বাস্তবতার ত্রিবিধ রূপরেখা (সত্য): জগতে পরিলক্ষিত আপাত অভিজ্ঞতামূলক পার্থক্যগুলির সাথে অ-দ্বৈত পরম-এর সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য, অদ্বৈত বেদান্ত বাস্তবতার তিনটি স্তর (satya) অনুমান করে। এটা মনে রাখা অপরিহার্য যে, সত্য নিজেই একবচন; এই বর্ণনাগুলি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের উপলব্ধিকে প্রতিফলিত করে।
সর্বোচ্চ স্তরটি হলো পারমার্থিক সত্যম্ (Pāramārthika Satyam) (পরম বাস্তবতা), যা বিশুদ্ধ, সর্বব্যাপী অস্তিত্ব-সচেতনতা (sat-cit বা ব্রহ্ম)-এর সাথে সংগতিপূর্ণ। এটি সেই সত্য, শাশ্বত বাস্তবতা, যা "যা (যে-কোনো সময়) কখনোই বাতিল করা যায় না" হিসাবে সংজ্ঞায়িত। এই মৌলিক বাস্তবতাকে চিত্রিত করে, এমন উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে অন্তর্নিহিত সোনার পদার্থ যা সোনার অলঙ্কারগুলির (আংটি, হার, চুড়ি) পরিবর্তনশীল নাম ও রূপ সত্ত্বেও অপরিবর্তিত থাকে, বা মাটি যা বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পাত্রের নিচে অপরিবর্তিত থাকে।
দ্বিতীয় স্তরটি হলো ব্যাবহারিক সত্যম্ (Vyāvahārika Satyam) (অভিজ্ঞতামূলক বা ব্যবহারিক বাস্তবতা), যা জাগ্রত অবস্থায় অনুভূত জাগতিক জগৎ গঠন করে। এই জগৎটি ব্যাবহারিক উদ্দেশ্যে বাস্তব বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু এটি অস্থায়ী এবং পরম বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল, অনেকটা আয়নায় একটি প্রতিচ্ছবির অস্তিত্বের জন্য মূল বস্তুর প্রয়োজন হওয়ার মতো। বাস্তবতার এই স্তরটি পরিবর্তনের অধীন কিন্তু ব্যক্তিভেদে সুসংগত থাকে।
তৃতীয় এবং সর্বনিম্ন স্তরটি হলো প্রাতিভাসিক সত্যম্ (Prātibhāsika Satyam) (বিভ্রমমূলক বা আপাত বাস্তবতা)। এই স্তরটি সবচেয়ে অবাস্তব, যার কোনো সহজাত ভিত্তি বা স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। প্রাতিভাসিক সত্যম্-এর উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে স্বপ্নের অবস্থায় অনুভূত বস্তুগুলি, অথবা কম আলোতে একটি দড়িকে সাপ বলে ভুল করার সাধারণ দৃষ্টি বিভ্রম। সাপটি সম্পূর্ণরূপে মনের মধ্যে একটি অভিক্ষেপ, বাইরের স্থানে এর কোনো বাস্তবতা নেই, যা কেবল দড়ি।
বাধ (Bādha) মানে হলো অবলোপন বা বাতিলকরণ। দর্শনে এর অর্থ: উচ্চতর সত্য যখন প্রকাশিত হয়, তখন নিম্নতর বাস্তবতা ভেঙে যায়। অদ্বৈত বেদান্তে—ব্রহ্ম উপলব্ধি হওয়ার পর জগতের মিথ্যা অবস্থাকে বাতিল (অবলোপিত) মনে করা হয়। ‘বেদান্তপরিভাষা’ গ্রন্থে বাধের সংজ্ঞা: বাধ = অবিদ্যা (অজ্ঞান) ও তার সব ফল (যেমন জগত, ভেদ, দুঃখ)—এগুলোর অবসান। যখন সত্যজ্ঞান (তত্ত্বজ্ঞান) হয়, তখন অবিদ্যা আর তার সব ফল মুছে যায়। কেবল যা আসলে বাস্তব নয়, কিন্তু বাস্তব বলে মনে হয়—তা-ই বাধ হয়। ব্রহ্ম, যেটি সত্যিকারের বাস্তব—সেটা কখনও বাধ হয় না।
