ব্যর্থতা জিন্দাবাদ

 
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥’
...আমি যখনই নিজেকে নিয়ে কিছু বলি বা লিখি, তখনই কবিগুরুর এই লাইন দুইটা মনের মধ্যে গাঁথা থাকে। নিজেকে আমি অমন করেই দেখতে বড়ো ভালোবাসি।


আমি প্রিয়দর্শী তালুকদার। ডাক নাম প্রিয়। আমার জীবনের গল্পটা আপনাদের শোনাতে এলাম। জীবনের কাছে বহু বহুবার হেরে যেতে যেতেই আমি আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি। বারবার হোঁচট খেতে খেতে দুই পা রক্তাক্ত হয়ে হয়ে হৃদয়ক্ষরণ হয়েছে অগুনতিবার। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় যখন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তখনও নিজেকে জ্যান্ত করে রাখা ও সামনের দিকে হেঁটে যাওয়ার গল্পটা শুনবেন, চলুন।


আজ থেকে এক যুগ পেছনে যাওয়া যাক। তখনও আমি আমার স্বপ্নের পিছু ছুটেছি পাগলের মতো। ঠিক এক যুগের ব্যবধানে আজ স্বপ্নরা আমার পিছু নেয়। যার মধ্যে নিজেকে নিয়ে কোনও উচ্চভাবনা কাজ করেনি একসময়, সে-ই এখন না চাইতেও অনেক চমৎকার ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই যাত্রাটা সহজ ছিল না। এই যাত্রা এক অনিশ্চিত যাত্রা। এই যাত্রা নিরুদ্দেশ গন্তব্যের দিকে এক বোকামানুষের যাত্রা।


পড়াশোনায় ছিলাম একেবারেই মাঝারি মানের। ফেল করতাম না, টেনেটুনে পাস হয়েই যেত। ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় ছিলাম প্রথম পঞ্চাশজনের বাইরে। ওটা তো আর বলার মতো কিছু নয়, পরীক্ষায় বসলে ওরকম একটা রেজাল্ট সবাই করে। ফেলকে কাবাডি কাবাডি বলে ক্লাস নাইনে উঠলাম। বাবার খুব শখ, আমি সায়েন্সে পড়ি। বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে হবে, এটাই ছিল আমাকে সায়েন্সে পড়াতে চাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য। বাবা-মায়ের ধারণা, জীবনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে এই পৃথিবীতে এসে কী লাভ? অথচ আজ আমি জানি, এই পৃথিবীতে যাঁদের ইতিহাস গ্রেটম্যান বলে চেনে, তাঁদের কেউই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নন। তখন তো আর এসব বুঝতাম না, এসব নিয়ে কথাবলার বয়সটাও তখন ছিল না।


বাবার ইচ্ছেয় সায়েন্সে ভর্তি হলাম। ক্লাসে রেজাল্ট হতো ওই মাঝামাঝিই। ফেল করি না, আবার ভালো নম্বরও পাই না। অবশ্য, বাবার ওতে তেমন কোনও দুঃখ নেই। তবে কখনও কখনও, কোনও বিষয়ে ছেলেকে একটু ৬০-এর আশেপাশে পেতে দেখলে উনি খুশি হয়ে ওঠেন, বাসা থেকে বেরিয়ে পাড়ার মহেশকাকুর দোকান থেকে কয়েক পিস রসগোল্লা নিয়ে আসেন। এই আরকি!


