গায়ের রং, মনের রং





কিছু কিছু মানুষ দৈহিক সৌন্দর্যকে এতটাই মূল্যায়ন করে যে, দেখলে ভীষণ অবাক হই। যে দেখতে ফরসা নয়, সে-ই ওদের চোখে অসুন্দর ও কালো। আর কালো মানেই, ওদের ভাবনায়, বাজে ও মূল্যহীন। যার গায়ের রং ফরসা, মনের রং কালো, ওদের চোখে…সে-ও ভালো সে-ও ভালো! এই দলে উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, প্রায়শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই-ই আছে! এই জায়গাতে ওরা খুব বিশ্রী রকমের ঐক্যবদ্ধ!

 যা-ই হোক, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও ঠিক এরকম করে ভাবে। ওরা সবাই দেখতে কম-বেশি ফরসা। আর ওরা কালো কাউকে সহ্যই করতে পারে না। আমার হাজব্যান্ড আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে বলে আমাকে ওরা খুব অনিচ্ছেতেও মেনে নিয়েছে। যেহেতু আমার হাজব্যান্ডের আয়ে সংসার চলে, সেহেতু সংসারে ওর সিদ্ধান্তের একটা বিশেষ দাম আছে।

 গত নভেম্বরে আমার ছেলে হলো। ও দেখতে খুব কালো হয়েছিল। আমার মায়ের কাছে শুনেছি, বাচ্চাদের গায়ের রং জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত বদলাতেই থাকে। কিন্তু আমার ছেলেটা হবার পর থেকেই ওর গায়ের রং নিয়ে আমার শাশুড়ি ও ননদের মুখে নানান রকমের কটুবাক্য শুনতেই থাকলাম। ‘এই ছেলে আমাদের বংশে কীভাবে হলো?’ ‘এটা তো দেখতে মা আর নানির মতোই কালো হয়েছে!’ ‘আল্লাহ, আমার ভাইটা দেখতে এত সুন্দর, আর ওর ছেলে এরকম কালো কেন হলো?’ ‘কালো মেয়ে এই বাড়িতে আনাটাই ভুল হয়েছে!’ এরকম আরও হাজারো কথা।

 কথাগুলি ওরা বলত আমার সামনে এসেই। আমার হাজব্যান্ড অবশ্য আমাদের ছেলের গায়ের রং নিয়ে কখনও কিছু বলেনি, তবে ওদের ওরকম কথার কোনও প্রতিবাদও কখনও করেনি। ও একজন প্রতিবাদহীন ঝামেলা-এড়ানো মানুষ। মা-বোনের অন্যায় দেখলেও কিছু বলে না, আবার এদিকে আমার অভিযোগগুলিও চুপচাপ শুনে যায়---সেগুলির পক্ষে বা বিপক্ষে, কোথাও তাকে কখনও দেখিনি। শুধু বলে, মানিয়ে নাও। ওর এমন নীরব ভূমিকা ওদের আরও আশকারা দেয়। ওরা দ্বিগুণ উৎসাহে আমায় নানান রকমের খোঁটা দিতেই থাকে।

 এখন ছেলেকে নিয়ে আমার হাজব্যান্ডের আহ্লাদের কোনও শেষ নেই। এমন একটা ভাব যেন এই ছেলের জন্য সে প্রাণটাও হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারে। আমার ছেলের গায়ের রং এখন আর কালো নেই, ওকে শ্যামলা বলা যায়। মজার ব্যাপার হলো, ছেলের প্রতি আমার হাজব্যান্ডের এমন টান দেখে আমার শাশুড়ি আর ননদ এখন আর তেমন কিছু শোনায় না আমাকে। ছেলেকে নিয়ে বাবার এমন আহ্লাদ আগে কিন্তু ছিল না।

 এর মানেটা কী দাঁড়াল? স্ত্রীর পাশে বা পক্ষে স্বামীর অবস্থানটা পরিবারে স্ত্রীর অবস্থানটাকে অবশ্যই শক্ত করে। যে মেয়ের পাশে তার স্বামী দাঁড়ায় না, সে মেয়ের পক্ষে পরিবারে টিকে থাকাটা অনেক কঠিন। তার চাইতে একাকী মানুষ আর হয় না।

 এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার হাজব্যান্ড যে সন্তানকে নিয়ে ওদের এত আজেবাজে কথা বলার সুযোগ করে দিল সেই সময়, সে সন্তানকে নিয়ে এখন তার কত আগ্রহ, কত ভালোবাসা। এই যে ভালোবাসাটা, এটা কি মেকি নয়? তার তখনকার অবস্থানটা এরকম ছিল না কেন? কেন সে এমন দুমুখো সাপের মতো তার ভূমিকাটা দেখাল? নিজের সন্তানকে নিয়েও যে তার পজেসিভ ভূমিকাটা দেখাতে পারে না, সে আবার কেমন পিতা?

 আমি যখন হয়েছিলাম, ঠিক একই রকমের কথা আর খোঁটা আমার মাকেও শুনতে হয়েছে। সেই সময় আমার বাবার ভূমিকাটা ছিল আমার স্বামীর ভূমিকার মতো। আমি তো সেই বাবারই মেয়ে! মায়ের দীর্ঘশ্বাস কি তবে বিধাতার ইশারায় আমার গায়ে এসে পড়েছে? এ কি তবে আমার বাবার কৃতকর্মের ফল? নিজের বাবাই হোক, আর স্বামীই হোক, পুরুষমানুষ মাত্রই কি তবে এরকম?

 এসব ভাবলেও আমার কান্না পায়। কালো হয়ে জন্মানোটা কি পাপ তবে? নিজের জন্মের উপর কি কারও হাত থাকে? নিজের চেহারা বা গায়ের রঙের উপর কারও হাত থাকে? বাহ্যিক সৌন্দর্য কি এমন কোনও কিছু, যা কষ্ট করে অর্জন করতে হয়? যা নিজের অর্জনই নয়, তা নিয়েও এত কীসের অহংকার মানুষের? এইসব সহজ কথা যদি নিজের জন্মদাতা বাবাই না বোঝে, তবে আর কে বুঝবে? বাকিদের দোষ দিয়ে কী হবে!

 একবিংশ শতাব্দী চলছে। মানুষ আর কখন মানুষকে সত্যিকারের ভালোবাসতে শিখবে? গায়ের রঙের দিকে তাকিয়ে থাকে যারা, ওদের চোখে আর বোধে কি মনের বা মস্তিষ্কের রঙটা কখনওই ধরা পড়ে না? সুন্দর মানুষ, এর অর্থ হবার কথা ছিল ‘সুন্দর মনের মানুষ’, আর আমরা কিনা সেটাকে বানিয়ে ফেলেছি…‘সুন্দর গায়ের রঙের মানুষ’! সত্যিই, এই সমাজটা মানুষের মেধা আর মননের সৌন্দর্যটা কিছুতেই ডিজার্ভ করে না।

 যে সমাজের পুরুষদের কাছে নিজের সন্তানের গ্রহণযোগ্যতাও গায়ের রংনির্ভর, সে সমাজে নারীদের মস্তিষ্ক আর মননের বিকাশটা সুষ্ঠুভাবে হবে না, এটাই স্বাভাবিক।