জীবনের প্রথম টিউশনির গল্প

সুশান্ত উবাচ, টিউশনিচিন্তা চমৎকারা, কাতরে ক্যারিয়ার কুতঃ!!!

মাস্টারি বড়ই প্যারাদায়ক জিনিস। সারামাস পড়ালাম, আর বেতন দেয়ার সময়ে শুনলাম, “আপনি তো অমুক-অমুক দিন আসেননি।” (হয়তো ক্যালেন্ডারেও দাগানো কোন-কোন দিন পড়ানো বাদ গেছে!) “আগামী মাসে একসাথে নিয়ো, এ মাসে একটু সমস্যায় আছি।” (বাসায় খরচের ধরন ‘সমস্যা’র কথা জানায় না।) “এবারের রেজাল্ট তো গতবারের চাইতে খারাপ হল।” (ওরা যে এবার কয়েকটা ফ্যামিলি ট্যুর দিল, সে কথা বলবে কে?) “ইদানীং সময় একটু কম দিচ্ছেন, একটু বাড়িয়ে দিলে ভাল হত।” (কী পড়াচ্ছি, সে খবর নেই, বেশিক্ষণ বসে-বসে গল্প করলেও সমস্যা নেই, কিন্তু বসে থাকতে হবে!) “এ মাস থেকে ওকে ধর্মটাও যদি একটু দেখিয়ে দিতে……” (আহা! ভাগ্যিস, শারীরিক শিক্ষা সিলেবাসে নেই। নাহলে হয়তো জিমে গিয়ে এটা শিখে স্টুডেন্টকে পড়াতে হতো।) “গতমাসে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছি তো, একটু খরচের মধ্যে আছি। তুমি পড়াতে থাক, দেখি তোমার জন্য কী করা যায়।” (আহা! যেন করুণা করছে! বাড়ি ওঠে, আর মানসিকতা ওটার তলায় চাপা পড়ে থাকে। বাড়ি করার টাকা আছে, আর আমার বেতন দেয়ার টাকা নেই।) …………. এরকম আরও অনেক-অনেক কিছু।

ডাক্তারি যাঁদের পেশা, তাঁরা জানেন, রোগীর সাথে গল্প করা তাঁর কাজ না। অল্প সময়ে যে কাজ হয়ে যায়, সে কাজের জন্য বাড়তি সময় দেয়ার সময় কোথায়? দরকারই বা কী?

মাস্টারি যারা করে, তারা জানে, স্টুডেন্টের জন্য কতটুকু দরকার। যে মাস্টার বাসায় পড়াতে এসে ২ ঘণ্টার চাইতে বেশি সময় দেয়, বুঝতে হবে, সে মাস্টার নতুন, মানে অভিজ্ঞতা অল্প। দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মাস্টার আধা ঘণ্টা গল্প করে যে পড়াটা স্টুডেন্টকে পড়াতে পারেন, সেটা নিতেও ওর অন্তত দুইদিন লাগার কথা!

আমি একটা সময়ে অনেক অনেক মাস্টারি করেছি। অনেক মানে, অনেক!!! দিনে ৪-৫টাও টিউশনি থাকত। নিজের কোচিং দেয়ার আগে অন্যের কোচিংয়েও ক্লাস নিতাম। পলস্ কোচিং হোম শুরু করার আগে মোট ১৩টা কোচিংয়ে পড়িয়েছি। জীবনে স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে ভূতের মতো অকল্পনীয় পরিশ্রম করেছি। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে নোট আর শিট রেডি করেছি।

কেন? টাকার জন্য? সে তো কিছুটা বটেই! প্রেম করতাম না বলে কি টাকা লাগত না নাকি? কিন্তু পুরোপুরি টাকার জন্য না। বাবার টাকাপয়সা ভালই ছিল। কিন্তু বাবার টাকা তো বাবার টাকা, আমার তো না। বাবার টাকায় প্রেম করা যায় না, বাবার টাকায় সিগারেট খাওয়া যায় না, বাবার টাকায় সৌখিনতা করা যায় না, বাবার টাকায় বইকেনা যায় না। প্রেম করার বুদ্ধি আর সাহস ছিল না, কখনওই সিগারেট ফুঁকিনি। সৌখিনতা ছিল সেই লেভেলের; প্রচুর-প্রচুর শপিং করতাম, লোকজনকে দুই হাতে টাকা ধার দিতাম, বাসার জন্য চোখের সামনে যা পেতাম তা-ই কিনে নিতাম, ওদিকে অশারীরিক প্রেমিকা বই না হলে চলত না। প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০-৩০ হাজার টাকার বই কিনতাম। তাও প্রতি মাসে লাখ-লাখ টাকা জমত।

