অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: আটানব্বই



দর্শনে ‘পরম পুরুষার্থ’ বলতে বোঝায় মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বা সর্বোচ্চ সাধ্য। শাস্ত্রমতে, জীবনের চারটি পুরুষার্থ আছে—ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। ধর্ম মানে ন্যায় ও কর্তব্য, অর্থ মানে জীবিকার উপায় ও সম্পদ, কাম মানে ইন্দ্রিয়সুখ ও মানসিক তৃপ্তি, আর মোক্ষ মানে মুক্তি—অবিদ্যা, দুঃখ ও জন্মমৃত্যুর বন্ধন থেকে চিরমুক্ত অবস্থা। এই চারটির মধ্যে মোক্ষই পরম পুরুষার্থ, কারণ ধর্ম, অর্থ ও কাম সীমিত ও পরিবর্তনশীল, কিন্তু মোক্ষ চিরস্থায়ী, অখণ্ড ও পরিপূর্ণ।

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়, মোক্ষ কোনো নতুন অবস্থা নয়; এটি নিজের প্রকৃত স্বরূপে প্রতিষ্ঠা—যেখানে আত্মা ও ব্রহ্ম অভিন্ন বলে প্রত্যক্ষ হয়। এই উপলব্ধিই জ্ঞান, আর সেই জ্ঞানই মুক্তি। তাই বলা হয়—“জ্ঞানে মুক্তি, জ্ঞানই পরম পুরুষার্থ”। মুক্তির অবস্থায় অবিদ্যা বিলুপ্ত হয়, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু ও ভয়ের ধারণা লুপ্ত হয়, এবং আত্মা নিজের স্বপ্রকাশ চৈতন্যে অবস্থিত থাকে।

ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রাচীন ও যুক্তিনির্ভর তত্ত্বপ্রণালী সাংখ্য। এর প্রতিষ্ঠাতা ঋষি কপিল। “সাংখ্য” মানে সংখ্যা বা বিশ্লেষণ—বাস্তবতাকে গঠিত করে, এমন মৌল উপাদানগুলির গণনাভিত্তিক ব্যাখ্যা।

সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী, সৃষ্টির মূলে রয়েছে প্রকৃতি ও পুরুষ—এই দুই মৌলিক তত্ত্ব। পুরুষ হলেন শুদ্ধ চৈতন্য, যা নিষ্ক্রিয় এবং কেবল দ্রষ্টা বা সাক্ষী। অন্যদিকে, প্রকৃতি হলো সক্রিয়, ত্রিগুণাত্মিকা (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) এবং সমস্ত সৃষ্টির মূল কারণ। এই দুইয়ের সংযোগে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হয়, যেখানে প্রকৃতি থেকেই মহৎ বা বুদ্ধি থেকে শুরু করে ইন্দ্রিয় ও পঞ্চভূত পর্যন্ত ২৪টি তত্ত্বের ক্রমবিকাশ ঘটে।

প্রথমে প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয় মহৎ বা বুদ্ধি। এটিই হলো প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ স্তর, যা জ্ঞান, স্মৃতি, সংকল্প ও সংশয়ের ভিত্তি। মহৎ থেকেই উৎপন্ন হয় অহংকার, যা 'আমি' বা 'আমার', এই বোধের জন্ম দেয়। অহংকার তিন প্রকারের হতে পারে—সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক—এবং এর উপর ভিত্তি করেই অন্যান্য তত্ত্বের বিকাশ ঘটে।

সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক—এই তিনটি হলো প্রকৃতির গুণ। গীতা বলে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতি থেকে জন্ম নিয়ে জীবকে শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখে (গীতা, ১৪.৫)।

সাত্ত্বিক মানে শুদ্ধ, শান্ত, জ্ঞানময় ও ভারসাম্যপূর্ণ। গীতায় বলা হয়েছে, সত্ত্ব নির্মল, আলোকময় এবং কলুষহীন (১৪.৬)। যার মন সাত্ত্বিক, সে সত্যবোধী, শান্ত, করুণাশীল ও সমতাস্বরূপ হয়। সাত্ত্বিক গুণ মুক্তির দিকে নিয়ে যায় এবং চেতনাকে ঊর্ধ্বে তোলে।

রাজসিক মানে চঞ্চল, আকাঙ্ক্ষাময় ও ক্রিয়াশীল। গীতায় বলা হয়েছে, রজঃ আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি থেকে উৎপন্ন; এটি চঞ্চলতা আনে এবং কর্মে আবদ্ধ করে (১৪.৭)। রাজসিক মানুষ কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে, ফলের জন্য উদ্‌বিগ্ন হয়, ইন্দ্রিয়সুখে আকৃষ্ট হয়। রজঃ মানুষকে শক্তি দেয়, কিন্তু স্থিরতা নষ্ট করে।

