একটা সুইসাইড নোট দিয়ে লেখাটা শুরু করছি।
১৮ ডিসেম্বর
আমি এই কথাগুলো লিখে রেখে যাচ্ছি। মৃত মানুষ কী লিখে রেখে গেল এটা নিয়ে কারোর কিছু এসে যায় না, জানি। আমি এখনো বেঁচে আছি, এতেই বা কার কী? মানুষ কতটা অসহায় হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, আজ সেটা বুঝতে পারছি। বেঁচে থাকতে সবাইকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। আর কত? কালকে আমার জন্মদিন। কাউকে আমার জন্য কষ্ট করে দুটো তারিখ মনে রাখতে হবে না। আমার মিশনটা আগামীকাল সম্পন্ন করব। সবার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থী। সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কাউকে কোন আঘাত দিয়ে থাকলে আমি সত্যিই আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বেঁচে থাকতে কারোর ক্ষমা পাইনি, ভালবাসা পাইনি। কিছুই পাইনি। মরে গেলে তো পাবো। আর কিছু না হোক, অন্তত ক্ষমা তো পাবো। কালকে আমার মা-বাবা বাবার অফিসের পিকনিকে যাবেন। আর ছোটো ভাইটা সারাদিন ক্রিকেট খেলবে। সবাই খুব আনন্দে থাকবে। আমিও। আমার আনন্দ সবাইকে সবসময়ের জন্য আনন্দের ব্যবস্থা করে দেয়ার আনন্দ। আত্মহত্যার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য আমি সংগ্রহ করে লুকিয়ে রেখেছি। কাল সারাদিন নিজেকে অনেক খুশি রাখবো। জীবনের শেষ জন্মদিন আমার কাছে আমার মৃত্যুর আগে এবং বাকি সবার কাছে আমার মৃত্যুর পর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি কাল চলে গিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেবো, আমিও ছিলাম। তোমরা টেরই পাওনি, খেয়াল করার সময়ই হয়তো তোমাদের হয়নি, তবে ছিলাম। বাবা-মা ফেরার আগেই সন্ধ্যায় কাজটা শেষ করব। আমি আর পারলাম না আমার ধৈর্য্যকে ধরে রাখতে। মানুষ আত্মহত্যা করলে নাকি জাহান্নামে যায়। ভাল। পৃথিবী থেকে মুক্তি পেতে আমি জাহান্নামে যাচ্ছি, আমার কাজের ফল আমাকে ভোগ করতে হবে, জানি; তবে আমি যা করিনি তার জন্য যে শাস্তি আমি পাচ্ছি এই পৃথিবীতে থেকে, তা আর পেতে হবে না।
সবার মত আমিও বাঁচব বলেই এতদিন বেঁচে ছিলাম। এত তাড়াতাড়ি আমাকে মরতে হবে, ভাবতে পারিনি। কষ্ট একটাই, আমি দূরের কারোর জন্য দূরের দেশে চলে যাচ্ছি না। যার জন্য মারা যাচ্ছি তিনি হলেন আমার জন্মদাতা পিতা। আমি তার জন্য আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছি। তার জন্যই আমার শেষ আশাটুকুও আজ আর অবশিষ্ট নেই। মানসিক নির্যাতনে আজ আমি অতিষ্ট। (বাবা সবাইকে বলেন, উনি উনার ছেলেমেয়ের গায়ে কখনো হাত তোলেন না। আজ এটা ভেবে খুব হাসি পাচ্ছে। কী নিষ্ঠুর আত্মতৃপ্তি!) আমার অপরাধ, আমি দু’বার পরীক্ষা দিয়েও কেন মেডিকেলে চান্স পেলাম না। সবাই ডাক্তার হবে, সবার বাবা এতো খুশি। আমি কেন বাবাকে খুশি করতে পারলাম না। আমার জন্য কেন বাবাকে কলিগদের কাছে, সমাজের কাছে ছোটো হতে হবে। বাবার আফসোস, কেন আমাকে জন্মের পর লবণ মুখে দিয়ে মেরে ফেললেন না। আমার অপরাধ, আমি কেন আমার বান্ধবীদের বাসায় যাই। আমার কি লজ্জাও করে না ওদের সাথে মিশতে? আমার মত মেয়ে মরে গেলে কী হয়? আমার অপরাধ, আমি কেন আমার দরকারি জিনিস কিনতে বাজারে যাই। আমি না মেয়ে? কেন আমি ভুলে যাই বাড়ির গেটের