নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় যেভাবে

আমরা যা করি: যা নিয়ে বলার দরকার নেই, তা নিয়ে বলি; যা নিয়ে সময় দেবার দরকার নেই, তা নিয়ে সময় দিই। সবাইকেই সময় দিই, সবকিছুকেই সময় দিই। আমরা একটুখানি ফেইসবুকে ঢুকে দুই ঘণ্টা দিব্যি কাটিয়ে আসি। সময় নষ্ট করার যা যা অনুষঙ্গ আছে, তার সবকটিকেই আঁকড়ে ধরে রাখি।




তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি যেহেতু একটা জার্নিতে আছ, সেহেতু এই জার্নিটা তোমার জন্য একটা ইবাদত। এই জার্নিটা তোমার জন্য একটা রিজিক ঠিক করে দেবে। হ্যাঁ, এই জার্নিটা তোমার জন্য একটা প্রেয়ার বা প্রার্থনা। ইবাদতের ঘরে কোন‌ও ফাঁকি চলে না, ইবাদতের ঘরে ফাঁকি দিলে ইবাদত কখনও সম্পন্ন হয় না! খেয়াল রেখো, সেই ফাঁকিটা যেন তুমি না দাও।




সবাইকেই কেন সময় দিতে হবে? পরে তোমার বন্ধুদের তুমি অনেক সময় দিতে পারবে। তোমার প্রিয় মানুষটাকে বোঝাও, তুমি এখন একটা প্রিপারেশনের মধ্যে আছ। তুমি যদি আগের মতো করে তোমার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে দিনের মধ্যে চব্বিশ বার কথা বলো, তাহলে কীভাবে কী হবে?! তোমার যে বন্ধুটা চব্বিশ দিনে এক বারও কথা বলছে না, সে চাকরি পাবে না তো কি তুমি চাকরি পাবে?




আর এমনিতেই তো ব্রেকআপ হয়ে যাবে আগে পরে, তাই না? এখন তো ব্রেকআপ একটা কমন ব্যপার। ৯৬% প্রেমেই ব্রেকআপ হয়ে যায়! সত্যি বলতে কী, তোমার নিজের প্রেমটাতে তুমি যতই বলো, এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে, তোমার আমার প্রেম অমর প্রেম, তুমি আমার আমি তোমার, ফুল ঝরে পাতা নড়ে... তোমার কথা মনে পড়ে, তুমি আর আমি...বাকি সব হারামি, এই টাইপের যা-কিছুই বলো না কেন, সে চলে যাবে, সে চলে যায়।




এবং এটা কোনও ব্যাপার না, এইটা কোনও ব্যাপার‌ই না। কাউকে ভালোবাসা আর কাউকে পাওয়া ভিন্ন কথা, একই কথা নয়। তুমি যাকে ভালোবাসছ, তাকে ভালো তো বাসছ‌ই! তাকে তুমি না-ও পেতে পারো। কিন্তু তোমার চাকরিটা পেতে পারো, এটা পাবার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি। সো ইটস ইয়োর চয়েস যে তুমি কোনটাকে প্রায়োরিটি দিবে।




ত্রিশ বছরের পরে গিয়েও তুমি প্রেম করতে পারবে, কিন্তু ত্রিশ বছরের পরে গিয়ে তুমি ভালো একটা চাকরি পাবে না, এটা মাথায় রেখো। ত্রিশ বছরের পরে গিয়ে তুমি বিয়ে করতে পারবে, কিন্তু ত্রিশ বছরের পরে গিয়ে তুমি আর চাকরি পাবে না, চাকরির জন্য পরীক্ষাই দিতে পারবে না। তাই যতগুলো আননেসেসারি কাজ, যতগুলো অকাজের কাজ, সেগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে হবে দেরি হয়ে যাবার আগেই।




তুমি যদি নিজেকে বদলাতে না পারো, তুমি যদি তোমার আগের লাইফস্টাইলটাকে ধরে রাখো, তবুও তুমি ভালো কিছু করতে পারবে, এটা তুমি কেন আশা করছ, বলো তো, ভাই? তোমাকে আগে নিজেকে বদলাতে হবে, তোমার পুরোনো লাইফস্টাইল থেকে সরে আসতে হবে, নতুন একটা লাইফস্টাইলে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। ওইটুকু করতে না পারলে আসলে খুবই ডিফিকাল্ট এই জার্নিটা ঠিকভাবে শেষ করা! আর যদি এইটুকু করতে পারো, তবে আমি তোমাকে গ্যারান্টি  দিতে পারি, তুমি একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্লেস করার ক্ষমতা রাখো। হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয়‌ই প্লেস করবে!




আর প্লেস করলে তো অনেক ধরনের সুবিধা আছে, তুমি জানো। যারা মেরিট লিস্টে আগের দিকে থাকে, ওদের প্রমোশন কিন্তু আগে হয়। এটা একটা বিশাল সুবিধা! ডিপার্টমেন্টেও ওদের অনেক সম্মান পাবার কথা। হ্যাঁ, ঝামেলাও পোহাতে হয়। কেমন পোহাতে হয়? একটু বলি...তুমি ধরো ফার্স্ট হলে, এরপর তোমাকে বলা হবে, তুমি না ফার্স্ট হয়েছ, তুমি এটা পারো না! ক্লাসের ফার্স্টবয় যখন কোনও একটা পড়া পারে না, তখন সে যতটা চড় খায়, ক্লাসের লাস্টবয় সে পড়াটা না পারলে ততটা চড় খায় না।




