ভামতি শাখা (Bhāmati School) এই জটিল প্রশ্নের এক ভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করে। তাঁদের মতে, পরম সত্তা বা ব্রহ্মের মধ্যে অজ্ঞানতা স্থাপন করা দার্শনিকভাবে সমস্যাসঙ্কুল, কারণ ব্রহ্ম হলো স্বপ্রকাশমান (svayam-prakāśa), সর্বজ্ঞ (sarvajña), এবং সর্বদা স্বচেতন (nitya-bodha)। এমন একটি সর্বজ্ঞ চেতনার মধ্যে অজ্ঞানতা (avidyā) অবস্থান করতে পারে—এই ধারণা নিজেই আত্মবিরোধী। এই আপাত অসংগতি দূর করার জন্য ভামতি শাখা যুক্তি দেয় যে, অবিদ্যার আধার (āśraya) ব্রহ্ম নয়, বরং জীব (jīva)—অর্থাৎ ব্যক্তিগত আত্মা।
এই ব্যাখ্যা অনুসারে, জীব অর্থাৎ ব্যক্তিগত আত্মা অবিদ্যার (অজ্ঞানতার) প্রকৃত আশ্রয় এবং বিষয় উভয়ই। এই ব্যক্তিগত অবিদ্যাকে 'তুল-অবিদ্যা' (বা 'একক জীবের অজ্ঞানতা') বলা হয়, যা জীবের মধ্যে সীমিত উপলব্ধির জন্ম দেয় এবং ব্রহ্ম সম্পর্কে তার ভুল ধারণা বা জগতের বহুত্বময় প্রতিভাসকে সত্য বলে বিশ্বাস করানোর জন্য দায়ী। এই তুল-অবিদ্যা জীবকে ব্রহ্মের অদ্বিতীয় সত্তা উপলব্ধি করতে বাধা দেয় এবং তাকে জাগতিক দুঃখ, আসক্তি ও বন্ধনের দিকে চালিত করে। এটি জীবের ব্যক্তিগত কর্মফল ও পুনর্জন্মের কারণ।
অন্যদিকে, 'মূলোপাধি' বা 'মূলাবিদ্যা' হলো সর্বজনীন স্তরের অবিদ্যা, যা মায়ার সমার্থক। মায়া ঈশ্বরের অধীন এবং তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি ব্রহ্মের শক্তি এবং ব্রহ্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। মায়ার প্রভাবে ব্রহ্ম ঈশ্বর-রূপে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের উপাদান কারণ (upādāna-kāraṇa) হিসেবে প্রকাশিত হন। মায়া বিশ্বজগতের বহুত্বময় রূপ ধারণ করলেও তা ঈশ্বরের চেতনার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ব্রহ্মের পরম সত্তাকে কখনও প্রভাবিত করে না। মায়া এক অর্থে ব্রহ্মের লীলাশক্তি, যা ব্রহ্মকে নিজের মধ্যেই বিশ্ব-রূপে প্রকাশিত করে।
সুতরাং, তুল-অবিদ্যা হলো ব্যক্তিগত স্তরের অজ্ঞানতা, যা জীবকে তার প্রকৃত স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তাকে সংসারচক্রে আবদ্ধ রাখে। এটি জীবের সীমিত জ্ঞান, ভ্রম এবং ব্যক্তিগত দুঃখের উৎস। পক্ষান্তরে, মায়া বা মূলাবিদ্যা হলো সমষ্টিগত বা মহাজাগতিক স্তরের অবিদ্যা, যা ব্রহ্মের শক্তি হিসেবে বিশ্বসৃষ্টির মূল কারণ। এটি ব্রহ্মের সর্বশক্তিমানতার প্রকাশ এবং এর দ্বারা ব্রহ্মের পরম সত্তা কখনই বিঘ্নিত হয় না। তুল-অবিদ্যা দূর হলে জীব মুক্তি লাভ করে, আর মায়া ঈশ্বরের ইচ্ছায় কার্য সম্পাদন করে এবং তাঁর সৃষ্টির অংশ হিসেবে বিদ্যমান থাকে। এই দুটি অবিদ্যার মধ্যে পার্থক্যটি জীব ও ঈশ্বরের সম্পর্ক এবং তাদের প্রতি আরোপিত অজ্ঞানতার প্রকৃতি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব, মায়া এবং অবিদ্যার মধ্যে একটি কার্যগত পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত হয়: প্রথমটি সর্বজনীন (cosmic) এবং ঈশ্বরনিয়ন্ত্রিত; দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত (individual) এবং জীব-নিয়ন্ত্রিত। মায়া ব্রহ্মকে আচ্ছন্ন করে না, বরং মহাজাগতিক নিয়ম ও কার্যকারণ সৃষ্টি করে; তুল-অবিদ্যা জীবের জ্ঞানচক্ষুকে আচ্ছন্ন করে এবং ভুল পরিচয়ের