অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: আশি


এর ফলিতার্থ হলো: জগৎ-আত্মার “আধারত্ব” এক প্রকৃতির নয়। আত্মার আধারত্ব অনুপাধি—স্বতঃসিদ্ধ, নিরালম্ব, স্বপ্রকাশ; জগতের আধারত্ব সোপাধিক—মায়া-নির্ভর, শর্তসাপেক্ষ, ব্যবহারিক। এই ভেদ ধরা পড়তেই বক্তার সর্বজনীনতা-দাবি মিথ্যা প্রতীয়মান হয়: তিনি শর্তযুক্ত সহাবস্থানকে শর্তহীন সহাবস্থান ভেবে বসেছিলেন। দার্শনিক নির্যাস তাই এই—চূড়ান্ত সত্যের দিগন্তে উপাধি হলো সীমানা-রেখা: যেখানে উপাধি, সেখানে আপাত সহাবস্থান; যেখানে উপাধি নেই, সেখানেই তত্ত্বাবেদন। আত্মা সেই অনুপাধি সত্য; জগৎ, উপাধিসাপেক্ষ বলে, কখনোই H-র জোরে S-তে উন্নীত হয় না।

সিদ্ধান্তীর ব্যাখ্যা অনুসারে, বক্তার প্রস্তাবিত যুক্তির ব্যর্থতা কোনো সামান্য তর্কগত ত্রুটি নয়, বরং তা উপাধির গভীর উপস্থিতি থেকে উদ্ভূত। উপাধি এমন একটি গোপন শর্ত, যার উপস্থিতিতে একটি সম্পর্ক সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু যার অনুপস্থিতিতে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। অন্যভাবে বললে, উপাধি এমন একটি সূক্ষ্ম সীমাবদ্ধতা, যা আপাত-সর্বজনীন সম্পর্ককে আংশিক ও শর্তাধীন করে তোলে।

বক্তা বলেছিলেন, “যেখানে আধারত্ব আছে, সেখানে তত্ত্বাবেদন আছে”—অর্থাৎ, যে-জিনিস গুণ বা ধর্মের আধার, সেটিই চূড়ান্তভাবে সত্য। কিন্তু এই যুক্তি আত্মা ও জগতের মধ্যে এক গভীর গুণগত পার্থক্য উপেক্ষা করে। আত্মার আধারত্ব স্বপ্রকাশ, কারণ আত্মা নিজেই চৈতন্যময়, স্বতঃসিদ্ধ ও নিরালম্ব। কিন্তু জগতের আধারত্ব ভিন্ন প্রকৃতির—তা মায়া ও অবিদ্যার দ্বারা নির্ধারিত, পরিবর্তনশীল ও সীমাবদ্ধ। এখানে সিদ্ধান্তী দেখান যে, এই “আধারত্ব” গুণটি কেবল তখনই তত্ত্বাবেদন সৃষ্টি করে, যখন সেটি আত্মাস্বরূপে বিদ্যমান। অর্থাৎ, “আধারত্ব” গুণটি আত্মা-হওয়ার শর্তে আবদ্ধ।

জগৎ এই শর্তটি পূরণ করে না, কারণ জগৎ অনাত্মা। ফলে এমন উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে আধারত্ব আছে, কিন্তু তত্ত্বাবেদন নেই—এটি প্রমাণ করে যে “আধারত্ব” একা যথেষ্ট নয়। এই অবস্থায় হেতু বা কারণ (আধারত্ব) সর্বত্র প্রযোজ্য থাকলেও তার সঙ্গে চূড়ান্ত সত্যের অনুষঙ্গ সর্বত্র বজায় থাকে না। সম্পর্কটি তখন শর্তযুক্ত হয়ে যায়—যেখানে আত্মা-হওয়ার গুণ আছে, সেখানেই তত্ত্বাবেদন সত্য। অর্থাৎ, উপাধি আত্মত্ব (Ātmatvam) হলো সেই অন্তর্নিহিত শর্ত, যা অনুপস্থিত হলে তত্ত্বাবেদনও অনুপস্থিত।