তামসিক মানে জড়তা, অন্ধকার, অলসতা ও অজ্ঞতা। গীতায় বলা হয়েছে, তমঃ অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়, বিভ্রান্তি ও অলসতা আনে (১৪.৮)। তামসিক মানুষ উদাসীন, অলস, বিভ্রান্ত বা হিংসাপ্রবণ হয়। তামসিক গুণ জ্ঞানের আলো ঢেকে দেয় এবং চেতনাকে নিচে নামায়।

গীতায় আরও বলা হয়েছে, সত্ত্বে স্থিত মানুষ ঊর্ধ্বগামী, রাজসিক মানুষ মধ্যবর্তী স্তরে থাকে, আর তামসিক মানুষ নিচের স্তরে গমন করে (১৪.১৮)।

সব মানুষের মধ্যেই এই তিন গুণ মিশে থাকে; যেটি বেশি প্রাধান্য পায়, সেটিই চরিত্র ও প্রবণতা নির্ধারণ করে। সাত্ত্বিকতায় জ্ঞান ও শান্তি, রাজসিকতায় ক্রিয়া ও আকাঙ্ক্ষা, তামসিকতায় জড়তা ও অন্ধকার। অদ্বৈতমতে, আত্মা বা চেতনা এই তিন গুণের ঊর্ধ্বে। গীতায় বলা হয়েছে, যখন দ্রষ্টা দেখে যে, গুণই সব কাজ করছে, আর আত্মা কেবল সাক্ষী—তখনই সে মুক্ত হয় (১৪.১৯)।

অহংকার থেকে বিকশিত হয় মন, যা জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মধ্যবর্তী সেতু হিসেবে কাজ করে। মন হলো ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির মধ্যে সংযোগকারী শক্তি। বাহ্যিক ইন্দ্রিয় যেমন চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক—এগুলো আলাদা আলাদা তথ্য আনে। এই বিচ্ছিন্ন সংবেদনগুলিকে মন একত্র করে। মন সেই তথ্যগুলিকে মিলিয়ে দেখে, তুলনা করে, গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়াকেই বলে সংকল্প–বিকল্প, অর্থাৎ মন চিন্তা করে, বিচার করে, দ্বিধা করে—“এটা হবে, এটা হবে না”, “এটা ভালো, এটা খারাপ”—ইত্যাদি সিদ্ধান্ত তৈরি করে।

তারপর মন এই সংগৃহীত ও প্রাথমিকভাবে প্রক্রিয়াজাত অভিজ্ঞতাকে বুদ্ধির কাছে পাঠায়। বুদ্ধি তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়—“এটা কী”, “এর মানে কী”, “কী করণীয়”। অতএব, মন সংবেদনগুলিকে একত্রিত করে বুদ্ধির কাছে পৌঁছে দেয়; মন হলো মধ্যস্থ শক্তি, আর বুদ্ধি হলো বিচারক।

এরপর আসে জ্ঞানেন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক) এবং কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ)। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি বাহ্যিক জগতের জ্ঞান আহরণ করে, আর কর্মেন্দ্রিয়গুলি বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করে।

এগুলো ছাড়াও, প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয় তন্মাত্রা—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এই তন্মাত্রাগুলিই হলো পঞ্চভূতের সূক্ষ্ম রূপ এবং পঞ্চভূতের উৎপত্তির কারণ। তন্মাত্রাগুলি থেকেই স্থূল পঞ্চভূত—ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ) উৎপন্ন হয়। এই পঞ্চভূতগুলিই আমাদের দৃশ্যমান জগতের সকল বস্তুর উপাদান।

এভাবে প্রকৃতি থেকে মহৎ, অহংকার, মন, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচটি তন্মাত্রা এবং পাঁচটি পঞ্চভূত—এই মোট ২৪টি তত্ত্ব উৎপন্ন হয়। এই ২৪টি তত্ত্বই সক্রিয় এবং পরিবর্তনশীল।

অন্যদিকে, পুরুষ হলেন ২৫তম তত্ত্ব, যিনি এই সমস্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার কেবল দর্শক বা সাক্ষী। তিনি নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ, নিত্য ও অপরিবর্তনীয়। পুরুষের সান্নিধ্যেই প্রকৃতির ক্রিয়াশীলতা শুরু হয়, কিন্তু পুরুষ নিজে কোনো সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন না। পুরুষ অকর্তা এবং অনাদি-অনন্ত চৈতন্যস্বরূপ।

দুঃখের কারণ হলো পুরুষের নিজের সঙ্গে প্রকৃতির মিশ্রণকে ভুলে যাওয়া। যখন জ্ঞান দ্বারা বোঝা যায়—আমি চেতনা, আমি প্রকৃতি নই—তখনই মুক্তি বা কৈবল্য ঘটে।