আমার বাবা খুব অল্পতে খুশি হতে জানেন। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে এমন দেখেছি। এক আমার ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বাদে বাবাকে আর কখনও কাঁদতে দূরে থাক, মন খারাপ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কেউ যদি বাবাকে শুধু এইটুকুও বলত, ‘নরেশ বাবু, আজকে বাসায় ফ্রেশ রুইমাছ রান্না হচ্ছে। চলুন, আজ দুপুরে আমার সাথে দুটো মাছ-ভাত খাবেন।’ সেখানে বাবা হয়তো গেলেনই না, কিন্তু ওই ভদ্রলোককে সারাজীবনই মনে রেখে দিতেন। বাবাকে খুশি করে দেওয়া এতটাই সহজ। আমি এমন একজন সাদাসিধে মানুষের সন্তান।


টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেল, রেজাল্ট সেই মোটামুটিই। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন, আমার ভালো মানুষ বাবাকে একটু খুশি হতে দেখব। এর বেশি কিছু নয়। তাই খুব খেটে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। আমার খাটুনি করে পড়া মানে হয়তো অনেকের জন্য ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সমান। কিন্তু কী আর করা যাবে! আমার যে ধারণক্ষমতা ওইটুকুই!


আমি ফাঁকি দিইনি। দিনরাত পড়েছি। আমার তো পড়া মনে থাকত না, তাই বেশি সময় দিয়ে পড়তে হতো। বাবা তো আমাকে দেখে অনেক খুশি। সামনে হয়তো বাবার আনন্দের সময়। বাবা স্বপ্নে স্বপ্নে দিন গোনেন। এদিকে আমার চেষ্টাটাও চলতে থাকে পুরোদমে।


এত পড়াশোনা করলাম, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে রইলাম, শরীরও গিয়েছিল অনেকটা ভেঙে…এরপর কী হলো? ২০০৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় আমি এক সাবজেক্টে ফেল করলাম। ফেল করার পর দুঃখে আমি স্তব্ধ ও বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। ঈশ্বর মনে হয় সবাইকে সব কিছু দেন না। যে পায়, সে ঘুমিয়ে থাকলেও পায়; আর যে পায় না, সে যা-ই করুক, পায়ই না। যাকে তিনি দেন না, তাকে দেনই না, তা সে যতই চেষ্টা করুক না কেন! আমিও ওরকম একটা মানুষ। ফিজিক্সে ফেল করে বসলাম। কেন করলাম, আমি সত্যিই জানি না। ফেল করার মতো পরীক্ষা আমি দিইনি। আমার বিবেক সাক্ষী, আমার বাবা সাক্ষী, আমার স্রষ্টা সাক্ষী। তবু এসব বলে আর কী হবে! কেউ যদি ফেল করার মতোই পরীক্ষা দিয়েও পাস করে ফেলে, তবে সে ফেল করার মতো পরীক্ষা দেয়ইনি! আমি ফেল করেছি মানে ফেলই করেছি, এটার পেছনে হাজার হাজার অজুহাত দাঁড় হয়তো করানো যাবে, কিন্তু এক সান্ত্বনালাভ বাদে ওসবের আর কোনও মূল্য নেই। এটাই যে নিয়ম!


আমার ছোট্ট মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাবা আমার রেজাল্ট দেখে নির্বাক হয়ে গেলেন। ভাবলেন, আমার ছেলেটা এত পড়াশোনা করেও ফেল করল কীভাবে! বেচারা সব কিছুকেই সরলমনে নেন। আমার চেয়ে বয়সে এত বড়ো হয়েও ভাবতে শুরু করলেন আমার মতো করেই। ফেল না করার মতো পরীক্ষা দিয়ে একটা স্টুডেন্ট ফেল করে কী করে? বাবা বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না!


সব বাবা-মায়ের কাছেই তাঁদের সন্তান সেরা মেধাবী, সেরা মানুষ। আমি যদি সেদিকে না-ও যাই, তা-ও বলতে পারি, সত্যিই আমাকে নিয়ে বড়ো কিছু একটা আশা করাটা হোক না হোক, পাস করব, এইটুকু আশা করাটা বাড়াবাড়ি রকমের আশাবাদী মানুষের কাণ্ড, এটা বলা যাবে না। আমি সত্যিই পড়াশোনা করেছিলাম তো! হায়, কিছু মানুষের রেজাল্ট আশানুরূপ হয় না, আর কিছু মানুষ পাসই করতে পারে না! কেউ আশি পায়নি বলে আফসোস করে, আর কেউ মাত্র তেত্রিশও তুলতে না পারার লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারে না। জগতে যে মানুষের কত রকমের দুঃখ থাকে!


