ফেরা

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উনার নিজের সবচে’ প্রিয় বই কালো যাদুকর-এর শুরুতে উনি লিখেছেন,

আমি যা বিশ্বাস করি তাই লিখি।

অবিশ্বাস থেকে কিছু লিখতে পারি না। আমার বিশ্বাসের জগৎটা আবার খুবই বিচিত্র। সেই বিচিত্র বিশ্বাসের একটা গল্প লিখলাম। গল্পটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ না করাই ভালো হবে।

…………আমি এই লেখাটা উনার এই বইটার কথা দিয়ে কেনো শুরু করলাম, সে কথায় পরে আসছি। তবে উনার পরামর্শ মেনে আমার ক্ষতি হয়েছে।

একদিন।

হ্যালো হ্যালো!

………………..

হ্যালো! কে বলছেন? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো! কে বলছেন, প্লিজ?

………………..

ধ্যত! ফালতু লোক! বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। এটা আমি প্রায়ই করি। আমাকে করতে হয়।

আরেকদিন একই নাম্বার থেকে।

হ্যালো!

………………….

আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!

……………………..

হ্যালো, হ্যালো! আপনার ওখানে তো অন্য শব্দ শোনা যাচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করে চুপ করে আছেন কেনো? হ্যালো, হ্যালো!

………………………..

আমি বিরক্ত হয়ে অভ্যাসবশত ফোনটা না কেটে দূরে রেখে দিলাম। আমি চাই, ওর বিল উঠুক! দেখি, কতো পারে! অবাক করা ব্যাপার হলো, এর প্রায় ৪০ মিনিট পর ওদিক থেকে কেউ ফোনটা কাটলো।

এর ২ মিনিটের মধ্যেই টেক্সট। ওতে লেখা: আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি কথা না বলে ফোনটা রেখে দিলেন কেনো? আমি অপেক্ষা করে ছিলাম। অন্তত হ্যালো-হ্যালো হলেও তো বলতে পারতেন। আচ্ছা, ভালো থাকবেন।

টেক্সটটা পেয়ে আমি অতি বিরক্ত হলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি সাহসী মানুষ পছন্দ করি। ফোন করার সাহস আছে, অথচ কথা বলার সাহস নেই, এটা কোন ধরনের ফাজলামো? আমার দৃষ্টিতে এটা চরম অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে। এই ধরনের ফালতু বিরক্তিকর মানুষরা কাজের খুব ব্যাঘাত ঘটায়। আননৌন নাম্বার থেকে মিসড কল এলে আমি খুব বিরক্ত হই, ফোন করে কথা না বললে আরও বেশি বিরক্ত হই, আর টেক্সট পাঠালে কিন্তু পরিচয় না দিলে আমার মনে হতে থাকে, ওকে সামনে পেলে ওর সাথে নিশ্চয়ই খুব দুর্ব্যবহার করতাম। অবশ্য আমি যতোটা ভালোভাবে দুর্ব্যবহার করতে পারি, তার চাইতেও, দুর্ব্যবহার করবো, এটা ভালোভাবে ভাবতে পারি।

বেশিক্ষণ কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। ছেলে তো! (ভাবছিলাম, যদি সুন্দরী কেউ নক করে!)

রিপ্লাই করলাম, আপনার পরিচয়টা বলবেন কাইন্ডলি?

রিপ্লাই এলো, ভাইয়া, আমি তো বলেই দিয়েছি, আপনি আমাকে চিনবেন না। পরিচয় বলে কী হবে?

লিখলাম, তাহলে দয়া করে এভাবে বিরক্ত করবেন না। আপনার কাজ না থাকতে পারে, আমার আছে।

সেদিন আর কোনও টেক্সট এল না।

আরও একদিন ফোন এলো। এবার আমি মনে-মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, কঠিন-কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দেবো।

হ্যালো!

…………………

আপনি এভাবে আমাকে বিরক্ত করছেন কেনো? আপনার লজ্জা করে না এভাবে করে আরেক জনের সময় নষ্ট করতে? আপনার পরিচয়টা বলুন। হ্যালো!

…………………..

আমি আপনার নাম্বারটা ব্লক করে দিতে পারতাম। কিন্তু আপনার জন্যে ওটা করতে যে সময়টা নষ্ট হবে, সেটা করতেও আমার রুচিতে বাধে। আপনার যদি আত্মসম্মানবোধ আর লজ্জা থেকে থাকে, তাহলে আপনি আর কোনওদিনও আমাকে ফোন করবেন না। ভালো থাকবেন। রাখছি।

