প্রশ্ন: সমালোচকদের কথাগুলো আপনি কীভাবে গ্রহণ বা বর্জন করেন?
উত্তর: সমালোচকদের বর্জন করার কোনও কিছু নাই, সমালোচক থাকবেই। যারা কোনও কাজ করে না, তাদের কোনও সমালোচক নাই। যারা কাজ করে, তাদের সমালোচক থাকবেই। সমালোচনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার একটাই পথ---কাজ-টাজ না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা! সেটা যদি তুমি করতে না পারো, তবে তোমার সমালোচক থাকবেই।
আর সমালোচনাকে আমি কীভাবে ট্যাকেল করি বা হ্যান্ডেল করি, তাই তো? আমি প্রথমে দেখে নিই, যিনি সমালোচনা করছেন, তিনি আমার ওয়েল-উইশার কি না। তিনি যদি আমার ওয়েল-উইশার হন, তাহলে আমি বুঝতে পারি, তিনি আমার ভালোর জন্য কথাটা বলেছেন এবং সেটাকে আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করি। যদি তিনি আমার ওয়েল-উইশার না হন, তাহলে দেখা যায়, তিনি নিজেকে বড়ো দেখানোর জন্যই সমালোচনাটা করলেন!
আমরা অনেকেই বড়ো হতে পারি না। তখন আমরা অন্যকে ছোটো করি এবং মনে করি, আমি তো বড়ো হয়ে গেলাম! এটা বড়ো হবার কোনও টেকনিকই না। ইগল পাখি প্রাণিজগতে বা পাখিদের জগতে অনেক উপরের স্থানে অবস্থান করে। তাকে সবাই ভয় পায়। কিন্তু সেই ইগল পাখির ঘাড়ে উপর বসে ইগল পাখিকে ঠোকরাতে পারে একটাই পাখি। ওই পাখির নাম হচ্ছে কাক, যাকে আমরা কেউই পাত্তা দিই না! ইগলকে কিন্তু সবাই পাত্তা দেয়। কাক যখন ইগল পাখির ঘাড়ে বসে তাকে ঠোকরায়, তখন ইগল পাখি তাকে কিছু করে না এবং এ সাহসটা কাক ছাড়া আর কারও নাই। কেননা কাক ইগল পাখি চেনে না। কাক যখন ঠোকরায়, তখন ইগল পাখি তাকে সরানোর চেষ্টা করে না, বকাঝকা করে না, কিছুই করে না। তখন ইগল পাখি করে কী, আরও উপরের দিকে চলে যায়, আরও দ্রুত গতিতে উড়তে থাকে। ইগল পাখি যত দ্রুত গতিতে উড়তে থাকে, তত দ্রুত গতিতে কাক উড়তে পারে না, অতটা গতির সাথে কাক পাল্লা দিতেই পারে না! এবং যখন ইগল অনেক উপরে উঠে যায়, তখন আস্তে আস্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা হয়, আর এই স্বল্পতায় কাক ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারে না। কাকটা তখন বাধ্য হয়ে করে কী, ছিটকে পড়ে ওখান থেকে।
তাই যারা এই মুহূর্তে আমাকে ঠোকরাচ্ছে, যদি আমি নিজেকে আরও উপরে নিয়ে যাই, এতটাই উপরে যে তারা আমাকে ছুঁতেই পারবে না, আমাকে ছোঁয়ার সাহসই করবে না, সেটাই কিন্তু সবচাইতে ভালো জবাব। আমি সেটাই করার চেষ্টা করি। আর যখন দেখি, যে আমার সমালোচক, তাকে আমি আমার কোনও ভালো কাজে কখনও দেখিনি, সে কখনও আমার কোনও ভালো কাজে বাহবা দিতে আসেনি, কিন্তু যেই আমি একটা খারাপ কাজ করেছি বা ভুল কাজ করেছি, তখনই সে ওখানে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এসেছে, তাহলে সে লোক তো আমার ভালো চায় না, সে তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী না, আমার মঙ্গলকামী না। ফলে তাকে আমি পাত্তা দিই না, তার কোনও কথাকে আমি গ্রাহ্যই করি না।
আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ; উইলিয়াম শেক্সপিয়রকে যদি নাট্যকার হিসেবে এক নম্বর অবস্থানে ধরি, তাহলে জর্জ বার্নার্ড শ'কে আমরা নাট্যকার হিসেবে দ্বিতীয় সেরা ধরব। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সবচাইতে বড়ো সমালোচক ছিলেন এই জর্জ বার্নার্ড শ! তিনি তাঁর (শেক্সপিয়র) নাটক নিয়ে বিশ্লেষণ করে একেবারে ধুয়ে ফেলতেন, ছেড়ে কথা বলতেন না। এখন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সমালোচনা করতে পারেন বার্নার্ড শ। কেননা বার্নার্ড শ নিজেও একজন মহৎ নাট্যকার। কিন্তু উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সমালোচনা যদি করত আমাদের পাড়ার সলিমুদ্দিন কলিমুদ্দিন—যে জীবনে নাটক লেখেওনি, নাটক বোঝেও না, নাটক সম্পর্কে কিছু জানেও না, সে যদি উইলয়াম শেক্সপিয়রের ফেইসবুক-ওয়ালে গিয়ে লিখে আসত, আপনি নাটকের ঘোড়ার ডিম লিখতে পারেন, আপনি কিছু পারেন না, তাহলে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের উচিত, সলিমুদ্দিন কলিমুদ্দিনের কমেন্ট ডিলিট করে দেওয়া, তাকে ব্লক করে দেওয়া কিংবা ওই কমেন্টটাকে গ্রাহ্যই না করা।