বাইরে পা রাখা আমার উচিত নয়। আর সবচাইতে বড় অপরাধ, আমি পাবলিকে চান্স পাইনি। আমি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অনার্স কমপ্লিট করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হতে চেয়েছিলাম। যারা কোথাও চান্স পায় না তাদের জন্য স্বপ্ন দেখাটা অনেক বড় একটা অপরাধ। আমার বাবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাকে প্রাইভেটে ভর্তি করাবেন না তার একগুঁয়েমির কারণে। যা ভাবেন, বোঝেন, তা করেই ছাড়েন। এই পৃথিবীতে উনি ছাড়া আর কেউ ঠিক বোঝে না, ঠিক বলে না। আমি তো শুধু বড় হতে চেয়েছিলাম। আমার পরিবারকে একধাপ এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, মেডিকেলে চান্স না পেয়েও যে জীবনে ভাল একটা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়, এটা সবাইকে দেখাতে। কিন্তু আমি পারলাম না, কারণ আমি মেয়ে। মেয়েরা এতো পড়বে কেন? পড়লে ফ্রিতে কিংবা কম পয়সায় পড়বে। আমাকে এতো পড়িয়ে কী লাভ আমার বাবার? পাস করার পর চাকরি নিয়ে দিতেও তো ঘুষ দিতে হবে। প্রাইভেটে পড়ে আবার এমনিএমনি চাকরি হয় নাকি? কে দেবে এতো টাকা? বাবার কীসের এতো দায় যে একটা মেয়েকে পড়াতে টাকার শ্রাদ্ধ করবেন? তারপর বিয়ে দিতেও তো কমপক্ষে ৪-৫ লাখ টাকা লাগবে। আমার লজ্জা করে না? আমার মতন মেয়ের দুনিয়াতে বেঁচে থেকে কী লাভ? এতো মানুষ মরে আল্লাহ আমার বাবাকে দেখেন না কেন? মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে পরিবারের একটা বোঝা হয়েই তো আছি। তার উপর কোথাও চান্স পাই না। আমার ভাত খেতে লজ্জা করে না? কত টাকা আমি নষ্ট করি এর হিসাব বাবাকে দিতে হবে। মানুষকে এখনো মুখ দেখাই কীভাবে? আমার তো বেঁচে থাকাই পাপ। আসলে আমার বাবাকে আমি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে আমাকে অনার্স পড়ালেই তার আর কোনো চিন্তা নেই। মেয়েরা আজকাল আর পরিবারের উপর নির্ভর করে না। আমিও করব না। তার ধারণা, আজকাল টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। জানিনা আল্লাহ এত বড় আশা কেন মনে জাগিয়েছিলেন। আর কেনই বা তা পূরণ করলেন না।
আজ মুসলমান হয়ে কুরআন পড়তে জেনেও আমাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। আমি কি খুব বড় ভুল করে ফেলেছিলাম একটা স্বপ্ন দেখে?? নাকি মেয়ে হয়ে জন্মানোই ভুল? আমি জানি, আমার মায়ের হাত-পা বাঁধা। তিনি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমার পক্ষে কথা বলতে পারেন না কারণ তালাক নামক একটা শব্দ আছে যা প্রতিটি মহিলার কাছেই ভীতকর একটা ব্যাপার। বাবা ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মে তালাক দেয়ার কথা বলা আছে। এলাকার সবাই বলছে আমাকে পড়াতে, কিন্তু আমার বাবা আমাকে আর পয়সা খরচ করে পড়াবে না। বাবা আমার জন্য ছেলে খুঁজছে। আমি ডাক্তার হতে পারব না, তাই আমার পড়ার কোনো অধিকার নেই। বাবা একটা ছেলের খোঁজ পেয়েও গেছে। মূর্খ ফ্যামিলি, কিন্তু ওদের অনেক টাকা। ফ্যামিলির সবাই লন্ডনে থাকে। সিলেটে বাড়িগাড়ি সবই আছে। আমি সুখী হব। একদম প্রি-প্রাইমারি থেকে আজ পর্যন্ত ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হইনি, আর সেই আমি কীভাবে