বাধ আর নিবৃত্তি (Nivṛtti) দুটো আলাদা বিষয়—
ক) নিবৃত্তি: কোনো ফল ধ্বংস হলো, কিন্তু তার উপাদান-কারণ (material cause) রয়ে গেল। মাটির পাত্র ভেঙে গেল; পাত্র নেই, কিন্তু মাটি রয়ে গেছে। দড়িকে সাপ ভেবে ভুল করলেন, পরে দেখলেন দড়ি—এটা কেবল ভুল সংশোধন (অজ্ঞতা বা দড়িকে সাপ ভাববার অভ্যেস এখনও আছে)।
খ) বাধ: এখানে শুধু ভুল ধারণা ভাঙে না, ভুলের মূল কারণও (অবিদ্যা) বাতিল হয়। আলো জ্বেলে স্পষ্ট বুঝলেন এটা দড়ি, আর কখনোই সাপ বলে ভুল হবে না। এই জ্ঞান মূল অজ্ঞতাকে সরিয়ে দেয়।
বাধ তখনই ঘটে, যখন পরম সত্য (ব্রহ্ম) উপলব্ধি হয়। এতে শুধু জগতের ভুল ধারণা নয়, সেই ধারণার মূল কারণও (অবিদ্যা) মুছে যায়। এর ফলে নিশ্চিত হয়, ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু পরম সত্য নয়। বাধ মানে হলো সত্যজ্ঞান দ্বারা অবিদ্যা ও তার সমস্ত ফলের সম্পূর্ণ বাতিলকরণ। সংক্ষেপে, বাধ (Bādha) হচ্ছে, উচ্চতর সত্যের আলোতে নিম্নতর ভ্রান্ত বাস্তবতা পুরোপুরি বাতিল। নিবৃত্তি (Nivṛtti) হচ্ছে, কেবল বাহ্যিক ভুল সংশোধন, কিন্তু মূল অজ্ঞতা থাকে।
“বাধ আর নিবৃত্তি”-র পার্থক্য আরও পরিষ্কারভাবে বোঝাতে কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়ে লিখছি—
১) নিবৃত্তি (Nivṛtti): আংশিক ধ্বংস বা ভুল সংশোধন—এখানে বস্তুটা বা ধারণাটা পুরোপুরি বাতিল হয় না, শুধু তার একটি রূপ বা ফল ভেঙে যায়।
দৃষ্টান্ত ১: একটি মাটির কলস ভেঙে গেল। কলস নেই, কিন্তু মাটি রয়ে গেছে। কলসের ধ্বংস হলো, এটাই নিবৃত্তি।
দৃষ্টান্ত ২: অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পেলেন। পরে কাছে গিয়ে দেখলেন—এটা সাপ নয়, দড়ি। ভুল ভাঙল, কিন্তু অজ্ঞতার মূল কারণ (দড়িকে ঠিকমতো চিনতে না পারার অভ্যাস) থেকে গেল। এটাও নিবৃত্তি।
২) বাধ (Bādha): সম্পূর্ণ বাতিল বা অবলোপন—এখানে কেবল ভ্রম ভাঙে না, মূল অজ্ঞতাও মুছে যায়।
দৃষ্টান্ত ১: আলো জ্বালানোর পর স্পষ্ট দেখা গেল—এটা দড়িই, সাপ নয়। এবার থেকে আর কখনো দড়িকে সাপ বলে ভুল হবে না। এখানে ভ্রমও গেল, অজ্ঞতাও গেল। এটা বাধ।
দৃষ্টান্ত ২: স্বপ্নে দেখলেন—আপনি রাজা হয়েছেন। ঘুম ভাঙার পর বুঝলেন, রাজা হওয়া এবং তার সাথে যা যা, তার সবই মিথ্যা ছিল। স্বপ্নের ভ্রম পুরোপুরি অন্তর্ধান করল। এটাই বাধ।
দৃষ্টান্ত ৩ (অদ্বৈতের মূল শিক্ষা): আগে ভেবেছিলেন—আমি দেহ, আমি মন, আমি পৃথক ব্যক্তি। আত্মজ্ঞান (তত্ত্বজ্ঞান) লাভ করলে বোঝা গেল—আমি আসলে ব্রহ্ম, একক সত্য। দেহ-মনকে আত্মা ভেবে থাকা ভ্রান্তি শুধু ভাঙল না, সেই অবিদ্যা-র মূলও মুছে গেল।
