রিক্ত ও ঋদ্ধ

সাংবাদিক বন্ধু মুর্তজার সাথে হঠাৎ দেখা। তখন চারিদিকে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের পিচঢালা রাস্তাটার মাঝে পানি জমে উঠেছে। রাস্তাটার যে অনেক দিন সংস্কার হয়নি, তা সহজেই বোঝা যায়। এমন করে যে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হতে পারে, তা আগে থেকে ভাবা যায়নি। আর আকাশ তার সমস্ত ব্যথা চেপে রাখতে না পেরে এমন করে যে কেঁদে উঠবে, আমিও তা কল্পনা করিনি। এখন চলছে বিদ্যুৎ-খেলা, আর মুক্ত প্রসারিত আকাশটা যেন ক্ষতবিক্ষত—যেন সে ব্যথার কথা বলে বলে হালকা হতে চাইছে। তার অশ্রু, তার রোদন, তার হিংস্র হাসি শহরের প্রাণীগুলোর মাঝে যে কী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে, সেদিকে তার যেন খেয়ালই নেই।




হ্যাঁ, চা-দোকানের এককোনায় বসে বসে আকাশ নিয়ে এসব ভাবছিলাম। মুর্তজার কলম-ধরা হাতটা হঠাৎ কাঁধের উপর এসে ঠেকতেই স্বাভাবিকভাবেই কল্পনার জাল ছিন্ন হয়ে গেল, খেই হারিয়ে ফেললাম, চোখদুটো চারিদিকে ঘুরিয়ে আনলাম; দেখলাম, চা-দোকান বেশ জমে উঠেছে। একবার ভাবলাম, মুর্তজাও বুঝি-বা আমার চারপাশের বৃষ্টি-কবলিতদেরই একজন। তাই একটু রসিকতা করেই বললাম, এ অসময়ে সাংবাদিক সাহেবের সামান্য চা-স্টলে আগমনের হেতু? সে উত্তর দিল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। তা আজকাল যে দেখাই পাওয়া যায় না, প্রেমে-ট্রেমে পড়েছেন নাকি? সত্যিই বন্ধুবর মুর্তজার সাথে আটচল্লিশ দিন পর দেখা, তবে তার অভিযোগটা মিথ্যে। কারণ সে ভালো করেই জানে, আমার কাছে কোনো হতভাগিনী প্রেম নিবেদন করতে আসবে না।




কলেজের বন্ধু মুর্তজা অনার্স পাশ করে জার্নালিস্ট হয়েছে। আর আমি? নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তান, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়েছি, আইএ পাশ করে।




মুর্তজা সামনের চেয়ারে বসল। কারুকার্য-করা চটের থলি থেকে ওদের পত্রিকায় ছাপানোর জন্য পাওয়া একরাশ কবিতা বের করল। কয়েকটা কবিতা আলাদা করে নিয়ে বলল, তোর কবিতা একটাও সিলেক্ট হয়নি। বলল, আধুনিক কবিতা কিছু পড়। এতে আজকের জীবনের কথা থাকে। জীবনকে না চিনতে পারলে কবিতা লেখা যায় না, ভালো কবি হওয়া যায় না, বুঝলি!




হয়তো মুর্তজার অভিযোগই ঠিক। সে সাংবাদিক, জীবনকে সে হয়তো আমার চেয়ে বেশি চেনে, কিন্তু হায়রে মুর্তজা, বাস্তবের কশাঘাতে জর্জরিত এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চেয়েও কি তুই জীবনকে বেশি চিনিস? তুই তো শুধু 'ওপেন সিক্রেট', আমদানি-রপ্তানি বাজেট এসব নিয়ে লিখতেই ব্যস্ত থাকিস। কখনও কি ফুরসত পাস আমাদের মতো জীবনকে এভাবে দেখতে? তোর ক্যামেরায় বন্দি হয় অফিস কর্মচারীর কাজ ফাঁকি দেবার দৃশ্য, রাস্তার ম্যানহোলের দৃশ্য, চাল পাচারের দৃশ্য, দুধে পানি মেশানোর ছবি, আলু পচনের ছবি। কিন্তু তোর চারপাশে প্রতিপলে মানুষ কী করে পচছে, তা কি দেখেছিস কোনোদিন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কেমন জীবন তুই চিনিস শোনাবি? সে বলল, শুধু শোনাব না, চোখে দেখিয়ে ছাড়ব। আগামীকাল তৈরি থাকিস।