আমার প্রিয় ছাত্র সৌম্য চৌধুরী বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে দ্বিতীয় হয়েছিল। সে যখন ক্লাসে একটা এমসিকিউ'তে ভুল করত...লিখতে গিয়ে আমার প্রিয় ছাত্রদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যাদের কথা আমি নানান জায়গায় বলি, ওদের খুব মনে পড়ে, ওদের পড়াতাম, স্নেহে ও শাসনে বেঁধে রাখতাম! যা-ই হোক, এই সৌম্য চৌধুরী যখন কোনও একটা মাল্টিপল চয়েসে ভুল করত, অর্থাৎ এমসিকিউ'তে, তখন সে যতটা চড় খেত আমার কাছে, যতটা বেতের বাড়ি খেত, যে ছাত্রটা অতটা ভালো না, সে ওরকম ভুল করলেও আমি ততটা মারতাম না। মনে হতো, সে যা পেরেছে, তাতেই আলহামদুলিল্লাহ!




দেখা যেত, সৌম্য চৌধুরী এক-শো'টা অবজেক্টিভের মধ্যে ভুল করেছে চারটা, সে এই চারটার জন্য আমার কাছ থেকে দশটা বেতের বাড়ি খেল। তার এক বন্ধু, সে এক-শো'টা অবজেক্টিভের মধ্যে ভুল করেছে ধরো চৌদ্দটা, আমি কিন্তু তাকে ব্রাভো বলেছি। খুশি হয়ে বলেছি, ভেরি গুড! ভেরি গুড! ভেরি গুড!




তুমি যখন ফার্স্ট হয়ে চাকরিতে ঢুকবে, তখন দেখবে, তুমি তোমার কলিগের চাইতে বেশি বেশি ঝামেলা ফেইস করছ। এতে কিছুই করার নেই। মানুষের কীরকম একটা এক্সপেক্টেশন তৈরি হয়ে যায়। এবং এই ঝামেলার জন্য, তুমি যে বাড়তি কোনও রিওয়ার্ড পাবে, তা-ও কিন্তু নয়। আমি তোমাদের বলব, ফার্স্ট হয়ে ঢোকার দরকার নেই! তুমি শুধু চাকরিতে ঢোকো, তাহলেই হবে। ফার্স্ট হলে অনেক ধরনের ঝামেলাও আছে! সত্যিই অনেক ধরনের ঝামেলা আছে!




মাথায় রাখো, চাকরিটা পাওয়া যায়, চাকরিটা পাবার আগে এটাকে অনেক কিছু মনে হয়...সোনার হরিণ, রুপার হরিণ, মাটির হরিণ, চামড়ার হরিণ, মাংসের হরিণ! এমন অনেক কিছুই মনে হয়। আর চাকরিটা পাবার পরে মনে হয়, এটার জন্য এত কিছু ভেবেছিলাম...এটার জন্য‌ও! এটা তো সোজা! দিনের শেষে নেলসন মেন্ডেলার কথাটাই সত্য, “কোনোকিছু করতে পারার আগ পর্যন্ত সেটাকে অসম্ভব মনে হয়।" আর করতে পারার পর সেটাকে তেমন কিছুই মনে হয় না!




আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও কখনও বেড়াতে যেতাম, তখন আইবিএ-এর সামনে দিয়ে যাবার সময় আমার মনে হতো, আরে বাব্বাহ!! এরা তো এলিয়েন; এখানে যারা পড়ে, তারা তো এলিয়েন! পরে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম, সেখান থেকে পাশ করলাম, এখন কিছুই মনে হয় না। হ্যাঁ, দুনিয়াটাই হচ্ছে এরকম। যতক্ষণ পাচ্ছি না, ততক্ষণ আসলে অনেক কিছুই মনে হয়! কিন্ত যখন পেয়ে গেলাম, তখন অতকিছু মনে হয় না। যারা ভাবছ, বিশাল কঠিন বিশাল কঠিন, হেনতেন হেনতেন, তাদের বলি, প্লিজ, যাদের সঙ্গে কথা বললে তোমার কাছে পরীক্ষাটাকে বিশাল কঠিন মনে হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দাও।




মনে রেখো, সবার সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই তো! যাদের সাথে কথা বললে তোমার কনফিডেন্স নষ্ট হয়, তোমার ড্রিম-জার্নিটা ব্যাহত হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলার কী দরকার? তুমি বরং নিজের সঙ্গে কথা বলো। সবচাইতে ভালো হয়, যদি কথা বলার জন্য তুমি বেটার কাউকে না পাও, বেটার কোনও পার্সন না পাও, তবে Talk to yourself! You are the best person for yourself in the world! তোমার নিজের জন্য তুমি সবচেয়ে সেরা মানুষটি।




আমরা মানুষের সঙ্গে প্রচুর কথা বলি, তার ফলে নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়টা আর পাই না। নিজের সঙ্গে কথা বলে দেখো। নিজের সঙ্গে কথা বললে অনেকগুলো প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে। কারণ তোমার ভেতর থেকে তখন বিভিন্ন অটো-সাজেশন তৈরি হবে, অটোমেটিক্যালি কতগুলি কথা ভেতর থেকে কেউ বলবে। বলবে, এটা করো, ওটা করো, এটা করলে ওটা হবে, ওটা করলে সেটা হবে। একটু চোখ-কান খোলা রেখে সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবলে অনেক কিছু করা সম্ভব, অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। এটা আমি মনে করি।




আরেকটা কথা। কখনও অন্য কারও সঙ্গে নিজেকে তুলনা কোরো না। আজকের তুমি'টা গতকালের তুমি'কে ছাড়িয়ে যেন যায়, সেদিকে খেয়াল রেখো। প্রতিদিনই নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে যাও। বাকিটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে।