প্রযত্নে পেখম,
তোমার ভাবনাদেয়ালের যত পলেস্তারা, ওদের মতো আমিও খসে পড়তে পড়তে ভালোই আছি। বহু শুভলগ্ন পেরিয়ে গেল, তবু একটাও চিঠি এল না আজও। ডাকবাক্সটা যে আমার শূন্যই পড়ে রইল! ফিরতিচিঠি দেবো বলে যে-কটা সুগন্ধি খাম কিনেছি, দমবন্ধ হয়ে সব মরে পড়ে আছে বাক্সে। একদিকে আমার ডাকবাক্সটা শূন্য, অন্যদিকে আমার সোনালি বাক্সটা মৃত খামে পূর্ণ! কী-একটা জীবন যে হয় বিপন্ন চিঠির!
থাক সেসব কথা। আজ বরং তোমায় একটা গল্প শোনাই, সে-ই ভালো। গল্পটা নিজেই গোটা একটা জীবন, একটা মুক্তপ্রাণ, একটা উপন্যাসের খসড়া, যার হয়তো অনেক কিছুই সংশোধনের এখনও বাকি। অনেকের তুমি, অথচ এক আমারই তুমি, যে ভালোবাসে ভিন্নতা, ভালোবাসে জন্মান্তর, ভালোবাসে শান্তি। আজ তবে ঠিক সেই স্বাদে ভিন্নতার আদলে গল্প শোনাব তোমাকে, শোনাব কবিতায়, শোনাব ভাঙা ছন্দে!
তোমার কি মনে আছে, ঠিক তিন বছর আগে সংকীর্ণতার খোলসে পোরা এক লিভিং-ফসিল হুট করেই তোমার গণ্ডিতে ঢুকে পড়েছিল!? একটা খুদেবার্তা, তোমার নাম লেখা তাতে। কী ছিল লেখা ওতে? কেমন ছিল তার ধরন? কিছু কি চেয়েছিল সে তোমার কাছে? ভেবেছিলে কি সেসময়…উটকো ঝামেলা! আর সবার মতোই জ্বালাতে এসেছে আমাকে, গবলেট! বিশ্বাস করেছিলে তুমি তাকে? বিশ্বাস করার মতন যদিও সে কিছুই করেনি—তখনও না, এখনও না! সে জানে, চিনেবাদামের খোসা ছাড়িয়ে আয়েস করে চিবোনোর মতন কিংবা মুখের কথায় দু-চারবার প্রতিশ্রুতি দেবার মতন সহজ তা নয়। প্রশ্ন, তার সাথে কড়ালিকারে অবিশ্বাস, আবারও প্রশ্ন…এবার ধোঁয়াওঠা একটুখানি দ্বিধা, আর তারপর একসময় বিশ্বাস করে ফেললে তাকে। আচ্ছা, বিশ্বাস মানুষ কেন করে? বেঁচে থাকতে হলে পৃথিবীতে কাউকে-না-কাউকে বিশ্বাস করতেই হয়, প্রত্যেকটা মানুষ এই কথাটাকেই ধ্রুব মানে! কেন? তার নিজের জন্য? না কি সামনে দাঁড়ানো মানুষটার জন্য?
