অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান (৫)



জ্যৈষ্ঠের সাতাশ। আজ আমাদের পরিবারের বড়ো আনন্দের দিন, একটা নতুন অভিজ্ঞতার সূচনালগ্ন! আর মাত্র দু-দিন পর বড়ো আপার বিয়ে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত, চারদিকে শুধুই তাড়া! মনে হচ্ছে যেন ছোটোখাটো একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি! ভাবছেন, বিয়ের মতো একটা শুভকাজকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করলাম কীভাবে! জীবনটা যদি হয় বেঁচে থাকার এক যুদ্ধক্ষেত্র, তাহলে বিয়ে এর পূর্বপ্রস্তুতি নয় কেন?

এটা ছাড়া বিয়ের আর কোনো অর্থ আমার জানা ছিল না! অবশ্য বিয়ের অর্থ বোঝার জন্য তখনও আমি যথেষ্ট অপরিপক্ব ছিলাম। আপাতত বিয়ের ব্যবচ্ছেদ না করে মূল অংশে আসা যাক!

জ্যৈষ্ঠের ছাব্বিশে বড়ো আপার হলুদসন্ধ্যা হয়। আমাদের বাসার ছাদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ছোটো আপা, আমি আর দুই মামা—আমরা এই কয়েক জন মিলে ছাদ সাজিয়েছিলাম। কনে বসার মঞ্চটা জরি আর সিল্কের রঙিন ঝালর, তার সাথে লাল, হলুদ, সাদা এই তিন ধরনের গোলাপ, আপার পছন্দের কাশ্মীরি গাঁদা, কাঁঠালচাঁপা, রেইনলিলি আর কুঞ্জলতা দিয়ে সাজালাম। ও আচ্ছা, ‘সাভেরার হলুদসন্ধ্যা’ কথাটা লিখেছিলাম জলগোলাপ, পার্পলহার্ট আর কাঁটামুকুট ফুল একসাথে গেঁথে। ছোটো ছোটো ড্রিমলাইট আর হার্টশেইপ বেলুন দিয়ে বাকি চারপাশটা সাজিয়ে নিলাম। সেদিন আকাশে চিতইপিঠের মতো চাঁদ উঠেছিল, আমি গান ধরেছিলাম, সেই বিখ্যাত গান!
চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে?
কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে?
চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে?
কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে?
তাহারে চিনি না আমি, সে আমারে চেনে
চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে?
কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে?

সেদিন বড়ো আপা লালপেড়ে হলুদশাড়ি পরেছিল। মাথায় ত্রিকোণ ফুলের মালা দিয়ে সেজেছিল, তবে খোঁপায় আপার প্রিয় কামিনী পরেছিল। আপা সত্যিই অনেক সেজেছে। অনেক সুন্দর লাগছিল দেখতে। হঠাৎ করেই কেমন যেন নারী হয়ে উঠেছে সে! ছোটো আপাও শাড়ি পরেছিল, কিন্তু ওকে ছোটো আপাই লাগছিল! সারাবাড়িতে মৌমাছির ঝাঁকের মতন মানুষ! টুইনওয়ানে একটার পর আরেকটা গান বাজছে, কিন্তু আমার কাছে শুধুই কোলাহল ঠেকছিল সব কিছু! রাত দেড়টা বেজে গিয়েছিল আপার হলুদসন্ধ্যা শেষ হতে! কেন যে সবাই একে হলুদসন্ধ্যা বলে!

আপার হলুদ ঘরোয়াভাবেই করা হয়েছে, বাইরের কাউকে ডাকা হয়নি; কিন্তু বিয়েতে প্রচুর মানুষকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের তিন ভাই-বোনের বন্ধুবান্ধব তো আছেই। কিন্তু কমলিকা? ওকে তো নিমন্ত্রণপত্র পাঠালাম না! কিন্তু পাঠাবই-বা কেন? ও কি আমার বন্ধু? না প্রেমিকা? না কি শুধুই পরিচিত? ওর সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক? ও কে হয় আমার? কেউই তো না! নামহীন সম্পর্কের জন্য তো খামবিহীন পত্র লাগে শুনেছি। আমার কাছে তো শুধুই মোড়ক পড়ে আছে কতগুলো। খোলসে পুরে অমন নীরস পত্র সরস মানুষটার কাছে কী করেই-বা পাঠাতাম! তাই এসব চিন্তাভাবনায় যবনিকা টেনে আগামীদিনের আয়োজনে লেগে পড়লাম।