সারসংক্ষেপ—নিবৃত্তি (Nivṛtti): ফল বা ভ্রম ভেঙে যায়, কিন্তু মূল কারণ থাকে। বাধ (Bādha): ফলও যায়, মূল কারণও যায়—পুরো সত্য প্রকাশিত হয়।
দড়ি-সাপ ভ্রমের উদাহরণে: নিবৃত্তি = ভ্রম ভাঙল, কিন্তু অজ্ঞতা থাকতে পারে। বাধ = আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল, আর কোনোদিন ভুল হবে না।
অদ্বৈত জ্ঞানতত্ত্ব এবং শাস্ত্রের অগ্রাধিকার:
ক. প্রত্যক্ষের পরিমার্জিত সংজ্ঞা (উপলব্ধি):
প্রমাণের বিস্তার: অদ্বৈত বেদান্তে বৈধ জ্ঞান (প্রমাণ, pramāṇa) ছয়টি পথে পাওয়া যায়: ১. প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa): সরাসরি উপলব্ধি, ২. অনুমান (Anumāna): যুক্তি বা সিদ্ধান্ত, ৩. শব্দ (Śabda): শাস্ত্র বা বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য, ৪. উপমান (Upamāna): তুলনা বা সাদৃশ্য, ৫. অর্থাপত্তি (Arthāpatti): পরিস্থিতি থেকে অনুমান (presumption), ৬. অনুপলব্ধি (Anupalabdhi): অনুপস্থিতির দ্বারা জ্ঞান। অদ্বৈতবাদীরা মনে করেন—এই সব প্রমাণ একে অপরের সাথে বিরোধ করে না; তারা মিলিতভাবে জগতকে বোঝার উপায় দেয়।
অদ্বৈতের বিশেষ অবস্থান—প্রত্যক্ষের পুনঃসংজ্ঞা: সাধারণভাবে, প্রত্যক্ষ মানে, ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগে প্রাপ্ত জ্ঞান। কিন্তু অদ্বৈত এ সংজ্ঞা মানে না। কারণ এতে অনুমান (anumiti) বা স্মৃতি (smṛti)-ও প্রত্যক্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত, যেহেতু এগুলিও মন (manas)-এর মাধ্যমে ঘটে। আরেকটি বড়ো সমস্যা হলো, যদি প্রত্যক্ষ কেবল ইন্দ্রিয়সংযোগ হয়, তাহলে ঈশ্বর বা ব্রহ্মের জ্ঞান ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ ঈশ্বর ইন্দ্রিয়-অঙ্গের বাইরে। তাই অদ্বৈত বলে—প্রত্যক্ষ মানে হলো অন্তঃকরণবৃত্তি (মন/চিত্তের রূপান্তর)-এর দ্বারা অর্জিত তাৎক্ষণিক জ্ঞান।
অন্তঃকরণবৃত্তির (Antaḥkaraṇa-vṛtti) তত্ত্ব: মন বা অন্তঃকরণকে বস্তুগত ধরা হয়। যখন ইন্দ্রিয় কোনো বস্তুতে যায় (যেমন একটি কলসি), তখন মনও বাইরে গিয়ে সেই বস্তুটিকে পরিব্যাপ্ত করে। তারপর মন সেই বস্তুর আকার ধারণ করে—একে বলে অন্তঃকরণবৃত্তি। এই বৃত্তি আত্মার আলো দ্বারা আলোকিত হয়, তখনই জ্ঞান ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি কলসি দেখলেন—মন বাইরে গিয়ে কলসির রূপ নিল। তারপর চেতনার আলোয় সেই রূপ জ্ঞান হয়ে উঠল।
প্রত্যক্ষের ধরন: অদ্বৈত প্রত্যক্ষকে আরও ভাগ করেছে—১. অনুভব (অভিজ্ঞ উপলব্ধি): সরাসরি দেখা বা জানা। ২. স্মৃতি (স্মরণ): আগের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি। এরপর আরও সূক্ষ্ম ভাগ—
