সৃষ্টির আদিকাল থেকেই, ঈশ্বর কে, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি গবেষণা হয়েছে ভারতবর্ষে। সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে, ভারতবর্ষের বাইরে ঈশ্বর নিয়ে গভীর অনুধ্যান তত বিস্তৃত হয়েছে; তবে এই যাত্রার গোড়াপত্তন ভারতেই। পৃথিবীর বড়ো বড়ো পণ্ডিত ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে তাঁদের নানান যুক্তি উপস্থাপন করে চলেছেন, তবু যেন কিছুতেই আঁধার কাটছে না। তত্ত্বটির অতলতা ও জটিলতা গবেষকদের মতভেদকে উলটো আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মানুষের জ্ঞান বাড়ছে, মনের ক্ষমতার সাথে পরিচয় বাড়ছে, যুক্তিবিচার পরিপক্ব ও মার্জিত হচ্ছে, তবু ঈশ্বর নিয়ে মানুষের ভাবনা নতুন নতুন মত ও পথের জন্ম দিয়ে চলেছে। অতীতের দিকে তাকানো যাক। এ পর্যন্ত ঈশ্বর নিয়ে যা যা জ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানই সব দিক বিচারে পরিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। এমন দাবি কেন করছি? আলোচনা করতে করতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মানুষ হতে হলে দুইটি গুণ লাগবেই: চিন্তা ও ভাব। যে মানুষ ভাবতে পারে না এবং ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না, তার সাথে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য অল্প। ভাববার ক্ষমতা বা কল্পনা ও চিন্তা, এই দুইয়ের সমন্বয়ে জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে। এই জ্ঞান আবার দুই রকমের: প্রত্যক্ষ বা সাকার ও পরোক্ষ বা নিরাকার।
ব্রহ্মজ্ঞান এবং এ ধরনের সকল আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উদ্বোধন ও বিকাশ মনের মধ্যেই হয়, বাইরে এসবের দৃশ্যমান প্রকাশ নেই, তাই এদের সবই অপ্রত্যক্ষ বা নিরাকার। যে-সকল বস্তু আমরা দেখতে পাই, সেগুলি থেকে যা জ্ঞান, তা প্রত্যক্ষ বা সাকার জ্ঞান। যেমন গাছ, মানবদেহ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সম্পর্কিত জ্ঞান। ঈশ্বরের জ্ঞান সব বিচারেই অপ্রত্যক্ষ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জ্ঞান থেকে ব্রহ্মজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। এ কারণেই ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে হাজারো রকমের মতের সৃষ্টি হয়েছে।
সহজ করে বলি। যদি ধরে নিই, ঈশ্বর থাকতেও পারেন, আবার না-ও থাকতে পারেন, তাহলে ঈশ্বর নিয়ে কথা বলা সহজ। এর অর্থ, ঈশ্বর আছেন কি না, তার উত্তর 'হ্যাঁ' হোক, কিংবা 'না' হোক, প্রকৃত সত্য নিয়ে ভাবতে চাইলে দুইয়ের মধ্যস্থলে নিজেকে রেখে এ নিয়ে ভাবতে হবে। ঈশ্বর কীভাবে আছেন বা কীভাবে নেই, তা ব্যাখ্যা করে করে এগোলে আমাদের সুবিধে হবে।
ব্রহ্মজ্ঞানের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ঋষিদের কাল থেকে শুরু করে প্লেটো-অ্যারিস্টটল এবং তাঁদের সমসাময়িক দার্শনিকগণ এই জ্ঞানকে মূল ধরেই দর্শনচর্চা করেছেন। ঈশ্বরের নির্দেশই তাঁদের ভাবনার মূলসূত্র ছিল। বীরেরা যুদ্ধে নামতেন ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ধার্মিকেরা প্রাণ বিসর্জন দিতেন ঈশ্বরের নামে, অসংখ্য মানুষ দুঃখে-বিপদে সাহস ও সান্ত্বনা পেতেন ঈশ্বরে বিশ্বাসের ফলে। তাঁদের সকলেই মনে করতেন, ঈশ্বর একজন সর্বশক্তিমান মহাপুরুষ, এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, মানুষের অদৃষ্টের নিয়ন্তা।
জ্ঞানের দুইটি রকমের কথা আগেই বলেছি। প্রথম ধরনের জ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। শুভ্রতা, সাহস, ভালোত্ব, বিবিধ গুণ, শক্তি, উদারতা এবং এমন আরও যা যা আছে, সেগুলির জ্ঞান অপ্রত্যক্ষ। জ্ঞান মাত্রেই জ্ঞাতা (যিনি জ্ঞানলাভ করেন) ও জ্ঞেয় বস্তু (যা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা হয়) এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবের ফল। জ্ঞাতার ভূমিকা কী? তিনি বস্তুর বা ধারণার বা বিশ্বাসের বা অভিজ্ঞতার বিভিন্ন দিক হতে সৃষ্ট বা উদ্বোধিত শক্তি তাঁর নিজের জ্ঞানশক্তিকে যেভাবে জাগায়, ঠিক সেভাবেই কোনো বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। ওই জ্ঞানটি বস্তুর বাহ্যিকতা বিষয়ক হলেও বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ বা গুণের প্রকাশ জ্ঞাতার বোধের সাথে সম্পর্কিত। তাই সাদা রঙের বিভিন্ন আকার ও আকৃতির অনেক বস্তু থাকলেও শুভ্রতার গুণটি অপরিবর্তনীয় ও ইন্দ্রিয়াতীত। ঠিক তেমনি সাধু চরিত্রের বিভিন্ন মানুষ আছে, তবে সাধুতা বিষয়টি কিছু বৈশিষ্ট্যের একটি সমন্বিত রূপ, যা সকল সাধু মানুষের জন্যই অভিন্ন। শুভ্রতা বা সাধুতা দ্বারা আমরা কোনো সত্তা তথা ব্যক্তি বা বস্তুকে বুঝি না, বরং সত্তার অপ্রত্যক্ষ গুণটিকেই বুঝি। এই বোধগম্যতা নিয়ে আমাদের একটুও অসুবিধে হয় না।
বুদ্ধি ও বুদ্ধিস্থ চৈতন্য উভয়ই বাহ্যিক বস্তুর নিজের মতো করে ছবি বা জ্ঞান সৃষ্টি করে। প্রথম ধাপে বুদ্ধি বা মন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বস্তুর ছবি বা জ্ঞান তৈরি করে, পরবর্তী ধাপে মন বা বুদ্ধি কর্তৃক সৃষ্ট ছবি বা জ্ঞান চৈতন্যের জন্য বস্তু হিসেবে কাজ করে এবং চৈতন্যের ঘরে গিয়ে বস্তু তথা মন বা বুদ্ধি চৈতন্যকে জাগ্রত করে। অবশেষে বাহ্যিক বস্তু একধরনের চূড়ান্ত ছবি বা পরা-জ্ঞান হিসেবে চৈতন্যের মধ্যে থেকে যায়।
