পৃথিবীতে খুব সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে জামাইআদরের মতন 'উদ্ভট' এবং অহেতুক একটি প্রথার জন্ম হয়েছিল। কেন হয়েছিল, আমার তা জানা নেই; এবং এ যুগে এসে এখনও অনেক পরিবার এই বিদঘুটে প্রথাটিকে ঠিকঠাক অনুসরণ ও পালন না করতে পারাকে নিজেদের অক্ষমতা বলে ধরে নেয়। এই প্রথায় জামাই মানে মেয়ের জামাইকে আদর করতে করতে বাঁদর না বানানো পর্যন্ত তো অনেক পরিবার মেয়ের জামাইকে জামাই বলতেই অস্বস্তি বোধ করে! কীরকম? উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করে বলছি:
১. বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে, যারা প্রয়োজনে ধারদেনা করে হলেও বছর বছর পশু কুরবানি করে শুধু মেয়ের জামাইকে আপ্যায়ন করতে, জামাই ও জামাইয়ের পরিবারের কাছে নিজের মেয়েকে দামি করে তুলতে। অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের জামাই তার স্ত্রীর বাপের বাড়ির আর্থিক দুরবস্থার কথা জেনেবুঝেই সেই কুরবানির গোশত ভক্ষণ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে শ্বশুরকূলকে পথে বসিয়ে দেন। আমাদের দেশে অনেক পরিবারেই জামাইকে কে কত বেশি উপহার দিতে পারে, খাওয়াতে পারে, তার উপরে মেয়ের সুখে থাকা নির্ভর করে। শুধু তা-ই না, অনেক ক্ষেত্রে এ-ও হতে দেখেছি, বেকার, বাজে লোক, দুর্ব্যবহারকারী, মেয়ের গায়ে হাত তোলে এমন মেয়ের জামাইকেও শ্বশুর-শাশুড়ি জামাইআদর থেকে বঞ্চিত করেন না; ঠিকই রুইমাছের মাথাটা জামাইয়ের পাতে তুলে দেন!
২. আমাদের দেশে অনেক পুরুষমানুষ এত বেশি পরিমাণ হীনমন্যতায় ভোগে যে, শ্বশুরবাড়িতে তার সামনে কয়টা মাছ, মাংস, দই-মিষ্টির আইটেম রাখা হয়েছে, তা দিয়ে নিজের সম্মান, শ্রদ্ধা, অবস্থান বিচার করে! ইয়ে মানে, ওই খাবারের আইটেমগুলোর সাথে সাথে তারা আত্মসম্মানবোধও চিবিয়ে খেয়ে ফেলে অনায়াসে! অবশ্য, ওদের ওই বোধটুকু আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে গবেষণারও দরকার পড়ে না!
৩. এসব ব্যাপারে স্ত্রীরত্নরাও কম যান না! এই উদ্ভট প্রথা টিকিয়ে রাখার পেছনে শুধু বেআক্কেল জামাই ও শ্বশুর-শাশুড়িরই হাত নেই, সেই জামাইদের বেআক্কেল বউদেরও হাত আছে। অবশ্য ছোটোলোক প্রকৃতির জামাইয়ের বউ হয়ে বাঁচতে চাইলে নিজেও ওরকম ছোটোলোক ও বেআক্কেল না হয়ে থাকাটা তো রীতিমতো একটা অপরাধ!
এখন কয়েকটা সত্য ঘটনা বলি।
ঘটনা ১:
চাচীর লাশ দেখতে এক মেয়ে বহুদিন পর তার স্বামী আর পরিবার নিয়ে চাচীর বাড়িতে যায়। সেই শোকের বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখে, "সামান্য" ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। তা দেখে সেই মেয়ে রাগে ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, 'আমি নাহয় এটা খেতে পারব, তাই বলে তোমরা তোমাদের জামাইয়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে পারলে না!'
ঘটনা ২:
এক আত্মীয়ের জন্মদিনে গেলাম। রান্না করা হয়েছিল চিকেন বিরিয়ানি। সবাই মজা করে খাচ্ছিলাম। একসময় দেখলাম, সেই বাসার একমাত্র জামাইয়ের জন্য মুরগির বদলে গরুর বিরিয়ানি রান্না করা হয়েছে। মুরগির বিরিয়ানি খেতে দিলে যদি জামাইকে অসম্মান করা হয়! অবশ্য, সেই বলদমার্কা জামাই এটা বোঝেইনি যে, সবাই যা খাচ্ছে, সেটা বাদ দিয়ে অন্যটা খাওয়াই হচ্ছে সেক্ষেত্রে অসম্মানের। গরুর প্রতি বলদের অমন টান দেখে সেদিন খুব হাসি পেয়েছিল।
ঘটনা ৩:
এক মেয়ের জামাই নিজের শ্বশুরবাড়ি বাদ দিয়ে চাচাশ্বশুরের বাড়িতে ওঠেন। এর কারণ, সেই বাড়িতে তাকে চুলা থেকে পিঠা নামানোর সাথে সাথেই একদম গরম গরম পরিবেশন করা হয়। তার শ্বশুরবাড়িতে আবার খাবার বাড়ার সময়টাতে যেটুকু ঠান্ডা হয়ে যায়, সেই ঠান্ডা খাবার খেলে তার নাকি নিজেকে বাড়ির জামাই বলে মনেই হয় না!
এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। আপনি চারপাশে চোখ মেলে দেখুন, ঠিকই এসব বিশ্রী ব্যাপার দেখতে পাবেন।
আমাদের দেশে মেয়ের মায়েরা জামাইদের পছন্দ-অপছন্দ একদম ঝাড়া মুখস্থ করে রাখেন; কিন্তু খুব কম ছেলের মা-ই আছেন, যাঁরা ছেলেবৌয়ের পছন্দ-অপছন্দের খবর রাখেন। সত্যিই অবাক লাগে এসব পরগাছা সংস্কার আর আগাছাটাইপ "জামাই"দের দেখে। শুধু মেয়ের সুখের জন্য এসব উটকো লোকদেরকে বাবা-মায়েরা টাকাপয়সা, সম্মান-শ্রদ্ধা দিয়ে ডুবিয়ে রাখেন, যেগুলো নিজচোখে দেখলে ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে!
ঘরে ঘরে এখনও অনেক কুলাঙ্গার জামাই আছে, যারা শ্বশুরবাড়ির সর্বস্ব কেড়ে নেয় রীতিমতো নিজের অধিকার ভেবে! আমি মনে করি, জামাইআদরের নামে আর্থিকভাবে অসচ্ছল নিরীহ মানুষদের উপর যুগ যুগ ধরে যেসব মানসিক অত্যাচার, আর্থিক শোষণ ও জুলুম চলে আসছে, সেগুলোকে লাথি মেরে সমাজ থেকে তুলে দেবার সঠিক সময় চলে এসেছে।
পুনশ্চ। বাংলাদেশ ছাড়াও বাংলাভাষী সকল অঞ্চলে এই অদ্ভুত অপপ্রথার প্রচলন রয়েছে।