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ (Nirvikalpaka): যেখানে কোনো ভেদ বা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে না। জিনিসটিকে যেমন আছে, তেমন ধরা পড়ে। দূর থেকে একটি বস্তু দেখলেন, শুধু জানলেন—“কিছু আছে”, কিন্তু এর রং, আকার, নাম—কিছুই বোঝেননি। দার্শনিক অর্থে: ব্রহ্মের উপলব্ধি, যা বৈশিষ্ট্যহীন (Nirguṇa)।
সবিকল্পক প্রত্যক্ষ (Savikalpaka): যেখানে বৈশিষ্ট্য, পার্থক্য, নাম-রূপ সব ধরা পড়ে। আগের উদাহরণে, কাছাকাছি গিয়ে বুঝলেন—ওটা একটি নীল রঙের কলসি।
অদ্বৈতের জন্য নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মুক্তির জন্য (mokṣa) ব্রহ্মকে যেমন আছে, বৈশিষ্ট্যহীন (Nirguṇa), সেইভাবে জানা দরকার। Savikalpaka আমাদের লেনদেনের জগৎ (vyavahāra) বোঝায়, কিন্তু Nirvikalpaka আমাদের পরম সত্য (paramārtha) দেখায়।
অদ্বৈত বেদান্ত প্রমাণতত্ত্বকে (epistemology) সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করে। প্রত্যক্ষ মানে কেবল চোখে দেখা নয়, বরং মন (অন্তঃকরণ) যখন বস্তু হয়ে যায় এবং চেতনার আলোতে প্রকাশিত হয়। এর দুটি স্তর: Savikalpaka—বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, ব্যবহারিক জ্ঞান। Nirvikalpaka—বৈশিষ্ট্যহীন, মুক্তিদায়ক জ্ঞান। তাই মুক্তির পথ হলো Nirvikalpaka Brahma-jñāna—বৈশিষ্ট্যহীন ব্রহ্ম-স্বরূপের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
খ. শ্রুতি-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা (আগম):
ছয় প্রমাণ ও তাদের সীমা: অদ্বৈত বেদান্ত ছয়টি প্রমাণ (pramāṇa) গ্রহণ করে—প্রত্যক্ষ (দেখা), অনুমান (যুক্তি), শব্দ (সাক্ষ্য), উপমান (তুলনা), অর্থাপত্তি (অনুমান), অনুপলব্ধি (অনুপস্থিতি)। এগুলো সবই অভিজ্ঞতার স্তরে (vyavahārika satya) জ্ঞানের উপায়। মানে—জগতের সত্যকে বোঝার জন্য এগুলো যথেষ্ট। কিন্তু চূড়ান্ত সত্য (paramārthika satya)—যা ব্রহ্ম—এগুলো দিয়ে ধরা যায় না।
কেন শ্রুতিকে (Śruti) অগ্রাধিকার? ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গোচর নয়, কারণ ব্রহ্ম পরিবর্তনশীল নয়, বিভাজ্য নয়, রূপহীন। ইন্দ্রিয় কেবল পার্থক্য, গুণ, পরিবর্তন—এই সব কিছু উপলব্ধি করতে পারে। তাই ব্রহ্মকে ইন্দ্রিয় (প্রত্যক্ষ) দিয়ে পাওয়া যায় না। উপনিষদের বাক্যই একমাত্র পথ। যেমন “তত্ত্বমসি” (Tat Tvam Asi)—“তুমিই সেই”। এর মানে—তুমি নিজেকে যে-ব্যক্তি বলে ভাবছ (জীব), তার প্রকৃত স্বরূপ আসলে ব্রহ্ম। এই বাক্যগুলো আমাদের অজ্ঞতা (avidyā) ভাঙার জন্য, বাস্তব সত্য উপলব্ধির জন্য।