প্রাচীন মানুষেরা জ্ঞান বলতে মূলত অপ্রত্যক্ষ জ্ঞানকেই বুঝতেন। গ্রিকেরা গুণ, পুণ্য ইত্যাদি শব্দে গুণবতী সুন্দরী স্ত্রী বুঝে নিতেন। শব্দের এরকম জন্ম দেবার ক্ষমতা আছে বলেই শব্দকে শব্দব্রহ্ম বলা হয়। ব্ৰহ্মজ্ঞান তাই অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান, যাকে ধরা-দেখা-শোনা-চাখা-শোঁকা যায় না; তবে তা স্পষ্ট বোধের সাহায্যে অনুভব করে নিতে কোনো বাড়তি প্রয়াস লাগে না।
জ্ঞানের বিকাশ হবার শুরুর দিকে মানুষ ঈশ্বরকে সাকার ভেবে পৃথিবীর স্রষ্টা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ম রচনাকারী পালনকর্তা, পাপ ও পুণ্যের বিচারক হিসেবে বিশ্বাস করতেন। তাঁদের ভাবনা ছিল, সাকার রূপে ঈশ্বরের জ্ঞানই যথার্থ, কেননা যার অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়ের বাইরে, তা আদৌ সত্য নয়। এমন ভাবনার অস্তিত্ব আজও আছে। এটি ঠিক কি বেঠিক, তার চাইতে জরুরি হচ্ছে, সাকারত্বের মধ্য দিয়েও কিন্তু মানুষ শেষমেশ নিজের অন্তরস্থিত ভক্তিকে তথা চৈতন্যকে জাগিয়ে তুলছে, যা ব্রহ্মজ্ঞানে পৌঁছনোর একটি ভিন্ন পথ ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের হৃদয়ের গোপন ঘরে পৌঁছতে কেউ যদি বাহ্যিক কোনো অবয়বের আশ্রয় নেন, তবে সেখানে তো কোনো অসুবিধে দেখছি না। আসল কাজটি হলেই হলো। নিরাকারত্বের উপাসক যদি জ্ঞানে ও বুদ্ধিতে সাকারত্বের উপাসকের চাইতে পিছিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই এ-কথা বলা যায় না যে, নিরাকারত্বের ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তির সাধনা একেবারে ঠিক পথে চলছে, তাই না?
আধ্যাত্মিকতার চর্চার জন্য বিশ্বাস ও ভক্তি লাগবেই লাগবে, আর তা যে পথেই আসুক না কেন, তাতে এই চর্চায় কোনো বাধা আসে না। ভক্তের হৃদয়ে বিশ্বাসের শক্তিতে যতক্ষণ না ধর্মভাব জাগছে, ততক্ষণ আধ্যাত্মিকতা তথা চৈতন্য জাগবে না। যার যতদূর ভাব, তার ততদূর লাভ। দেব-দেবী'র মূর্তির সামনে বসে লোকে যে কথা বলেন, তা মূলত নিজের আত্মাস্থিত ভগবানের সাথে একান্ত আলাপচারিতা। একই কাজ কেউ এভাবে সাকার উপাসনায় করেন, আর কেউবা তা করতে গিয়ে নিরাকারত্বে আস্থা রাখেন। লক্ষ্য একটাই, পথ যদিও অনেক।
কল্পনায় যা আসে, তাকে কি কোনো দৃশ্যমান বস্তু হতেই হবে, না কি তা কোনো ধারণার নামও হতে পারে? কল্পনার নিশ্চয়ই কোনো লক্ষ্যবস্তু আছে, সেটির প্রকৃত সত্তাও আছে, ঠিক এরকম করেই অনেক মানুষ ভাবেন। ওঁরা চেষ্টা করেন কল্পনালব্ধ জ্ঞানকে সকল ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু অমন কি আর করা যায়? মানুষের নিজস্ব মত, পথ, যুক্তি, বিশ্বাস, সিদ্ধান্ত, পছন্দ থাকবেই। কেন জ্ঞান- ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চাপিয়ে দেওয়া জিনিস মেনে নেবে চুপচাপ? অপদার্থরা সকলকেই নিজের মতন অপদার্থ ভাবে; মূল সমস্যা এখানেই।
আমাদের জ্ঞান কেবলই কোনো মতবাদ বা ধারণা বা বস্তুর প্রতিরূপ, আমাদের কল্পনা নিতান্তই একধরনের মানসিক অবস্থান। পদার্থের প্রকৃত রূপ এবং আমাদের কল্পনাপ্রসূত রূপ এক নয়। তবে কল্পনার মাধ্যমেই জ্ঞানের উদ্বোধন ঘটে। এই মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গেলে প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এক উদ্বোধন বহু উদ্বোধনের জন্ম দেয়। এক কল্পনা বহু সত্যের জন্ম দেয়। এভাবেই জন্ম হয় সিদ্ধান্তের ও সভ্যতার। উদ্বোধনের উদয় হয় জ্ঞানের বারংবার বিকাশে আর তার ব্যাপ্তি ঘটে ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমে। জ্ঞানের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে এমন সাধনার গুরুত্ব অসীম।
অনেক দর্শনে আস্থা রেখে ঈশ্বরের স্বরূপ বোঝা যায় কি? না কি ঈশ্বরের ধারণা এমন কোনো দর্শন, যেটার প্রকৃতি বোঝা মানুষের অসাধ্য? প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর একটি আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা ধারণার নাম, এবং এই বিচারে, ঈশ্বর হচ্ছেন গভীর চিন্তার ফল বা একটি মানসিক অবস্থা। আর্য ঋষিগণ এ কারণেই ঈশ্বরের নাম দিয়েছিলেন 'চিন্তামণি'। হিন্দুধর্ম বলেন, ঈশ্বরের আধ্যাত্মিক আখ্যা: মনোময়, জ্ঞানময়। আরও ভেঙে বললে, ঈশ্বর হচ্ছেন মনে জাত বা সম্ভূত জ্ঞান। ফলে ঈশ্বরই আত্মাস্থিত ব্রহ্ম।
ঈশ্বর কি তবে সত্তাহীন? যাঁর সত্তা নেই, তাঁকে কীভাবে বুঝব? উত্তরটা এভাবে দিই: ঈশ্বর শুদ্ধ চিন্তার ফলস্বরূপ আসেন। ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের চিন্তার উদ্বোধন; দৈনন্দিন জীবনে তাঁর অস্তিত্ব বা প্রভাব আমরা অনুভব করতে পারি। হাতেকলমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা না গেলেও ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতায় ব্রহ্মজ্ঞানের সত্যতা খুব স্পষ্ট করেই আমরা বুঝতে পারি। বাহ্যবস্তু হতে ইন্দ্রিয়ে, ইন্দ্রিয় হতে মনে, মন হতে চৈতন্যে—এই তিন যাত্রা পূর্ণতা পেলে যেটির উদ্ভব হয়, তার নামই ব্রহ্মজ্ঞান। এ নিয়ে মতবিরোধ নেই, কেননা এই ধারণাটি সকল ধর্মমতের সার বা নির্যাস।
ঝামেলাটা কখন বাধে তাহলে? প্রতিমাপূজারি আর প্রতিমাভঞ্জক যখন বুঝতে পারেন না যে, তাঁদের গন্তব্য বা লক্ষ্য এক—ব্রহ্মজ্ঞানলাভ, তখন তাঁরা দুই পরস্পরবিরোধী শিবিরে অবস্থান নেন। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য জ্ঞানের উন্মেষ নয়, অজ্ঞানতার প্রতিষ্ঠা। এই দুই দল শব্দের কলহে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাক্যের তাৎপর্য ভুলে থাকেন। মজার ব্যাপার, এঁরা ধার্মিক নন, ধর্মোন্মাদ; এবং এই সত্যটা এঁরা নিজেরাই জানেন না। ধর্মের উপলব্ধি ও অনুভব, দুই-ই হয় নিভৃতে, চৈতন্যের নীরব জাগরণে। চৈতন্যের জাগরণ হইচই করে বা লোক দেখিয়ে ঘটার বিষয় নয়। এ কারণেই, ধর্ম নিয়ে চেঁচামেচি-করা মানুষ বরাবরই নির্বোধ।