একদিন বিকেলের শেষে, মানে ওই তো সন্ধেটা হবে হবে করছিল, এমন সময় মেঘে মেঘে দারুণ ঝগড়া! সে কী বৃষ্টি! বারান্দায় বসে বৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম, বৃষ্টির শ্বাশত ফোঁটা আমার প্রতিটি মাংসের ভাঁজে ভাঁজে শুদ্ধতা ছড়িয়ে দিতে থাকল, আমার মাংসে মাংসে পবিত্রতা ঢুকছে, আমি পবিত্র হচ্ছি বৃষ্টির ছন্দে, মাটির গন্ধে, মেঘের কাজলে! ফুসফুস ভরে গেল সদ্যপ্রসূত বাতাসে! নির্মল, শীতল, পরিশোধিত প্রাণ সঞ্চরিত হলো রক্তে, মাংসে, নিঃশ্বাসে! মনে হলো, এ বৃষ্টি নয়, এ তো কবিতা! শুদ্ধতম পঙ্ক্তি যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে! আমি ছুঁয়েছি, স্বাদ নিয়েছি মাংসে, রক্তে! আমার রক্ত ভরে গেছে পঙ্ক্তিতে, ফুসফুসে জমেছে শব্দরা! এত সুখ স্বার্থপরের মতো শরীরের মেখে যাচ্ছি...যাচ্ছি তো…যাচ্ছিই, হঠাৎ দেখি, তুমি সেখানে! আনন্দে পাখির মতো ডেকে উঠেছিলাম—
'জানেন, আমাদের এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘমাসিরা ঝগড়া বাধিয়েছে কিনা। সে যাকগে! আচ্ছা, আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে? বৃষ্টিতে ভিজে কখনও আম চুরি করেছেন?... তারপর...কদম…শাড়ির পাড় বেয়ে গড়িয়ে-পড়া বৃষ্টি...রাজহাঁস...সবুজ মাঠে জমতে থাকা বৃষ্টির শরীর...পুকুরে মাছেদের নেত্ত…!'
আরও কত-কী যে বলেছি সেদিন! তুমি করে বলতে তখনও শিখিনি! আপনি…হ্যাঁ, আপনি…আরও একবার আপনি…শুধু আপনাকে ডাকতেই তখন ভালো লাগছিল! বৃষ্টি দেখলেই এখন ইচ্ছে করে, কোথাও লিখি তোমার নাম। ভরাআঁচলের একটুখানি শুদ্ধতা তোমায় দিতে চেয়েছিলাম সেদিন। তুমি শুধু ভালোবাসাটাই দিয়েছিলে আমায়! সুখ বিনিময় করেছিলে। একটা নাম দিয়েছিলে তোমার কাছে আমার, আমার কাছে তোমার, আমাদের পথের, তখনও গর্ভে-থাকা বাগানটার, কবিতার, ঘরের চালে ফুরিয়ে যাওয়া রাতটার! সুখী করেছিলে আমাকে। নিজেকে সুখী ভাবতে আমি সুখ পাই, জানো! সুখ পাই তোমাকে ভালোবাসি বলতে, তোমার জন্য প্রতীক্ষা আমাকে সুখী করে। কবিতা সুখ দেয়, দুঃখ সুখ দেয়, তোমার অভিমান সুখে ভরে তোলে।
তুমি আছ ভাবনাটা আমাকে সুখ দেয়। তুমি থাকবে না ভাবনাটা আমাকে কষ্ট দেয়, তবুও আমি সুখ পাই। কেঁদে কেঁদে যে সুখটা পাই, খুব করে হেসেও সে সুখটা পাই না। আমি রক্ত দিয়ে, মাংস দিয়ে, নিঃশ্বাস দিয়ে সেই সুখ অনুভব করি, স্পর্শ দিয়ে নয়। ভালো কথা, মনে পড়ে, নামটা ঠিক কী দিয়েছিলে?