আমি হতাশায় ডুবে গেলাম। বয়স ছিল অল্প, বুদ্ধি তো ছিল আরও অল্প। ফেল করেও বাকবাকুম করার মতো অতটা মানসিক শক্তি কিংবা বাবা-মায়ের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আমার সামনে তখন ছিল না। আমার কাছে মনে হতে লাগল, আমি বোধহয় আসলেই খুব দুর্বল ছাত্র, আমার কোনও মেধা নেই, আমি চেষ্টা করলেও কোনও লাভ নেই। আমি জীবনে কিছুই করতে পারব না। যে মানুষটা জীবনে কিছু করতে পারে, সে বেশি কিছু করতে পারুক না পারুক, পরীক্ষায় পাস তো অন্তত করতে পারে! আমি যে তা-ও পারলাম না! আহা, এতটা ব্যর্থজীবনও মানুষের হয়!


ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর রকমের ভেঙেচুরে যাচ্ছিলাম। বাবার মতো সহজ একজন মানুষকে এতটা নিরাশ করে দিলাম! প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ডুবতে লাগলাম। আমি যখন এমনি করে ক্রমাগত দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছি, তখন পাশে ছিলেন বাবা। বাবা আমার সামনে কখনও মন খারাপ করে থাকতেন না। সব সময়ই হেসে বলতেন, আরে, ফেল তো মানুষ করেই! এটা কোনও ব্যাপার না! তুই কি না পড়ে ফেল করেছিস রে? অত পড়লে তো এপ্লাস এমনিই পায়! কত ছেলে তোর চেয়ে কত কম পড়ে এপ্লাস পেয়ে গেল, দেখলাম তো! আসলে কী জানিস তো, নসিব বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা নসিবের বাইরে যেতে পারি না। তোর নসিবে এটাই ছিল। মেনে নে। আমাদের জন্য যা-কিছু পূর্বনির্ধারিত, তার বাইরে আমরা কেউই যেতে পারি না। আমি তো আর অত বুঝি না, তবে যেটুকু বুঝি, সেখান থেকে বলতে পারি, তোর জীবনটা এভাবেই সাজানো। কী হলো বা সামনে কী হবে, এটা ঠিক করা আছে। সময় হওয়ার আগে এটা তুই আমি কেউই জানতে পারব না। তুই আবার পড়াশোনা কর, পরীক্ষা দে। দেখবি, এবার তোর জয় হবেই!


বুকের ভেতরটা একেবারে ঠান্ডা হয়ে যেত বাবার এসব কথা শুনে। জীবনে এমন একজন মানুষ সবারই লাগে। যে পায়, সে বড়ো ভাগ্যবান! আমার সমস্ত অপরাধবোধ একেবারে উবে গিয়ে একরাশ সাহস এসে ভর করত। হাঁটতে গেলে পঙ্গু মানুষের একটা লাঠি লাগে। বাবা ছিলেন আমার সেই লাঠিটা। তবু দুশ্চিন্তা তো হতোই! তা-ও ভাবতাম, দেখিই না চেষ্টা করে আর একবার। জীবন তো আর শেষ হয়ে যায়নি। একটা খারাপ রেজাল্টই তো! দেখিই না, কী হয়!


পরের বছর মাথাভর্তি উদ্বেগ আর তীব্র দায়িত্ববোধ নিয়ে আবার পরীক্ষায় বসলাম। কুড়িগ্রাম সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩.৫৩ জিপিএ নিয়ে পাস করলাম। বলে বেড়ানোর মতো ভালো কোনও রেজাল্ট হলো না। আর আমিও তো বলে বেড়ানোর মতো ভালো কোনও ছাত্রও নই। আমার রেজাল্ট ভালো হওয়ার ছিল না বোধহয়। সবার রেজাল্ট ভালো হয় না, নিজের রেজাল্ট নিয়ে কাউকে বলার মতো কপাল নিয়ে সবাই জন্মায় না। ওদিকে আবার সার্টিফিকেটে স্টুডেন্টটাইপ-এর পাশে লেখা ইরেগুলার, মানে আমি প্রথমবারে পাস করতে পারিনি। কী একটা বাজে অবস্থা! ফুলই চাইলাম না, অথচ কাঁটা দিয়ে দিলো!