প্রাচীন সাংখ্যে ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই; সৃষ্টির কারণ প্রকৃতি ও পুরুষের পারস্পরিক সংযোগই যথেষ্ট। পরবর্তী “সেশ্বর সাংখ্য” ঈশ্বরকে এক বিশুদ্ধ পুরুষ হিসেবে স্বীকার করলেও মূল সাংখ্য ঈশ্বর-নিরপেক্ষ।

সেশ্বর সাংখ্য মানে ঈশ্বর-স্বীকৃত সাংখ্য দর্শন। এখানে সাংখ্যের মূল তত্ত্বগুলো অপরিবর্তিত রেখে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ভূমিকা যুক্ত করা হয়েছে।

মূল বা প্রাচীন সাংখ্য, যাকে নিরীশ্বর সাংখ্য বলা হয়, ঈশ্বরকে স্বীকার করে না। এই মতে, সৃষ্টির কারণ দুটি চিরন্তন তত্ত্ব—পুরুষ ও প্রকৃতি। পুরুষ হলো চেতনা, বহু ও নির্লিপ্ত দর্শক; প্রকৃতি হলো জড় শক্তি, যার গুণত্রয়—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। এই দুইয়ের সংযোগেই জগৎ প্রকাশিত হয়, ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই।

সেশ্বর সাংখ্য এই অবস্থান পরিবর্তন করে ঈশ্বরকে যুক্ত করে। এই মতে, ঈশ্বর আছেন—তিনি এক বিশেষ পুরুষ, যিনি অন্য সব ব্যক্তিগত পুরুষের মতো নয়। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং প্রকৃতির বিকারে আসক্ত নন। তাঁর উপস্থিতিই প্রকৃতিকে কার্যকর করে তোলে, কিন্তু তিনি নিজে কর্মফলভোগী নন।

এই মতের স্পষ্ট প্রকাশ দেখা যায় ‘যোগসূত্র’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় (সমাধিপাদ)-এর ২৪ নম্বর সূত্রে। এখানে পতঞ্জলি ঈশ্বরকে “পুরুষবিশেষ” বলেছেন—অর্থাৎ সকল ব্যক্তিগত পুরুষের মতো তিনিও চেতনা, কিন্তু পার্থক্য এই যে, তিনি কখনোই প্রকৃতির বিকার, ক্লেশ বা কর্মফল দ্বারা স্পর্শিত হন না। অন্য পুরুষেরা অবিদ্যা ও কর্মে আবদ্ধ, ঈশ্বর চিরমুক্ত। তাঁর অস্তিত্ব সেশ্বর সাংখ্যে এক অভ্রান্ত, সর্বজ্ঞ, অনাদি চৈতন্য, যা যোগীর ধ্যানের আদর্শরূপ।—“ঈশ্বরঃ পুরুষবিশেষঃ”। পতঞ্জলির যোগদর্শন মূলত সেশ্বর সাংখ্যের ধারাতেই গঠিত, কারণ তাতে সাংখ্যের তত্ত্ব কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে ঈশ্বরকে যুক্ত করা হয়েছে।

সেশ্বর সাংখ্য মানে সাংখ্য দর্শন এবং ঈশ্বরের সমন্বয়। এখানে ঈশ্বর জগতের নিয়ন্ত্রক ও অনুপ্রেরণাকারী সত্তা, কিন্তু সরাসরি সৃষ্টিকর্তা নন। নিরীশ্বর সাংখ্যে সৃষ্টি ঘটে প্রকৃতির গুণসাম্যের ভঙ্গের ফলে, আর সেশ্বর সাংখ্যে ঈশ্বর সেই প্রক্রিয়ার নির্লিপ্ত, সচেতন নায়ক।

সাংখ্য দ্বৈতবাদী—পুরুষ ও প্রকৃতি পৃথক, বাস্তববাদী—প্রকৃতির তত্ত্বসমূহ বাস্তব, মায়া নয়, এবং জ্ঞানবাদী—মুক্তির কারণ উপাসনা নয়, বিভেক-জ্ঞান। পতঞ্জলির যোগসূত্র সাংখ্য তত্ত্বের ভিত্তিতেই গঠিত।

‘বিভেক-জ্ঞান’ মানে সঠিক পার্থক্যবোধ বা বিশুদ্ধ বিচারশক্তি, যার দ্বারা মানুষ সত্য ও অসত্য, স্থায়ী ও অস্থায়ী, আত্মা ও অনাত্মার মধ্যে প্রকৃত ভেদ বুঝতে পারে।