আমাদের কল্পনায় যা আসে, তার সাথে বিশ্বাস মিলে যা-কিছুর জন্ম হয়, তার সব কিছু সত্য নয়, প্রকৃত বিষয়ের অনুরূপ নয়। অনেক কল্পনাই ভ্রান্তির বিকাশ ঘটায়, এবং তা থেকে নানান অনিষ্টের উৎপত্তি হয়। আমাদের কাজ, আমাদের কথা, আমাদের চিন্তা, সমস্ত কিছুই ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের ফলই প্রসব করে। দিনশেষে, ভালোটি টিকে থাকে, মন্দটি বিদেয় হয়। এটাই প্রকৃতির বিচার। তবে মন্দটি বিদেয় হবার আগেই মানুষের অনেক ধরনের ক্ষতিসাধন করে ফেলে। শরীরের রোগ ওষুধে সারে, কিন্তু মনের ভ্রম মানুষ মরতে মরতেও আঁকড়ে ধরে রাখে। ভ্রান্ত মনের চাইতে পরাক্রমশালী নির্বোধ সম্রাট কোথাও নেই। ভ্রান্ত মন মনুষ্যত্বের শক্তিতে বিশ্বাস করে না, নিজমতের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে।
এখন কথা হচ্ছে, ব্রহ্মজ্ঞান আসলে কী? এটা কি সত্য, না কি কেবলই ভ্রান্তি বা মোহ?
প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব বোধ এবং অনুভব রয়েছে। একেকটি মানুষ নিজের ক্ষমতা ও অবস্থান অনুযায়ী একেক উপায়ে ঈশ্বরের ধারণা নিজের মধ্যে ধারণ করে। কোনোটিকেই গায়ের জোরে বাতিল করে দেওয়া যায় না। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে কারও কোনো ক্ষতি না করে, মন চাইলেই সেটিকে ভুল বলে রায় দেওয়া যায় না।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "আমার ভক্তদের মধ্যে যিনি যেভাবে আমাকে চিন্তা করেন, অথবা যিনি যেমন কাজ আমাতে সমর্পণ করেন, আমি ঠিক তেমনি করেই তাঁর ধ্যানের বা প্রার্থনার বিষয় হয়ে থাকি।" ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তাই ভক্ত তাঁকে যেভাবে কল্পনা ও বিশ্বাস করে স্বস্তি পান, ঈশ্বর ঠিক সেভাবেই সেই রূপেই ভক্তের মানসপটে আবির্ভূত হন। সিংহের ঈশ্বর বলশালী সিংহের মতন, মানুষের ঈশ্বর সুমহান মানুষের মতন। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলা যায়, ঈশ্বর কিছু আদর্শ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়, যে-বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্ন।
ঈশ্বরের জ্ঞান অপ্রত্যক্ষ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানসজাত, তবু মানুষ তার জীবদ্দশায় নিজের মধ্যে ঈশ্বরের গুণগুলির প্রকাশ ঘটিয়ে আয়ুযাপন করে। বলা প্রয়োজন, মানুষের প্রতিটি কল্পনা তথা বিশ্বাসই তার নিজের কাছে অখণ্ড সত্যের আসনে অধিষ্ঠিত। একটি কল্পনা আরেকটি কল্পনাকে মনের মধ্যে ডেকে নিয়ে আসে এবং এভাবেই চলতে থাকে। ব্রহ্মজ্ঞানের মতোই তার পূর্ববর্তী সকল জ্ঞান আমাদের জীবনকে কর্মময় রাখে এবং পূর্ণ পরিসরে বিকশিত করে। ব্রহ্মজ্ঞানের দিকে যাত্রাপথটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন বহুদেবতা বা একদেবতার সাকার উপাসনা, পৃথিবীর সব কিছুকেই ব্রহ্ম বিবেচনায় প্রার্থনা, একেশ্বরবাদ, ব্রাহ্মধর্ম, অদ্বৈতবাদ, এমনকি নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিকতাও নানা পথ অতিক্রম করে অবশেষে আত্মা তথা চেতনার উদ্বোধন ঘটায়। এই উদ্বোধনই মানুষের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
মজার ব্যাপার, একজন নাস্তিক মানুষও নিজের অজান্তেই ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যগুলি নিজের মধ্যে ধারণ করে এবং সেগুলির যথার্থ বিকাশ ঘটিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যেতে পারেন, যেখানে একজন পরম ধার্মিক মানুষ চৈতন্যের জাগরণ ঘটাতে ব্যর্থ হবার কারণে সারাজীবন চেষ্টা করেও কিছুতেই সাফল্যের দেখা পান না। পৃথিবীর সভ্যতম মানুষেরাও বহু দেব-দেবী'র উপাসক ছিলেন এবং এখনও আছেন। তাই মোটাদাগে এমন কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, দেব-দেবী'র উপাসনা করাটা ভ্রান্ত। প্রাচীন সময়ের দিকে তাকান। গ্রিক ও হিন্দু জাতি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উৎকর্ষের চরমে পৌঁছেছেন যখন, তখন তাঁরা বহুদেবতার সাকার উপাসনা করছেন। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? সাকারত্ব বা নিরাকারত্ব যা-ই হোক না কেন, মূল কাজ হচ্ছে, নিজেকে জাগানো, মনের শক্তির স্ফুরণ ঘটানো। এই কাজটি করতে না পারলে সারা-দিনরাত এক করে প্রার্থনা করলেও কোনো লাভ হবে না।
বহুদেবতার উপাসনার মূল বিশ্বাস হলো, ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা প্রতিভূ দেব-দেবী'গণ মানুষের মতন সত্তা এবং সে অনুযায়ী তাঁদের মূর্তি গড়া হয়; মূর্তিতেই ভক্ত মৃন্ময়ের মাঝেই চিন্ময়ের খোঁজ পেয়ে কৃতার্থ হন। এখানে উল্লেখ করা যায়, হিন্দুরা যে-সকল দেব-দেবী'র উপাসনা করেন, তাঁদের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের জন্ম অতীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হয়েছিল এবং তাঁরা সাধনাবলে দেবত্বলাভ করেছিলেন। শিব, কৃষ্ণ, রাম, দুর্গা, কালী, গণেশ প্রভৃতি দেব-দেবী কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা গুণের আধাররূপেই কল্পিত ও পূজিত হন। তাই তাঁদের পূজার্চনা করার মধ্য দিয়ে হিন্দুরা মূলত নিজের আত্মার দেবত্বসাধনে প্রবৃত্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই, এতে আত্মোন্নতি ঘটে, জীবন সুন্দর হয়, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের মঙ্গল হয়।