আমি বারবার রেজাল্ট খারাপ করায়, পরিবারের সবার ধারণা হলো, জেনারেল লাইনে পড়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিলে আমি বোধহয় আর পাস করতে পারব না। এই আশঙ্কায় আত্মীয়স্বজনরা বাবাকে পরামর্শ দিলো, তিনি আমাকে যেন জেনারেল লাইনে না পড়িয়ে টেকনিক্যাল লাইনে পড়ান। ওরা বললেন, ‘নরেশদাদা, পরে কিন্তু ছেলে আপনাকেই দোষী করবে! বলবে, আমি নাহয় তখন ছোট ছিলাম, বুঝিনি। কিন্তু বাবা আমার জন্য কিছু ভাবল না কেন?’ সবাই ধরেই নিয়েছিল, প্রিয়র পড়া হয়তো আর বেশি এগোবে না, ওর ব্রেইনে ঠিক কুলোচ্ছে না, চেষ্টা তো করেই, কিন্তু পারে তো না!


ওদিকে বাবাও ভাবলেন, টেকনিক্যাল লাইনে পড়লে অন্তত কিছু একটা করে খেতে পারব। ছোটোখাটো একটা চাকরি করে আর কিছু না হোক, আমার ছেলেটা দুবেলা ভাত তো জোটাতে পারবে! জেনারেল লাইনে পড়ে যদি আবারও ফেল করে, তখন? আর ইন্টারের সায়েন্স তো নাকি অনেক শক্ত! ভালো ভালো স্টুডেন্টরাই পারে না! বাবারও মনে এল, আমার প্রিয় চেষ্টা তো করেই, কিন্তু পারে তো না!...আহা, চেষ্টা করেও না পারা! এর চাইতে অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে!


আমি কিন্তু টেকনিক্যাল লাইনে পড়তে চাইনি। ওদিকে আমাকে কেউই জেনারেল লাইনে পড়তে দিতে চাইছিল না। কেউ কেউ তো ধরেই নিলো, আমি বোধহয় আর পড়াশোনা করতেই পারব না। ওদের পরামর্শ, বাবা আমাকে পড়াশোনা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা কোথাও ঢুকিয়ে দিক! বাবা ওদের কিছুই বললেন না। বলার সময় এখন নয়, এখন শুধুই শোনার আর হজম করার সময়। একদিকে পরিবারের সিদ্ধান্ত, আর একদিকে আমার ইচ্ছে, এই দুই দ্বন্দ্বে পড়ে আমি গোঁ ধরে বসলাম, আমি দুটোতেই ভর্তি হব। জেনারেলেও, টেকনিক্যালেও। বেঁকে বসলাম তো বসলামই! আমার প্রবল জেদ দেখে বাবা কিছুটা ভয় পেয়ে সায় দিলেন।


ভর্তি হলাম কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড অটোমোবাইলস ডিপার্টমেন্টে। কিছুটা অনিয়মিতভাবে ক্লাস করতাম, ওদিকে এইচএসি’র পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক পরিশ্রম করতে হতো। করতামও। কিছু করার নেই তো! নিজেই তো দায়িত্ব নিয়ে এই বাড়তি ভারটা নিয়েছি কাঁধের উপর। কিন্তু টেকনিক্যাল লাইন আমাকে কেমন জানি একদমই টানছিল না। অনেকটা মনের বিরুদ্ধেই আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।


পড়াশোনা জিনিসটা মনের বিরুদ্ধে টেনে-নেওয়া সহজ নয়। তবু আমি অনেক কষ্টে দুইনৌকায় পা দিয়ে চলছিলাম। কষ্ট হচ্ছিল, তবু দমে যাইনি। নিজের উপর বাড়তি চাপ নিয়েও দুটোকেই টানছিলাম। সে সময় বড়ো কষ্টের সময়।


