রেইনকোট (২০০৪)

কিছু মুভি নিয়ে লেখা কঠিন। মনের ভেতরে কেমন একটা ধাক্কা দেয়, ঠিক সামলানো যায় না। ঋতুপর্ণের ‘রেইনকোট (২০০৪)’ ওরকমই একটা মুভি। মুভির শুরুতে স্টারিং কিংবা কাস্ট-এর বদলে দেখলাম ‘প্লেয়ার’। ব্যাপারটা নতুন। সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ডে শুভা মুদগালের কণ্ঠে ‘পিয়া তোরা ক্যায়সা আভিমান’ গান আর গুলজারের আবৃত্তি মনের মধ্যে কী এক শূন্যতা ছড়িয়ে রাখে। যাকে ভালোবেসে পেলাম না, সে মানুষটির জন্য প্রয়োজনে নিজের সবকিছুই দিয়ে দেয়া যায়, তবু তার কাছে কখনো ছোট হওয়া যায় না। নিজের কষ্টের কথা বলা যায় না, তার কষ্টের কথা নেয়া যায় না। যা নিজে নেয়া যায় না, তা কি অন্যকে দেয়া যায়? কষ্ট গিলে বাঁচা, বাইরে দেখানো, কী যে ভাল আছি! মুখে কত সহজে বলে যাওয়া, এই দেখো, খুব সুখে বেঁচে আছি! মনে একটা দীর্ঘশ্বাস: হায় সুখ!……..যারা সুখে বেঁচে আছে, ওদের বড় দেখতে ইচ্ছে করে। ওরা এখনো মিউজিয়ামে যায়নি তবে?

জানোই তো, আমি উচ্ছিষ্ট পছন্দ করি না। সত্যি তো? মন মেনে নেয় অমন রায়? শুনেছি, ভালোবাসা তো এঁটোও খেয়ে নেয়। আসলে কী, ভালোবাসার মানুষ কখনো এঁটো হয় নাকি? শরীরে থাকে, মনে কোনো এঁটো থাকে? ভালোবাসা তো মনে থাকে, শরীরে নয়। শরীরে যা থাকে, তা ভালোবাসা কতটুক? যাকে পেলাম না, পাবোও না কোনোদিন, তার কথা মন এতো ভাবে কেন? কেন এই ব্যাকুলতা? প্রতিটি মুহূর্তে তার জন্য প্রার্থনা করে যাওয়া, এর কি কোনো অর্থই নেই? আমি কোথায় আছি, আর সে কোথায় আছে, দুইজনের পথ দুইদিকে। তবু সে মানুষটিকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসা, তার কাছে হাসিমুখে হার মেনে নেয়া, যে কাজটি আমাকে পুরো পৃথিবী মিলেও করাতে পারবে না, তার জন্য সে কাজটিই করে ফেলা………এইসব কি স্রেফ পাগলামি? হলোই-বা! কত মানুষই তো পাগল হয়েই বাঁচে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওরা পাগল নয়, ওরা ভালোবেসেছিল।

শুনেছি, উনি দেখতে ভাল। লম্বায় ৬ ফুট। ভাল চাকরি করে। তুমিই বলো, এইবার বিয়েটাকে ঠেকাই কীভাবে?

কীভাবে মানে? তুমি কি বাচ্চা নাকি যে ওরা তোমাকে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে?

প্লিজ মান্নু, চেঁচিয়ো না।

ওদের পরিষ্কার জানিয়ে দাও, তুমি এ বিয়েতে রাজি নও। চলো, আমিই তোমার মায়ের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবো।

প্লিজ মান্নু, বোঝার চেষ্টা করো, তোমার শরীর ভাল না।

বাদ দাও ওসব! দুইদিন আগেই তোমার বিয়ের সবকিছু ঠিক হয়ে আছে, আর তুমি আমাকে আজকে বলছ!

বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে রাজি হইনি। তোমাকে বললে তুমি কষ্ট পেতে।

তো? এখন কি আমার ভাল লাগছে?

দুইচারদিন খারাপ লাগবে, এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

মানে, তুমি নিজেই বিয়েটা করতে চাইছ।

সব মেয়ের বাবা-মা’ই তো চায় যে তাদের মেয়েটা জীবনে সেটল্ড হোক। তাই না, মান্নু?

আমরাও সেটল্ড হবো, নীরু।

সামনের মাসে উনাকে কোম্পানি গাড়ি দেবে। দুইদিন আগে ওরা এটা জানিয়েছে। এই দেখো, দিওয়ালির উপহার। এমন একটা আংটি তুমি আমাকে দিতে পারতে?