পৃথিবীজুড়ে যে ঐশশক্তি বিরাজমান, তার সামগ্রিকতাকে ধারণ করার চাইতে বরং চোখের সামনে থাকা প্রতিমাতে আবির্ভূত খণ্ডশক্তিকে আত্মশক্তিতে পরিণত করা অনেক সহজ। নিজেকে নানান ক্ষতিকর প্রলোভন থেকে দূরে রাখতে, মানসিক মুক্তিসাধন করতে, ভালো প্রবৃত্তিগুলিকে আরও বাড়াতে, খারাপ ইচ্ছেগুলিকে নিবৃত্ত করে রাখতে মানুষের ঐশশক্তির সাহায্য লাগে। তবে সবার বোঝার ও ধারণ করার ক্ষমতা তো এক নয়। তাই সাধনার শুরুতে খণ্ডশক্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে ক্রমান্বয়ে অখণ্ডশক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। এতে করে চিত্তের উন্নতি হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বিভিন্ন ধরনের সংশয় মন থেকে দূর হয়। সবচাইতে বড়ো কথা, এই রাস্তাটি সহজ; আর সহজ বলেই সাধারণ মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।
উপাসনার প্রথম অবস্থাতেই সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয়ের অতীত সচ্চিদানন্দ তথা পরমাত্মাজ্ঞান তথা ব্রহ্মবিদ্যায় চিত্তকে নিবিষ্ট করবেন, তা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। যাঁরা চিত্তের ঊর্দ্ধারোহণে সমর্থ, তাঁরাও এক দিনে তা করতে পারেননি; এই কাজে অসীম ধৈর্য ও সাধনা লাগে। শূন্য থেকেই শুরুটা করতে হয়। ধাক্কা খেয়ে খেয়েই একদিন মানুষ আত্মতত্ত্বে উপনীত হয়। অমন স্তরে পৌঁছে গেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য প্রতিমাপূজা আবশ্যক নয়। ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিমায় নিজের চৈতন্যকে জাগ্রত করে মানুষ ধীরে ধীরে অখণ্ড আত্মশক্তি তথা ঐশচেতনার অভিজ্ঞতালাভ করে। প্রতিমাপূজা তাই খুবই ফলপ্রসূ একটি চৈতন্য-বিজ্ঞান।
প্রতিমাপূজার আগে মানুষ ছিল প্রকৃতির পূজারি। মানুষ, নদী, সাগর, সূর্য, পাহাড়, জলপ্রপাত, আগুন, গাছ ইত্যাদি প্রাকৃতিক সত্তা দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। এ ধরনের আরাধনা সমাজে খুবই স্বাভাবিক রীতি ছিল। মানুষের বিশ্বাস ছিল, আমাদের চারপাশের সব কিছুই আমাদের মতন সজীব; শুধু তা-ই নয়, আমাদের মতোই ওঁদের আত্মা আছে, সেই আত্মায় ওঁরা শক্তিধারণ করেন। গীতাতে আছে, সৃষ্টবস্তু মাত্রেই ভগবানের শক্তির প্রকাশ। তবে সৃষ্টবস্তুগুলির মধ্যে যে-সকল বস্তুতে শক্তির আধিক্য বেশি দেখা যায়, তাঁদেরকেই ভগবানের মূল অংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। (উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, তবে সে-সমস্ত বস্তু ও প্রাণী তথা সত্তার কথা উল্লেখ করা যায়, যেগুলির বৈশিষ্ট্যকে মানুষ নিজের জীবনে ধারণ করতে চায়। যেমন, মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সৃষ্টিশীল কিংবা নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হতে চায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নক্ষত্র ভগবানের মূল অংশ হিসেবে গণ্য হতে পারেন। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।)
খেয়াল করুন, দুর্বলতাকে দূরে সরিয়ে শক্তির নানান লক্ষণকে নিজের মধ্যে ঈশ্বরের শক্তি হিসেবে ধারণ করার জন্য কত চমৎকারভাবে গীতা আমাদের শেখাচ্ছেন! শক্তিই মঙ্গল, দুর্বলতাই পাপ—এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারলেন না যিনি, ধর্মের মূলসুর তাঁর কানে আসলে পৌঁছোয়ইনি। এর চাইতেও বড়ো পাপ কী, জানেন? নিজেকে সবল ও অভ্রান্ত ভেবে অন্যকে দুর্বল ও ভ্রান্ত ভাবা। কারও সম্পর্কে না জেনেই তাঁকে দুর্বল ও ভ্রান্ত হিসেবে রায় দিয়ে বসা, এই কাজটি নিঃসন্দেহে অধার্মিকতা।
আমরা দেখেছি, বহুদেবতার উপাসনা করেন যাঁরা, তাঁরা কিন্তু প্রকৃত বিচারে ব্রহ্মজ্ঞানেরই উদ্বোধন ঘটান। এ পৃথিবীতে যা-কিছুই ঘটে, তার সবই ঈশ্বরের লীলা; একেশ্বরবাদ তা-ই বলে, একক ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ দিয়েই একেকটি দেবতার সৃষ্টি, সৃষ্টির এই বিশ্বাসই মানুষকে বিভিন্ন প্রতিমা গড়তে এবং তাঁদের পূজা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। আর প্রতিমা ভাঙতে শিখিয়েছে অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও মূর্খতা।
একেশ্বরবাদের উৎপত্তি আর্য ঋষিগণের চেতনায়। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে বৈদিক ঋষির কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছিল: ঈশ্বর একমেবাদ্বিতীয়ম্, অর্থাৎ ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্ম পরবর্তীকালে ছান্দোগ্য উপনিষদের এই ঘোষণাটি গ্রহণ করে। সে-সময় সব কাজেই ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য নিবেদন করা ছিল অতিস্বাভাবিক ব্যাপার, তাতে চৈতন্যের স্ফুরণ ঘটত এবং হৃদয়ে সর্বোচ্চ ভক্তিভাবের উদয়ের মাধ্যমে উপাসনা প্রক্রিয়ার পূর্ণতা সাধিত হতো।
একেশ্বরবাদের উৎপত্তি হবার পর থেকেই নিজেকে জানার কৌতূহল থেকে ঈশ্বর সকল দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিলেন। দেখা গেল, ঈশ্বর নিয়ে মানুষ যতই ভাবতে লাগল, ব্যাপারটি ততই জটিল ও দুর্ভেদ্য হয়ে যেতে শুরু করল। এমন রহস্যের ঘনঘটায় অনেক মত ও পথের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। খ্রিস্টধর্মে বিধৃত একেশ্বরবাদ এবং আর্য ঋষিগণ প্রবর্তিত ঈশ্বরতত্ত্ব একসময় অঙ্গীভূত হয়ে গেল।
সন্দেহাতীতভাবে, বহুদেবতার ধারণা হতেই একেশ্বরবাদের উৎপত্তি ও অভ্যুদয়। কালক্রমে প্রশ্ন এল, একেশ্বরবাদের মূলসূত্র যে 'ঈশ্বর', তা আসলে কী? তখন দার্শনিকগণ এগিয়ে এলেন। তাঁরা মত দিলেন, ঈশ্বর আমাদের মতো কোনো দেহধারী মানুষ নন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই ঈশ্বর এবং ঈশ্বরই এই বিশ্বসংসার। সমস্ত জগৎ ও ঈশ্বর একই সত্তা, এই মতের নাম বিশ্বব্রহ্মবাদ।