প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও নৈরাশ্য মাথায় নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। এরপর? আমার সাথে যা হলো, তা মেনে নেওয়ার জন্যও একটা স্টুডেন্টকে প্রস্তুত থাকতে হতে পারে, এটাই কখনও মাথায় ছিল না। এই জীবনে কখনও কাউকে এতটা বাজেভাবে ফেল করতে দেখিনি। মানুষের রেজাল্ট খারাপ হয় শুনেছি, কিন্তু তাই বলে এতটা ভয়াবহ রকমের খারাপ হয়, নিজেকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না! ২০০৭ সালে আমি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় এক বাংলা বাদে বাকি সব বিষয়েই ফেল করলাম। রেজাল্ট পাওয়ার পর, আমি দুঃখ পাবো কী, বেকুব হয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এসএসসি’তে তা-ও এক বিষয়ে ফেল করেছিলাম, আর এখানে দেখি, পাস করলামই এক বিষয়ে! আমি জানতাম না, এমন রেজাল্ট করলে কী করতে হয়! মানুষ চেষ্টা করেও কি সত্যি সত্যি এত বাজে রেজাল্ট করতে পারে?


মানুষ খারাপ স্টুডেন্ট হয়, ঠিক আছে, কিন্তু তা-ই বলে এতটা? যে মুহূর্তে একটা স্টুডেন্ট বাংলা বাদে আর কোনও বিষয়েই পাস করতে পারল না, সে তখন কীভাবে বেঁচে থাকে, এই পৃথিবীতে একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচেথাকা! বাবা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। উনি জানতেন না, এই সময় আসলে কী বলতে হয়। মা আমার পাশের রুমে বসে বসে লুকিয়ে কাঁদছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে নিয়ে নানান কথা বলতে লাগল। ওদের যে আজ নানান কথা বলার সুযোগ এসেছে! সময় আজ চুপচাপ কথা শুনে যাওয়ার। আমার নিজেকে নর্দমার কীটের চেয়ে জঘন্য মনে হতে লাগল। এমনকি আয়নার সামনে দাঁড়াতে পর্যন্ত লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। এতটা ব্যর্থ একজন মানুষ কীভাবে হতে পারে! আমি কি অনেক বড়ো একটা ভুল পথে হেঁটে চলেছি?


বাবা আমাকে বকলেন না, কাউকে আমার সামনে আসতে দিলেন না। বাবার স্থিরচোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব শান্তকণ্ঠে বললেন, বাবা প্রিয়, এরকম হয়, তুই মন খারাপ করিস না। তুই তো চেষ্টা করেছিসই, কত কষ্ট করলি, আমি তো দেখেছি, তাই না? ওদের কারও কথা তুই শুনিস না, লোকের কথায় কী এসে যায়, বাবা? দিনের শেষে তো তুই আমার ছেলে, ওদের তো কেউ না রে! ওরা বললেও-বা কী? তুই অনেক ভালো করতে পারবি সামনের বার, দেখিস। আমার আশীর্বাদ আছে তোর সাথে। দুইদিন ধরে কিছু খাচ্ছিস না ঠিকমতো। এতটা বোকার মতো ভেঙে পড়লে চলে, বাবা? রেজাল্ট কি কেউ খারাপ করে না? তাই বলে কি এতটা মন খারাপ করতে হয়? তুই তো ভালো করে পড়লে ঠিকই পারবি, এত ভাবছিস কেন?


আমি তখনও সব কিছুকে অবিশ্বাস করতে শিখে যাইনি। বাবার কথাগুলি শুনে আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। আমি যা করেছি, ওই বয়সের বিচারে, এর চাইতে জঘন্যতম অপরাধ তো আর হয় না! আমাকে তো পিটিয়ে বা কথার তীর ছুড়ে ছুড়ে মেরেই ফেলার কথা, বাসা থেকে বের করে দেওয়ার কথা। অথচ বাবা আমাকে একটু বকলেন পর্যন্ত না! এমন একজন মানুষের ছেলে হয়েও এতটা কষ্ট দিচ্ছি বাবা-মাকে! জগতে কত মেধাবী মানুষ পড়াশোনা করার সুযোগই পায় না, আর আমি? সব সুযোগ পেয়েও কিছুই করতে পারছি না!