অদ্বৈত বেদান্তে বিভেক-জ্ঞান মুক্তির প্রধান উপায়। অবিদ্যার কারণে মানুষ দেহ, মন ও আত্মাকে এক মনে করে। বিভেক-জ্ঞান এই ভুল ধারণা দূর করে জানায়—আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সেই চেতনা, যা সব কিছুর সাক্ষী। যখন এই জ্ঞান স্থির হয়ে যায়, তখনই মুক্তি ঘটে।

সাংখ্য ও যোগদর্শনে বিভেক-জ্ঞান মানে পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদ-উপলব্ধি। যখন যোগী জানে—আমি প্রকৃতির বিকার নই, আমি কেবল সাক্ষী, তখন তার বিভেক-জ্ঞান জন্মায়। এই জ্ঞানেই ক্লেশ ও দুঃখের অবসান ঘটে এবং যোগী পায় কৈবল্য, অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।

গীতায় বলা হয়েছে, বিভেক-জ্ঞান সেই বোধ, যা ঠিকভাবে জানে, কী কর্তব্য, কী অকর্তব্য, কী ভয়, কী নির্ভয়, কী বন্ধন এবং কী মুক্তি (গীতা, ১৮.৩০)।

বিভেক-জ্ঞান হলো সেই অন্তর্দৃষ্টি, যা জিনিসকে যেমন আছে তেমন দেখতে শেখায়। এটি অবিদ্যা দূর করে আত্মা ও অনাত্মার সীমারেখা স্পষ্ট করে। এই জ্ঞান স্থায়ী হলে মানুষ আর ভ্রান্ত থাকে না; তখন সে নিজেকে ব্রহ্মরূপে জানে, এবং সেখানেই মুক্তি।

সাংখ্য দর্শন মুক্তির পথ হিসেবে বিভেক-জ্ঞান বা পার্থক্য-বোধকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। সাংখ্য মতে, মানুষ দুঃখভোগ করে, কারণ সে চেতনা বা পুরুষ এবং প্রকৃতি বা জগৎকে এক মনে করে ফেলে। সে ভাবে, আমি দেহ, আমি কর্তা, আমি ভোগী, অথচ সত্য হলো—দেহ ও মন প্রকৃতির বিকার, আর আমি কেবল সচেতন সাক্ষী।

তাই সাংখ্য বলে, চেতনা ও প্রকৃতির ভেদ জানাই মুক্তির পথ। অর্থাৎ জেনে ফেলো, কী তুমি আর কী তুমি নও। যখন এই পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়, তখন আসক্তি ও ভ্রান্তি ভেঙে যায়।

“দেখো, কিন্তু জড়িয়ো না”—জগতের কার্যকলাপ ও পরিবর্তনকে দেখো, কিন্তু নিজের বলে আঁকড়ে ধরো না। তুমি সেই পরিবর্তনশীল অংশ নও, তুমি দর্শক। “জানো, কিন্তু অধিকার কোরো না”—জ্ঞানে স্থিত থেকো, কিন্তু নিজের বলে কিছু দাবি কোরো না। আত্মা কিছু করে না, কিছু পায়ও না, সে সর্বদা পূর্ণ ও স্বাধীন।

এই অবস্থায় পৌঁছালে দুঃখ আর থাকে না, কারণ দুঃখ সবসময় আসক্তি ও ভুল পরিচয় থেকে জন্মায়। যখন বোঝা যায়, আমি প্রকৃতি নই, আমি চেতনা—তখনই দুঃখের অবসান ও আত্মার স্বাধীনতা ঘটে।

অদ্বৈতের বাইরে সাংখ্যে পরম লক্ষ্য “কৈবল্যলাভ”—পুরুষ আর প্রকৃতির চূড়ান্ত বিচ্ছেদ/বৈরাগ্য। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার ৬৮তম কারিকায় কৈবল্যের লক্ষণ দেওয়া আছে—প্রকৃতির ক্রিয়া স্তিমিত হলে পুরুষ “অত্যন্ত/অবিকল কৈবল্য” প্রাপ্ত হয়; অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য-নিরালম্বতা।

‘স্বাতন্ত্র্য-নিরালম্বতা’ মানে এমন অবস্থা বা সত্তা, যা নিজের অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে না। এটি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বতঃপ্রকাশ।

‘স্বাতন্ত্র্য’ মানে স্বাধীনতা, নিজের দ্বারা থাকা। ‘নিরালম্বতা’ মানে কোনো ভর বা আশ্রয় না থাকা। তাই ‘স্বাতন্ত্র্য-নিরালম্বতা’ মানে সেই সত্য, যা নিজেই নিজের ভিত্তি, যার অস্তিত্ব বা জ্ঞান কোনো উপাদান বা কারণের ওপর নির্ভরশীল নয়।