিশক্তির স্বরূপে প্রতিষ্ঠা (৪.৩৪)।
কৈবল্যের প্রত্যক্ষ লক্ষণ হলো—অবিদ্যা, আসক্তি, রাগ, দ্বেষ ক্রমে ক্ষয় হয়; ভয়, ক্রোধ ও দুঃখ স্বতঃসিদ্ধভাবে দমন হয়; মন শান্ত, সম, করুণাময় ও স্বচ্ছ থাকে।
বাহ্য আচরণ ও কর্ম থাকতে পারে, কিন্তু কর্তা-ভাব থাকে না; তাই আর নতুন কর্মবন্ধন তৈরি হয় না (৪.৭-৪.৮, ৪.১১)।
জ্ঞান-সমাধির পর চিত্তের সমস্ত বীজ-সংস্কার ক্ষয় হয়ে যায়, বৃত্তিগুলো নিস্প্রভ হয়ে থাকে (১.৫০-১.৫১)।
কৈবল্য মানে এমন এক অবস্থা, যেখানে চিত্ত সম্পূর্ণ নির্মল, গুণত্রয় প্রত্যাবর্তিত, আর চেতনা বা পুরুষ নিজের স্বরূপে অবিচলভাবে প্রতিষ্ঠিত।
“হান” শব্দটি যোগসূত্রে কেবল নেগেশন নয়, বরং এক সক্রিয় উপশম-প্রক্রিয়া। পতঞ্জলি বলেন, অবিদ্যা-সমর্থিত সংযোগই দুঃখের কারণ (২.২৪), এবং সেই সংযোগ ছিন্ন করাই হান—যেখানে দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মিথ্যা একাত্মতা ভেঙে যায় (২.২৫)। এই ভাঙন ঘটাতে হয় জ্ঞানের মাধ্যমে, তাই হান কোনো একক ক্রিয়া নয়—এটি ধীরে ধীরে অবিদ্যা-নিবৃত্তির প্রক্রিয়া।
হানের কার্যকর উপায় দুটি—প্রথমত, নিরবচ্ছিন্ন বিবেক-প্রকাশ (২.২৬-২.২৭), দ্বিতীয়ত, অষ্টাঙ্গ-সাধনা (২.২৯)। বিবেকখ্যাতি মানে দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ভেদে অবিচল জ্ঞান, যা কখনও বিচলিত হয় না; আর অষ্টাঙ্গ-যোগ—যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি—চিত্তকে নির্মল ও স্থির করে এই জ্ঞানকে দৃঢ় করে।
যখন যোগী এই পথে এগোয়, তখন ক্লেশ, কর্ম ও সংস্কারের প্রবাহ স্তব্ধ হতে শুরু করে। পতঞ্জলি (৪.৩০-৪.৩২)-এ বলেন—ধর্মমেঘ-সমাধিতে ক্লেশ ও কর্ম নিঃশেষ হয়; চিত্ত কলুষমুক্ত ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মন আর বিকার সৃষ্টি করে না, সংস্কারের বীজ শুকিয়ে যায়, এবং ক্লেশের ক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়।
যোগসূত্র (৪.৩৩)-এ পতঞ্জলি বলেন—“ক্ষণপ্রতিযোগী পরিণাম অপরান্ত নিরগ্ৰহ্যঃ ক্রমঃ।” অর্থাৎ প্রতিক্ষণে প্রকৃতিতে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে, আর সেই পরিবর্তনগুলির ধারাবাহিকতাই কালের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
প্রকৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল, কারণ এটি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণে গঠিত। দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তা—সবই এই গুণত্রয়ের প্রকাশ, তাই এগুলো প্রতিক্ষণ পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনশীলতার ধারাই হলো “ক্ষণপ্রতিযোগী পরিণাম”—প্রতিক্ষণ নতুন রূপ নিচ্ছে প্রকৃতি।
যোগী যখন গভীর পর্যবেক্ষণে বুঝতে শেখেন, তখন উপলব্ধি করেন যে, সময় কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়; সময় কেবল এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতার মানসিক প্রতিফলন। অর্থাৎ কাল নিজে অস্তিত্বশীল নয়—এটি কেবল প্রকৃতির রূপান্তরের মাপমাত্র।
এরপর যোগী বোঝেন যে, পরিবর্তন কেবল প্রকৃতিতে ঘটে, চেতনায় নয়। মন, দেহ, ইন্দ্রিয়, চিন্তা সবই পরিবর্তিত হয়, কিন্তু দ্রষ্টা বা পুরুষ কখনো পরিবর্তিত হন না। তিনি অপরিবর্তনশীল, চিরসচেতন, অচঞ্চল সাক্ষী।