ওদিকে আমি টেকনিক্যাল লাইনের পড়াশোনায়ও ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারছিলাম না, ওখানেও রেজাল্ট খারাপ করে যাচ্ছিলাম। বাবাকে জানালাম, ‘আমি ওই লাইনে আর পড়ব না। আমি শুধু এইচএসসি’র জন্যই পড়াশোনা করতে চাই।’ বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আমি নিজেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। টেকনিক্যাল বাদ। আমি আমার নিয়তের প্রতি শতভাগ অবিচল ও আন্তরিক থেকে পড়াশোনায় গভীর মনোনিবেশ করলাম। বাবার কাছ থেকে প্রতিদিনই উৎসাহ পেয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা ছিলেন আমার সেই অন্ধকার দিনগুলির প্রদীপের অকম্পিত শিখাটি।


বাবার অগাধবিশ্বাস ও আমার প্রস্তুতির উপর ভর করে ২০০৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। এবার সব বিষয়ে পাস করলাম। রেজাল্ট হলো বরাবর ৩.০০। সিজিপিএ একটু কম পেয়েছি, কিন্তু পাস তো করেছি! আমার মতো একটা ছাত্র আর কী-ইবা বেশি করতে পারত! বাবাকে দেখলাম, বাবা অনেক খুশি! বাবা খুশি তো আমিও খুশি, আবার কী! আমার পাস করে যাওয়ার প্রাপ্তি একটাই---বাবাকে খুশি হতে দেখা। এর বেশি ভাবনা আমার মাথায় আসেনি।


বাবা খুশিতে আমাকে ইন্ডিয়াতে ঘুরতে পাঠালেন। আহা, আমার আনন্দ দেখে কে! ৩২ দিনের সেই ভ্রমণে আমার দিল্লি, আগ্রা, মথুরা, অযোধ্যা, বৃন্দাবন, ওদিকে গয়া, কাশী, বারানসি, বুদ্ধগয়া, সারনাথসহ কলকাতার নানান জায়গায় ঘোরার সুযোগ হয়। আমার মনে হচ্ছিল, এই জীবনে এমন একটা বাবা পেলে আর কিছুই লাগে না, তাঁর পায়ে মাথা রেখেই হাসতে হাসতে জীবন পার করে দেওয়া যায়! এমন একটা বাবাকে পেয়েছি, আর কোনও অর্জন আমার না থাকলেও মনে দুঃখ থাকবে না।


ফিরে আসার পর এদিকে ভার্সিটি-অ্যাডমিশনের জন্য ভর্তিযুদ্ধ! ইন্ডিয়াট্যুর শেষ করার পর তেমন একটা সময় পেলাম না ভার্সিটির অ্যাডমিশনের টেস্টের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার। হাতে যে কয়েকটা দিন আছে, সেগুলিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমে পড়লাম। এক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও পরীক্ষা দিতে পারলাম না। কোথাও বলতে বাবা আমাকে যতদূরে যেতে দেবেন বলেছিলেন, ততদূরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা বলছি।