পড়াশোনা ছেড়ে একটা ঘরে আবদ্ধ থাকব! আমার বান্ধবীরা সবাই পড়বে, বড় হবে, আর আমি একটা মূর্খের সাথে মূর্খের মতো সংসার করব। আজ তিন মাস হল বাসায় বসে আছি উদ্দেশ্যহীন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবাই বলে এই দুনিয়ায় কোন মুখে বেঁচে আছি? আর পারছি না সবার এত কথা সহ্য করতে। আজ অনেক না-করা অপবাদও আমার ঘাড়ে জুটছে। আমি চলে যাচ্ছি। আর কী-ই বা করার আছে? আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর আমার বাবা অন্তত এইটুকু বুঝতে পারুক যে তার আদরের মেয়ে তার জন্যই মরেছে। যতদিন বেঁচে থাকবেন প্রতিটা রাতে যেন একবার হলেও তার মনে হয় তিনি ভুল করেছেন, তিনি আমার সাথে অন্যায় করেছেন। আমি যা চেয়েছিলাম, মানুষ হিসেবে তা আমার পাওনা ছিল, কিন্তু তিনি আমাকে সেটা থেকে বঞ্চিত করেছেন। তিনি সন্তানের হক আদায় করেননি। আমি আমার এই মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলব। যারা আমার এই হত্যার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী, তাদের কেউ যেন শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আমি যতটা কষ্ট এ বুকে চেপে মরতে যাচ্ছি এর চেয়েও সহস্রগুণ কষ্ট যেন আল্লাহ তাদের মৃত্যুর আগেই দেন।
কুরআনের প্রথম কথাটাই ‘ইকরা’; মানে, ‘পড়’। পুরো আয়াতের অর্থ, পড় তোমার প্রভুর নামে। আমি তো বেশিকিছু চাইনি। আমি শুধু সেই পড়াটাই পড়তে চেয়েছিলাম আর তার জন্যই আজ এতকিছু। আজ ভাবি, আল্- হাদিসে আছে,“পড়াশোনার জন্য দরকার হলে সুদূর চীন দেশে যাও”। জন্মের পর দোলনা থেকে কবর, অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করার কথা কেন বলা হয়েছে?? আসলেই কি আমার ইচ্ছাটা পাপের ছিল? আমাকে সবাই খারাপ বলে এই পড়তে চাওয়ার কারণে। কতটা খারাপ আমি, তাইনা??? কাউকে আর কোনোদিন কষ্ট দেবো না। চলে যাচ্ছি। আপনারা ভাল থাকেন।
জন্মদিনের কথা
১৮ তারিখ সারারাত কেঁদেছি। একটাসময় কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ১৯ তারিখ খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলাম। গোসল করলাম, নতুন কাপড় পরে বাবা-মা’কে সালাম করলাম। উনারা পিকনিকে চলে গেলেন। ভাবতে লাগলাম, সারাদিন কী করব। অনেক কষ্ট লাগছিল মরতে। আশেপাশে যা দেখছিলাম, তা-ই ভাল লাগছিল। পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন? মরতে ইচ্ছে করছে না। আমার শেষ ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যিনি এসে আমার পাশে দাঁড়াবেন একজন অভিভাবক হয়ে। আমার সব দায়িত্ব কাঁধে নেবেন, আমার ইচ্ছাটাকে পূর্ণ করতে আমাকে সাহায্য করবেন। তাই আজ আমার সব শেষ।
এসবকিছু ভাবছিলাম। ভোর ৬টার দিকে রাজশাহী থেকে আমার এক আপু ফোন করে বার্থডে উইশ করল। আজকের দিনে আমার কী প্ল্যান জিজ্ঞেস করাতে বললাম, তেমন কিছু ভাবিনি। ও রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে। ওখানে আপনার ক্যারিয়ার আড্ডায় ছিল, ফেসবুকে আপনার ফলোয়ার। ওর ধারণা, আপনার কথায় ওর লাইফে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ওর পরামর্শেই আমি কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে আপনার লেখাগুলো পড়ি, লাইকটাইক দিই না, তবে ভাল