দেহে বার্ধক্য আসে, মন ক্লান্ত হয়, অনুভূতি আসে ও যায়, কিন্তু “আমি আছি”—এই চেতনা অপরিবর্তিত থাকে। এই “আমি” কোনো দেহ বা মন নয়; এটি সেই শুদ্ধ দ্রষ্টা, যিনি সমস্ত পরিবর্তনের সাক্ষী।
অতএব, সময় ও পরিবর্তন প্রকৃতির ধর্ম, চেতনার নয়। চেতনা সময়ের ঊর্ধ্বে, কারণ সময় কেবল পরিবর্তনের পরিমাপ, আর চেতনা পরিবর্তনেরও সাক্ষী।
যোগদর্শনে এই উপলব্ধি আসে গভীর সমাধিতে। তখন যোগী প্রত্যক্ষ করেন যে, কাল, পরিবর্তন ও ক্রম সবই গুণত্রয়ের কার্য, এবং চেতনা এইসবেরও স্বাক্ষী।
এই বোধ স্থায়ী হলে যোগী বুঝতে পারেন—পরিবর্তন কেবল প্রকৃতিতে, আমি কেবল দর্শক। আমি অপরিণামী, চিরশান্ত চেতনা। এই স্থায়ী উপলব্ধিই মুক্তির চিহ্ন, যা পতঞ্জলি কৈবল্যের পূর্বমুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
শেষে (৪.৩৪)-এ পতঞ্জলি বলেন, যখন গুণত্রয় তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে এবং আর পুরুষের জন্য কাজ করে না, তখন তারা প্রতিপ্রসব—নিজ উৎসে প্রত্যাবর্তন করে। পুরুষ তখন নিজের চিতিশক্তি-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এটিই কৈবল্য—চেতনার নিঃসঙ্গ স্বাধীনতা, যেখানে আর কোনো ক্লেশ, কর্ম বা পরিবর্তন নেই।
পুরো যোগসূত্রের নকশা এক সরল মুক্তিপথ তৈরি করে। দুঃখ এড়াও (২.১৬), কারণ জানো (২.১৭, ২.২৪), উপায় গ্রহণ করো—বিবেকখ্যাতি ও অষ্টাঙ্গ-যোগ (২.২৬-২.২৯), ধ্যান-সমাধিতে বীজক্ষয় (১.৫০-১.৫১; ৩.৯-৩.১২), ধর্মমেঘ-সমাধিতে ক্লেশ ও কর্মের নিঃশেষ (৪.২৯-৪.৩১), এবং শেষে গুণত্রয়ের প্রতিপ্রসব ও দ্রষ্টার স্বরূপস্থিতি—এই অবস্থাই কৈবল্য (৪.৩৪)।
কৈবল্য বা মুক্তি যোগ ও সাংখ্য দর্শনের গভীর উপলব্ধি। এটি কেবল দুঃখের অনুপস্থিতি নয়; বরং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি এবং আত্মার বিশুদ্ধ, শর্তহীন সারসত্তায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পতঞ্জলি একে বলেছেন—চিতিশক্তির স্বরূপস্থিতি, অর্থাৎ চেতনার নিজের প্রকৃত রূপে স্থিত থাকা।
পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগের অবসানই কৈবল্যের মূল অর্থ। যোগসূত্রে (২.২৫) বলা হয়েছে, অবিদ্যা এই সংযোগের কারণ, আর জ্ঞান সেই সংযোগের অবসান ঘটায়। এই অবসানকেই হান বলা হয়। যখন পুরুষ প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে করা বন্ধ করে, তখন দুঃখ ও বন্ধনের কারণ লুপ্ত হয়। পুরুষ তখন নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে—যা স্বাধীন, শুদ্ধ ও অপরিবর্তনশীল।
কৈবল্যের আরেকটি দিক হলো গুণত্রয়ের প্রতিপ্রসব, অর্থাৎ তিন গুণ—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—নিজ নিজ উৎসে ফিরে যাওয়া (যোগসূত্র, ৪.৩৪)। প্রকৃতি গুণত্রয় দ্বারা গঠিত; তারা পুরুষের জন্যই ক্রিয়া করে, ভোগ ও মুক্তির অভিজ্ঞতা দিতে। কিন্তু যখন সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়, তখন গুণত্রয় আর সক্রিয় থাকে না; তারা নিস্তব্ধ হয়ে প্রকৃতিতে লীন হয়। পুরুষ তখন নিজ চিতিশক্তির স্বরূপে প্রকাশিত হয়, প্রকৃতির সব ক্রিয়া থেকে মুক্ত।