আমরা প্রায় সাড়ে তিনটা অবধি কাজ করলাম সবাই। ঘুমিয়েছিলাম মোটে তিন ঘণ্টা। সকাল সাতটা থেকেই বাড়িতে অতিথি আসা শুরু হলো। মা এর আগেই উঠে সবার জন্য চা করলেন, বাবা গলির সামনের দোকান থেকে পরোটা কিনে আনলেন। কোনোমতে গোগ্রাসে গিলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নিজ নিজ কাজে। আমি আর মামা বাজারে গেলাম আরও কিছু কেনাকাটা করতে। বাসার পেছন দিকে অল্প কিছু খালি জায়গা ছিল, সেখানে গর্ত করে রান্নার জন্য অস্থায়ী চুলো প্রস্তুত করা হলো। বার্বুচিরা এসে রান্না শুরু করে দিলেন। আর ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে বর‍যাত্রীদের খাবারের জন্য ব্যবস্থা করা হলো। বাড়ির প্রবেশপথ সুন্দর করে সাজানো হলো। ওখানে আবার রঙিন ফিতে বাঁধা হলো। ছোটো আপা তার বান্ধবীদের নিয়ে প্রস্তুত বরযাত্রীদের পথ আগলে দাঁড়ানোর জন্য। সবাইকে ভীষণ আনন্দিত মনে হচ্ছিল—পুরো বিষয়টা যদিও আমার অনুভূতির বাইরে ছিল। নানা নিয়মকানুন পালনের মধ্য দিয়ে বড়ো আপার বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বড়ো আপা চলে যাবার পর আমি আর ছোটো আপা আরও কাছাকাছি এলাম, ছোটো আপা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। খুব যত্ন নিত, পজিটিভ হতে শেখাত। ছোটো আপাকে কখনও চাপ নিতে দেখিনি, কখনও মনেই হয়নি, তার আদৌ কোনো দুর্বলতা আছে! একেবারে স্বচ্ছ, তবে যথেষ্ট রহস্যময়ী। এতটা নির্ভেজাল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আপা আমাকেও তার মতো করে গড়তে চাইত। নানুর পরে আমার এতটা যত্ন আর কেউ নেয়নি।

…একটু ভুল বললাম, আমার মা আমাকে যথেষ্ট সময় আর ভালোবাসা দিয়েছেন। তবে মায়ের ভালোবাসা বুঝতে হলে দিব্যজ্ঞান থাকতে হবে! আগে একটা কাজ আমি সবসময় করতাম, সেটা হচ্ছে, বাইরে থেকে এসেই আগে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতাম, মায়ের আদর খেতাম। বেশিরভাগ সময় মাকে রান্নাঘরেই পেতাম, ঘেমে একসার হয়ে থাকতেন। তবুও মায়ের গন্ধ নিতে, জড়িয়ে ধরতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। প্রায়ই ছোটো আপা হাসাহাসি করত আর বলত, এত বড়ো পটকা হয়েছিস তুই, এখনও এই স্বভাব গেল না! শুনেছি, যে নয় বছরে ঠিক হয় না, সে নাকি নব্বই বছরেও হয় না। তোকে আমি এখন থেকে বড়ো পটকা নামেই ডাকব ভাবছি।

ছোটো আপার ভার্সিটির পার্ট প্রায় চুকে আসছিল, তখন আমার ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পালা। এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম দশ জনের একজন হয়ে প্রথম ধাপ এগোলাম।

সবাই ভীষণ খুশি আমাকে নিয়ে! যাকে পাচ্ছে, তাকেই আমার সাফল্যের লিফলেট বিলোচ্ছে সবাই মিলে।

ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ছোটো আপা সব রকমের সাহায্য করেছে, মা আর ছোটো আপা পালা করে রাত জাগতেন যেন আমার কোনো সমস্যা না হয় না। আল্লাহ মাথাটা ভালোই দিয়েছেন, তাই খুব বেশি আদাজল খেতে হয়নি আমাকে। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর ভর্তি পরীক্ষার দিন চলে এল। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি সাতাশতম হই, সাবজেক্ট এসেছিল পদার্থবিদ্যা। আর জাহাঙ্গীরনগরে হই সপ্তম, সাবজেক্ট রসায়ন।

জাহাঙ্গীরনগরের ফল নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। যেদিন রেজাল্ট বেরিয়েছিল, সেদিন সকাল সকাল ক্যাম্পাসে গিয়ে হাজির হলাম। সবগুলো রেজাল্টবোর্ড খুঁজে কোথাও আমার রোলনম্বর দেখতে পাইনি। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম, আমার সরু পা-দুটো লোহার মতো ভারী মনে হচ্ছিল, নাড়াতে পারছিলাম না। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সিঁড়িতে অসহায়ের মতো বসে পড়লাম। একে একে আমার বিগত সব অপমানের কথা মনে পড়তে লাগল—পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত। সেইসব ঘা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, যেগুলো এখনও বেশ টাটকা। নিজের জীবনের জন্য খুব মায়া লাগছিল। মাথায় চরকির মতো পাক খেয়ে উঠল এক অনাকাঙ্ক্ষিতের ঝুলিভর্তি দুঃখগাথা।