কখনোই এমন কারও সমালোচনাকে গ্রাহ্য করবে না, যে লোকটা তোমার কাজ সম্পর্কে জানেই না। তুমি ফটোগ্রাফার, যে লোকটা ফটোগ্রাফি বোঝেই না, ফটোগ্রাফি অনুভব করতে পারে না, তার কাছ থেকে ফটোগ্রাফি সম্পর্কে সমালোচনা গ্রহণ করার কোনও মানে হয় না। যে লোকটা সিনেমা বোঝে না, সে লোকটা থেকে সিনেমা সম্পর্কে সমালোচনা নেবার কোনও মানে হয় না। যে লোকটা লিখতে পারে না বা লেখা বোঝে না, তার কাছ থেকে লেখালেখির সমালোচনা নেবার কোনও মানে হয় না। এটা আমি মনে করি।
আরেকটা বিষয় বলি, যদি আমার কখনও কোনও পরামর্শের দরকার হতো, তখন আমি যে মানুষটার কাছে পরামর্শ চাইতে যেতাম না, যে মানুষটাকে আমি পরামর্শদাতার আসনে বসাতে চাই না, সেই মানুষটা যদি আমাকে পরামর্শ দিতে আসে বা আমার সমালোচনা করতে আসে, তাহলে আমি কখনোই তার সমালোচনা গ্রাহ্য করি না। এমন উটকো গায়ে-পড়া লোকের কোনও প্রকার সমালোচনাই আমি গ্রহণ করি না।
আরেকটা জিনিস মনে রাখবে, যারা সমালোচনা করে, নিন্দা করে, কারও পেছনে লেগে থাকে, তারা সাধারণত সে-ই মানুষ, যে মানুষ, তুমি যেটা করতে চাইছ, সেটা করতে পারেনি। তারা হচ্ছে কিছু ব্যর্থ মানুষ। তুমি যদি তাদের গ্রাহ্য করা শুরু করো, তাহলে তোমার এতটাই সময় নষ্ট হবে যে, তুমি যা করতে চাইছ, তা করতেই পারবে না। সেই মানুষটাকে নিয়েই লোকজন বেশি সমালোচনা করে, যে মানুষটার ওই লোকজনকে চেনার কোনও সময়ই নাই। এ কারণেই ওই লোকজনকে বলা হয়েছে আমজনতা, আর তাঁকে বলা হয়েছে বিশেষ কেউ। পাবলিক অলওয়েজ পাবলিকই থাকে। এখন তুমি নিজেকে পাবলিকের মধ্যে রাখবে, না কি তাঁর কাতারে নিয়ে যাবে, ইটস আপ টু ইউ!
কোনোদিনই কোনও ব্যক্তির পেছনে লেগে থেকে তাঁর সামনে যাওয়া সম্ভব না, এটা সবসময় মনে রেখো। তাঁর সামনে যেতে হলে তাঁর কাজের পেছনে লাগতে হবে, তাঁর পেছনে লাগার দরকার নাই। বাজে সমালোচক তারাই, যারা কাজের সমালোচনা করতে পারে না বলে ব্যক্তির সমালোচনা শুরু করে দেয়। একজন ব্যক্তি যে কাজটা করছে, ভালো সমালোচক সে কাজের সমালোচনা করবে, সেই পয়েন্ট থেকে সমালোচনা করবে। আর বাজে সমালোচক ওই ব্যক্তির সমালোচনা করা শুরু করবে। তার একটা দাঁত বাঁকা, সে হাসির সময় ঠোঁটটাকে বাঁকা করে ফেলে, তার চরিত্র ভালো না, সে বাজে, সে দেখতে এমন, সে দেখতে তেমন, সে পরীক্ষায় ফেইল করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কবির ওয়ালে গিয়ে যে লোক লেখে, কবির চরিত্র খারাপ, বুঝতে হবে, সে-ই লোকের দুঃখের উৎস আসলে অন্য কোথাও।
একটা কবিতার সমালোচনা করার সময় যদি বলতে হয়, কবি পরীক্ষায় ফেইল করেছে, তাহলে বুঝতে হবে, পরীক্ষায় পাশ করা কাহাকে বলে, ফেইল করা কাহাকে বলে, সে কেবল অতটুকুই বোঝে! কবিতা আর বোঝে না! তাকে তো আমি সমালোচক বলতে রাজি নই। তাকে আমি নিন্দুক বলতে রাজি। নিন্দুক এবং সমালোচকের মধ্যে পার্থক্য আছে। নিন্দুক স্রষ্টার পেছনে লাগে, সমালোচক সৃষ্টির পেছনে লাগে। যাদের মেন্টাল ম্যাচুরিউটি নাই, তারা সমালোচনা করতে গিয়ে নিন্দুক হয়ে পড়ে। আমার লেখায় লোকজন কী পরিমাণে যে উলটাপালটা কমেন্ট করে, এটা তো তোমরা দেখো, ফেইসবুক দেখলেই বঝতে পারবে। প্রথম দিকে আমি খুব রাগ করতাম; এখন মনে হয়, সে তো এর চাইতে বেশি কিছু করতে পারবে না। সে একটা গালি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। আমার লেখা নিয়ে বললে আমি খুশি হতাম, কিন্তু সে তো লেখা নিয়ে কিছু বলতে পারবে না, লেখা নিয়ে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তো লেখা বোঝেই না!