পরদিন বিকাল। আমি তৈরি হয়ে মুর্তজার জন্যে অপেক্ষা করছি। অধীর আগ্রহে পায়চারি করছি আর ভাবছি, কী ধরনের জীবন মুর্তজা আমাকে দেখাবে? সেখানে কি গল্প লেখার মতো প্লট খুঁজে পাওয়া যাবে? এসব কথা ভেবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখি, মুর্তজা সশরীরে উপস্থিত। দরজা আমাদের খোলাই থাকে, কারণ মেসের দরজা একজনের নয়।




বললাম, আমি তৈরি।




ও বলল, যদি তোর ভেতরে শিল্পীর অণুমাত্র‌ও হৃদয় থাকে, তাহলে আমার বিশ্বাস, তুই ফিরে এসে সত্যি কথাগুলোকে সাজিয়ে লিখলেও একটা উৎকৃষ্ট গল্প হবে।




বললাম, ভণিতা রাখ, কোথায় নিয়ে যাবি, চল।




রিকশায় উঠে মুর্তজা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠল। তার চোখে-মুখে একটা বিষণ্নতার ছাপ। আর সেই সাথে বুঝি-বা একটু ঘৃণারও! সে বলল, আজ তোকে যার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, সে এক পুড়ে ছাই-হয়ে-যাওয়া শিল্পী। নিয়তির নির্মম পরিহাসে সে এখন পঙ্গু। নেপথ্য থেকে সে শুধু ছবি তাঁকে। আর তার রক্তমাংস, চেতনা, মজ্জা আর পরিশ্রমকে পয়সার বিনিময়ে কিনে নিয়ে খ্যাতিমান হচ্ছে একজন সাধারণ শিল্পী। বলল, তমাল, তোর কি মনে পড়ে, কিছুদিন আগে একটা চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল, যাতে আকবর হোসেন নামে একজন শিল্পী বছরের সেরা চিত্রশিল্পী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল? বললাম, হ্যাঁ। মুর্তজা বলল, সেই শিল্পকর্মগুলোও ছিল এ হতভাগ্য শিল্পীর। একদিকে আকবর হোসেন দিন দিন যশ, সম্মান আর খ্যাতির উচ্চআসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে এই হতভাগ্য পঙ্গু, যুবক বস্তির অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।




কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললাম, শিল্প নিয়েও কি কারসাজি চলে? বলল, হ্যাঁ, চলে। তোকে আজ সবই শোনাব, সবই জানাব, সবই দেখাব।




রিকশা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কয়েকটি বাড়ি ডিঙিয়ে গলি দিয়ে একটা বস্তিতে এসে উপস্থিত হলাম। দু-চারটে কুঁড়েঘরের পর একটি কুঁড়েঘরের সামনে এসেই থমকে দাঁড়াল মুর্তজা। ভেতর থেকে দুটি চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। মুর্তজা চুপিচুপি ঘরের বাইরের দিকের এককোণে আমাকে টেনে নিয়ে বলল, ওই দেখ। ভেতরে উঁকি মেরে দেখলাম, প্রদর্শনীতে দেখা সেই উঠতি শিল্পী দাঁড়িয়ে আছে একপাশে, যার ভূয়সী প্রশংসায় প্রদর্শনীকক্ষ সেদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। পুরস্কার পাবার পর যার চারপাশে বিভিন্ন আলোকচিত্রশিল্পী ও সাংবাদিককে দেখা গিয়েছিল। সেই স্বনামধন্য শিল্পী আকবর হোসেনকে তাকে বলতে শোনা গেল, এ কটা টাকা রাখো; আর হ্যাঁ, গোটা দুই ছবি এঁকে রেখো, কেমন? আর পুরোনো ছবির ফাইলটা দাও। ও হ্যাঁ, কোনটার কী নাম, তা লিখে রেখেছ তো? আমি তাহলে আসি, কেমন?