এভাবে বোঝা যায় যে, উপাধি হেতুর তুলনায় সংকীর্ণ, কারণ সব আধারই আত্মা নয়। আবার দেখা যায় যে, উপাধি সাধ্যের তুলনায় প্রসারিত, কারণ যে-সমস্ত সত্তা চূড়ান্তভাবে সত্য, তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আত্মা-হওয়ার গুণ বিদ্যমান। আত্মা তাই অনুপাধি—তার সত্যতা নিঃশর্ত, স্বতঃসিদ্ধ ও চিরন্তন। কিন্তু জগৎ সোপাধিক—তার সত্যতা শর্তসাপেক্ষ, আপাত ও ব্যাবহারিক।

বক্তার সর্বজনীন সম্পর্কের দাবি এভাবে ভেঙে যায়। তিনি ভেবেছিলেন “যেখানে আধারত্ব আছে, সেখানে চূড়ান্ত সত্য আছে,” কিন্তু দেখা গেল, এই সম্পর্কটি আত্মত্ব নামক শর্তের ওপর নির্ভর করে। সেই শর্ত অনুপস্থিত হলে সম্পর্কটি ভ্রান্ত হয়ে যায়। বক্তা শর্তযুক্ত সহাবস্থানকে শর্তহীন বলে ভেবে বসেছিলেন, এবং এই ভুল ধারণাই তার যুক্তিকে অকার্যকর করে তোলে।

দার্শনিকভাবে এটি এক মৌলিক সত্য উন্মোচন করে: জগৎ ও আত্মা উভয়ই আধার বটে, কিন্তু তাদের আধারত্ব এক নয়। আত্মার আধারত্ব তার নিজস্ব চৈতন্য থেকে উৎসারিত—তা অনাদি, নিরালম্ব ও পরমার্থিক; জগতের আধারত্ব মায়িক প্রতিফলন—তা অনিত্য, নির্ভরশীল ও প্রাতিভাসিক। আত্মা চূড়ান্ত সত্য, কারণ তার অস্তিত্ব স্বরূপতই জ্ঞান; জগৎ আপাত সত্য, কারণ তার অস্তিত্ব নির্ভর করে অবিদ্যার ওপর।

অতএব, উপাধি এখানে শুধু যুক্তিগত সীমা নয়, বরং অস্তিত্বতাত্ত্বিক বিভাজনরেখা। এটি দেখায় যে, যেখানে উপাধি আছে, সেখানে সত্য আপাত; আর যেখানে উপাধি নেই, সেখানে সত্য চূড়ান্ত। আত্মা সেই অনুপাধি সত্য, জগৎ সেই সোপাধিক প্রতিফলন। এইভাবে উপাধি-তত্ত্ব সমগ্র বাস্তবতার স্তরভেদকে প্রকাশ করে, এবং এক সূক্ষ্ম রেখায় পৃথক করে দেয় মায়ার জগৎ ও ব্রহ্মের অনন্ত সত্তাকে।

অদ্বৈত সিদ্ধান্তীর যুক্তির কেন্দ্রে রয়েছে “প্রমাণ” বা pramāṇa-এর দ্বিস্তরীয় কাঠামো—যার মাধ্যমে তিনি জগৎ ও আত্মার সত্যতার স্তরকে পৃথক করেন। বাস্তবতা এখানে একক নয়; তা দ্বিমাত্রিক—একটি আপাত, ব্যাবহারিক স্তর এবং একটি চূড়ান্ত, তাত্ত্বিক স্তর। তাই প্রমাণও এই দ্বিস্তরীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুই প্রকারে বিভক্ত হয়।