লাগে। ও আমাকে বলল, “রোটার্যাক্ট ক্লাবের আমন্ত্রণে সুশান্ত ভাইয়া তো আজকে হবিগঞ্জে আসছেন। ৯:০০টায় প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা। তুই অ্যাটেন্ড করতে পারিস। এখন রওয়ানা দিলেও ধরতে পারবি। যা, তোর ভাল লাগবে।” আমি কী যেন ভেবেটেবে একটুপর রেডি হয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম। যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখি, প্রোগ্রাম শুরুই হয়েছে দেরি করে। কোনার একটা চেয়ারে বসলাম, আপনার কথাগুলো শুনলাম।
অবশ্য কথাগুলোর অনেককিছুই আপনার ফেসবুকের লেখায় পড়েছিলাম। কিন্তু সামনাসামনি দেখে আপনার আবেগটা যেন ছুঁয়ে দেখতে পারছিলাম। আপনার নিজের জীবনের কষ্টের প্রতিটি কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ওগুলো আমার নিজেরই কথা। একটা পর্যায়ে আপনি বললেন, প্রচণ্ড অভিমান, কষ্ট আর হতাশা থেকে একটাসময়ে আপনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। একদিন ঘরে বিষ কিনে নিয়ে এলেন। বিষ খাবেন ভাবছেন, এইসময়ে আপনার সামনে ভেসে উঠল আপনার মায়ের মুখ। ভাবলেন, আপনার এই জীবনটা তো আপনার নিজের সৃষ্টি নয়। এটা আপনার মায়ের দেয়া একটা উপহার। আপনার মায়ের দেয়া জীবনকে আপনি নিজে কীভাবে শেষ করে দেবেন? আপনার কী অধিকার, যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে আপনাকে আপনার মা এই পৃথিবীতে এনেছেন, সেটাকে অগ্রাহ্য করে নিজের খুশির জন্য যা ইচ্ছা তা করার? আপনি ভাবলেন, আর দশটা উজ্জ্বল মানুষের মত না হোক, অন্তত একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে হলেও বেঁচে থেকে দেখাই যাক না কী হয়। আপনি বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ব্যাপার সফল হওয়া নয়, বড় হওয়া নয়, ভাল ক্যারিয়ার নয়, অনেক টাকার মালিক হওয়া নয়; এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, বেঁচে থাকা। স্রেফ বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। সেদিন স্রেফ বেঁচে ছিলেন বলেই আজকে আপনি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার কথাগুলো শুনে মাথা ঝিনঝিন করতে লাগল। মনে হতে লাগল, পুরো হলে এই কথাগুলো আপনি শুধু আমাকেই বলছেন। কেউ যেন আমাকে কানে কানে বলে দিচ্ছে, তোকে যারা ভুল বুঝছে, তাদের ভুল ভাঙানোর জন্য হলেও তোকে যে বাঁচতেই হবে। দেখিস, একদিন তুই অনেক বড় হবি। শুধু মরে যাস না। এতেই হবে!
৫ ঘণ্টা আপনার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই আপনার সাথে দেখা করতে আর ছবি তুলতে গিয়েছিল, অনেকে আপনার অটোগ্রাফ নিয়েছে, আপনি অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও কেউ কেউ আপনার পা ছুঁয়ে আপনাকে সালাম করেছে। দাদা, আমিও সেখানে ছিলাম। আমার সাথে কোনো কাগজকলম ছিল না। আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে আপনার অটোগ্রাফ নিই। কেন জানি না, আপনি আমাকে লিখে দিলেন, “Live to dream. Dream to live.” কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল, আপনাকে পায়ে ছুঁয়ে সালাম করব। আমি ভয়ে আর আপনার সামনেই যেতে পারিনি। দূর থেকে দেখে শুধু ভাবছিলাম, আপনি জানলেন কীভাবে আপনি জানলেন কীভাবে??