আকবর চলে যাবার পর ধীরপায়ে আমরা ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম, শিল্পী পুরোনো বিছানার উপর বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভাবলেশহীন সে দৃষ্টি। তার সেদিনের সে চাহনিতে কী ফুটে উঠেছিল, তা এখনও আমি উদ্ধার করতে পারিনি। সে চাহনিতে কি বিদ্রূপ ছিল? না কি ব্যঙ্গ? না কি পরিহাস, না অসহায়তা? কী ছিল সেখানে? ঘৃণা? অভিমান? আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। 'শ্যামল ভাই' বলতেই শিল্পী ফিরে তাকাল। মুর্তজা পরিচয় করিয়ে দিল। মার্জিত, সংযত ভাষায় শিল্পী আমাদের বসতে বললেন হাতল-ভাঙা দুটি চেয়ারে।




ঘরে ঢোকার পর থেকেই আমার অস্বস্তি বেড়ে উঠছিল। বিড়ি ও আনুষঙ্গিক অন্য দুটো জিনিসের গন্ধ সমস্ত পরিবেশকে নোংরা করে রেখেছে। নড়বড়ে চৌকির ওপর তেল-চিটচিটে বালিশ, মশারির নটের প্রতিটি ছিদ্রে ময়লার প্রবেশ, নোংরা বিছানায় তালি-দেওয়া চাদর, ছোট্ট টেবিল, তার উপর অনেকগুলো বই, রং, তুলি, ড্রয়িংপেপার কেমন যেন সব অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো। আমার সন্ধানী দুটো চোখ যখন এসব খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন শিল্পীর কথায় সংবিৎ ফিরে পেলাম।




আপনি বুঝি গল্প লেখেন? চেষ্টা করি। অট্টহাসি হেসে বললেন, প্লটের খোঁজে এসেছেন বুঝি এখানে? হাসির সঙ্গে তাঁর গলা থেকে নিঃসৃত হল খকখক কাশির আওয়াজ। তাঁর কথায় কোথায় যেন লজ্জা পেলাম। বুঝলাম, ধরা পড়ে গেছি। অবশ্য সেই সাথে বুঝলাম, শরীরের উপর বেশ অত্যাচার করেন। বললাম, যদি চান্স পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ কী?




অতিকষ্টে কাশি থামিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করলেন, আজ আমার জীবন নিয়ে মানুষ গল্প লিখতে আসে, ভাবতে আশ্চর্য লাগে!




জানেন, পৃথিবীতে সবাই স্বার্থপর। আকবর, সে আসে ছবি কিনতে। শাঁওলি এখন সুখে আছে, জীবনের সব অনুষঙ্গ নিয়ে পরিপূর্ণ। আজমল, সে-ও নিজেকে নিয়ে বেশ আছে। তামান্না আজ অন্যের জীবনের সুখের অর্গল খোলার কাজে ব্যস্ত; আর মুর্তজা, তুমিও বন্ধুকে সঙ্গে করে আজ গল্পের প্লট খুঁজতে এসেছ! বেশ ভালোই সব কিছু। বেশ ভালো। তোমরা সবাই বড়ো হও, সুখী হও...। একটি আবেগাপ্লুত কণ্ঠের ঘৃণিত উচ্চারণ, আকুল প্রার্থনা, উপেক্ষার সুর অন্তরাত্মা ছাপিয়ে আমাকেও স্পর্শ করছে। বাধা দিলাম না, মুর্তজা বেশ বিব্রত বোধ করতে লাগল।




অথচ এমন একদিন ছিল, যখন এমন ছিলাম না। গ্রাম্য মাতবরের ভাইপো আমি। শৈশবে বাবা মারা গিয়েছিলেন। মা-বাবা শখ করে নাম রেখেছিল শ্যামল। সেই শ্যামলের আজ ধূসর অপমৃত্যু ঘটেছে, সে শ্যামলিমা এখন রৌদ্রের উত্তাপে দগ্ধ। দুটি সন্তান রেখে বাবা মারা যাবার পর মা বড়োই বিপদে পড়লেন। তবুও বাবার রেখে-যাওয়া জমিজমার উপর ভিত্তি করে তিনি আমাদের মানুষ করতে লাগলেন।