প্রথম স্তরটি হলো ব্যাবহারিক প্রমাণ (Vyāvahārika Pramāṇa)—যে-প্রমাণ ইন্দ্রিয়, মানসিক অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন কার্যকারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি জ্ঞানের সেই ক্ষেত্র, যার দ্বারা আমরা জগৎকে জানি, চিনে নিই এবং তার সঙ্গে ক্রিয়াশীল সম্পর্ক স্থাপন করি। এই প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সত্য কার্যকর—অর্থাৎ আমরা তার উপর নির্ভর করে কাজ করতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি, অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি। কিন্তু এটি কখনোই চূড়ান্ত নয়; এটি আপেক্ষিক, কারণ এর বৈধতা অন্য কিছুর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। যে-সত্য কেবল অভিজ্ঞতার পরিসরে টিকে থাকে এবং উচ্চতর উপলব্ধি দ্বারা লুপ্ত হয়, সেই সত্য ব্যাবহারিক। তাই জগতের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এই ব্যাবহারিক প্রমাণ যথেষ্ট, কিন্তু জগতের চূড়ান্ত বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্য নয়। জগৎ বাস্তব, কিন্তু কেবলই সেই অর্থে যে, তা অভিজ্ঞতার পর্যায়ে কার্যকর।

দ্বিতীয় স্তরটি হলো তাত্ত্বিক প্রমাণ (Tāttvika Pramāṇa)—যে-প্রমাণ চূড়ান্ত বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা আত্মার স্বরূপ। এই প্রমাণ কোনো ইন্দ্রিয় বা মানসিক অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না; এটি স্বতঃসিদ্ধ, কারণ আত্মা নিজেই নিজের প্রমাণ। আত্মার অস্তিত্ব কোনো বাহ্য উপাদান দ্বারা স্থাপিত নয়—তা স্বপ্রকাশ (svaprakāśa) এবং নিরালম্ব (nirālamba)। তাই আত্মার ক্ষেত্রে যে-প্রমাণ কার্যকর, তা জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

অদ্বৈত মতে, এই দুটি প্রমাণ একে অপরকে পরিবর্তন করতে পারে না। ব্যাবহারিক প্রমাণ কেবল আপাত-জগতের সত্যকে প্রমাণ করতে পারে, কিন্তু তা কখনোই চূড়ান্ত সত্যের প্রমাণ নয়। আবার তাত্ত্বিক প্রমাণ আত্মার স্তরে প্রযোজ্য, কিন্তু ব্যাবহারিক জগতে নয়। তাই বলা হয়—“যে-প্রমাণ আত্মার জন্য বৈধ, তা জগতের জন্য অকার্যকর।”

এই দ্বিস্তরীয় প্রমাণতত্ত্ব জগৎ ও আত্মার মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যকে প্রকাশ করে। জগৎ যতক্ষণ না আত্মজ্ঞানে বিলীন হয়, ততক্ষণ তা ব্যাবহারিক স্তরে সত্য বলে মনে হয়; কিন্তু আত্মজ্ঞান উদয় হলে দেখা যায়, তার সত্যতা আপাত মাত্র। অন্যদিকে, আত্মা কখনোই অন্য কোনো প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়—সে নিজেই প্রমাণ, নিজেই জ্ঞান, নিজেই সত্য।

ফলত, সিদ্ধান্তীর অবস্থান স্পষ্ট—জগৎ অভিজ্ঞতাগতভাবে সত্য, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে অনির্বচনীয়; আত্মা তাত্ত্বিকভাবে সত্য, এবং অন্য সব সত্যতার মানদণ্ড তার থেকেই উৎসারিত। প্রমাণের এই পার্থক্যই দেখায় যে, জগতের অস্তিত্ব আপেক্ষিক, আত্মার অস্তিত্ব স্বতঃসিদ্ধ। জগৎ “ব্যাবহারিক প্রমাণে” প্রতিষ্ঠিত, আত্মা “তাত্ত্বিক প্রমাণে”—এবং এই বিভাজনই অদ্বৈত দর্শনের সত্য-মাপক রেখা, যেখানে অভিজ্ঞতা ও পরমার্থ পৃথক দুই স্তরে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আত্মাতেই একীভূত হয়।