কৈবল্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ হলো নিরবচ্ছিন্ন বিবেক-জ্ঞান—দ্রষ্টা ও দৃশ্যের চিরভেদে অবিচল জ্ঞান। যোগসূত্র (৩.৫৫; ৪.২৬-৪.২৭)-এ বলা হয়েছে, যখন এই বিবেকজ্ঞান কখনো বিচলিত হয় না, তখনই মুক্তি অনিবার্য। এটি বুদ্ধির অনুধাবন নয়, বরং এক নিরন্তর অন্তর্দৃষ্টি—যেখানে যোগী স্পষ্ট অনুভব করেন, মন ও চিন্তা পরিবর্তিত হলেও আমি অপরিবর্তনশীল চেতনা। মন তখন কেবল প্রতিফলনমাত্র, প্রকৃতি নিঃশব্দ সাক্ষীস্বরূপ পুরুষের সামনে স্থিত।
যখন সমস্ত গুণ, কর্ম ও সংস্কার নিঃশেষ হয়, তখন চিত্ত সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়। পুরুষ তখন নিজের অন্তর্নিহিত দীপ্তিতে স্থিত থাকে—এটাই কৈবল্য। এটি কোনো স্থানান্তর নয়, বরং সময় ও প্রকৃতির সীমা অতিক্রম করে নিজের শাশ্বত স্বরূপে প্রত্যাবর্তন।
এই অবস্থায় চেতনা স্বাধীন, অপরিবর্তনশীল ও নিঃসঙ্গ। তিনি আর কর্তা নন, ভোক্তা নন—তিনি কেবল চিরসাক্ষী, স্বপ্রভা।
কৈবল্য মানে পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগের অবসান। এতে গুণত্রয় তাদের উৎসে ফিরে যায়, ক্লেশ ও কর্ম নিঃশেষ হয়, বিবেকজ্ঞান অবিচল থাকে, এবং চেতনা নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অবস্থাই যোগদর্শনের চূড়ান্ত মুক্তি—যেখানে আত্মা সম্পূর্ণ স্বাধীন, শুদ্ধ ও চিরপ্রকাশমান।
ধর্ম-মেঘ-সমাধি (যোগসূত্র ৪.২৯-৪.৩২) হলো যোগপথের চূড়ান্ত সমাধিস্থ অবস্থা। এই অবস্থায় সমস্ত ক্লেশ, কর্ম ও আশয়ের অবসান ঘটে। দুঃখের যে-সব উৎস, তারা যে-কর্মকে চালিত করে এবং যে সংস্কার বা স্মৃতি মনোজগতে জমে থাকে, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়। তখন চিত্ত আর কোনো প্রেরণা বহন করে না; এটি নির্মল ও স্থির হয়।
এই অবস্থায় জ্ঞানের বন্যা প্রবাহিত হয়—প্রজ্ঞার অসীম স্রোত পূর্বের সমস্ত আচ্ছাদন ধুয়ে দেয়। পতঞ্জলি বলেছেন, তখন (তৎঃ)—যখন ধর্মমেঘ-সমাধি উদিত হয়, সমস্ত আচ্ছাদন (আবরণ) ও মল (অশুদ্ধি) দূর হয়ে যায়, আর আত্মজ্ঞান-প্রদীপের (স্বজ্ঞানদীপেন) আলোয় যোগী স্বয়ং উদ্ভাসিত হন (বিবস্বান্)। অর্থাৎ, এই স্তরে চিত্তের সমস্ত ক্লেশ-কর্ম-সংস্কার নিঃশেষ হয়, জ্ঞানের দীপ্তি নিজে নিজেই জ্বলে ওঠে, আর যোগী নিজের অন্তর্নিহিত প্রভায় আলোকিত হয়ে ওঠেন—এটিই ধর্মমেঘ-সমাধির প্রতিফল, কৈবল্যের প্রাক্অবস্থা। (যোগসূত্র, ৪.৩১) এই আলোই ধর্মমেঘের মতো—পুণ্যের মেঘ জ্ঞানবর্ষণ করে, কিন্তু কোনো বন্ধন সৃষ্টি করে না।
কৈবল্যে পৌঁছানোর পথে অহংবোধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়। যোগসূত্র (৪.৭-৪.৮) এবং গীতা (৩.১৭, ৪.১৮, ৫.৮-৫.৯, ৫.১০)-এ বলা হয়েছে—মুক্ত ব্যক্তি কর্ম করলেও অহংবোধ থাকে না। তাঁর মধ্যে সমতা, অনাসক্তি ও করুণার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। তিনি কর্তব্য করেন, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত নন। তাঁর কর্ম নতুন সংস্কার সৃষ্টি করে না, কারণ কর্তা-ভাব অনুপস্থিত। গীতা এই অবস্থাকে বলে—“কর্মে অকর্ম দেখা” এবং “অকর্মে কর্ম দেখা”—অর্থাৎ বাহ্যত কর্ম চলছে, কিন্তু অন্তরে সম্পূর্ণ নির্বিকারতা।