মাধ্যমে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়কে আত্মা বলে ভ্রম ঘটায়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। যদি অবিদ্যা ব্রহ্ম-কেন্দ্রিক হয়, যেমন বিবরণ ঐতিহ্য বলে, তবে সমস্যাটি মূলত অধিবিদ্যাগত (metaphysical) —অর্থাৎ, কীভাবে এক পরম অদ্বৈত সত্য থেকে বহুত্ব প্রতীয়মান হয়, সেটিই মুখ্য প্রশ্ন। কিন্তু যদি অবিদ্যা জীব-কেন্দ্রিক হয়, যেমন ভামতি ঐতিহ্য জোর দেয়, তবে সমস্যাটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক (psychological) ও জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) —অর্থাৎ, জীবের ব্যক্তিগত চেতনার ভুল আরোপ (adhyāsa) কীভাবে ঘটে, সেটিই অনুসন্ধানের কেন্দ্র।
এই পার্থক্য মুক্তির (mokṣa) ধারণাকেও সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করে। বিবরণ ঐতিহ্যে মুক্তি এক গভীর অধিবিদ্যাগত উপলব্ধি—যেখানে জ্ঞানের (vidyā) আলো মহাজাগতিক বিভ্রমের পর্দা সরিয়ে দেয়। ভামতি ঐতিহ্যে মুক্তি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও অন্তর্মুখী প্রক্রিয়া—যেখানে জীব নিজস্ব আরোপিত ভ্রান্তি (adhyāsa) ও সীমাবদ্ধতা (upādhi) ভেঙে নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করে।
শেষপর্যন্ত উভয় শাখাই একই পরম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়—দ্বৈততা (dvaita) মিথ্যা (mithyā), ব্রহ্মই একমাত্র সত্য (Brahma satyam)—তবে অবিদ্যার আধার নিয়ে এই সূক্ষ্ম মতভেদ অদ্বৈতের ভেতরের পরিশীলিত যুক্তিকৌশলকে উন্মোচন করে। এর ফলে একদিকে পরম অদ্বৈতবাদ (absolute non-dualism) বজায় থাকে, আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত দুঃখ, বিভ্রম ও আধ্যাত্মিক সাধনার বাস্তবতাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।
অদ্বৈত বেদান্ত এক সম্পূর্ণ সঙ্ঘবদ্ধ এবং স্বনির্ভর অধিবিদ্যামূলক দার্শনিক ব্যবস্থা, যেখানে সমগ্র দৃশ্যমান জগৎকে (jagat) কোনো স্বাধীন বা বাহ্যিক সৃষ্টিরূপে বিবেচনা করা হয় না। এই জগৎ কেবল পরম সত্তা—ব্রহ্ম (Brahman)-এর—উপর অবিদ্যা (Avidyā) বা আধ্যাত্মিক অজ্ঞানতার দ্বারা আরোপিত এক আপাত-প্রকাশ (vivarta)। ব্রহ্মের বাইরে অন্য কোনো সত্তার স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; কিন্তু অজ্ঞান-আবৃত চেতনা সেই একক ব্রহ্মকেই বহুরূপে প্রতীয়মান বলে মনে করে।
অবিদ্যা এখানে কোনো নেতিবাচক শূন্যতা নয়—এটি একটি সক্রিয়, অথচ অনির্বচনীয় (anirvacanīya) শক্তি, যা চেতনার প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং ভুল আরোপণের (adhyāsa) প্রক্রিয়াকে স্থায়ী রাখে। এই আরোপণই সমস্ত বিভ্রমের উৎস, যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও কর্মের সঙ্গে ভুলভাবে একীভূত করে।
অবিদ্যার এই গতিশীল কার্যপ্রণালী দুটি পরস্পর-নির্ভর শক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। প্রথমটি হলো আবরণ শক্তি (Avaraṇa Śakti)—যা ব্রহ্মের স্বপ্রকাশিত, সীমাহীন প্রকৃতিকে আড়াল করে, জ্ঞানের স্বচ্ছ আলোকে অস্পষ্ট করে তোলে। দ্বিতীয়টি হলো বিক্ষেপ শক্তি (Vikṣepa Śakti)—যা বিভ্রমমূলক বহুত্বের সৃষ্টি করে, স্থান, কাল, কারণ-কার্য এবং ব্যক্তিগত সত্তাগুলিকে (jīva) প্রক্ষেপণ করে। এই দুই শক্তি একত্রে অভিজ্ঞতামূলক বাস্তবতার পূর্ণ কাঠামো নির্মাণ করে, যেখানে ব্যক্তি এক সীমিত কর্তা (kartā) ও ভোক্তা (bhoktā) হিসেবে কাজ করে, এবং কর্ম (karma) ও পুনর্জন্ম (saṁsāra)-এর চক্র অব্যাহত থাকে।