অদ্বৈত সিদ্ধান্তীর বিশ্লেষণ কেবল উপাধির উপস্থিতি দেখিয়েই থেমে যায় না; তিনি যুক্তিটির অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তাও প্রমাণ করতে চান, যাতে বিরোধী পক্ষ এটিকে কোনো সাধারণ তর্কভ্রান্তির দায়ে ফেলতে না পারে। তাই তিনি একে একে সেই প্রচলিত হেত্বাভাস বা কারণের ভ্রান্তিগুলিকে খণ্ডন করেন, যেগুলির সাহায্যে প্রতিপক্ষ প্রায়শই কোনো অনুমানকে দুর্বল করে দেখাতে চায়। এতে বোঝা যায় যে, বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সত্যিই উপাধি, অন্য কোনো ত্রুটি নয়।

প্রথমেই আসছে অসিদ্ধ (Asiddhaṁ)—অর্থাৎ যেখানে কারণ নিজেই প্রমাণিত নয়। সিদ্ধান্তী এই সম্ভাবনাটিকে সরাসরি অস্বীকার করেন। জগৎ যে আধার—এই হেতুটি স্বীকার্য, কারণ জগতে অংশ, গুণ, আকার ও কর্ম সবই প্রতিষ্ঠিত। আমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখি যে, পদার্থ কোনো না কোনোভাবে অন্য কিছুর আশ্রয়। তাই “আধার হওয়া” গুণটি জগতে অপ্রমাণিত নয়; বরং প্রত্যক্ষই প্রমাণ করে যে, এই কারণের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। ফলে অসিদ্ধতার অভিযোগ অপ্রযোজ্য।

পরবর্তী সম্ভাব্য ভ্রান্তি বিরুদ্ধ (Viruddhaṁ)—যেখানে কারণটি আসলে প্রমাণিতব্য বৈশিষ্ট্যের বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করে। যদি এমন কোনো উদাহরণ পাওয়া যেত, যেখানে হেতু আছে, কিন্তু সাধ্য নয়, বরং বিপরীত ফল ঘটে, তাহলে এই ত্রুটি প্রযোজ্য হতো। কিন্তু সিদ্ধান্তী দেখান যে, বিপক্ষ দৃষ্টান্তে—অর্থাৎ যেখানে চূড়ান্ত বাস্তবতা অনুপস্থিত—সেখানে হেতুও অনুপস্থিত। আত্মায় যেমন আধারত্ব ও তত্ত্বাবেদন একত্রে সত্য, তেমনি জগতে আত্মত্বের অনুপস্থিতির কারণে তত্ত্বাবেদনও অনুপস্থিত। ফলে হেতু কখনও বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না; তাই বিরুদ্ধ ভ্রান্তি এখানে খাটে না।

তৃতীয় সম্ভাবনা অনৈকান্তিক (Anaikāntika)—অর্থাৎ অ-নির্ণায়ক কারণ, যা কখনো সত্য, কখনো মিথ্যা, ফলে তার দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। সিদ্ধান্তী এটিও খণ্ডন করেন। তিনি দেখান যে, যেখানে প্রমাণিতব্য বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত (যেমন জগতে আত্মা হওয়ার গুণ নেই), সেখানে হেতুটিও অনুপস্থিত, কারণ সেই হেতু আত্মত্বের শর্তেই সত্য। সুতরাং এখানে কারণটি অনিয়মিত নয়; তা নির্দিষ্ট সীমায় স্পষ্টভাবে কাজ করে। ফলে যুক্তিটি অনৈকান্তিক নয়—বরং নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে নির্ভুল।