বিশ্বব্রহ্মবাদই একেশ্বরবাদের প্রাথমিক সূত্র। প্রকৃতির বাইরেও একজন আছেন, যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমন মতবাদের চাইতে বিশ্বব্রহ্মবাদ বোঝাটা অনেক সহজ এবং সে কারণে তা নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। মানুষ যখন জানল, তার নিজের মধ্যেই ঈশ্বরের গুণগুলি জাগ্রত করে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তখন সে নিজের শক্তিমত্তা ও দায়িত্ববুদ্ধি সম্পর্কে সচেতন ও সচেষ্ট হয়ে উঠল।
প্রাচীন ব্রহ্মবাদের প্রতি আকর্ষণ আবারও বাড়তে লাগল। প্রকৃতির বাইরেও অন্য একজন পুরুষ রয়েছেন, যিনি সব কিছুকেই পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, এই মতবাদ বেশিরভাগ প্রজ্ঞাবান মানুষ মেনে নিতে চাইলেন না। তার চাইতে বরং সাকার ঈশ্বরের মূল লক্ষ্য বা ফলাফল—খণ্ড চৈতন্যের জাগরণ, তা থেকে দুইটি মত প্রতিষ্ঠিত হলো: ব্রহ্মবাদ ও অদ্বৈতবাদ। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি-সহ পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে অদ্বৈতবাদের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল।
অদ্বৈতবাদ বলে, ঈশ্বরের অবস্থান সাধকের চৈতন্যে। তাঁর দেখা পেতে চাইলে তাঁকে আগে আত্মায় অধিষ্ঠিত করতে হয়। তিনিই এই জগতের সৃষ্টিকর্তা। একেশ্বরবাদের ঈশ্বর অলৌকিক ঘটনা ঘটালেও অদ্বৈতবাদের ঈশ্বর কখনোই প্রাকৃতিক নিয়মের উপর হস্তক্ষেপ করেন না। ব্রহ্মবাদ অনেকটাই অদ্বৈতবাদ প্রবর্তিত মতের সহগামী। সাকারতত্ত্বের নানান বাহ্যিকতাকে সংস্কার করে ঈশ্বরচেতনাকে বিশুদ্ধ করাই ব্রহ্মবাদের লক্ষ্য। ব্রহ্মবাদী বলেন, ঈশ্বর পৃথিবীর সব বিষয়েরই সাক্ষী, তবে ঈশ্বর নিজে কোনো বিষয়ে জড়িয়ে যাবেন না। বাতাস যেমনি আবর্জনার স্তূপ এবং ফুলের বাগান উভয়ের পাশ দিয়েই বয়ে যায় নিজের গায়ে দুর্গন্ধ বা সুগন্ধ না মেখে, ঈশ্বরও ঠিক সেরূপ সাক্ষী হয়ে থাকেন সকল ঘটনার। যাবতীয় প্রাকৃতিক নিয়ম এবং অলৌকিক ঘটনা ঈশ্বরের ইচ্ছামাত্র, ওসবে তাঁর নিজের কোনো অংশগ্রহণ নেই।
একটা বিষয় এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়—সমস্ত মৌলিক লক্ষণ বিবেচনায় একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতবাদী ও ব্রহ্মবাদীর ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। ঈশ্বর নিজেই নিজেকে পূর্ণ করেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা এবং বাহ্যিক প্রকৃতি থেকে ঈশ্বর পৃথক—এই তিন বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত মতবাদ তিনটিই মেনে নেয়; তবে দর্শন, বিজ্ঞান ও যুক্তির সাহায্যে বিবিধ মীমাংসা-প্রণালী থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অদ্বৈতবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ, পরিষ্কার ও সারগর্ভ। দৃশ্য ও দ্রষ্টার তিন পর্যায়ের যাত্রা স্পষ্ট করে বুঝলে পৃথিবীর সকল বস্তু, অভিজ্ঞতা, ঘটনা, বিশ্বাস, দুঃখ, জ্ঞান ইত্যাদি দৃশ্য থেকে দ্রষ্টার ভেতরে চৈতন্যের জাগরণ তথা ঈশ্বরের উদ্বোধন অনুধাবন করা যায়।
এ-সকল মতামতের বাইরে অবস্থান করে নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিকতা। ব্রহ্মবাদ থেকে অব্রহ্মবাদে পরিণতিই হচ্ছে নাস্তিকতা। এই মতবাদ প্রচার করে, প্রকৃতির মধ্যে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত যা-কিছু আছে, তা থেকেই জগতের সকল কিছুর সৃষ্টি এবং বিকাশ। এখানে যা-ই ঘটুক না, তার কিছুই ঈশ্বর ঘটান না, বরং সবই কোনো-না-কোনো প্রাকৃতিক কারণে ঘটে। এই মত আধুনিক, তবে চূড়ান্ত নয়। প্রচলিত মতগুলির বিরোধিতা করাই নিরীশ্বরবাদের মূল লক্ষ্য। নাস্তিকতার অনুসারীরা কোনো নির্দিষ্ট মতে বিশ্বাস করেন না, এঁদের উদ্দেশ্যই সকল ধর্মমতকে অবিশ্বাস করা।
বিশ্বব্রহ্মবাদ থেকেই নাস্তিকতার উৎপত্তি, তবে "বিশ্বসংসারই উপাস্য ঈশ্বর।"---এই মতবাদ নিরীশ্বরবাদ অনুমোদন করে না। বিশ্বসংসার কেবলই মানুষ, মানুষের চেয়ে নিম্নবৃত্তির প্রাণী এবং জড় বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলির কোনোটিই উপাস্য ঈশ্বর হতে পারে না। এই মতবাদ আরও বলে, বিশ্বব্রহ্মবাদ তার অনুসারীদের অস্পষ্ট পথের নির্দেশ দেয় এবং প্রায় সময়ই বিপথে নিয়ে যায়। আত্মার উপর সবটা ছেড়ে দিলে বোধ ও জ্ঞানের অভাবে আত্মা ভুলভাল সৃষ্টি করে, যার ফলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। একেশ্বরবাদ, বহুদেবতাবাদ, ব্রহ্মবাদ যেমন ভ্রান্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ, ঠিক তেমনি বিশ্বব্রহ্মবাদও অমূলক। নাস্তিকতা এভাবেই মত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
মানুষ ব্রহ্মজ্ঞানলাভ করার আগ পর্যন্ত যা যা মতে ও পথে চলে, সেগুলি নিয়ে তর্ক করা নাস্তিকতা সমর্থন করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই ক্ষেত্রে নিরীশ্বরবাদ যা করে ঠিকই করে, কিন্তু কেবল এই দিকটি নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে এই মতবাদকে সাদরে গ্রহণ করা যায় কি? একটু ভেবে দেখা যাক।
ব্রহ্মবাদ যা বলে, তা কি আদৌ সত্য? ওদিকে নাস্তিকতা বলে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা বোকাদের কাজ, ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এক মায়ামৃগ ছাড়া আর কিছু নয়; এইসব বক্তব্য কতটুকু সত্য?