অবিদ্যার এই সর্বজনীন দিকটি মায়া (Māyā) নামে পরিচিত, যা ঈশ্বর (Īśvara) তথা ব্রহ্মের মায়া-শর্তযুক্ত রূপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মায়া মহাজাগতিক স্তরে ক্রিয়াশীল থেকে সৃষ্টির, সংরক্ষণের এবং বিনাশের নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এটি সেই সর্বজনীন বিভ্রম, যার মাধ্যমে পরম এক ব্রহ্ম জগৎরূপে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু কখনও বাস্তব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায় না।
ব্যক্তিগত স্তরে অবিদ্যা (Avidyā) এক সূক্ষ্ম, প্রায় অচেতন বাস্তবতায় রূপ নেয়, যাকে অদ্বৈত বেদান্তে কারণ-শরীর (Kāraṇa Śarīra) বা কারণ-দেহ বলা হয়। এই কারণ-দেহই হলো ব্যক্তিগত অস্তিত্বের অদৃশ্য ভিত্তি—যে-আধারে ভবিষ্যতের সমস্ত অভিজ্ঞতা, কর্মফল (karma-phala) এবং মানসিক প্রবৃত্তির (vāsanā) বীজ সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এটি মূল অবিদ্যা (Mūla Avidyā)-র এক ব্যক্তিগত প্রতিফলন, অর্থাৎ সর্বজনীন অজ্ঞানতা (মায়া)-র এক ক্ষুদ্র, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রূপ।
কারণ-দেহ কোনো পদার্থ নয়—এটি এক অপ্রকাশিত, সম্ভাবনামূলক অবস্থা (avyakta avasthā)। এর প্রকৃতি “অসত্তা” (non-being) নয়, আবার “সত্তা” (being) ও নয়; এটি মধ্যবর্তী এক অনির্বচনীয় (anirvacanīya) স্তর, যা না পুরোপুরি বাস্তব, না পুরোপুরি অবাস্তব। এ কারণেই অদ্বৈত বেদান্ত বলে—অবিদ্যা ব্যাখ্যাহীন (anirvacanīyā)। কারণ-দেহ হলো সেই আচ্ছাদন (āvaraṇa), যা আত্মার অসীম চৈতন্যকে (Ātman) সীমিত জীব (jīva)-রূপে প্রতীয়মান করে তোলে।
এই কারণ-দেহের অবস্থা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অনুভূত হয় গভীর নিদ্রায় (suṣupti)। এই অবস্থায় ব্যক্তি কোনো স্বপ্ন দেখে না, চিন্তা করে না, অনুভব করে না, তবু “আমি কিছু জানি না”, “আমি কিছু টের পাইনি”, এমন এক অচেতন চেতনা থেকে জেগে ওঠে। সেই “না জানা”, “টের না পাওয়া”—অর্থাৎ জ্ঞানের অনুপস্থিতির অনুভূতি—কারণ-দেহের অভ্যন্তরীণ প্রকাশ। গভীর নিদ্রায় দেহ ও মন সাময়িকভাবে বিলীন হলেও অবিদ্যা তখনও অক্ষুণ্ণ থাকে; আত্মা তখনও সম্পূর্ণ স্বচেতনার জাগরণে অবস্থান করতে পারে না। তাই সুপ্তির পর ব্যক্তি আবার সেই একই দেহ-মন-চেতনার জগতে ফিরে আসে।
অবিদ্যা এখানে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। প্রথমত, এটি চেতনার উপর এক পর্দা ফেলে আত্মার স্বরূপ (svarūpa) আড়াল করে রাখে। দ্বিতীয়ত, এটি সেই আড়াল থেকে এক মিথ্যা অভিজ্ঞতার জগৎ প্রক্ষেপণ (vikṣepa) করে। এই দুই প্রক্রিয়া—আবরণ (āvaraṇa) এবং বিক্ষেপ (vikṣepa)—মিলেই কারণ-দেহের কার্যকর গঠন নির্ধারণ করে। আত্মার সহজাত অসীমতা এই আচ্ছাদনের দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ে; ফলে আত্মা নিজেকে এক ক্ষুদ্র, পৃথক ব্যক্তি হিসেবে ভুলভাবে চেনে।