শেষে আসে বাধিত (Bādhitaṁ)—অর্থাৎ যে-অনুমানকে কোনো শক্তিশালী প্রমাণ, যেমন প্রত্যক্ষ জ্ঞান, বাতিল করে দেয়। সিদ্ধান্তী এক্ষেত্রেও অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, বাধা বা বোধের সংঘর্ষ তখনই ঘটে, যখন একটি শক্তিশালী প্রমাণ (যেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা) কোনো অনুমিত সত্যকে পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করে। যেমন, কেউ যদি বলে—“এই তন্তুগুলিতে বস্ত্রের পরম অনস্তিত্ব আছে”, তবে তা বাধিত, কারণ আমরা প্রত্যক্ষে দেখি যে, সেই তন্তুগুলিতেই বস্ত্র বিদ্যমান। কিন্তু অদ্বৈত বিতর্কে এইরূপ বাধা ঘটে না, কারণ এখানে জগতের ব্যাবহারিক বাস্তবতা অস্বীকার করা হচ্ছে না; অস্বীকার করা হচ্ছে কেবল তার চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় অস্তিত্ব। প্রত্যক্ষ প্রমাণ জগৎকে ব্যাবহারিক স্তরে সত্য প্রমাণ করে, আর শাস্ত্রজ প্রমাণ দেখায় যে, সেই সত্য চূড়ান্ত নয়। দুই প্রমাণ তাই পরস্পরবিরোধী নয়; বরং স্তরভেদে সমন্বিত।

এভাবে সিদ্ধান্তী একে একে চারটি সম্ভাব্য ভ্রান্তি দূর করে দেন। হেতু প্রতিষ্ঠিত, বিরোধ নেই, অনৈকান্তিকতা অনুপস্থিত, বাধাও ঘটে না। ফলে যুক্তিটি তর্কগতভাবে সম্পূর্ণ, এবং এর সমস্ত দুর্বলতা কেবল উপাধির উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই উপাধিই দেখায় যে, জগৎ সত্য বটে, কিন্তু পরম নয়; সে ব্যাবহারিকভাবে বাস্তব, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে অনির্বচনীয়। আত্মাই একমাত্র অনুপাধি সত্য—যার অস্তিত্ব কোনো প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং সমস্ত প্রমাণের উৎস ও আলো।

জগৎ বাস্তব হলেও তা সীমিত ও আপেক্ষিক; আত্মাই একমাত্র চূড়ান্ত সত্য। জগৎ ইন্দ্রিয় ও অভিজ্ঞতার স্তরে কার্যকর কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, অবিদ্যা-নির্ভর হওয়ায় জ্ঞান দ্বারা মায়িক প্রমাণিত। আত্মা স্বতঃসিদ্ধ ও চিরন্তন, নিজেই প্রমাণ ও সত্য।

বক্তা জগৎ ও আত্মাকে "আধার হওয়া" গুণের ভিত্তিতে সাদৃশ্য দেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিদ্ধান্তী দেখান যে আত্মার আধারত্ব স্বরূপগত (অনুপাধি) আর জগতের আধারত্ব উপাধিসাপেক্ষ। জগৎ অনাত্মা হওয়ায় এর আধারত্ব মৌলিক নয়, যা বক্তার যুক্তিকে ত্রুটিপূর্ণ করে তোলে।

সুতরাং, জগৎ ব্যাবহারিক সত্য হলেও চূড়ান্তভাবে তাত্ত্বিক নয়। আত্মাই একমাত্র অনুপাধি সত্য, যার উপর জগতের আপাত বাস্তবতা নির্ভরশীল। দর্শনের মূল শিক্ষা হলো—চূড়ান্ত সত্য ও অভিজ্ঞতাগত সত্য এক নয়। জগৎ মায়ার অধ্যাস, যা জ্ঞানের উদয়ে বিলীন হয়ে একমাত্র অবিকৃত সত্য ব্রহ্মকে প্রকাশ করে।