সেই থেকে পথ চলেছি। তুমি আমার ব্যক্তিগত পথ, আমায় সুখী করে সে পথটা। ওই পথে প্রজাপতি হয়ে ফুলেরা ওড়ে, ডানাভর্তি রঙে সুখ মেখে ওড়ে; আমি ওদের দেখি, আমার চোখদুটি সুখ পায়। আমাকে দেওয়া তোমার প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে সুখী করেছে। না-দেওয়া মুহূর্তগুলোও আমাকে সুখী করেছে, কেন জানো? আমি সময় পেয়েছি তোমায় নিয়ে আমার ভাবনাগুলোর যত্ন নেবার। কোথাও কে যেন বলেছিল, Take care of your thoughts when you are alone! ওগো আমার নীলরঙা পেখম, তোমাকে ভালোবেসে আমি সুখী।
তুমি যদি রোজ আমার স্বপ্নে আসতে, আমি সুখী হতাম; তুমি তিন বছরে এক বার এক মুহূর্তের জন্যে আমার স্বপ্নে এসেছ, আমি এতেও সুখী হয়েছি। স্বপ্ন…সে কেন আসে? তাকে ডেকেছি? না তো! না এলেই-বা কী হতো? এসব নিয়ে কখনও ভাবিইনি। হ্যাঁ, তবে একটা ব্যাপার, স্বপ্ন এলে কী হয়, তা এবার জেনেছি! আমাদের কখনও দেখা হয়নি, তাই বলে প্রতিরাতে স্বপ্নে তোমাকে চেয়েছি, এমন নয়। বরং কখনোই চাইনি বা চাইতে হয়, তা-ও ভাবিনি! স্বপ্ন দেখার সুখটা কেমন, ঠিক অনুভব করে উঠতে পারিনি কখনও।
বেশ অনেক দিন ধরে তোমাকে দেখার জন্য তীর্থের কাকের মতন হাঁ করে ঠিক ভুঁইচাপা হয়ে বসে আছি। কোনও কোনও দিন এমন হয় যে ইচ্ছে করে, মাকে না বলেই বেরিয়ে পড়ি! কিন্তু আমি যে ভয় পাই গো! নতুন দর্শনের পাঠে বড্ড ভয়। বাইরের আকাশ, গোত্তাখাওয়া হাত-পা ছড়ানো ঘুড়ি, উড়তে থাকা পাখি, ব্যস্ত মানুষের ঢিবি, তাদের চোখের পরিবর্তিত রং আমার বড্ড বিচ্ছিরি লাগে, ভয় করতে থাকে। মনে হয়, সবাই আমার উপর ক্রুদ্ধ, বিরক্ত। বুঝতে পারি না কী করব। কোথায় যেতে হবে আমাকে, কতদূর! কী করে গাড়ি চড়তে হয় আমি ভুলে যাই, কার কাছে যাব মনে করতে পারি না। অসহায় লাগতে থাকে। মনে হতে থাকে, আমার কেউ নেই, আমি কয়েক লক্ষ পিঁপড়ের মাঝে একটা মৃত ফড়িং!
ছোট্ট থেকে এখন অবধি মা আমার হাত ছাড়েনি তো, তাই বোধ হয় অমন ঘরকুনো ব্যাং হয়েছি। তবে মা সাথে থাকলে খুউব সাহস বেড়ে যায় আমার, বাসের উসকোখুসকো মানুষগুলোকে আমার বুবুর বানানো পাটিসাপটার মতন লাগে, কাকের দলটাকে প্রজাপতির দল মনে হয়, মনে হয় কলেজ-পালানো বখে-যাওয়া পানুর দলটাকে কষে চড় মেরে আসি। ফুটপাতের হাঁটারাস্তায় মাঝবয়সি শকুনগুলোর মুখে থুথু ছিটিয়ে আসি। কী করবে ওরা, ওদের আমি থোড়াই পরোয়া করি…বয়েই গেল! খুউব নিশ্চিন্ত মনে হয় নিজেকে তখন, শান্তি পাই, যেমনটা তোমাকে ভালোবাসলে পাই।
সেদিন রাত্রিবেলা, সব ব্যস্ততা শেষে আমার আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসেছিলাম, আর মাথায় তুমি। অনেক চিন্তাভাবনার পর দুটো লাইন আর কার্বনীয় রক্তমাংসের মিশ্রণে এক-আধটু অনুভূতি এঁকেছিলাম। দেখানো হয়নি তোমায়। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আকাশ ভেঙে আবারও নেমেছিল সেই ঘন বৃষ্টি! বৃষ্টির নির্যাস নেবার লোভে যেই চৌকাঠ পেরিয়েছি, পায়ের নিচের মাটি হড়কে হড়কে মনে হচ্ছিল, কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন শূন্যে উড়ছিলাম, আহা! স্বাধীনতার সুখ! আর তারপর ভূতলশয্যায়! তৃষ্ণার্ত চাতক আমি ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম একাই নিজের খেয়ালে; প্রথম হোঁচট খেয়ে পড়েছি যখন অতলে, খুব যত্ন করে হাত বাড়িয়ে শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়েছ তুমি…এক তুমিই এসে!