আত্মজ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া: শাস্ত্র শুধু ব্রহ্ম বলে দেয়—“তুমি ব্রহ্ম।” কিন্তু শাস্ত্র শোনার পরও মানসিক অভ্যাস, অজ্ঞতা ভাঙতে হয়। এজন্য দরকার আত্মা-অনাত্মা-বিবেক (ātma-anātma viveka)—আমি দেহ নই, মন নই, বুদ্ধি নই; আমি চিরন্তন আত্মা। এই বিবেকের মাধ্যমে শাস্ত্রের বাণী কার্যকর হয়, অজ্ঞতা ভাঙে।
দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝা যাক।
আয়না ও মুখের দৃষ্টান্ত: নিজের মুখ সরাসরি দেখা যায় না। আয়না দরকার। শাস্ত্র হলো সেই আয়না, যা বলে দেয়—“এই তুমি।”
দড়ি-সাপ দৃষ্টান্ত: অন্ধকারে দড়িকে সাপ ভেবে ভুল করলাম। চোখ দিয়ে বার বার দেখা সম্ভব, কিন্তু ভুল কাটছে না। কারও কথা শুনলাম—“এটা সাপ নয়, দড়ি।” তখন সত্য ধরা পড়ল। শ্রুতি সেই "কথা শোনানো ব্যক্তি"—যার মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হয়।
অল্পকথায় বললে, ছয় প্রমাণ জগতের (ব্যাবহারিক সত্য) জন্য যথেষ্ট। কিন্তু চূড়ান্ত সত্য (ব্রহ্ম) ইন্দ্রিয় ও যুক্তির বাইরে। তাই শ্রুতি (উপনিষদ)-ই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। “তত্ত্বমসি”-র মতো মহাবাক্য আমাদের অজ্ঞতা ভেঙে আত্ম-জ্ঞান দেয়। আত্ম-অনাত্মা-বিবেক সাধনা সেই জ্ঞানকে স্থায়ী করে, মুক্তির পথে নিয়ে যায়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ: অন্যান্য ধারার সাথে অদ্বৈত বেদান্তের সম্পর্ক
ক. ভেদাভেদ ও দ্বৈতবাদ থেকে পার্থক্য
অদ্বৈত বেদান্ত বলে, কেবল ব্রহ্মই সত্য। জগৎ (যা আমরা দেখি-শুনি-ছুঁই) চূড়ান্ত অর্থে সত্য নয়, বরং মিথ্যা (mithyā)—না একেবারে বাস্তব, না একেবারে অবাস্তব। যেমন স্বপ্নের অভিজ্ঞতা: স্বপ্নে সব কিছু বাস্তব মনে হয়, কিন্তু ঘুম ভাঙলে বুঝি, এগুলো স্থায়ী সত্য ছিল না।
ভেদাভেদ বেদান্ত (যেমন ভল্লভ বা নিম্বরক প্রবর্তিত) বলে, জগৎ বিভ্রম নয়, বরং বাস্তব। ব্রহ্ম বাস্তব + জগৎও বাস্তব, তবে জগৎ সর্বদা ব্রহ্মের ওপর নির্ভরশীল। যেমন সূর্য আর রশ্মি—সূর্য ছাড়া রশ্মি নেই, তবুও রশ্মি অস্বীকার করা যায় না।
অনির্বচনীয়তা (অদ্বৈতের ধারণা): অদ্বৈত বলে, জগৎকে পুরোপুরি “সত্য” বলা যায় না, আবার একেবারে “মিথ্যা”ও বলা যায় না। এই অবস্থাকে বলা হয় অনির্বচনীয় (anirvacanīya)—অর্থাৎ ভাষায় সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় না। যেমন, দড়িকে ভুল করে সাপ মনে করা। দড়ি আছে (সত্য)। সাপ নেই (অসত্য)। কিন্তু “সাপ-দেখা’র অভিজ্ঞতা” মিথ্যা—না পুরোপুরি সত্য, না পুরোপুরি মিথ্যা। ঠিক এভাবেই জগৎও অদ্বৈতের মতে “মায়িক সত্য”—অন্তিম সত্যে নেই, তবে অভিজ্ঞতায় আছে।