হয়তো আপনি আরো অনেককেই ওই কথাটাই লিখে দিয়েছেন। আরো অনেকেই হয়তো আপনার গল্প শুনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। জানি, কেউ কোনোদিন জানবেও না, কিন্তু আমি তো জানি, শুধু আপনার জন্যই আমি এখনো এই সুন্দর পৃথিবীর আলোবাতাসে বেঁচে আছি। শুধু আপনার জন্যই আমি জীবনের কাছে হারিনি। শুধু আপনার জন্যই সেদিন বিষের পেয়ালা আমার ঠোঁট অবধি ওঠেনি।
আপনি বলেছিলেন, ২০১১ সালের ২ নভেম্বর আপনার জন্মদিনেই আপনার পুনর্জন্ম হয়েছিল। আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমার জন্মদিনে ঠিক একইভাবে আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আমার বাবা-মা আমাকে এই পৃথিবীতে এনেছেন। আপনি আমাকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছেন। আমার বড় ভাই নেই। আপনি সারাজীবনের জন্য আমার বড় ভাই হয়ে গেলেন।
ভাইয়া, একটা কথা। আপনি আপনার সেমিনারে ছোটোদেরকে আসতে বারণ করেন কেন? ছোটোদের কি বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা নিষেধ?
আমার কথা।
বছর শেষ হয়ে এল। এই বছরে কয়েকটা ক্যারিয়ার আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে, অর্থ আর সময় দুটোই খরচ হয়েছে, ঈর্ষান্বিত আর নিন্দুক লোকজনের অনেক কটু কথা সহ্য করতে হয়েছে, তবুও আমি খুশি। কেন? আজকের কথাই বলি। আজকে সকালে ঘুম ভেঙেছে একজন মায়ের ফোন পেয়ে। উনার ছেলে নর্থসাউথে পড়ে। কিছু একান্ত ব্যক্তিগত কারণে ও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। মায়ের ধারণা, আমি যদি কিছু সময় উনার ছেলের সাথে কাটাই, তাহলে উনার ছেলে হয়তো আবার আগের মতোই হাসবে, মাকে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে, “মা, দেখ দেখ, শীতের এই রোদটা কী সুন্দর!” ভদ্রমহিলা নিয়মিত আমার লেখা পড়েন। আমাকে খুব করে অনুরোধ করলেন, যেন ঢাকায় গেলে উনাকে একটা ফোন করি। উনার ছেলেকে নিয়ে উনি আমার সাথে দেখা করতে চান।
কত কত মানুষ ফোন করে, দেখা করে, পরামর্শ চায়। মাঝে মাঝে ক্লান্তিবোধ করি, তবুও কথা বলি, হেল্প করার চেষ্টা করি। এ বছরে অনেককেই ফোনে কাউন্সেলিং করেছি। একজনের ফিডব্যাক বলি। “ভাইয়া, কালকের আগ পর্যন্ত আমার সব প্ল্যানই ছিল আমার নিজের মৃত্যুকে ঘিরে। আপনার সাথে কথা বলার পর মনে হল, কারোর জন্য না হোক, আমি শুধু নিজের জন্য হলেও বাঁচব। কেউ ভালবাসুক আর নাই বাসুক, আমি নিজেকে ভালবেসেই বাঁচব। আল্লাহ যতদিন চাইবেন, ততদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকব। ভালো থাকবেন, ভাইয়া। আমি প্রতিদিন নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করব।”
২৬ নভেম্বরের একটা ঘটনা। ঘুম ভেঙে পাওয়া একটা মেসেজ আপনার দিনের শুরুটাকে অন্যরকম সুন্দর করে দিতে পারে। সেদিন সকালে পাওয়া একটা মেসেজ হুবহু শেয়ার করলাম।
"Identity is more important than existence." কিংবা "জীবন আমাদের কখন কোথায় নিয়ে যায় তা আমরা কখনই বলতে পারি না ................. " এরকম আরোকিছু কথা।