স্বপ্ন আমার বিগত পাঁচ বছরের প্রাক্তন! শেষবার ঘুমিয়েছি বছর পাঁচেক আগে। সে এসেছিল কোনও এক রাতে এমনই অপরিকল্পিত পথে, সৈয়দ শামসুল হকের "অচিন্ত পূর্ণিমার" মতো। তারপর, দু-চোখের ঘুম নিলামে রেখেছি বহুবছর! চিরটাকালের নিভৃতবাসী আমারই চোখের কোটরে নিঃসঙ্গ অমাবস্যা জমতে থাকে শ্যাওলার মতন।
অসুস্থ চোখে চেয়ে দেখেছি, মানুষের শরীরেই আজ মানুষ নিখোঁজ! আত্মার মোড়কে বৈধ শব্দের অপমৃত্যুর মিছিল চলছে।
কুমারী জোছনায় হেঁটে যায় লজ্জিত প্রেমিক। প্রতিশ্রুতি ভেঙে আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে ঘনিয়ে আসে বিচ্ছেদ, কেউ তা দেখে না, কেউ তা বোঝে না! দুর্বল মুঠোয় কেঁদে ওঠে বিপন্ন যৌবন। ভারি অদ্ভুত সময় চলছে পৃথিবীর, প্রেমের, সবুজ পাতাদের, কবিতার, লাউডগার এবং গৃহবধূটির! সেই যন্ত্রণায় মরে যায় নক্ষত্র, করে নিজেই নিজেকে দাহ!
শুধু একটা স্বপ্নই পারে মুক্তি দিতে ওদের। হ্যাঁ, সেই স্বপ্ন, যা দেবে আনন্দ, দেবে ঘুমোবার অবকাশ। পৃথিবীসুদ্ধ লোক আজ যতটা না ভালোবাসার কাঙাল, ততোধিক ঘুমের কাঙাল! সেই কবে মায়ের বুকের গাঢ় ভাঁজে মুখ গুঁজে নির্ভার হয়ে ঘুমিয়েছিল, কারুরই হয়তো মনে নেই! এই পৃথিবীতে যে ঘুমের বড্ড আকাল গো! ওদের তো এবার মুক্তি চাই! কোথায় পাবো সেই মুক্তি? কে দেবে মুক্তি আমার মুঠোতে তুলে আঁজলা ভরে? তুমি...? হ্যাঁ, তুমিই তো!
তুমিই সেই মুক্তি, আনন্দ, সুখ আর না-ফুরোনো অবকাশ! নির্ভার হয়ে ঘুমোনোর শপথ, তুমি স্বপ্ন, তুমি সবুজ পাতা, তুমি কবিতার অতল এবং গৃহবধূটির লাউডগা। ওরা সবাই সন্ধানীযাত্রী তোমার। যখনই তোমার মুখটা ভেসে ওঠে, জীবনানন্দর সেই কবিতাটা মনে পড়ে…
একদিন খুঁজেছিনু যারে বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে, মালতীলতার বনে,- কদমের তলে, নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,- শেফালীর দলে! -যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো কামিনীর ব্যথার শিয়রে…
কেমন আছ জানতে চেয়ে বিব্রত করলাম না আজ। প্রিয় স্বপ্ন আমার, যত্নে থেকো, চিঠি লিখো, সন্ধে নামলে ফিরে এসো!
ইতি তোমার না-ছোঁয়া মৌরি
আষাঢ় ১৪২৯ ফুল পত্রলেখা, রজনীভাগ ২ (পেখম মৌরি) সুবর্ণগ্রাম, ঝিল রুহিতন