স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর মেজাজ তখন ঠিক থাকত না, তাঁর আদর আমি ঠিকমতো পেতাম না। মনে হতো, আমার মা বুঝি আমায় ভালোবাসে না। তাঁর সেই কড়া শাসন, ঝাঁঝালো কথা আমার ভালো লাগত না, মাকে আমি ভীষণ ভয় করতাম। বলতে বলতে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। অথচ আমি ভুল বুঝেছিলাম মাকে, আমি চিরকালই সেন্টিমেন্টাল। কেন যেন মায়ের সব কথাতেই মনে হতো, তিনি আমায় ভালোবাসেন না, আমি আনমনে দুপুরে বড়ো পুকুরের ধারে গাছের ছায়ায় বসে ধানখেতের ওপর বাতাসের খেলা দেখতাম। চাইতাম প্রকৃতির সাথে নিজেকে মিশিয়ে অন্তর্দাহ নিবারণ করতে।




তা ছাড়া চাচার অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীদের ঘৃণা, ভ্রূকুটি, এসব থেকে রক্ষা পাবার জন্যেও আমি হারিয়ে যেতে চাইতাম, থাকতে চাইতাম সবার আড়ালে। স্কুল পালাতাম। নিসর্গ তখন আমাকে মুগ্ধ করত। আমি কেমন যেন খেয়ালি উদাসীন হয়ে উঠেছিলাম। কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি কি তখন ছবি আঁকতেন। হ্যাঁ, হারিকেনের আলোতে বসে বসে রাতভর ছবি আঁকতাম। সারাদিনের দেখা ছবি রোমন্থন করতাম যেন। সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, কখন থেকে এবং কোন উৎস থেকে আপনার ছবি আঁকার ঝোঁক শুরু হলো?




বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ভয় আর অবহেলাই আমাকে ছবি আঁকাত। আর এখন অবচেতন মনের ঘৃণার গভীরতা থেকেই অধিকাংশ ছবি আঁকি। শিল্পীর প্রথম ছবি দেখলাম; তাতে আছে, একটি সাপ একটি শিশুকে তাড়া করছে। আট বছর বয়সে আঁকা ছবি। জিজ্ঞেস করলাম, সাপটা কীসের প্রতীক? বললেন, আমার মায়ের। এরকম অনেক ছবিই দেখলাম, যেখানে তার চাচা রূপায়িত হয়েছে হিংস্র প্রাণীতে। নিসর্গ চেতনার ছাপ‌ও তাঁর ছবিতে বিস্তৃত ছিল। আরও অনেক ছবি আছে আকবরের কাছে। আমি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মুর্তজা বলল, আগে কথা শেষ করতে দে, তারপর জিজ্ঞেস করিস।




শিল্পী বলে চলল, এসব কিছুর মাঝেই আমার কাল কাটছিল। ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলাম। এবং তা-ও বেশ ভালোভাবেই টের পেতে লাগলাম। সেদিন মনে হলো, এই কুলকুল বেগে বহতা বাতাস, সবুজ ধানের খেত, ভিজে মাটির ঘ্রাণ, গাছের ছায়া, নিবিড় সবুজ প্রান্তর আর সাত রঙের খেলায় ভরা আকাশ—এ সবের মাঝে থেকেও আমি শূন্য।




একদিন পুকুরঘাটে কলস নিয়ে আসা শাঁওলিকে গোধূলিবেলায় দেখে মনের ভেতর গভীর কান্নার মতো কিছু টের পেলাম। তা ছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম যে, শাঁওলিও যেন আমার প্রতি কিছুটা উন্মুখ। স্থির থাকতে পারলাম না। ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। সমাজ, সংস্কার, পরিবেশ সব কিছু ভুলে গিয়ে আমি তার দুটি হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিলাম। বললাম, শাঁওলি, তোকে আমি ভালোবাসি রে। শ্যামল ভাই… লাজুক মেয়ে আমার বুকের ওপর মুখ লুকোল।




তার সে উষ্ণ নিঃশ্বাস অপূর্ব লাগছিল। কিন্তু ভালোলাগাটা বেশিক্ষণ টিকল না। আমাদের পাড়ার একজনের চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। ক্রমে তার কৃপায় সবাই জানল। এর পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে, তা তখনও জানার বাকি ছিল। কেলেংকারিটা শত-সহস্র শাখায় রটে গেল। গ্রামের রক্ষণশীল সমাজের চোখে আমাদের ভালোবাসা পরিণত হলো মুখরোচক কুৎসিত আলাপ হিসেবে। চিরকাল পালিয়ে-বেড়ানো স্বভাবের ছেলে আমি। এই বিশ্রী কথাবার্তা সহ্য করতে পারলাম না। তা ছাড়া তখন শাঁওলির বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। তাই বুঝলাম, গ্রাম থেকে চলে না গেলে এ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।