বলেই ফোনটা কেটে দিলাম।

সেদিন আর কোনও ফোন কিংবা টেক্সট আসেনি। পরেরদিন এল। ফোন নয়, টেক্সট।

ভাইয়া, সালাম নেবেন। আমি কে, সেটা আপনাকে জানাবো না। আমি চাই, আপনিও দয়া করে জানতে চাইবেন না। আমি কিছুদিন আগে আপনার একটা ক্যারিয়ার আড্ডায় ছিলাম। আপনি যখন কথা বলতে শুরু করলেন, আমি চমকে উঠেছিলাম। আপনার কণ্ঠস্বর, কথা বলার স্টাইল, দাঁড়ানোর ভঙ্গি একেবারে হুবহু ওর মতো। সেদিন আপনার কথা যতোক্ষণই শুনেছি, পুরো সময়টাতেই শুধু রুমালে ভেজা চোখ মুছেছি। ভাইয়া, আপনি ওর মতো করে কথা বলেন, তাকান, ঘাড় নাড়েন, গলা কাঁপান। আপনাকে চোখে না দেখে ফোনে কথা শুনলে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, আপনি ও নন, আপনি আপনিই। আমি শুধু আপনার কণ্ঠটা শুনতে আপনাকে ফোন করি। আর কিছু না, কিছুই না। আমার মনে হতে থাকে, আমি ওর আওয়াজ শুনছি, একদম অবিকল। বিশ্বাস করতে থাকি, ও ফিরে এসেছে। আর ফোনটা রেখে দেয়ার পর সারাক্ষণ কাঁদতে থাকি। সারারাত আমি ঘুমাতে পারি না। গতকাল আপনার শেষের কথাগুলো শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক কেঁদেছি। কাঁদতে-কাঁদতে আমার কালকে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার ভালোবাসা, আমার স্বপ্ন, দুই-ই লজ্জাহীন। আপনি যা বলেছেন, খুব কমই বলেছেন। এরকম কিছু ওর সাথে হলে, ও আরও বেশি বলতো। আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবো না। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

আমি ভাবতে লাগলাম, কে সে? কে সে? ও-ই বা কে? আমি ওর মতো, মানে কী? ভাবতে-ভাবতে লিখে পাঠিয়েই দিলাম, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিনি। আপনি কে, সেটা না হয় না-ই বা জানলাম। কিন্তু, আমার মতো ‘ও’-টা কে?

অনেকক্ষণ পর উত্তর এল, সবার কাছে ও এখন আর কেউ নয়। কিন্তু আমি জানি, ও আছে, ও থাকবে; অন্তত আমি যতদিন বাঁচবো ততদিন। ও গত ৯ বছর ধরে আমার সাথে আছে, আমার কাছে আছে, আমার মধ্যে মিশে আছে। ওরা বলে, ও নেই। কিন্তু আমি তো জানি, ও আছে। ওরা আমাকে বলে, গত ২ বছর আগে ও রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব? ও যে আমাকে কথা দিয়েছিল, ঝগড়া হলেও আর ছেড়ে যাবে না। যে ভালোবাসে, সে ছেড়ে যায় কীভাবে? ও তো কখনওই মিথ্যে বলেনি। তবে কেনো ও ছেড়ে চলে যাবে? আমি জানি, আমি প্রলাপ বকছি। সবাই তা-ই ভাবে। আমি আর আপনাকে লিখবো না। ভালো থাকবেন।

আমার কাছে মনে হতে লাগলো, যেন কেউ একজন প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে-পিটিয়ে আমার সারাটা শরীর নিথর-অবশ করে দিয়েছে। নিজেকে খুব বড় কোনও একটা শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছিলো। ওই মুহূর্তে নিজেকে বারবারই মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচাইতে নির্দয় নির্মম নিষ্ঠুর মানুষ। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কী রিপ্লাই করবো, রিপ্লাই আদৌ করবো কিনা। এসব ভাবতে-ভাবতে কীসব যেন লিখে ফেললাম। লিখলাম, আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। লিখলাম, কিন্তু পাঠালাম না। উফফ! ক্ষমা চাওয়াটাও কী যে কষ্টের! প্রায় ২ ঘণ্টা পর ‘ক্ষমা চাইবো না, চাইবো না’ করতে-করতেও নিজের অজান্তেই টেক্সটটা পাঠিয়ে দিলাম।