আহারে, আমার জীবন!
তোর জন্য বড্ড মায়া হয়, নির্মম বাস্তবতার দুনিয়াতে তুই কেবল কল্পনা করতেই শিখেছিস।
কল্পনাই তোর আশ্রয়, তাই না রে…তোর বিস্তীর্ণ মাঠ, যেখানে তুই সন্ধে অবধি দৌড়ে বেড়াস!
জবাফুলের মতো চোখ পাকিয়ে কেউ বলে না তোকে…সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরিস!
কল্পনায় তোর সব স্বাধীনতা আর বিশুদ্ধ বাতাস, যেখানে তোকে মেপে মেপে শ্বাস নিতে হয় না।
আমি সব বুঝি রে!

মনে আছে? ওরা বলেছিল, তোর জন্যই বাইরে কেউ মুখ দেখাতে পারে না।
শুধু তোর জন্য তোর দুটি ভাই-বোনের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়েছে।
ওরা বলেছিল, ওদের সমস্ত টাকা ফেলছে জলে…একটা গাধার পেছনে ঢেলে।
এই সমাজ তোর গলা চেপে ধরেছিল, একটুখানি কাঁচা মাংস নখের ডগায় উঠে এসেছিল সেদিন। ক্ষতটা কতদিন ছিল, মনে আছে তোর?
আহারে, আমার জীবন! তুই ক্ষয়ে ক্ষয়ে বেঁচে রইলি মোমের মতন।

তোর কাছের মানুষগুলো বলেছিল, বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছিস, তবুও তুই ভাত গিলেছিস কাঙালের মতন।
আহারে, আমার জীবন, তুই জন্মাতে গেলি কেন? বলি, তোর কোনো লজ্জা নেই?
এই তো বছরদুয়েক আগে, তোর সব থেকে ভালোবাসার মানুষটা তোকে জীবন থেকে মুছে ফেলেছে, ভুলে গেলি কী করে?
কেন আবারও তাঁর স্মৃতিগুলো গর্ত থেকে টেনে বের করতে চাস? এতটা ভালোবাসার আকাল পড়েছে তোর?
আহারে, আমার জীবন!

তোর বন্ধুরা তোকে অপমান করে ফেলে দিয়েছিল অকৃতকার্যদের ভিড়ে, কারণ তোর যে দামি কোনো পরিচয়ই নেই!
তোকে অভিশাপ দিয়েছে কত-শত পবিত্র আত্মা!
ওরা বলেছে, তুই নোংরা, নোংরা তোর শরীর, নোংরা তোর ছায়া।
অথচ তুই . . .
তুই শুধু প্রমাণ করতে বেরিয়েছিলি, এটা তোর জীবন।
আহারে, আমার জীবন!

মনে হচ্ছিল, সবকটা শব্দ চোখের জলেই যেন অদৃশ্যপটে লিখে ফেলছিল আমার এযাবতকালের অর্জনের স্বীকারোক্তি।

ক্ষণকাল পর একটা মাইকের জোরালো শব্দে আমার টনক নড়ল। একটা ঘোষণা এল অফিস থেকে…প্রথম দশ জনের ফল ডিন অফিসের বোর্ডে টাঙানো হলো। আমি সেখানে থাকব, এমন ভয়ংকর দুঃসাহসী চিন্তা করার সাহসও আমার ছিল না। ঠিক কতক্ষণ বসে ছিলাম ওভাবে, জানি না। একসময় মনে হলো, আমি ভালো পড়াশোনা করেছি, আমি ফাঁকি দিইনি, আমি আড্ডা দিইনি, আমি প্রেম করে ঘুরে বেড়াইনি, আমি আল্লাহকে ভুলে যাইনি। আমার সাথে এমন কেন হবে? মনকে শক্ত করে উঠে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে বুঝিয়েছি, আমি অনাকাঙ্ক্ষিত নই, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ নামের আঘাত আমার জন্য নয়। ভাগ্যের কাছেও কি আমায় অনাকাঙ্ক্ষিত হতে হবে?

সরু দুটো পায়ে জোর এমনিতেই কম, মনের জোরটাও যখন স্তিমিত হয়ে আসে, তখন আর পা বাড়াই কোন ভরসায়! এক বন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে গেলাম, কাঙ্ক্ষিত হবার যুদ্ধে। এক-দুই-তিন…অবশেষে সাত নম্বরে দেখলাম আমার নাম। আমি ভর্তিযুদ্ধে সপ্তম হয়েছি। মোটাদাগে, আমার ভাগ্যরেখা স্বগৌরবে উজ্জ্বল!
Content Protection by DMCA.com