গ্রাম ছাড়ার আগে শাঁওলির সাথে একবার দেখা করতে যাব ভাবলাম। শুধু এটুকু শুনতে চাই, সে আমাকে ভালোবাসে কি না। শাঁওলি আমাদের গ্রামের ডাক্তার ভুঁইয়ার মেয়ে। ছোটোকালে একসাথে খেলাধুলা করেছি। তারপর ও শহরে পড়াশুনা করেছে, বাবার সাথে থেকে। বাড়িতে তখন বেড়াতে এসেছিল। বিদায়ের প্রাক্কালে যখন তার কাছে গেলাম, তখন তার মুখে যে-ঘৃণার বহ্নি দেখলাম, তা আজও আমি ভুলিনি। আমাকে কথা বলতে না দিয়েই ও চেঁচিয়ে বলল, আপনার মতো এমন অকর্মণ্য, অপদার্থ, অসভ্য কাপুরুষকে আমি ভালোবাসি না। আমার জীবনে আপনি যে-সর্বনাশ ঘটিয়েছেন, হয়তো সারাজীবন এর খেসারত আমাকে দিতে হবে। চলে যান আপনি এখান থেকে। লজ্জা করল না এখানে আসতে? মনে আবার কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে এখানে এসেছেন? বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম! ভাবলাম, এ-ই কি সেই শাঁওলি যার সাথে শৈশবে খেলা করেছি, যে পুকুরঘাটে একটা নিবিড় আশার মতো আমার বুকে মুখ লুকিয়েছিল? হায়, পৃথিবীতে এটাই কি স্বাভাবিক!




গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে এলাম। বাঁচার জন্য ভীষণভাবে চেষ্টা করলাম। যেমন জাহাজ ডুবে গেলে অসহায় যাত্রীরা সামান্য খড়ের কুটোকেও বিরাট অবলম্বন মনে করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, তেমনি জীবনসমুদ্রের যাত্রাপথে ভরাডুবি ঘটাতে আমিও এমনি একটি অবলম্বনকে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেছি এবং যত বেদনাদায়কভাবেই হোক, বেঁচেও গিয়েছি।




অবশ্য যে-বালকের স্বপ্ন ছিল গ্রামে বিপ্লব এনে সমস্ত কুসংস্কার আর গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে সেখানে আদর্শ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার, যে-যুবকের আদর্শ ছিল সৎ হয়ে বেঁচে থাকার, সে যুবক, সে বালক শহরে এসে হারিয়ে গেল। সেখানে দেখা গেল শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টায় সংগ্রামী একজন বিপর্যস্ত মানুষকে! বাঁচার জন্যে তাকে ধরতে হলো কালো পথ। সিনেমার টিকিট ব্ল‍্যাক করে, বাজে দলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার পথ তাকে ধরতে হলো। পাশাপাশি শুরু হল এই সিগারেট, মদ আর গাঁজা—সব কিছু ভুলে থাকার জন্যে।




হঠাৎ মুর্তজা বলল, আরে, আটটা বেজে গেল যে! আমার অফিসে আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মিটিং আছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হল। দেখলাম, শিল্পী একহাতে গাঁজার কলকিটা টেনে নিল।




বাইরে এসে মুর্তজাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই এর সন্ধান পেলি কোথায়?




সিনেমা হলে টিকেট করতে এসে এর সন্ধান পাই। সে এক বিরাট কাহিনি। তবে সেদিন এই ব্ল্যাকারের মধ্যে যে আশ্চর্য এক হৃদয় আছে, তা টের পেয়েছিলাম বলেই আজ এতদূর পর্যন্ত আসা।




আচ্ছা মুর্তজা, তুই কি এই শিল্পী সম্বন্ধে অন্য কিছু জানিস না? এর এতগুলি শিল্পকর্ম দেখলাম। তার মধ্যে কেমন যেন ঘৃণা, উপেক্ষা আর অবহেলার বেদনা! আবার অনেকগুলো দুর্বোধ্যও বটে। জীবনের ভালো ভালো দিকের সাথে এর কি একেবারেই সংস্রব ঘটেনি?