রিপ্লাই এল, আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন? আমার ভালোবাসা কিংবা কষ্ট, এর কোনওটার দায়ই তো আপনার নয়। আপনার সামর্থ্যে এতোটা নিশ্চিত বিশ্বাস কীভাবে এলো আপনার? আমার কোনও কষ্ট নেই, শুধুই ভালোবাসা আছে। এটাই আমার একমাত্র কষ্ট। অনেক দামী কষ্ট। এটা রাখার ক্ষমতা আমারই নেই। আমার কষ্ট আমার চাইতেও দামী। এটাই কষ্ট। আর কিছু না। জানেন, ও আমার সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করতো। অনেক মানে অনেক! অনেক ঝগড়া করতো। আমাকে বড়-বড় কথা শোনাত। আমি নীরবে সহ্য করতাম এই ভয়ে যে, যদি ও হারিয়ে যায়, যদি ও হারিয়ে যায়! ও হারিয়ে যেতোও, মাঝেমধ্যেই। কিছুতেই আমি ওকে আর খুঁজে পেতাম না। আমি খুঁজতাম, শুধু খুঁজতাম। ও ফিরে আসতো না। আমি এক নিরুদ্দেশ মানুষকে ভালোবাসতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসবো। ও চলে যাওয়ার এতোদিন পরেও আমি বিশ্বাস করি না, ও নেই। ওরা বলে, ও কবরে শুয়ে আছে। ওরা যে ওকে চেনে না। আমি তো চিনি। আমি তো জানি, ও এমন করেই হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। আমি বুকের ভেতরে অনুভব করতে পারি, ও আসবেই। আমি প্রতীক্ষায় থাকবো, ওকে খুঁজবো। আমি জানি, ও আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। আমি এতোদিন ধরে ওকে খুঁজেছি। আরও খুঁজবো। আরও! ওকে কোথায় পাই বলুন তো? আমি যে ওকে ভালোবাসি। আমি আর কার কাছে যাবো? কে আমার ভুলগুলোকেও ভালোবেসে আবার ফিরে-ফিরে আসবে, চিরদিনের জন্য হাত ছেড়ে দেবে না? ছেড়ে চলে যাবে না? আমি যে কিছুতেই যেতে পারি না, আমি যাবো না। আমি ওর সাথেই ছিলাম, আছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবো। একদিন আমি বুড়ি হয়ে যাব, ও কখনও বুড়ো হবে না। অমন রাগী-অভিমানী-সরল তরুণটিই থেকে যাবে আমার চোখে, আমার হৃদয়ে। ওকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আমি বেঁচে থাকব। আমার কোনও স্বপ্ন নেই, শুধুই ও আছে। আমি আপনাকে আর কখনওই বিরক্ত করবো না। এটা আপনার কাছে পাঠানো আমার শেষ কথা। ভালো থাকবেন। নিজের জন্য, সবার জন্য। বিদায়।

আমার যতদূর মনে পড়ে, আমি শেষবার অনেক কেঁদেছিলাম সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ পড়ে। এর আগে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ আমাকে প্রায় বিশ্বাস করিয়েই ফেলেছিলো যে আর কখনও কোনওকিছুই এতোটা কাঁদাবে না। ‘জাগরী’র প্রবল আঘাত আমার বিশ্বাসের মূর্তিটা ভেঙেচুরে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলো, শেষ হাসি আছে, কিন্তু শেষ কান্না বলে কিছু নেই। অনেকদিন পর এক অজানা অচেনা নিভৃতচারিণী সাধারণ মেয়ে আবারো ওরকম করে কাঁদালো। কষ্টের রঙ কী হয়, আমি জানি না। আমি এতোদিন ধরে কষ্টকে খুব কুৎসিত-কুৎসিত রঙ দিয়ে আসছিলাম। আজ আর দিতে পারছি না। কেনো? এখানে কষ্ট একা নেই, ওর সাথে ভালোবাসা আছে যে! ভালোবাসাকে কুৎসিত রঙ দিই কী করে? কষ্ট কান্না হয়ে ঝরে গেলে বাঁচা যেতো। কিন্তু হায়! কান্না ঝরে! কষ্ট তো ঝরে না! বেঁচে থাকতে চাইলে কষ্ট গিলে বেঁচে থাকতে হয়।

ফিরে আসি কালো যাদুকর-এর কথায়। হুমায়ূনের কথামতো আমি ওই গল্পটিকে গুরুত্বের সাথে নিইনি। ভেবেছি, ওটা নিছক গল্পই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি জগতে বাস করে গল্পকে নিছক গল্প হিসেবেই নেয়ার মতো পরম নির্ভার নির্ভরতার আশ্বাস কে-ই বা ফিরিয়ে দিতে পারে? আমিও পারিনি। ভেবেছিলাম, ছয় বছর পর না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া টুনুর আকস্মিক প্রত্যাবর্তন টুনুর মাকে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থায় এনে দিলেও সেটা সেই গল্পের কালো যাদুকরের যাদুমাত্র। টুনু ফিরে আসতে পারে না। টুনুরা ফিরে আসে না। টুনু তাই ফিরে আসেওনি। যে এসেছে, সে গল্পের যাদুকর, কিংবা রূপবদলানো কোনও এক অচিনবৃক্ষ। আর কিছুই না। আজ বুঝলাম, যারা চলেই যায়, ওরাও ফিরে আসে; ওরাও কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানুষের মতোই ফিরে-ফিরে আসে। এ পৃথিবীতে কেউই একেবারে হারিয়ে যায় না। সবাই ফিরে আসে। নিজে, কিংবা অন্যকেউ হয়ে।

শেষকথা। গল্পে বর্ণিত ‘কালো যাদুকর’, ‘জাগরী’ এবং ‘হাজার চুরাশির মা’ বাদ দিলে প্রতিটি কথা অকাল্পনিক। বাস্তবের কোন ঘটনা বা ব্যক্তির সাথে তার অমিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয় মাত্র।