তবুও…… বোঝে না বোঝে না সে বোঝে না। …….. কে সে?……… গার্ডিয়ান। আমার স্টুডেন্টের বাবার বিল্ডিং দোতলা থেকে তিনতলায় ওঠে, আর আমার বেতন পারলে দোতলা থেকে দেড়তলায় নামে। গার্ডিয়ানের ভাবখানা ছিল এই—দরিদ্র মাস্টার, পড়াতে এসেছে, পড়াবেই তো! দয়া করে বেতন দিচ্ছি, এ-ই তো বেশি!

ডিয়ার চৌধুরী সাহেব! মাস্টারদেরকে দরিদ্র ভাববেন না, প্লিজ! ওই বয়সের একটা ছেলে এর চাইতে আর বেশি কী-ই বা কামাই করতে পারত? আমি জানি, আমি কী পরিমাণ পয়সা জমিয়েছি মাস্টারি করে। এ জীবনে কখনওই দরিদ্র ছিলাম না। অবশ্য কিছুদিন স্বেচ্ছাদারিদ্র্যে কাটিয়েছি। সে গল্প আরেকদিন বলব।

তবে এত সহজে টিউশনি সবাই পায় না। টিউশনি শুরু করার সময়ে কত ছাড় দিয়ে টিউশনি করেছি, ভাবলেও হাসি পায়। পরে-পরে শুধু ভাল স্টুডেন্টকে বাসায় গিয়ে পড়াতাম। আসাম ভ্যালি স্কুলের ও লেভেলের এক স্টুডেন্ট ভ্যাকশনে বাংলাদেশে এলে আমার কাছে পড়ত। ওকে বাসায় গিয়ে পড়াতাম, মাসে পেতাম ৪০ হাজার টাকা; আমি ২০০৫ সালের কথা বলছি। সবসময়ই বুক উঁচিয়ে টিউশনি করেছি।

প্রথম টিউশনি থেকে বেতন পাইনি। ভুল হল, বেতন নিইনি। কেন নেবো? ওরা কম দিতে চেয়েছিল। তাই নিইনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা আকাশছোঁওয়া আত্মসম্মানবোধ নিয়ে চলে। প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাবে, তবুও মাথা নোয়াবে না, এরকম। আমিও ওরকম ছিলাম; সুখের বিষয়, এখনও আছি।

২০০২ সাল। জীবনের প্রথম টিউশনি। প্রচণ্ড আবেগ আর আন্তরিকতা নিয়ে পড়াতে গিয়েছিলাম। চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় সেকেন্ড-হওয়া ছাত্রের ‘রেট’ও বেশি ছিল। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন কোচিং ওমেকা’তে পড়ানো শুরু করেছিলাম। ম্যাথস্, ফিজিক্স, ইংলিশ পড়াতাম। খুব পড়াশোনা করে পড়াতে যেতাম, এই আশায়, যদি একটা টিউশনি মিলে যায়! তবে সে বয়সটা ছিল স্টুডেন্টদেরকে ইমপ্রেস করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করার বয়স। অনার্সে বাবার কাছ থেকে কোনওভাবেই টাকা নেবো না, এটা রীতিমতো সংকল্প করেছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই একটা টিউশনি মিলে গেলোও। আফিয়া নামের একটা মেয়েকে বাসায় গিয়ে পড়াতে হবে। ৩ মাসের কন্ট্রাক্ট। মাসে দেবে ৫ হাজার টাকা করে। টোটাল ১৫ হাজার টাকার কন্ট্রাক্ট। ও আপুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করত।