মুর্তজা বলল, বোধ হয় তা-ই হবে। প্রথমে শিশুকালের অবহেলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার পথে মানুষের কুটিল ভ্রূকুটি, চাচার অন্যায়কে রোধ করতে না পারার একটা অব্যক্ত দুর্বার বেদনা, গ্রাম্য সমাজব্যবস্থার বৃশ্চিক দংশন, শহুরে জীবনের পঙ্কিলতা, বেঁচে থাকার জঘন্য সংগ্রাম—এসব থেকে সে বুঝতে শিখেছে, জীবন এক যন্ত্রণা বই আর কিছুই নয়। তা ছাড়া ছেলেবেলার প্রাণপ্রিয় এক বন্ধুর উপেক্ষাও তার জীবন ও শিল্পের ওপর হয়তো প্রভাব ফেলে থাকবে, তাই যখন অন্য আর-একটি নারী তার সম্পূর্ণ রমণীয়তা নিয়ে তার মনের দুয়ারে এসে হাজির হয়েছিল, তখনও সে তাকে প্রত্যাখান করেছে। আসল কথা হলো, পৃথিবীর কাছে যে শুধু অবহেলার পর অবহেলাই পেয়ে এসেছে, পৃথিবী তার কাছ থেকে কীভাবে আশা করে ভালোবাসা পাবার।




কে সে রমণী?




মেয়েটির নাম তামান্না। সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে যখন মেয়েটি দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছিল, তখন শ্যামলই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। ও মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়াতে ও নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে মেয়েটির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত শূন্যতা পূরণ করেছিল। খবর পেয়ে তামান্নার বড়োলোক মা-বাবা হাসপাতালে এসেছিল। ভালো হবার পর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছিল তামান্নার মন। এ কৃতজ্ঞতা রূপ নেয় ভালোবাসাতে। কিন্তু মেয়েদের উপর এক আশ্চর্য কদর্য ধারণা থাকায় শ্যামল তাকেও বিশ্বাস করতে পারেনি।




একদিন এক বড়োলোকের কিছু ভাড়াটে গুন্ডার সাথে কিছু বস্তিবাসীর মারামারিতে ও বস্তির লোকেদের পক্ষ নেয়। মারের মুখে বস্তির লোকগুলো পালিয়ে যায়, কিন্তু ও পালায় না। গুন্ডাদের মারের মুখে সে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। অতঃপর হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ঘটনায় তাকে হারাতে হয় তার একটি মূল্যবান পা।




তামান্নার খবর কী?




প্রথম প্রথম সে ওর কাছে হাসপাতালে যেত। কিন্তু কোন মা-বাবা চায়, তার মেয়ে পঙ্গুর হাতে পড়ুক। তা ছাড়া তামান্নাও বুঝতে শিখেছিল রূঢ় বাস্তবকে। তাই সে ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগল। অবশ্য তামান্নারও এতদিনে বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। তারও তো গোটা জীবনটাই পড়ে রয়েছে। শুনলাম, তামান্না নাকি আজকাল কোন যুবকের সাথে ঘুরছে।




তুমি যে বললে, শ্যামলই তামান্নাকে প্রত্যাখান করেছে?




হ্যাঁ, তামান্নাদের পরিবারে সে নিজেকে বেমানান ভাবত।




তোমার কি মনে হয়, পা হারানোর পেছনে ওর কোনো আত্মঘাতী কারণ নেই? মারের মুখে বস্তির সব লোক চলে গিয়েছে, সে যায়নি কেন? আমার মনে হয়, তার কোনো কিছু হলে তামান্না তাকে ভালোবাসবে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্যই হয়তো ওদিন ও অমনভাবে লড়েছিল। হ্যাঁ, আর ওর সেই বন্ধুটার কথা কী যেন বলছিলে?




হ্যাঁ, ওর বন্ধুর নাম তো তুইও শুনেছিস। বিশিষ্ট ডাক্তার মিস্টার আজমল চৌধুরী। শাঁওলি আজ ওর বন্ধু সেই ডা. আজমল চৌধুরীর স্ত্রী।




জিজ্ঞেস করলাম, তার ভাই রশিদও তো ঢাকা শহরেই আছে। ভালো আয় করছে। ওর কাছে ও যায় না কেন?




