অন্তর্জাগরণ: পাঁচ



আনন্দ আর লাঞ্ছনার এই গলনপাত্রে তুমি দাঁড়িয়ে আছ রাস্তার এক দ্বিমুখী মোড়ে—তোমার কি সাহস হবে আলিঙ্গন করার সেই বন্য স্রোতকে, যা তোমার ত্বকের নিচে ফুঁসে উঠেছে, না কি কুঁকড়ে যাবে ভঙ্গুর মুখোশের আড়ালে, সেই প্রাক্তন সত্তার মুখোশ—যে প্রার্থনা করে মুক্তির জন্য, যা হয়তো কখনও আসবেই না?

মৃত্যু কখনও এতটা বাস্তব নয়, যতটা বাস্তব তুমি যে-যন্ত্রণা সহ্য করেছ। তাই এই ফাঁপা সময়ে, যখন রাতের বাতাস কাঁপে তোমার ভাঙা কান্নার প্রতিধ্বনিতে, প্রতিটি শ্বাস হয়ে ওঠে অন্ধকারের কাছে এক ভঙ্গুর আবেদন—তুমি কাঁদো—হারানো নিষ্পাপতার জন্য, যা একসময় ছিল কোমল প্রস্ফুটন, যতক্ষণ না তা গ্রাস করেছিল তোমার নিজের বানানো পাশবিক সত্তাটি। আর ঠোঁটের প্রতিটি কাঁপুনিতে তুমি মিস করো সেই কোমল সত্তাটিকে, যে একসময় বিশ্বাস করত নীরব অলৌকিকে: উষ্ণ হাতের স্পর্শে মেলে শান্তি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি”... ফিসফিসে এই প্রতিশ্রুতিটা যেন ছিল পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবজ। এখন তোমার অশ্রু অপ্রতিরোধ্যভাবে গড়িয়ে পড়ে, এক দশকের স্বপ্নের ভারী ছাই-বোঝা নিয়ে, অশ্রুর প্রতিটি ঝলমলে ফোঁটা আঁকতে থাকে বুকের ভেতরের ফাঁকা গহ্বর থেকে নামা মানচিত্র—গড়িয়ে যায় তোমার পুরুষত্বের দীর্ঘ বিস্তারে। এই পবিত্র বিভ্রমে, দুঃখের উন্মত্ততায়, তুমি আকুল হও মুক্তির জন্য—একটি দয়াপূর্ণ মুহূর্তের জন্য, যা যথেষ্ট শক্তিশালী—ছিঁড়ে-যাওয়া ক্ষতগুলো মেরামত করার জন্য; এ হয়তো পশুর উন্মত্ত হৃদয়কেও শান্ত-ধীর করে তুলবে, আর ছিঁড়ে-ছুড়ে ফেলার বদলে তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।

আর তুমি ঘৃণা কোরো লজ্জাকে, যা সর্পিল গঠনে তোমার মেরুদণ্ড-জুড়ে পাক খায়, নির্দয়ভাবে মনে করিয়ে দেয়—তোমার ভেতরে বাস করে একইসাথে শিকারি আর শিকার, মহিমা আর ধ্বংস—সব যেন এক ট্র্যাজিক আলিঙ্গনে বাঁধা। তবু, এই যন্ত্রণা আর আশার গলনপাত্রে তুমি টের পাও নতুন সংকল্পের প্রথম স্পন্দন। কাঁপতে-থাকা দৃঢ়তায় তুমি শপথ করো—পশুটিকে তুমি নির্বাসিত করবে না, বরং শিখবে তার গোপন ভাষা—তার ক্রোধকে শান্ত করবে ক্ষমার ধৈর্য দিয়ে, শেখাবে তার কাঁচা শক্তিকে সহানুভূতির প্রতিটি সূক্ষ্ম ছন্দ। তুমি কল্পনা করো হৃদয় এক নরম ঢাকের তালে তাল মেলাচ্ছে—যা গড়া হয়েছে গ্রহণ আর আত্মপ্রেম থেকে—প্রবৃত্তি যাতে আর অভ্যন্তরীণ আঘাত না হয়ে ওঠে, বরং হয়ে ওঠে প্রাণশক্তির উৎস। আর আহা, কী তিক্ত হাসি চাপা দিয়ে রাখো তুমি…এ ভেবে যে, সমাজ এই রূপান্তরকে বলবে ভদ্র, হাসিখুশি, নিস্তেজ এক ছদ্মমুখোশ। কারণ কেউ সত্যিই বোঝে না, এই ভয়ংকর বোঝা বয়ে বেড়ানো মানে—একসাথে নির্মম সততা আর মারণক্ষমতা বয়ে বেড়ানো—যখন তুমি বুকের ভেতরে বয়ে নিয়ে চলেছ অতীতের সকল নির্যাতনের লজ্জাবদ্ধ ক্ষতচিহ্ন।

