আমার কাছে প্রায়ই একেবারে পিছিয়ে থাকা লোকজন ক্যারিয়ার নিয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি নিতে আসে। ২টা কারণে। এক। আমি একেবারে বেকুবের মত প্রশ্ন করলেও ঝাড়ি দেই না। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করার জন্যে আমার চাইতে আপন আর কেউ হয় না। দুই। ওরা আমাকে আপন-আপন ভাবে। এর মানে, ওরা বিশ্বাস করে আমি গাধা থেকে মানুষ হইসি। অতএব, আমার বুদ্ধি শুনলে গাধা থেকে মানুষ হওয়া যাবে। ওদের এই আপন করে নেয়া আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, কেউই চিরদিন গর্দভ থাকে না। এবং আমি যে কত উন্নত জাতের ছাগল ছিলাম, সেটাও মনে পড়ে যায়। আমি আপনমনে হাসতে থাকি—সুখের হাসি।
ওরা আসলে, আমি যত ক্লান্তই থাকি না কেন, সময় দিই, কথা বলি। আজকেও এসেছিল। আমার পোস্টিং এখন এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরেছি রাত ১০টায়, কাল ভোর ৫টায় আবার ডিউটিতে ছুটতে হবে। আমি ‘না’ বলতে পারি না, তাই অনেকে আপন ভেবে আসে, দুঃখের কথা বলে। আমি মন দিয়ে শুনি, ওদের বিশ্বাস করিয়ে দিই, ওরা দুনিয়ার সবচাইতে দুঃখী মানুষ না। আমি লেখার সময় যেমনই লিখি না কেন, আমার কথাবার্তা বলার ধরন বেশিরভাগই ছাগলাছাগলা টাইপের বিধায় ওরা আমাকে কিছুতেই দূরের কেউ ভাবতে পারে না। ওরা শান্তিশান্তি অনুভব করে, আমিও করি। কেউ যদি বলে, ও কিছুই পারে না, আমি বলি কেবল বলদরাই সবকিছু পারে। আহা! এতে ওরা বড় খুশি হয়। তবে, আমি শুধু এইটুকুই বলে ছেড়ে দিই না, কিছুই না পারলে কী করলে কিছুই না পেরেও ঝামেলা এড়ানো যায়, সেই বুদ্ধিটাও দিয়ে দিই। কেন দিই? আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ!
এতে কিছু লাভও হয়। পুরনো দিনের স্মৃতির রোমন্থন হয়। এই যেমন আজকে একটু আগে কথা বলতে-বলতে মনে পড়ে গেল, আমি একসময় দোকানদারি করতাম। আমার গিফটের দোকান ছিল। আমিও আর দশটা দোকানদারের মত রাস্তা থেকে লোকজনকে ডেকে-ডেকে গিফট বেচতাম। (আমি এক জায়গায় খালি একটু আলাদা ছিলাম। সেটা হল, শালার পড়াশোনা আমার প্রেস্টিজটেস্টিজ একটু বাড়ায়ে দিসিল, তাই লোকজনকে ডাকতে শরম লাগত। কেউ দয়া করে দোকানে এলে ভুজুংভাজুং বলা শুরু করতাম আর জিনিস বেচতাম। তবে, আমার ‘দোভানা’র আসলেই সুনাম ছিল। দোভানা আমার গিফটশপের নাম ছিল। দোকানে হিউজ কালেকশন ছিল। কিছু রেয়ার জিনিস শুধু আমার দোকানেই পাওয়া যেত। হলমার্ক আর অর্চিস-এর অনেক রেগুলার কাস্টমার আমাদের রেগুলার কাস্টমার হয়ে গেসিল, মানে আমরা ভাগায়ে আনসিলাম, কিংবা ওরাই ভেগে আসছিল। দোকান বেচে দিয়েছি অনেক আগে। দোকান নেই, স্মৃতি রয়ে গেছে।) পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে এক টাকা দিয়ে জিনিস কিনে লোকজনকে ভংচং বলেটলে দুই টাকায় বেচতাম। আমার পাশের দোকানের ক্লাস ফাইভ-সিক্স পাসকরা দোকানদারের সাথে আমার কোনও তফাৎ ছিল না। ওরাও লোকজনকে মিথ্যা বুঝিয়েটুঝিয়ে কানের দুল বেচতো, আমিও বেচতাম। সত্যিসত্যি কোনও পার্থক্য ছিল না। ওরা ছিল আমার কলিগ। আমার সবচেয়ে বিদ্বান কলিগটি তৃতীয়বারে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেছিল আর আমি একবারে পাস করেছিলাম বলে (আমি তখনও অনার্স পাস করি নাই। আমার অনার্স কমপ্লিট না করার ধান্দা ছিল।) আমার পরে উনার সম্মান ছিল সর্বজনবিদিত। ওদের সাথে একটাই পার্থক্য ছিল, কাস্টমারটাস্টমার না থাকলে ওরা হয়তো নখে নেইলপলিশ দিত, আর আমি গল্পের বইটই পড়তাম, গানটান শুনতাম, মুভিটুভি দেখতাম, ফেসবুকে লিখতামটিখতাম। আর কোনও পার্থক্য নাই। সেই রাস্তার দোকানদারটাই পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। তাই কেউ যখন বলে, আমার সাবজেক্ট ভাল না, রেজাল্ট ভাল না, আমার খুব হাসি পায়। আরে বাবা, আমি গ্রাজুয়েশনে মাশাল্লাহ যে রেজাল্ট করসি, সেটা করতে হলে বহু কষ্ট করে অ্যান্টি-পড়াশোনা অভিযান চালাতে হবে। ওই পরিমাণ গাধা হইতে গেলেও কাঠখড় না শুধু, বড়-বড় গাছ আর গাদাগাদা খড় পোড়াতে হবে। আমার সাথে এখন কেউ যে টুকটাক সম্মান দিয়ে কথা বলে, সেটাই তো আমার সাত না, সাতকোটি জন্মের ভাগ্য! পাগলারা! চেষ্টা চালায়ে যা! তোরা পাগলা হইলে আমি পাগলাসম্রাট! জীবন যে তোদের কোথায় নিয়ে ছেড়ে দিবে, ইউ ক্যান নেভার টেল!!
আজকে একটা কথা ভাইব্যা বড়ই শান্তি পাইতেসিলাম। পরে বুঝলাম, আমার কপালে শান্তি নাই। অনেকেই আমাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করসে, ভাইয়া, আপনি কি অসুস্থ? কিসু লিখেন নাই যে? শোনেন ডিয়ার ভাইবইনেরা, একটা বিষয় আছে যার নাম, রাইটার্স ব্লক। এইটা হইলে রাইটাররা লিখতেই পারেন না। লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন; স্থায়ী কিংবা সাময়িকভাবে। দুনিয়ার বহুত মাতব্বর মাতব্বর রাইটাররা এই প্রবলেমে পইড়া অভিমানটভিমান কইরা দুনিয়া ছাইড়া চইলা পর্যন্ত গ্যাসে। আমি ভাবসিলাম, একটু পার্ট নিই, আমারও ওইটা হইসে। তার মানে, আমিও ইয়ে মানে, রাইটার। পাবলিকের ভালোবাসা আমারে রাইটার সাজতে আর দিল না। নিষ্ঠুর নির্দয় নির্মম পাষাণ বেরসিক পাবলিক। বড়ই পরিতাপের বিষয়! (আপ্নেরা কি খেয়াল করসেন, আমি চামেচামে কিঞ্চিৎ ভাব নিয়া ফালাইসি!)