সাংখ্য দর্শনও কৈবল্যকে একইভাবে দেখে, তবে ভিন্ন পরিভাষায়। সাংখ্যকারিকা (৬৪–৬৮)-এ কৈবল্যকে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য ও বিচ্ছেদের অবস্থা বলা হয়েছে। কারিকা ৬৮-এ বলা হয়—প্রকৃতি যেন এক নর্তকী; যখন পুরুষ তাঁকে দেখে ফেলে, তখন তিনি নৃত্য থামিয়ে দেন। অর্থাৎ, পুরুষ যখন প্রকৃতির স্বরূপ সম্পূর্ণ জেনে ফেলে, তখন প্রকৃতির অভিনয় শেষ হয়। পুরুষ তখন একা থাকে, স্বপ্রভা, স্বাধীন, অপরিবর্তনশীল।
এই “দেখার সমাপ্তি”-ই সাংখ্য ও যোগ উভয় ধারাতেই মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষণ। প্রকৃতি আর তার ক্রিয়া চালায় না, পুরুষ বা দ্রষ্টা থাকে নিঃসঙ্গ চেতনা হিসেবে—এবং সেই অবস্থাই কৈবল্য।
“দর্শন-সমাপ্তি” মানে, চিত্ত বা মানসিক পদার্থ আর পুরুষের উপর আরোপিত হয় না। যোগসূত্র (১.৩)-এ পতঞ্জলি বলেছেন, “তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপে অবস্থানম্”—অর্থাৎ তখন দ্রষ্টা নিজের স্বরূপে অবস্থান করেন। চিত্তের প্রবাহ তখন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, সত্ত্বের প্রশান্তি ও বিশুদ্ধতায় পূর্ণ হয়। চিত্তে আর কোনো বিকার বা প্রতিচ্ছবি থাকে না।
তখনও উপলব্ধি থাকে, কিন্তু গ্রাহক (জ্ঞানী), গ্রাহ্য (জ্ঞানবস্তু) ও গ্রহণ (জ্ঞানক্রিয়া)—এই তিনের দ্বৈততা বিলীন হয়। পুরুষ তখন কেবল নিজের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধ চেতনায় বিশ্রাম নেন—অচঞ্চল, অপরিণামী, চিরসচেতন সাক্ষীস্বরূপ।
যোগসূত্র (৪.৩৪)-এ পতঞ্জলি বলেন, “গুণদের প্রতিপ্রসবই কৈবল্য”—অর্থাৎ যখন গুণত্রয় তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে ফিরে যায়, তখন পুরুষ নিজের দীপ্ত চেতনায় স্থিত থাকে। এই অবস্থাই “দেখার সমাপ্তি”—যেখানে আর কোনো দর্শন নেই, কেবল স্ব-প্রকাশিত সত্তা।
কৈবল্য কোনো স্থানান্তর বা অন্য জগতে গমন নয়। এটি সময়ের মধ্যে ঘটে না, বরং অবিদ্যার অবসান। এটি চেতনার নিজের স্বরূপে স্থিতি—স্বরূপ-প্রতিষ্ঠা।
যোগদর্শনে কৈবল্য মানে উপভোক্তা (পুরুষ) ও উপভোগ্য (প্রকৃতি)-র চূড়ান্ত বিচ্ছেদ। সাংখ্যদর্শনে কৈবল্য মানে পুরুষের পরম স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা—পরম স্বাতন্ত্র্য বা নিরালম্বতা। প্রকৃতি তখন নৃত্য থামিয়ে দেয়, আর পুরুষ থাকে নিঃসঙ্গ আলোকরূপে।
কৈবল্য বোঝার জন্য মূল পাঠ্য তিনটি—পতঞ্জলির যোগসূত্র (২.২৫, ৪.২৬-৩৪), ব্যাসভাষ্য এবং ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকা (৬৪-৬৮)। সাংখ্যে বলা হয়েছে—পুরুষ যখন দেখে ফেলেন, প্রকৃতি তখন নৃত্য থামায়; এই অবস্থাই সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ।
কৈবল্য এমন এক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি প্রকৃতির আরোপিত সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে। তিনি কর্তা বা ভোক্তা নন—কেবল সাক্ষী। প্রকৃতি স্থির, চেতনা বিশুদ্ধ, এবং পুরুষ নিজের চির স্বাধীন দীপ্তিতে স্থিত। এই আত্ম-উপলব্ধিই মুক্তির চূড়ান্ত রূপ—যেখানে আর কোনো দর্শন নেই, কেবল স্বরূপের নীরব দীপ্তি।