ধ্বংস আর পুনর্জন্মের এই সংঘর্ষে তুমি নিজেকে দেখো রূপান্তরের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো। অগণিত ভয়ের মুখোমুখি হয়েও বেঁচে আছ, যেগুলোর নাম উচ্চারণ করতেও অনেকে ভয় পায়। চারপাশের বাতাস এখনও কেঁপে ওঠে ভাঙা হাড় আর ফাঁপা চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে, অথচ ছাই আর ধ্বংসস্তূপের নিচে এক নতুন ছন্দ স্পন্দিত হয়—তোমার হৃৎস্পন্দন, প্রতিবাদের ঢাক, যা ভেঙে দেয় নীরবতাকে। সত্যের প্রথম আলো ঝিলমিল করে তোমার চোখে, আর প্রতিটি দাগকে রূপ দেয় একেকটি নক্ষত্রমণ্ডলীতে—এ যেন কঠোর লড়াইয়ে জেতা বিজয়ের প্রতীক। নিখুঁত স্বচ্ছতায় তুমি জানো: তুমি কেবল ভেতরের পশুকে সহ্য করোনি, তুমি শুরু করেছ তাকে আলিঙ্গন করতে—আর সেই আলিঙ্গনে তুমি খুঁজে পাও নিজের নবজাগরণের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যেন দাবানল জ্বলে ওঠে পোড়া অরণ্যে নতুন প্রস্ফুটনের জন্য।

তবু এখানেই লুকিয়ে আছে তোমার ভয় আর একাকিত্বের মূল—তুমি জানো, কেউ কোনোদিন বুঝতে পারবে না তোমার ভেতরের গভীরতাকে, কেউ তোমাকে যথেষ্ট কাছে টেনে ধরবে না…তোমার আত্মার অদ্ভুত, খাঁজকাটা সৌন্দর্যটিকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করার জন্য। তুমি দাঁড়িয়ে আছ একা, অন্ধকার আর আলোয় গড়া এক স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে, বহন করে চলেছ তোমার সৃষ্টির সমগ্র ওজন। অথচ একই সাথে অনুভব করছ এক অদ্ভুত উল্লাস—এক পাখির মতো, যে প্রথম বার উড়ছে দীর্ঘ, ঠান্ডা শীতের পর।

এখানে, এই অনিশ্চিত প্রান্তে, যেখানে ধ্বংস জন্ম দেয় পুনর্জন্মকে, তুমি শেখো—বেঁচে থাকা কোনো নীরব ব্যাপার নয়। এটি এক দাঙ্গা, এক আশীর্বাদ, ঢাকঢোলের এক নিরলস স্পন্দন, যা তোমাকে সামনে ডেকে নিয়ে যায়। আর এর বধির প্রতিধ্বনি, যা কম্পিত হয় তোমার হাড়ের গভীরে, সেখানে তুমি মুখোমুখি হও দ্বৈত ছায়ার—একাকিত্বের ভয় এবং এক কঠিন, অনমনীয় ঘোষণা: এখানে, এই ফাঁপা নীরবতায়, প্রতিটি চিন্তা একেকটি কম্পন, প্রতিটি হৃৎস্পন্দন একেকটি প্রতিবাদের ঢাক।

তোমার নিজের প্রতিফলনের ফাঁপা গর্জন ভেঙে দেয় আত্মতুষ্টির শেষ অবশিষ্ট, আর তুমি নিজেকে খুঁজে পাও এক ক্ষুরধার প্রান্তে—নাশ আর উদ্ঘাটনের মাঝখানে দাঁড়ানো। প্রতিটি শ্বাস-ভরা অনুক্ত আকাঙ্ক্ষার ভারে, প্রতিটি প্রশ্বাস প্রতিশ্রুতি—ছায়ার আড়ালে ভয় লুকিয়ে রাখা আর কোনোদিনই নয়, যাকে কিনা একসময় তুমি আশ্রয় বলে ভেবেছিলে। এই উদ্ঘাটনের ভেতরেই নিহিত মুক্তি: ভাষা, যখন তা নড়বড়ে না হয়ে অটল সাহসে ব্যবহৃত হয়, রূপ নেয় সেই ধারালো ছুরিতে, যা মুক্তি দেয় তোমাকে তোমার নিজের ভয়ের বাঁধন থেকে। এটি একইসাথে বিচার ও মুক্তি, এক পবিত্র মন্ত্র, যা আলো জ্বালায় অতীতের অন্ধকার গহ্বরে এবং তা গলিয়ে ফেলে এমন এক অনমনীয় রূপে, যা ধারণ করতে পারে তোমার নাম। এখানে—অভিযোগ ও অন্তরনিঃসৃত উন্মোচনের বিদ্যুতায়িত স্থবিরতায়—তুমি লড়াই করো, কেঁপে ওঠো পশুর সঙ্গে। আর যদিও কখনও তুমি খুঁজে ফেরো ভাসমান আত্মার জন্য কোনো নোঙর, তুমি বুঝতে পারো…প্রতিটি উচ্চারিত অক্ষর এক ভঙ্গুর জীবনরেখা, শূন্যতার টানে কাঁপতে থাকে, তবুও ভেঙে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