আমি এইচএসসি পাস করেছিলাম ২০০২ সালে। ও ছিল আমার পরের ব্যাচ। বাসা হালিশহর কে-ব্লকে। মেয়ে অতি রূপসী। বড় আপুর বাসায় থেকে কোচিং করছে। পড়ানো শুরু করলাম, একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে। একে তো সুন্দরী, তার উপরে ব্রিলিয়ান্ট; ইমপ্রেস করারও একটা ব্যাপার ছিল। এসএসসি পাস করেছে ডাঃ খাস্তগীর স্কুল থেকে, এইচএসসি ইস্পাহানি কলেজ থেকে। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা করে পড়াতাম। সে কী যে কষ্ট করেছিলাম! বুয়েটে আর বিআইটি’তে বিগত বছরগুলিতে যা যা প্রশ্ন এসেছে, সেগুলিসহ ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথসের অন্তত ৪-৫টা করে বই সলভ করাতাম। ফিজিক্সের প্রামাণিক, ম্যাথসের লুৎফুজ্জামান, কেমিস্ট্রির কুণ্ডু’র বইও সলভ করিয়েছি। আর ইংরেজি পড়াতাম সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব স্টাইলে। আমি জীবনেও কখনও কাউকে গ্রামার শিখিয়ে ইংরেজি শেখাইনি, ইংরেজি শিখিয়ে গ্রামার শিখিয়েছি। কীভাবে, সেকথা আরেক দিন।

এভাবেই চলছিল। সেই রকম খাওয়াদাওয়া হত ওদের বাসায়। আপু পেপার থেকে বিভিন্ন রান্নার রেসিপি দেখে-দেখে রান্না করে খাওয়াতেন আর পেপারের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “সুশান্ত, দেখো তো ওদের মতো হয়েছে না?” আমি উনাকে উৎসাহিত করার জন্য বলতাম, “আপু, ওদেরটার চাইতেও ভাল হয়েছে।” মেয়েমানুষ মাত্রই রূপের আর রান্নার প্রশংসা শুনতে ভালবাসে; সে যতো কুৎসিতই হোক দেখতে, যতো অখাদ্যই রান্না করুক না কেন!

আহা, যদি জানতাম, যতো নাস্তা, ততো শয়তানি! বুঝিনি কোনওদিনও। প্রথম মাসটা ফুরোলো। বেতন চাইলাম। বলল, পরের মাসে দেবে। আমিও বিশ্বাস করলাম। অনেক অমায়িক ব্যবহার। অমন মুখ মিথ্যে বলতে পারে? অমন চোখে অন্য কিছু লুকানো থাকতে পারে? পড়াতাম, মজা করে নাস্তা খেতাম, আর আপুর ছোট্টো বাবুটার সাথে দুষ্টুমি করতাম। পড়াতে কী যে আনন্দ হতো! নিজের সমস্তটুকু উজাড় করে দিয়ে পড়াতাম। ঘড়ি ধরে কোনওদিনই পড়াইনি। পড়াবই কেন? অন্য কাজ ছিল না যে! একটা কোচিংয়েই তো পড়াই, কতই বা সময় লাগে! দেড় মাস ফুরোতেই একটু করে খুব সংকোচে কিছু টাকা চাইলাম। আপু জানালেন, “আহা, টাকার জন্য ব্যস্ত হচ্ছো কেন? দেবো তো! তুমি পড়িয়ে যাও!” নিজেকে খুব ছোটো মনে হল। মনে হতে লাগল, আমি এত কমার্শিয়াল কেন? ছিঃ! কোচিং থেকে যে টাকাটা পেতাম, সেটাতে আমার দিব্যি চলে যেত! কী দরকার! থাক না ওটা উনার কাছে! পরে একসাথে অনেক টাকা পেলে বাসার জন্য অনেককিছু কিনবো। আহা! পড়াতে থাকলাম। সপ্তাহে ৪ দিন; ৩-৪ ঘণ্টা করে। নিজে অনেক পড়াশোনা করেছিলাম ভর্তি পরীক্ষার আগে। এইচএসসি পরীক্ষায় বুয়েটে পরীক্ষা দেয়ার মার্কস পাইনি, তাই চুয়েটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। (তখন চুয়েট-কুয়েট-রুয়েট ছিল না, বিআইটি ছিল।) নিজের সবটুকু জ্ঞান ঢেলে দিয়ে পড়িয়ে যাচ্ছিলাম। যে করেই হোক, বুয়েটে চান্স না পাওয়াটা ওর সাধ্যের বাইরে করেই ছাড়বো, এ-ই ছিল ধনুর্ভঙ্গ পণ। ওকে দিয়ে অনেক-অনেক প্র্যাকটিস করাতাম। প্রচুর হোমওয়ার্ক দিতাম। আমি চলে যাওয়ার পর যাতে ‘বাড়ির কাজ’ করতে-করতেই ওর সব সময় চলে যায়, সে ব্যবস্থা করে আসতাম। স্টুডেন্টদের অনেক-অনেক এঙ্গেজড রাখাই ছিল আমার পড়ানোর টেকনিক। আমার স্টুডেন্ট ঘুমানোর সময়ও পাবে না, ওকে অমানুষিক পরিশ্রম করতেই হবে—এটাই ছিল আমার শিক্ষকজীবনের মূলমন্ত্র।