আবার আরেক ধরনের মানুষ খুব ক্ষতি করে। যাঁরা লেখালেখি করেন বা যাঁরা ক্রিয়েটিভ, তাঁদের বলছি। কিছু মানুষ পাবেন, যারা আপনার লেখা পড়ে না, আপনার লেখা বোঝেও না! কিন্তু শুধু শুধু একটা লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়ে বসে থাকে। আই লাভ ইউ! অসাধারণ লিখেছেন!! এই লোক কিন্তু পড়ে নাই, না পড়েই বলেছে, অসাধারণ লিখেছেন, চালিয়ে যান! অসাধারণ লেখা হয়েছে!...আমি আপনাকে একদম গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সে পড়েই নাই আপনার লেখা!! আমি কিন্তু বুঝতে পারি, কারা লেখা পড়ে আর কারা লেখা পড়ে না। এটা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারি। যারা আপনাকে এভাবে একদম অন্ধভাবে পছন্দ করে বিধায় আপনার যে-কোনও লেখায় বলছে…অসাধারণ, এমনকী ধরুন, কেউ একজন কমেন্ট করেছে, যার নাম রায়হান উদ্দিন; আপনি যদি আপনার লেখার কোনও একটা জায়গায় লেখেন, রায়হান উদ্দিন নামে একজন বলদ আছে, তাহলে সে ওখানেও কমেন্ট করবে, অসাধারণ, দাদা!
আবার আমার লেখাতেই কিছু মানুষ লাইক দেয়, কমেন্ট করে কেন, জানো? তারা ভাবে, লাইক দিলে যদি বিসিএস প্রিলিমিনারিটা পাশ করে ফেলতে পারি, তাহলে অসুবিধা কী! দিই না একটা লাইক…একটা লাইকই তো! আবার অনেকে আমাকে পছন্দ করে, কোনও-না-কোনও বিচিত্র কারণে আমাকে পছন্দ করে। তারা আমার লেখা না পড়েই লাইক দেয়, আমার লেখা না পড়েই কমেন্ট করে। এক্ষেত্রে আমি খুব দুর্ভাগা। আমি ভালো পাঠক খুব কম পেয়েছি; একেবারে যে নেই তা-ও না, কিছু ভালো পাঠক আছে আমার। আবার এমন মানুষও দেখবে, তুমি একটা ভালো লেখা লিখেছ, সে তোমার লেখার একজন ভালো পাঠক। সে তোমাকে লাইকও দেবে না, কমেন্টও করবে না। কিন্তু সে তোমার লেখাগুলো পড়ে। লাইক দেয় না কেন? কমেন্ট করে না কেন? তার আলসেমি লাগে, তাই লাইক দেয় না, কমেন্টও করে না।
আবার অনেকসময় কেউ কেউ ভাবে, লাইক দিয়ে ছোটো হব! দরকার কী একটা লাইক দেবার? থাক! তার কাছে একটু ভাব-টাব নিই! আরে ভাই, আপনার লেখা দেখার সময়ই আমার নাই! সে কিন্তু আপনার লেখা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। কখন আর কীভাবে বুঝবে? তুমি এমন একটা লেখা লিখো, যে লেখাটা ভালো না, যে লেখাটাতে তুমি একটা ভুল তথ্য দিয়েছ। কিংবা তুমি তোমার এমন একটা ছবি পোস্ট করেছ, যে ছবিটা তার ভালো লাগছে না। সে কিন্তু ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে তখন ভাবে, এখন তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে হবে। পাইসি তোরে, খাইসি তোরে!---একদম ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে! এ ধরনের লোকেদের কখনোই পাত্তা দিয়ো না।