কারণ রশিদ তার চাচা আর পিতামহের স্বভাব পেয়েছে। পদমর্যাদার জৌলুস আর টাকাই তাদের একমাত্র স্বপ্ন।




বললাম, তাহলে কী হয়েছে?




নিসর্গ যে-যুবককে প্রভাবিত করেছে, স্বাধীনচেতা সে যুবক কি টাকার জন্যে, বিলাসের আবিল পথে জীবননির্বাহ করার জন্যে নিজের সত্তাকে, স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দেবে? আমিও একদিন রশিদের কাছে গিয়ে শ্যামলের কথা বলেছিলাম। সবকথা জেনে সে বলেছিল, ওই চরিত্রহীন ইডিয়টটা এখনও মরছে না কেন? সে আমার ভাই নয়।




সবকথা শুনেও যে-ভাই সহজেই আপন ভাইকে নিজের পদমর্যাদার খাতিরে অস্বীকার করেছিল, সে কখনও শ্যামলের ভাই হতে পারে? শ্যামলকে বলেছিলাম এসব কথা। সে বলেছিল, শাঁওলি, আজমল, আমার ভাই—ওরা সবাই সুখে থাকুক, নেপথ্যে থেকে আমি এটাই দেখতে চাই।




আকাশে তখন মেঘ করে ছিল। রাত দশটা বেজে গিয়েছে, মুর্তজাকে বিদায় দিয়ে মেইন রোড দিয়ে মেসে ফিরে এলাম। সত্যিই মুর্তজা জীবন দেখতে শিখেছে।




পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে মেঘও জমা হয়েছে। প্রতিদিনকার মতো সংবাদপত্র পড়তে বসেছি। শেষ পৃষ্ঠার এককোণে চোখে পড়ল একটা খবর। আগামী পরশু শিল্পী আকবর হোসেনের একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্‌বোধন হবে। টেলিভিশনে ভালো অনুষ্ঠান আছে কি না দেখার জন্যে চোখ বোলাতেই দেখতে পেলাম ‘বিশিষ্ট সুখী দম্পতি’ ডাক্তার আজমল চৌধুরী ও শাঁওলি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার।




ঝুপ ঝুপ করে আজকের দিনের বৃষ্টির সূচনা হলো। ঘন কালো মেঘে আচ্ছাদিত আকাশ। অবিরল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। হয়তো শাজাহানপুরের সে বস্তিতে ছাদ ফুটো হয়ে জল ভেতরে পড়ছে। আর ভিতরে একটি পঙ্গু ধুঁকে ধুঁকে গাঁজা খাচ্ছে।




শিল্পী আকবর, তুমি বড়ো হও। শাঁওলি, তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো, সুপুরুষ ডা. আজমলের সুখী পত্নী হয়ে বেঁচে থাকো। আজমল, তুমি সম্মান আর খ্যাতির উচ্চশিখরে ওঠো, কিন্তু তোমরা দু-জন তোমাদের ছেলেটিকে স্নেহ কোরো, যাতে সে আমার মতো স্নেহের কাঙাল না হয়। তামান্না, তুমিও, তোমাদের সমাজের যাকে বিয়ে করেছ, তাকে নিয়ে সুখী হও। আশীর্বাদ করছি তোমাদের সবাইকে।




বৃষ্টির জলের সুরে একাত্ম হয়ে শুনতে পেলাম একটি ক্ষতবিক্ষত যুবকের হৃদয়-নিংড়ানো আশীর্বাদ, আকুতি, প্রার্থনা। সে যুবকের চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ছে হয়তো অবিশ্রান্ত জলের ধারা। কারণ প্রকৃতির নিয়মই যে বয়ে চলেছে তার রক্তে…প্রতিপলে, প্রতিমুহূর্তে। প্রকৃতির মতো তার মাঝেও তো আছে দুঃখ, আছে জীবনের অভিযাত্রা। হয়তো সে-ও আজকের খবরের কাগজের সব খবর পড়ে ব্যথা চেপে রাখতে না পেরে হু-হু করে কেঁদেই চলেছে এই বর্ষাদিনটির মতো। হয়তো বৃষ্টির জলের সাথে এক হয়ে যাবে তার কান্না। আর তার ক্ষুদ্র ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠে আশীর্বাদ করবে ওদের সবাইকে—তোমরা সবাই ভালো থেকো, তোমাদের সবার মঙ্গল হোক।
Content Protection by DMCA.com