দুইমাস শেষ হয়ে রোজার মাস এল। নাস্তার বহর আর বাহার দুইই আরও বাড়ল। আহা! কী যে মজার-মজার নাস্তা! এমন বাসায় আর কিছু হোক না হোক, কেবল নাস্তা খাওয়ার জন্য হলেও প্রতিদিন যাওয়া যায়। আপু কত্তো ভাল! এমন অমৃতসম নাস্তা দেখলে বেতনের কথা বলতে বড় লজ্জা লাগে। ওরা কত্তো বড়লোক! ওরা কি আমার টাকা মেরে দেবে? এ হয় না। আড়াই মাস গেল। হিসেব করে দেখলাম, সাড়ে বার হাজার টাকা জমে গেছে। আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কত সাইজের পাঞ্জাবি পর?” কিছুতেই বলতে চাইলাম না। “তোমার আপন বোন একটা পাঞ্জাবি দিতে চাইলে নিতে না?” এরকম আরও অনেক কথা বলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে পাঞ্জাবির সাইজ বলিয়ে নিলেন। আমি সেসময় সবসময়ই পাঞ্জাবি পরতাম, সাইজ ৪৪। কারোর কাছ থেকে উপহার নেয়া পছন্দ করতাম না, কিন্তু ওদের কাছ থেকে তো নেয়াই যায়, এত ভালমানুষ ওরা! কীভাবে ওদের মনে কষ্ট দিই?

ঈদ চলে এল। ওরা বাড়িতে যাবে। তিন মাসও প্রায় শেষ। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা ঈদের পরেই। আমার বিদায় নেবার পালা। আপুর ছেলেটাকে খুব মিস করছিলাম। বাচ্চাদের আমি এমনিতেই খুব ভালবাসি, আর ওই পিচ্চিটা ছিল অনেকবেশিই কিউট। আমি পড়ানোর সময় বেড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নিচে এসে বসে থাকত। ওকে ভীষণ আদর করতাম, সবসময়ই ওর জন্য চকোলেট নিয়ে যেতাম। আপু একদিন বললেন, “আচ্ছা, তিন মাস তো শেষ। আমরাও বাড়িতে যাব। তোমার পেমেন্টটাও তো দিতে হবে।” এটা শুনে কী যে লজ্জা পেয়ে গেলাম! “আপু, না না এসব বলবেন না! টাকা দেবেন আরকি!” “না না, তুমি কষ্ট করে পড়িয়েছ, তোমারও তো হাতখরচের জন্য টাকা লাগে। এই নাও ধরো, টাকাটা বুঝে নাও।” একটা নীল খামে কিছু টাকা হাতে পেলাম। গুনে দেখলাম না, পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। “ভাই, গুনে নাও, গুনে নাও!” “না না আপু, কী যে বলেন! কোনও সমস্যা নেই।” হাসিমুখে ওই বাসা থেকে বের হয়ে থ্রিহুইলারে চেপে খাম বের করে গুনে দেখলাম, ১৫ হাজার টাকার জায়গায় ৮ হাজার টাকা! দুটো পাঁচশ টাকার নোট ছেঁড়া, টেপমারা। ভাবলাম, আপু ভুল করে দিয়েছে, কালকে গিয়ে বললেই হবে। কী যে বোকাসোকা ছিলাম তখন!