পারবো। আমাকে একটু সময় দাও, নীরু। আমি সব ঠিক করে নিতে পারবো। আমি তোমাকে হিরের আংটি কিনে দেবো। ইদানিং তো লোনে গাড়ি কেনা যায়। নীরু, আমি তোমাকে গাড়িও কিনে দেবো। আমার হাইটও তো ৬ ফুট। দেখো, নীরু……….

নীরুরা দেখে না। ওরা দেখতে পারে না। নীরুদের বিয়ে হয়ে যায় অন্যঘরে। মান্নু শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেল। পারল না। নীরু চলে গেল। পরিবার ও সমাজের বাইরে গিয়ে কয়টা ভালোবাসা বিয়েতে গড়ায় শেষ পর্যন্ত? মন যতই কাঁদুক, প্রাণ যতই ছটফট করুক, হাত ছেড়ে দিতে হয়। এ সমাজ হাত বাড়িয়ে দিতে জানে না, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শিখেছে। হাতটা হারিয়ে গেলে ভালোবাসাও হারিয়ে যায়? মনকে কি আর শেকলে বাঁধা যায়? মন যাকে একবার জায়গা দেয়, সে জায়গা আর কাউকে দেয় কীকরে? যাকে চাইলাম, পেলাম না, কিংবা যাকে হারিয়ে বুঝলাম, ওকেই চেয়েছিলাম, তার কথা ভেবেভেবে জীবন কেটে যায়। ওকে পেলে সুখী হতাম কি না জানি না, তবে ওকে না পেয়ে জীবন বড় আফসোসে কাটছে, এটা জানি। যা ফসকে যায়, তা-ই তো মধুর! এরকম হয় তো! হয় না?

চাকরি নেই। চলতে কষ্ট হচ্ছে। বন্ধুরা চিনেও চিনছে না। হাতে কোনো টাকা নেই যে কিছু একটা ব্যবসা শুরু করবো। ঠিক করলাম, হাত পাতবো। কিছু টাকা পেলে কিছু একটা করে চলা যাবে। বন্ধুদের অনেকেই তো ভালই আছে। হাত পাতলে কিছু দেবে না? হাত পাতলাম। পেলামও কিছু। এর বাইরে আর কিছুই নেই আমার।

ঘরে রান্নার চালটুকুও নেই। দশমাসের ঘরভাড়া বাকি। স্বামীর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। চাকরি থেকে বের করে দিয়েছে। মদ খেয়ে এখানেওখানে পড়ে থাকে। কখনোবা বাসায় ফেরে। বোকাসোকা মেয়ে, ঘরে পড়ে থাকে খেয়ে না খেয়ে। জীবনে কান্না ছাড়া আর কিছু নেই। সামান্য কিছু অলংকার সরিয়ে রেখেছে। ওইটুকুই সম্বল।

ও হেনরির একটা গল্প পড়েছিলাম। দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই। জিম আর ডেলার গল্প। ওরা খুবই গরীব। ক্রিস্টমাসের উপহার কেনার জন্য কোনো জমানো টাকা নেই। তবু ভালোবাসা তো আছে। ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে কত কী যে করিয়ে নেয়! ডেলার চুলগুলি ছিল খুব সুন্দর। বেচে দিল। সে টাকা আর সবজিওয়ালাদের সাথে দরাদরি করে জমানো সামান্য টাকা দিয়ে জিমের জন্য একটা চমৎকার ঘড়ির চেইন কিনল। অতো দামি ঘড়িটার কোনো চেইন নেই বলে বেচারা সেটা পকেটে লুকিয়ে রাখে, পরতে পারে না।

ডেলার অমন চমৎকার চুলগুলি আঁচড়ানোর জন্য বেচারির কাছে একটা ভাল চিরুনিও নেই। কিন্তু ভাল চিরুনি কিনতে গেলে যে টাকার দরকার, জিম তা পাবে কোথায়? জিমের কাছে সবচাইতে মূল্যবান বলতে ওই ঘড়িটাই আছে। বেচে দিল। সে টাকা দিয়ে স্ত্রীর জন্য দামি চিরুনি কিনে নিয়ে বাসায় এল।

……….এরপর? টেবিলে পড়ে রইল ঘড়ির চেইন, চিরুনি। চেইন কোথায় লাগবে? চিরুনি কী আঁচড়াবে? সেগুলি আজ আর কোনো কাজে আসবে না। তবু এর চাইতে দারুণ উপহার পৃথিবীতে কেউ কাউকে কখনো কিনে দেয়নি।