ঈশ্বর অপ্রত্যক্ষ সত্তা; আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বস্তুগুলির মতো স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ না হলেও আমাদের অনুভবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ বা বিরাগ টের পাওয়া কঠিন কিছু নয়। ঈশ্বরের গুণ কী কী, তা জানলে ও সেগুলি নিয়ে গভীরভাবে ভাবলে ঈশ্বর আমাদের মধ্যে আছেন কি নেই, তা বোঝা যায়। চোখের সামনে যখন দয়ালু পুরুষ বা রূপসী নারী দেখতে পাই, তখন তাঁদের বৈশিষ্ট্য তাঁদের সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে দেয় এবং আমাদের চৈতন্যে তাঁদের নিয়ে যে নানান ধারণার জন্ম হয়, এসব কিছু যদি সত্য হয়, তবে দয়া ও রূপ—এই দুই অপ্রত্যক্ষ সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। এখানে কোনো বিভ্রম নেই, এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। দয়ালু মানুষের অন্তরেই দয়ার বসবাস, সুন্দর মানুষের বৈশিষ্ট্যেই সৌন্দর্যের প্রকাশ। তাই দয়া এবং রূপ দুই-ই সজীব, সত্য, অস্তিত্বশীল।
ব্রহ্মজ্ঞানও কি অনুরূপ কিছু নয়? ইন্দ্রিয়ের বাইরে অবস্থান করে বলেই কি এই মহাজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করা যায়? মানুষের চাইতে প্রকট কোনো অস্তিত্ব প্রকৃতিতে আর নেই। মানুষের মধ্যে দয়া, রূপ, সাহস, পুণ্য, কাপুরুষতা, কদর্যতা, নির্দয়তা, পাপ ইত্যাদি প্রবৃত্তি অপ্রত্যক্ষ হলেও খুব স্পষ্ট করেই ওরা ওদের অস্তিত্বের জানান দেয়; বলা বাহুল্য, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ ঠিক একই উপায়েই সিদ্ধ হয়। তবে যতদিন না প্রতিমায় কল্পিত ও উদ্বোধিত প্রত্যক্ষ খণ্ডজ্ঞানের শৃঙ্খল থেকে আমাদের চেতনার মুক্তি ঘটছে, ততদিন অবধি অখণ্ড ঈশ্বরের জ্ঞান আমাদের কাছে দুর্বোধ্য, দুর্জ্ঞেয়, দুরূহ থেকে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য নিম্নস্তরের জ্ঞানকে সম্বল করে এই মুক্তির স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়।
ঈশ্বর একটি নাম, কিছু বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, একধরনের তীব্র অনুভূতি, চৈতন্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জাগরণ। ঈশ্বর এমনই এক শক্তি, যা মঙ্গলের জন্ম দেয়; আমাদের অপ্রত্যক্ষ বৈশিষ্ট্যগুলিতে এতটাই প্রাণসঞ্চার করে, যার ফলাফল প্রত্যক্ষ ও দৃঢ়রূপে গোচরীভূত হয়। ঈশ্বর নামের শক্তিতে মানুষ তথা বিশ্বপ্রকৃতির উদ্বোধন ঘটে বড়ো চমৎকারিত্বের সাথেই।
প্রকৃতি যখন তার সব কিছুতেই সামঞ্জস্য রেখে চলে, তখন ঈশ্বরের কৃপা চোখের সামনে স্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। প্রাকৃতিক নিয়ম যে-সকল উপায়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ, সব কিছুকেই তেমনভাবে চলতে হয়, এর লঙ্ঘন হলেই পাপ হয়, আর পাপের শাস্তি হিসেবে প্রকৃতির বিকট-উৎকট চেহারা আমাদের সহ্য করতে হয়। ঈশ্বর প্রকৃতিরই অন্তর্গত, তাই প্রকৃতির নিয়মগুলি ঈশ্বরেরই নিয়ম, সেগুলির ব্যত্যয় ঘটলে ঈশ্বরের নিয়ম ভেঙে ফেলা হয়।
ঈশ্বর অনন্ত শক্তির আধার, পরমার্থিক জ্ঞানের উৎস, সাকারত্ব ও নিরাকারত্ব উভয়েরই বিপুল আধার। বস্তুপ্রধান প্রকৃতির আধ্যাত্মিক প্রকাশের রাস্তাই ঈশ্বরের রাস্তা। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে যতটা সত্য ধরে, ওইটুকুর মধ্যেই ঈশ্বরের স্বরূপ রয়েছে, এবং এর মধ্যে কোনো জটিলতা বা রহস্যময় কিছু নেই; তবে সেই সত্যের সন্ধানপ্রাপ্তি সাধনাসাপেক্ষ। ঈশ্বর হচ্ছেন জীবনের বৃদ্ধি এবং মনুষ্যত্বের ঋদ্ধি। এই দুইটি দিকই প্রাচীন ব্রহ্মবাদের মূলসুরে প্রোথিত। এই মতবাদ মানুষকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে শেখায়, কোনো ধর্মের সদস্য হিসেবে নয়; এবং এ কারণেই, মানবিকতার বিচারে এর স্থান অনেক উঁচুতে। ঈশ্বর মানুষকে বিভিন্ন দর্শনের খোঁজে ব্যস্ত রাখেন না, বরং সকল দর্শনের সার হিসেবে মানুষের মস্তিষ্কে প্রতিভাত হন।
জ্ঞানের পূর্ণতা যখন মনের মধ্যে বিকশিত হয়, তখন তার সারত্ব জন্মে। আমাদের উচ্চলক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য এই সারত্ব খুব জরুরি, তাই একে নির্জীবতার খোলস থেকে বের করে এনে সজীবতায় ছেড়ে দিতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে যত আলোচনা ও গবেষণা করা হবে, ততই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি বিশুদ্ধ হবে।
ঈশ্বর নিয়ে যা-কিছু বললাম, তা অনেকেরই হয়তো পছন্দ হবে না। নিজস্ব বিশ্বাস ও ধারণা তাঁদের কিছুতেই পুরোনো কমফোর্ট-জোন থেকে বেরোতে দেবে না। আবার যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও নিজধর্মমতের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ঝগড়া করে আনন্দ পান, তাঁদের কেউ কেউ আমাকে নাস্তিক হিসেবে রায় দিয়ে দেবেন। প্রাচীন ধর্মতত্ত্বের কিছু কিছু ভ্রান্ত, আমার এমন ব্যাখ্যাও কারও কারও বোধে আঘাত করতে পারে।