দাদা, আপনার কথাগুলো আমার চলার পথটাকে সুগম করেছে I আমি আজ সহকারী জজ হয়েছিI আপনার কথাগুলো অনুপ্রেরণা হয়ে আমার সাথে ছিলো, আছে এবং থাকবেI ভালো থাকবেন দাদা। আপনাকে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছেটা খুব শীঘ্রই পূরণ করেনিবোI দোয়া করবেন আমার জন্য…… স্যালুট দাদা।
মেসেজের নিচে নাম্বার দেয়া ছিল। ফোন করলাম। ও ধরতে পারেনি। পরে নিজেই ফোন করলো। ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। গতকাল BJS পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পর কাছের মানুষদের সাথে ওর আমার কথাও মনে হয়েছে। এ যে আমার জন্যে কতো বড় পাওয়া ও যদি বুঝতো! ওর নিজের কথাতেই বলি। "দাদা, আমি আপনাকে ফেসবুকে ফলো করি ২০১৩ থেকে। কখনো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনি। আপনার মোবাইল নাম্বারও ছিল আমার কাছে। কখনো ফোন করিনি। আজকের দিনটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম হয়তো। আপনার পোস্টগুলি নিয়মিত দেখতাম। সবসময় মনে হতো, আপনি আমার নিজের জীবনের কথাই বলছেন। আপনার কিছু কিছু কথা মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিলো যে যখনই অনুভব করতাম, আমি হারিয়ে যাচ্ছি আমি হারিয়ে যাচ্ছি, আপনার কথাগুলোই আমাকে নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখাতো। খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমি গেছি। আমি স্টামফোর্ডে পড়ানোর সময় অথরিটি কিছু ফ্যাকাল্টি ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি জুনিয়র ছিলাম বলে আমিও সেই লিস্টে ছিলাম। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। মন খারাপ হলেই আপনার লেখাগুলো বারবার পড়তাম। বুকের ভেতরে এক ধরণের সাহস চলে আসতো। আজকের দিনটার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, দাদা।"
এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে। লিখতে গেলে শেষ হবে না।
বলাই বাহুল্য, এই নোটটির প্রথম দুটো অংশের কথাগুলো ঠিক ওরকমভাবে আমার কাছে আসেনি। আমার ছোটো বোনটা ওর মত করে লিখে পাঠিয়েছে। আমি নিজের মত করে লেখাটা সাজিয়েছি। তবে, ওর ভাবনাগুলো একটুও বদলে দিইনি। যেসব কথা ভেবে এই নোটটা লিখলাম, এখন সে প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি।
• আমাদের বাবা-মা’দের জিজ্ঞেস করছি, “আচ্ছা, পৃথিবীর সেরা কিংবা সফল মানুষগুলো কি সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার? মেডিকেলে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স না পেলেই কি জীবন শেষ হয়ে যায়? জীবনের এতোটা সরলীকৃত রায় দিয়ে দেয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”
• আপনার সন্তানের কাছে আপনার চাওয়াটা হতে পারে, যাতে সে সুস্থ শরীরে হাসিখুশি মনে বেঁচে থাকে। দয়া করে ওদের সাথে এমনকিছু করবেন না কিংবা ওদেরকে এমন কিছু বলবেন না, যেটা ওদেরকে নিজেদের সম্মান করতেই ভুলিয়ে দেয়। যে নিজেকে সম্মান করে, সে কখনোই চিরদিন নিজেকে ছোটো করে রাখবে না। বড় সে হবেই হবে!
• সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়া নয়, বরং নিজের অবস্থান থেকে সেরা কাজটা করে দেখানোই কৃতিত্ব। সেরা প্রতিষ্ঠানের কাজ কী? সেরা মানুষটা তৈরি করা, এইতো? বরং ওকে এই বিদ্যেটা শিখিয়ে দিন। ওদের উৎসাহ দিন। এতে ওদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়ে। আপনার মুখ যদি কেউ উজ্জ্বল করে সেটা আপনার নিজের সন্তানই করবে, অন্য কারোর সন্তান নয়।
• প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়লেই কি জীবন শেষ হয়ে গেল? প্রাইভেটে যারা পড়ে, তাদের সবাই কি জীবনবোধবর্জিত? কিছুদিন আগে আমি ইস্টওয়েস্ট ভার্সিটির আমন্ত্রণে একটা ক্যারিয়ার আড্ডায় কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমার অনেক সফল বন্ধু আছে, যারা প্রাইভেট থেকে গ্রাজুয়েশন করা। কই, আমার অভিজ্ঞতা তো সেটা বলে না। পুরোনো ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। ভার্সিটি স্টুডেন্টদেরকে বড় করে না, স্টুডেন্টরাই ভার্সিটিকে বড় করে।
• মেনে নিন, সবাই সবকিছু পারে না। আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি, কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। আমার ব্যর্থতার জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। জোর করে আমাকে কেউ ইঞ্জিনিয়ার বানালে হয়তো আমার দিকে আঙুল তুলে লোকে বলত, “দেখ দেখ, চুয়েটের প্রোডাক্ট কতোটা বাজে!” আমি খুশি। লোকে আমার জন্য আমার ভার্সিটিকে বকবে কেন? আমাকে গালি দিক, আমার মাকে নয়।
• কিছু লোক কখনোই আপনার কোনো ঠিক কাজেরই প্রশংসা করেন না, কিন্তু সবসময়ই আপনার ভুল কাজের নিন্দা করেন৷ ওদের পাত্তা কম দেয়াই ভালো৷ প্রশংসা করতে পারার মতো উদারতা ছোটোলোকদের থাকে না৷ নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো৷ ভালো কথা৷ তবে যে নিন্দুক আপনার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, তাকে ভালোবাসাবাসির কিছু নাই৷ এতো কেয়ার করার টাইম আছে নাকি? জীবনটা আপনার৷ আপনি কী নিয়ে থাকবেন, কী নিয়ে থাকবেন না, এটা ঠিক করার সবচে' নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি আপনি নিজেই৷ সাফল্য কী? আফসোস ছাড়া বেঁচে থাকাই সাফল্য৷ আর কিছু না৷ নিন্দা করা তারেই সাজে, প্রশংসা করে যে৷
• আমি দেখেছি, শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়৷ হারিয়ে গেলে, খুব কাছের মানুষ ছাড়া কারোরই কিছু এসে যায় না৷ তাই, বেঁচে থাকুন। আপনার মৃত্যু কিছু লোককে দারুণ অস্বস্তিতে ফেলে দেবে, যারা আপনার মৃত্যুকামনা করে স্বস্তি পায়। অন্তত তাদের কথা ভেবে হলেও . . . . . . . বাঁচুন! বেঁচে থাকাটাই সবচে’ বড় প্রতিশোধ। তাই, অন্তত নিজের কথা ভেবে হলেও . . . . . . . বাঁচুন! বাঁচুন, নিজের জন্যে। বাঁচুন, অন্যের জন্যে।
• কারোর জন্য মরে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। যার জন্য মরে যাবেন ভাবছেন, সে আপনার কথা কতোটুকু ভাবে? ভাবলে আপনাকে মরতে দিত? পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। জীবন কারোর জন্যই থেমে থাকে না, শুধু মাঝমাঝে থমকে যায়। ওকে ওর মত করে ভালো থাকতে দিন। আপনি আপনার মত করে ভালো থাকুন। ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা।
• কখনোই বিশ্বাস করে বসবেন না, আপনিই পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষ, আপনিই সবচাইতে বেশি কষ্টে আছেন। আপনি ভাবতেই পারবেন না, হয়তো পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষটি সবচাইতে সুন্দর করে হেসে কথা বলে। আপনি উনার কষ্টের কথা কল্পনাও করতে পারবেন না।
• জীবনে কোনোকিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভালো। আপনার যে কষ্টটা আপনাকে শেষ করে দেয় না, সেটাকে আপনি চাইলে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত করতে পারেন।
• বাবা-মা’র সাথে অভিমান হবে, খুব কষ্ট পাবে, মনে হতে থাকবে, বাবা-মা আমার ভালো চান না, আমাকে একটুও ভালবাসেন না, ওরা আমার শত্রু। এরকম আরো অনেককিছু। আমি এটা নিয়ে শুধু একটা কথাই বলব। জীবন শেষ পর্যন্ত আমাকে এটাই শিখিয়েছে, আসলে আমার বাবাই ঠিক ছিলেন, আমার মায়ের চোখের জল মিথ্যে বলেনি। অনেক সময় নষ্ট করে ওদের দেখিয়ে দেয়া পথেই আবার ফিরে এসেছি। আমি বিশ্বাস করি, ওদের মধ্যে ঈশ্বর আছেন। মাঝে মাঝে ওরা যা বলেন, সেটা ঈশ্বরের ইশারা ছাড়া আর কিছুই নয়।