মান্নু আর নীরুর গল্পে ফিরে আসি। ওদের বিয়েটা হয়নি, তার মানে কি এটা যে ওরা কষ্টের কথাও শেয়ার করতে পারবে না? ভালোবাসা যে কষ্টের ভাগ নিতে শেখায়। নীরুর বিয়ের ৬ বছর পর মান্নু নীরুকে দেখতে গেল। ওরা পরস্পরকে নিজেদের কষ্টের কথা জানতে দিল না। অভিনয় করে গেল। খুব ভাল আছে। টাকা আছে, স্বাচ্ছন্দ্য আছে, সুখ আছে। আর কী চাই? তবু কিছু আড়াল থাকল না। প্রকৃতি প্রচ্ছন্নতা সহ্য করল না। নিজের সবটুকু দিয়েই ওরা পরস্পরের কষ্টের ভাগ নিল। অগোচরে। এটা প্রায়শ্চিত্ত নয়, প্রতিশোধও নয়, এটা ভালোবাসা। একটা মামুলি রেইনকোট সম্পর্কের উষ্ণতাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখল।

আর্টে দ্ব্যর্থতা থাকবেই। আর্টকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণকে দেখলে বিভিন্ন রকমের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। এ ফিল্মেও কিছু দ্ব্যর্থতা আছে। আর্টের উপাদানগুলিকে আমরা আমাদের মতো করে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে পারি। সবকিছুর উত্তর যা দিয়ে দেয়, তার নাম আর্ট নয়, জার্নালিজম। এ মুভিতে মীনা চরিত্রটি খুব আকর্ষণীয়। তাকে দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, সে স্বামীকে ভালোবাসে? কিংবা মান্নুর প্রতি কি তার বিশেষ কোনো টান আছে? বিবাহিত জীবনে মীনা কি অসুখী? মান্নু কি ব্যবসার টাকাটা বন্ধুদের কাছ থেকে নেবে? আচ্ছা, নীরু কোনো এক অচেনা ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করার জন্য ওরকম উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল কেন? মান্নু নীরুর বাসায় গেলে ৬ বছর পর প্রাক্তন প্রেমিককে দেখেও নীরুর মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস দেখিনি, ভাবলেশহীন চোখে নীরু মান্নুকে ঘরে ডেকেছে: এসো। অথচ, নীরু চরিত্রটি নিঃস্পৃহ কোনো চরিত্র নয়। দেখে মনে হয়েছে যেন মান্নু আসবে, এটা নীরু আগে থেকেই জানতো, মান্নুর জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। অবশ্য, এমনও হতে পারে, ৬ বছর আগে যার সাথে সম্পর্ক ছিল, তাকে হঠাৎ করেই বাসায় চলে আসতে দেখে নীরু এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে ‘এসো’, এর বাইরে কী বলা যায়, সেটিই ওই মুহূর্তে মাথায় আসেনি। নীরুর বাড়িওয়ালা কি কথা রাখবে আদৌ? শেষ দৃশ্যে রিক্সার ভূমিকা কী? এ মুভিতে দেখানো বিভিন্ন প্রতীক, যেমন রেইনকোট, বৃষ্টি, অলংকার, ট্রেন, ওয়ালেট, ডোরবেল, সেলফোন, শাড়ি, চিঠি, ফার্নিচার, এসব নিয়েও লেখা যায়, প্রতিটির নিজস্ব তাৎপর্য আছে।

এ মুভির থিমটা আসলে কী? সংশয়? ভালোবাসা? বিরহ? আফসোস? আত্মসম্মানবোধ? নৈরাশ্য? ব্যর্থতা? নাকি সবকটিই? মুভির গল্পে কোনো ফাঁক আছে? আচ্ছা, নীরু যখন লাঞ্চ কিনতে ঘর থেকে বের হলো, তখন মান্নু ঘরটা ঘুরে দেখল না কেন? সে একটু রিজার্ভ টাইপের, তাই? কিংবা এই যে নিজের অবস্থান নিয়ে নীরু মান্নুকে এতকিছু বানিয়ে বলল, তার কি একবারও মনে হয়নি যে মান্নুকে একলা ঘরে রেখে বাইরে গেলে সে তার আর্থিক অবস্থাটা বুঝে ফেলবে? নীরু একটু ছেলেমানুষ ধরনের, তাই অতোটা মাথায় আসেনি হয়তো। এ ছবিতে মান্নু আর নীরা অনেক মিথ্যে বলে, অনেক সত্য গোপন করে। এবং, সিনেমা দেখার সময় মনে হতে থাকে, ওরা যা করছে, ঠিকই করছে। ওদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান ও অবস্থা ওদের দিয়ে ওরকমই করিয়ে নেয়ার কথা। এখানেই আর্টিস্ট হিসেবে ঋতুপর্ণ সার্থক।