আমার লেখায় আমি অখণ্ড ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পথে প্রতিমাপূজা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট বাড়াবাড়িগুলিকে অগ্রাহ্য করতে বলেছি; ঈশ্বর মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট ও রিপুপরবশ, এমন অমূলক বিশ্বাস থেকে সরে আসতে বলেছি। তবে ঈশ্বরের ব্রহ্মত্ব, মহত্ত্ব, সৌন্দর্য, শক্তিমত্তা, বিশুদ্ধতা, এসবের কোনোটিকেই আমি ঈশ্বরের গুণের বিরোধী হিসেবে দেখাইনি কোথাও। জ্ঞানের শুদ্ধতার নাম যদি হয় নাস্তিকতা, তাহলে নাস্তিক হয়ে বাঁচতে পারাই হবে সবচাইতে বেশি গর্বের বিষয়।
গায়ের জোরে প্রতিমাপূজার বিরোধিতা করেন যাঁরা, তাঁদের চিত্তে ও বাক্যে কোনো ধরনের স্থিরতা নেই, বুদ্ধি খরচ করে ভাবনাগুলিকে সাজানোর জন্য ধৈর্য নেই। ব্রহ্মজ্ঞানকে নিছকই কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে চান যাঁরা, তাঁদের অন্যান্য কল্পনা বা অপ্রত্যক্ষ জ্ঞানও তাহলে দূরে ছুড়ে ফেলাই উচিত। এই যে লোকে ভালোবাসে, এই ভালোবাসাও একধরনের অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান; তাহলে তো ভালোবাসা বলতেও স্পষ্ট বিচারে তেমন কিছু নেই। দয়া, সততা, মানবিকতা, আশা, স্বপ্ন, সকল ধরনের আদর্শ, কলাবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়েরও তো প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব নেই, তাহলে এসবও নিশ্চয়ই বর্জনীয়।
যদি বলি, কেবল প্রত্যক্ষ জীব ও জড় শরীর বাদে বাকি সব ভ্রান্ত, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য, প্রীতি, সদ্ভাব, ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, সব কিছুই ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ে। এ কি সম্ভব? এ যদি হয় অসম্ভব, তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করাও কার্যত অসম্ভব। দেখা যায়, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা মানুষের জন্য অনেক উপকারী। জগতের কল্যাণসাধন, উন্নত মানসিকতা গঠন, কাজে নিয়োজিত থাকার শক্তিবৃদ্ধি, হৃদয়ে ভক্তিভাবের আবির্ভাব, এ সব কিছুই ঈশ্বরের জ্ঞান থেকে উদ্ভূত হয়। ব্যাবসায় সততা, জীবনযুদ্ধে সাহস, বৈজ্ঞানিক কর্মযজ্ঞে একাগ্রতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহানুভূতি, এবং এ ধরনের আরও যা যা প্রয়োজনীয় গুণ রয়েছে, সেগুলি যতটা জরুরি, সেগুলির সম্পাদনের জন্য ঈশ্বর তথা ব্রহ্মজ্ঞানের উদ্বোধন ততোধিক জরুরি।
ঈশ্বর মূলত প্রকৃতির নানান উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত একটি আধ্যাত্মিক জীবনাচরণের নাম। ঈশ্বরের অবস্থান ভক্তের হৃদয়ে, তাঁকে কোনো আকারবিশিষ্ট, অলৌকিক, মহাশক্তিমান পুরুষ হিসেবে গণ্য করার কোনো যুক্তি বা কারণ নেই। এই সহজ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে হাজার হাজার বছর আগেই। ঈশ্বর নারী বা পুরুষ নন, প্রকৃতিও নন। তবে পুরুষের সকল পৌরুষের মূলে তিনি আছেন, নারীর সকল নারীত্বের মূলেও তিনিই আছেন। ঈশ্বরের যা যা বৈশিষ্ট্য, সেগুলিই মানুষের সবচাইতে উন্নত গুণ। যিশু খ্রিস্টের খুব চমৎকার একটি কথা আছে। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, "তোমার পিতা কোথায় আছেন? তুমি তাঁকে কীভাবে জানতে পারলে?", তিনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন, "আমি আর আমার পিতা এক।" ঈশ্বর যেহেতু প্রকৃতির আধ্যাত্মিক জীবন, সেহেতু মানুষের প্রকৃত জন্ম তখনই হয়, যখন সে তার চৈতন্যস্থিত ঈশ্বরকে জাগাতে পারে। ঈশ্বরের উদ্বোধনেই মানুষের পথচলা শুরু। এই বিবেচনায় মনুষ্যত্বের অপর নাম ঐশশক্তি।
কোনো রহস্যময়, গুপ্ত, অগম্য, অজ্ঞাত, অন্ধকার স্থানে ঐশশক্তি লুকিয়ে আছে, এমন নয়; মানুষের হৃদয়ই ঐশশক্তির আধার, প্রকৃতির আধ্যাত্মিকতাই ঐশশক্তির উৎস, মানুষের জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরেই ঐশশক্তির আবাস। আমাদের একটাই কাজ: এই ঐশশক্তি বা ঈশ্বরের গুণের খোঁজে সাধনায় নিয়োজিত হওয়া। সেই শক্তির প্রভাবে জীবনযাপনের শুরু যেদিন থেকে, সেদিন থেকেই আমাদের লক্ষ্যের দিকে যাত্রাটি প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়। তাই এই কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, মানুষ ঈশ্বরের সন্তান। তবে সন্তান হিসেবে পিতার যথার্থ উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠার জন্য মানুষকে অনেক সাধনা করতে হয়। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারলে পরে মানুষ ও ঈশ্বর, তথা সন্তান ও পিতা একক সত্তায় পরিণত হয়। মানুষের চৈতন্যেই ঈশ্বর, মানুষের চৈতন্যই ঈশ্বর। মানুষে ঈশ্বরে মিলেমিশে এক ও অখণ্ড চেতনায় রূপলাভ করলেই জীবনের পরমার্থিক সমস্ত দিকের উন্মোচন ঘটে।