কারণ-দেহের উপস্থিতিই সংসারের (saṁsāra) অবিরাম প্রবাহের মূল চাবিকাঠি। এটি কর্মফল ও মানসিক ছাপের (saṁskāra) ধারক ও বাহক, যা এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে প্রবাহিত হয়। যতক্ষণ এই কারণ-দেহ টিকে থাকে, ততক্ষণ পুনর্জন্মের সম্ভাবনা অব্যাহত থাকে, কারণ এটি সেই “অজ্ঞতার ভাণ্ডার”, যা আত্মাকে সীমিত পরিচয়ে আবদ্ধ রাখে।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, মুক্তি (mokṣa) মানে নতুন কোনো অবস্থা বা অর্জন নয়, বরং এই মূল আচ্ছাদনের সম্পূর্ণ বিলোপ। বিদ্যা (Vidyā), অর্থাৎ আত্মজ্ঞান, অবিদ্যার পর্দা ছিন্ন করে। যখন এই জ্ঞান উদয় হয়, তখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, যে-চেতনাকে সে “আমি” বলে জানে, তা আসলে ব্রহ্মেরই (Brahman) পরিপূর্ণ প্রকাশ। জ্ঞানের এই আলোতে কারণ-দেহ, তার সম্ভাবনাসমূহ এবং পুনর্জন্মের বীজ—সব একসঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।
এই অবস্থাই প্রকৃত মুক্তি—যেখানে আত্মা আর কর্তা (kartā) বা ভোক্তা (bhoktā) নয়, বরং নিছক সাক্ষী (sākṣin), নিস্পৃহ, অবিভক্ত চেতনা। এটি এমন এক জাগরণ, যেখানে অজ্ঞানতা, দেহ, মন, জগৎ—সব মিথ্যা প্রতীয়মান সত্তাগুলি নির্বাপিত হয়, এবং কেবল অবশিষ্ট থাকে সেই একক, অনাদি, অপরিবর্তনীয়, অদ্বৈত সত্তা। তখন জীব উপলব্ধি করে—“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি সেই ব্রহ্ম, যে কখনও আবদ্ধ নয়, কখনও মুক্তও নয়, কেবল অনাদি চেতনা নিজেই।
কারণ-দেহ (Kāraṇa Śarīra) অদ্বৈত বেদান্তে জীবের অস্তিত্বের সূক্ষ্মতম এবং মূল স্তর—এটি অবিদ্যা (Avidyā)-র প্রকাশ, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, কর্মফল এবং মানসিক প্রবৃত্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এটি কোনো পদার্থ নয়, বরং এক অপ্রকাশিত, সম্ভাবনামূলক স্তর (avyakta), যা আত্মাকে আবৃত করে রাখে। কারণ-দেহ হলো সেই অদৃশ্য আধার, যার মধ্যে জীবের ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতার নকশা নিহিত থাকে—এটি যেন মাটির নিচে রোপিত বীজ, যেখান থেকে কর্মফল এবং অভিজ্ঞতার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। কারণ-দেহ মূল অবিদ্যার (Mūla Avidyā) ব্যক্তিগত রূপ, যার সারবস্তু অজ্ঞানতা। মহাজাগতিক স্তরে এই একই নীতি মায়া (Māyā) নামে পরিচিত, যা ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে এটি অবিদ্যা রূপে জীবের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। কারণ-দেহ তাই আত্মার প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে রাখে, যেন সূর্যের আলো ঘন মেঘে ঢাকা।
অদ্বৈতের তত্ত্ব অনুযায়ী, কারণ-দেহ কোনো স্বাধীন বাস্তবতা নয়; এটি মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ, এর অস্তিত্ব কেবল আত্মার (Ātman) উপর নির্ভরশীল। এটি অনাদি (anādi), কারণ এর কোনো সূচনা নেই; কিন্তু এটি অনন্ত নয়, কারণ বিদ্যা (Vidyā)—আত্মজ্ঞান—উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিলুপ্ত হয়। যতক্ষণ কারণ-দেহ বিদ্যমান, ততক্ষণ সংসারের (saṁsāra) ধারা চলমান থাকে, কারণ এই দেহই পুনর্জন্মের (punarjanma) বীজ। কর্ম, ইচ্ছা ও স্মৃতির সমস্ত বীজ এখানে সঞ্চিত থাকে, এবং মৃত্যুর পর এই বীজই নতুন দেহ ধারণের কারণ হয়। কারণ-দেহ তাই সংসারের নীরব কিন্তু স্থায়ী বাহক।