পরের দিন গিয়ে খুব সংকোচে বললাম, “আপু, কালকে বোধ হয় আপনি আমাকে ভুল খাম দিয়েছেন।” “মানে?” (গলা বেশ উঁচু!) আমি খুব নরোম স্বরে বললাম, “কিছু মনে করবেন না, খামে টাকাটা গুনতে গিয়ে দেখি, ৭ হাজার টাকা কম আছে।” “কম থাকবে কেন? আমি তোমাকে ৮ হাজারই দিয়েছি।” “কিন্তু, আমাকে তো পনের হাজার টাকা দেয়ার কথা।” “১৫ হাজার? ও মাই গড! তুমি এত টাকা দিয়ে করবেটা কী? এখনও তো স্টুডেন্ট! কত টাকা লাগে তোমার? তুমি চাকরি করলেও কি এত টাকা পেতে নাকি?” উনার কথার এ সুর আমি কখনওই দেখিনি। বললাম, “আপনি এসব কী বলছেন? আমি যা-ই হই, আপনার সাথে তো ওটাই কথা ছিল আমার! আপনি কম দেবেন কেন?” “কম দিচ্ছি কোথায়? তোমার যা দরকার, তা-ই দিচ্ছি। এর বেশি দিলে তো তুমি সেটা বাজে কাজে খরচ করবে। আর তুমি এমন কী পড়িয়েছ যে তোমাকে অতো টাকা দিতে হবে? আফিয়া যদি বুয়েটে চান্স না পায়? তুমি কি এটার গ্যারান্টি দিতে পারবে? তোমাকে এত ছাড় দিতাম, আমরা যা খেতাম, তা-ই খেতে দিতাম, আজকে তুমি সব ভুলে গেলে? তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবিও কিনেছি। এখন কোনও কথা না বলে এটা রেখে দাও। এই আফিয়া, তোর ভাইয়ার পাঞ্জাবিটা নিয়ে আয় তো!” আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, ওরকম কিছু একটা আসলেই ঘটছে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় উনাকে খামটা ফেরত দিয়ে বললাম, “আপু, আমি ১৫ হাজার টাকার একটা টাকাও কম নেবো না।” উনার কথাগুলি আমার আত্মসম্মানে লাগছিল। “পাগল নাকি! ১৫ হাজার টাকা মানে তুমি বোঝো কত টাকা? এখনও তো চাকরি কর না, তাই বুঝবে না। তোমার বাবা তো আর গরিব না। উনি আইনজীবী মানুষ, উনি শুনলে কী ভাববেন, বলতো? তুমি এরকম টাকা-টাকা করছ কেন? এত কম বয়সে তোমার মাথায় এত লোভ ঢুকল কীভাবে? আচ্ছা যাও, আরও ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছি। আর কিচ্ছু বলো না। ধর, এবার নিয়ে যাও।” উনি উনার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলতে লাগলেন। মাথায় রক্ত চেপে গেল। উনার সামনের সেন্টার টেবিলে খামটা রেখে খুব শান্ত গলায় বললাম, “আপু, আমার টাকা লাগবে না। এটা দিয়ে ওকে ঈদের ড্রেস আর কিছু খাবার কিনে দেবেন।” এই বলে আপুর ছোট্টো বাবুটাকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে ওই বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। আফিয়া আসার সময়ে বলেছিল, “স্যার, আপনি কোনও কষ্ট রাখবেন না মনে। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

সত্যি বলছি, আমি ওকে কখনওই কোনও বদদোয়া দিইনি। আমারই তো স্টুডেন্ট! অভিশাপ কীভাবে দিই? কিন্তু ন্যাচারাল জাস্টিস সবসময়ই কাজ করে। পরে জেনেছি, ও কোথাও চান্স পায়নি, অনেক টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়াশোনা করেছে।