অদ্বৈতবাদ, বহুদেবতাবাদ, একেশ্বরবাদ, বিশ্বব্রহ্মবাদ, নিরীশ্বরবাদ, এসবের কোনোটিই ঈশ্বরকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রতিটি থেকেই জানার আছে, শেখার আছে, নেবার আছে। উদারমন নিয়ে শিখতে চাইলে জীবনপথে চলাটা অনেক স্বস্তির হয়ে পড়ে। তবে একটি মতের অন্ধত্বের নিগড়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারলে—বিচারবুদ্ধিকে দূরে সরিয়ে রেখে, তাহলেও বাঁচতে তেমন কোনো অস্বস্তি হয় না। অন্ধের অস্বস্তি বরং আলোতেই।
ঈশ্বর অন্তরে আছেন; তিনি পূর্ণ, তবে সেই পূর্ণতার খোঁজ আমরা এক বারেই পাই না, তা ধীরে ধীরে খুঁজে বের করতে হয়; তিনি প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও আমাদের চৈতন্যের কল্যাণে প্রকৃতির সব অংশে সমানভাবে বিরাজিত রয়েছেন; তিনি সব কিছুতেই লিপ্ত থেকেও চিরকালের এক নির্লিপ্ত সত্তা থেকে যান।
প্রকৃতিতে যা যা শক্তি আছে, সেগুলির মধ্যে যেগুলি পৃথিবীর জন্য মঙ্গলকর, তার একটি সমন্বিত রূপই হচ্ছেন ঈশ্বর। প্রকৃতির সবই কিছু নিয়মে আবদ্ধ। এমনকি দৈবদুর্যোগগুলিও নিয়মের বলেই ঘটে থাকে। দুর্বিপাক আছে বলেই মানুষ ঈশ্বরের মঙ্গলময়তার কাছাকাছি থাকতে চায়। এই অর্থে বলা যায়, দুর্যোগও ঐশশক্তি গ্রহণের একটি অব্যর্থ রাস্তা।
এখন কথা হচ্ছে, ঈশ্বর কি উপাসনার লক্ষ্য, না কি উপায়? উপাসনাকে যদি বাহ্যিক সত্তা মনে করা হয়, তবে কেঁদে কেঁদে হাতজোড় করে মিনতি করে, নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হিসেবে স্বীকার করে, পূজায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলেও কোনো কাজ হবে না, যদি ভেতরটা না জাগে। বরং কোনো বস্তুর বা ব্যক্তির কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য মনের মধ্যে ধারণ করে লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে সেই গুণের অনুপ্রেরণায় কাজ করে যাওয়াই ঈশ্বরের উপাসনা। একজন নাস্তিক ব্যক্তিও যদি নিজের অজান্তেই এই কাজটি করে ফেলেন, তাহলে তিনি প্রকৃত বিচারে সফলভাবে উপাসনাই করেছেন। সত্যের সাথে আত্মার মিলন ঘটানোই হচ্ছে প্রার্থনা বা উপাসনা। মিলন ঘটাতে পারেন যে কেউই, তা তিনি বাহ্যিকভাবে ধার্মিক হন বা না হন। যে উপাসনায় মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না, পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ হয় না, তা উপাসনাই নয়, তা বড়োজোর ধর্মের সারশূন্য বাহ্যিকতা। লোকদেখানো উপাসনায় মনজাগানো উপাচার থাকে কি আদৌ?
প্রার্থনা কীভাবে করা যায়? কাতর হয়ে চোখে জল এনে দু-হাত জোড় করে কপটবিনয়ে ভিক্ষুকের মতো প্রার্থনা করা লোকদেখানো অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়, যদি না তা দিয়ে প্রার্থনাপরবর্তী সময়ে নিজেকে শুদ্ধ করা যায়। পাপ করে গেলাম, তার সাথে প্রার্থনাও করে গেলাম, এমন কাজ নিছকই ভণ্ডামি। আত্মসংযম, আত্মসমর্পণ, প্রায়শ্চিত্ত, চিত্তের দৃঢ়তা, একাগ্রতা, এ ধরনের মানসিক গুণগুলির সমন্বয়ে যদি প্রার্থনা করা হয়, তাহলে আমরা ঈশ্বরের সাথে এক হয়ে যেতে পারি, নিজের আত্মাস্থিত চৈতন্যকে জাগাতে পারি এবং এমন প্রার্থনাই প্রকৃত কল্যাণের পথ দেখায়। ঈশ্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আধ্যাত্মিক জীবনই এ পৃথিবীর মঙ্গলের সর্বোত্তম উৎস।
ঈশ্বরের বিধান ভেঙে মানুষের ক্ষতি করে কেউ কেউ অবশ্য উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায়। ভালো মানুষ বিপদে পড়ে, খারাপ লোকেরা দিনদিন ভালো অবস্থানে যায়। ভালো মানুষ সাময়িক কষ্ট পেলেও খারাপ মানুষ তার কর্মফল ভোগ করে নিখুঁত হিসেবে। ঈশ্বরের বিধানে জীবন কাটায় যারা, তাদের জীবনে সাময়িকভাবে যা যা দুঃখ আসে, সেগুলি বরং তাদের ধৈর্য ও মনের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। আর খারাপ লোকেরা একসময় পদে পদে ব্যর্থ ও দুর্বল হতে থাকে, যা স্পষ্ট করেই চোখে দেখা যায়। যার জীবনের চালিকাশক্তি অন্যায় ও অবিচার, তার পক্ষে সাধুতার ঐশ্বর্য আস্বাদন করা সম্ভব নয়। মিথ্যা টিকে থাকে কিছু সময়ের জন্য, আর সত্যের স্থায়িত্ব চিরকালের। যা সত্য, তা বদলানোর কিছু নেই; কিন্তু মিথ্যা যা-কিছু, সেগুলিকে বদলে বদলে টিকিয়ে রাখার দরকার হয়। খারাপ লোকের ঘর নির্মিত হয় বালি দিয়ে, ভালো লোকের ঘর নির্মিত হয় পাথর দিয়ে। শুরুতে টের পাওয়া যায় না, তবে সময় হলে দেখা যায়, ঝড়বৃষ্টি যা-ই আসুক, ভালো মানুষের ঘর ঠিকই টিকে থাকে সব সহ্য করে, কিন্তু খারাপ লোকের বালির ঘর চোখের পলক ফেলার আগেই ভেঙে ঝরে পড়ে। এর নামই কর্মফল বা ঈশ্বরের বিচার। এই বিচারপ্রক্রিয়া ধীর, তবে অনিবার্য।