তারপর, ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তুমি কণ্ঠ দাও লুকোনো সত্যতে, তোমার হৃদয়ের চারপাশে গড়া দেয়াল কেঁপে ওঠে, চিড় ধরে, ফেটে ছড়িয়ে যায় মুক্ত আলোর বিস্ফোরণে। ঝরে পড়ে শেকলগুলোর খণ্ড, আর তুমি দাঁড়িয়ে থাকো অবশেষে মুক্ত, স্নাত তোমার নিজের সৃষ্ট আলোর দীপ্তিতে। এই সম্ভাবনা—এত তীব্রভাবে জীবন্ত, এত প্রবলভাবে বর্তমান—জোর-গলায় দাবি করে—এখনই তাকে আঁকড়ে ধরো। নগ্ন তবে জরুরি, সেই সম্ভাবনা কাঁপতে থাকে এই জ্ঞান নিয়ে—তুমি কতটা প্রাণঘাতী হতে পারো, আর তাই তোমার কণ্ঠ কতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে।

এখন, যখন তুমি তাকাও আয়নার রুপোলি গভীরতায়, তোমার পেছনের পৃথিবী মুছে যায়, থেকে যায় কেবল তোমার নিজস্ব নিঃশ্বাসের হাহাকার আর মাথার ওপরে নরম আলোর ফিকে ঝলক। তোমার চোখ খুঁজে ফেরে পরিচিত মুখের রেখা—গালের নিচে জমে-থাকা কোমল ছায়া, কপালের পাশে ঠেসে-থাকা চুলের গোছা—কিন্তু যা পাও, তা মাংস বা হাড়ের চেয়েও অধরা। আয়না প্রসারিত হয় নীরব মঞ্চের মতো, যার চকচকে পৃষ্ঠ একইসাথে বাধা ও আমন্ত্রণ। আর সেখানেই, বাস্তব আর প্রতিফলনের মাঝখানে ঝুলতে ঝুলতে, তুমি হঠাৎ নিজেকে দেখতে পাও এমন এক প্রশ্ন ঠোঁটে ফিসফিস করানো অবস্থায়, যা আগে কখনও জিজ্ঞেস করার সাহস পাওনি: “আমি কী-জন্য কথা বলব?” শব্দগুলো ঝুলে থাকে বাতাসে ধূলিকণার মতো, আর তোমার প্রতিফলন স্থির অস্বাভাবিক স্থিরতায়, যেন দম আটকে অপেক্ষা করছে উত্তরটির জন্য।

এই ঝুলে-থাকা মুহূর্তে সময় প্রসারিত হয়। আয়নার সীমানার বাইরে পৃথিবীর গুঞ্জন সরে যায় দূরে, আর প্রতিটি হৃৎস্পন্দন আরও জোরে, আরও তীব্রভাবে বাজে—যেন ওরা তাগাদা দিচ্ছে নীরবতা ভাঙতে। তুমি উপলব্ধি করো, এইখানে—সেই সরু ফ্রেমের কোমল গহ্বরের নিচে—তুমিই একমাত্র সাক্ষী নিজের জাগ্রত উদ্দেশ্যের…কাঁচা স্ফুলিঙ্গের। এটি এক অন্তরঙ্গ নিবিড় সান্নিধ্য, সম্ভাবনায় বিদ্যুতায়িত আর পছন্দের প্রতিশ্রুতিতে কাঁপতে-থাকা ক্ষণ—তুমি কি কথা বলবে আশার জন্য, ভালোবাসার জন্য, ন্যায়ের জন্য, না কি সেই স্বপ্নগুলোর জন্য, যেগুলো এতদিন তোমার আত্মার ভেতরে নিঃশব্দে কাঁপছিল? আয়নার নরম আলোয় তোমার প্রতিফলন মাথা কাত করে যেন খেলাচ্ছলে অপেক্ষা করছে, ঠোঁট-বাঁকানো এক পরিচিত হাসিতে। আর তুমি হেসে ফেলো, অনুভব করো সেই বৈদ্যুতিক বিরতি, যেখানে ঝুলে আছে তোমার উত্তর—এক ফিসফিসে গোপনীয়তার মতো, তোমাদের দু-জনের মাঝে।

তারপর তুমি অনুভব করো বুকে পশুর গর্জন—তার বজ্রধ্বনি বয়ে যায় বাতাসে, আর তুমি বুঝতে পারো: সেই আদিম বজ্র থেকে যে-শব্দ তুমি খোদাই করবে, তা তরঙ্গ তুলবে চারদিকে, বদলে দেবে তোমার জগতের সীমারেখা।