আমি ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় সায়েন্সের সাবজেক্টগুলি পড়তাম আমাদের স্কুলের সমর স্যারের কাছে। উনি ডিসেম্বর মাসে পড়াতেন না, কিন্তু কেউ বেতন দিলে ‘না’ করতেন না। আমাদের সাথের অনেকেই স্যারকে ওই মাসে বেতন দিত না। কিন্তু বাবাকে এটা বলাতে উল্টো বকা দিয়ে বলেছিলেন, “উনার সংসারের কিছু ফিক্সড খরচ আছে। সেটা তো উনাকে মেইনটেইন করতে হয়। তুই স্যারের টাকাটা নিয়ে যাস।” কখনওই কোচিংয়ের কোনও স্যারের একটা পয়সাও মেরে দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমার বাসায় এসে টিচার পড়াতেন। টিচার মাসে ১ সপ্তাহ পড়ালেও বাবা পুরো মাসের টাকাটা দিয়ে দিতেন। তখন বাবাকে খুব বোকা মনে হত। এখন বুঝি, জীবনের হিসেবে ঈশ্বরের কখনওই কোনও ভুল হয় না।

আমি স্টুডেন্ট পড়িয়ে অনেক টাকা আয় করেছি। পরে যখন নিজের কোচিং দিলাম, তখন তো প্রতি মাসে ভূতের মতো টাকা আয় করতাম। অনেক স্টুডেন্ট বেতন দিত না, বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেটা দিয়ে ঘোরাঘুরি করতো, ডেটিংয়ে যেত। ওরা পরবর্তীতে খুব বেশিদূর যেতে পেরেছে বলে শুনিনি। এমনই হয়। হওয়া উচিতও। আমি চাই, এরকম স্টুডেন্ট অবশ্যই জীবনে শাস্তি পাক।

অনেক টিউশনি থেকে বেতন পাইনি। আমি জীবনে কখনও কারও কাছ থেকে পড়িয়ে কম টাকা নিয়েছি বলে মনে পড়ে না। হয় পুরো টাকা নিয়েছি, অথবা একেবারে ফ্রি পড়িয়েছি। অনেক গরীব ছেলেমেয়ের কাছ থেকেই পয়সা নিতাম না। গরীবদের ফ্রি পড়ালে বরং ভাল। পার্থিব এবং অপার্থিব, দুই ধরনের লাভই আছে। মনে অনেক শান্তি পাওয়া যায়। কম টাকা নেয়াটা আমার কাছে সবসময়ই অপমানজনক মনে হত। আমার শ্রমের আর মেধার দাম আছে। কেউ হয় সে দামটা পরিশোধ করবে, নতুবা সে দাম পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকলে বিনে পয়সায় আমার কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করবে। হয় আমার সময় ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করব, কিংবা আমার সময় অমূল্য রেখে দেবো—আমি এ নীতিতে বিশ্বাসী।

গার্ডিয়ানদের বলছি, ছেলেমেয়ের মাস্টারকে কম টাকা দেবেন না। যদি আপনি ব্যবসা করতেন, তবে আপনি ইনভেস্ট করতেন না? পৃথিবীর সবচাইতে ভাল ইনভেস্টমেন্ট হল, নিজের সন্তানের পড়াশোনার পেছনে ইনভেস্টমেন্ট। এর রিটার্ন সবসময়ই সবচাইতে বেশি! ডাক্তারকে কম টাকা দিলে রোগ সারে না, মাস্টারকে কম টাকা দিলে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। এটা পরীক্ষিত সত্য। ছেলেমেয়েকে পড়ানোর সময়ে কখনওই কার্পণ্য করবেন না। ওরা মানুষ না হলে, আপনার জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ই নিরর্থক!

মজার ব্যাপার হল, আমার ছোটভাইও ওর জীবনের প্রথম টিউশনি থেকে একটা টাকাও নেয়নি। একই কারণে, ওরা কম দিতে চেয়েছিল। ছেলেটাকে ও কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি কোচিং করিয়েছিল। (আমার ছোটভাই কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সের ভর্তি পরীক্ষায় থার্ড হয়েছিল।) ওই ছেলে কোনও সরকারি স্কুলে চান্স না পেয়ে পরে একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়েছে। ওর বাবার জুতোর ব্যবসা ছিল, উনার আর উনার স্ত্রীর মানসিকতা ছিল জুতোর তলায়। অনেকেই হয়তো বলবেন, এটা ঠিক না। টিউশনিতে যা পাই, তা-ই লাভ। নাই মামার চাইতে কানা মামাও ভাল। কিন্তু আমি মনে করি, এতে নিজের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস কমে যায়।