পরীক্ষা দিলাম, রেজাল্ট হলো। রাজশাহী ভার্সিটির একটাও অনুষদের কোনও সাবজেক্টেই চান্স পেলাম না। ওয়েটিং লিস্টে অনেক দূরে আমার রোল নাম্বার। সেখানে থেকে কিছুই আশা করা যায় না। অগত্যা, খুব মন খারাপ করে ভর্তি হলাম কারমাইকেল কলেজে ‘সেই ফিজিক্স’-এ। আমার বাবা কিন্তু অতটা মুষড়ে পড়েননি। ছেলে কোথাও ভর্তি হয়েছে, পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে, তিনি এতেই খুশি। তিনি অল্পতে সুখীথাকার জাদুটা জানতেন। আমার জীবনে বাবার কাছ থেকে শেখা অনেক জাদুর মধ্যে এটিই সেরা। খুব ছোট ছোট ঘটনা, ছোট ছোট ব্যাপার বাবাকে মুগ্ধ করে রাখতে পারত দিনের পর দিন। এ এক আশ্চর্য জীবনদর্শন, নিবিড় অনুভব! এমন একজন মানুষকে কষ্ট দেওয়ার চাইতে অনেক সোজা কাজ হচ্ছে, মরে যাওয়া।


এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রবল আগ্রহ আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। সেই সময়ে বাংলালিংকের একটা বিজ্ঞাপন খুব মনে ধরেছিল। বিজ্ঞাপনটা ছিল আজাদ প্রোডাক্টস-এর আজাদ সাহেবকে নিয়ে তৈরি, যেটির মূলথিম ছিল---হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখিনি!...আমার রক্তে যেন আগুন ধরে গেল!


লড়াইটা থামালাম না। আমি জানি, থেমে-যাওয়া সহজ। এ-ও জানি, থেমে-যাওয়ার পরের জীবনটা সহজ নয়। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি দ্বিতীয়বার পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তিপরীক্ষা দিব। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায়ই তো দ্বিতীয়বারে পাস করেছি। দেখিই না, এবার ভাগ্যে কী লেখা আছে। সুযোগ যখন আছেই, কাজে লাগিয়ে দেখিই না কী হয়! আর কিছু না হলেও-বা কী! আমি তো কলেজে ভর্তি হয়েই আছি! বাবা তো খুশি আছেন আমাকে নিয়ে। আমার আর চিন্তা কীসের?


বাবা এবারও সাথে ছিলেন। আমার মাথায় হাত রেখে আদর করে বললেন, বাবা, সুযোগ যখন পেয়েছিসই, নষ্ট করে কী লাভ? ওরকম দুই-এক বছর লাইফ থেকে লস হলে কিছু হয় না! একদিন এসব কেউ মনে রাখবে না। তোর নিজেরও মনে থাকবে না, মনে রাখার সময়টাই তুই আর পাবি না! তুই কোথায় পৌঁছাচ্ছিস, সেটা হচ্ছে আসল; কীভাবে সেখানে পৌঁছাচ্ছিস, সেটা কোনও ব্যাপার না! তুই পারবি! আর না পারলেও কী হবে রে? জীবন কি আর ভার্সিটি - কলেজ - সাবজেক্ট বোঝে রে, ব্যাটা?


বাবার কথা শুনে যেন গায়ের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল! হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই পারব! আমার সাথে সেকেন্ড-টাইমার হিসেবে চারজন বন্ধুকে পেলাম। ওদের সবার সিজিপিএ আমার চেয়েও কম। এত বাজে রেজাল্ট নিয়েও আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখলাম।


আমাদের পাঁচজনের রাতদিন এক হয়ে গেল! আক্ষরিক অর্থেই, চন্দ্রসূর্যের মুখ না দেখে পড়াশোনা করতে লাগলাম। এ দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ হেরে যাওয়া যাবে না। হেরে যাবার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। আমাদের পাঁচজনের মধ্যে তখন কী একটা জানি ভর করেছিল বোধহয়! আহা, সে এক অসীম পরিশ্রমের ইতিহাস! পরস্পরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে গ্রুপস্টাডির ভেতর দিয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম। যেভাবেই হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে!


আমরা পাঁচ বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিলাম। এবার আমাদের স্বপ্নদেখা আর বৃথা যায়নি। আমরা প্রত্যেকেই দুঃসাহসিক এই যুদ্ধে জয়ী হলাম। আমাদের সবারই রাজশাহী ভার্সিটিতে কোনও না কোনও সাবজেক্টে হয়ে গেল। আমাদের খুশিতে যেন আজ পুরো আকাশটাই নেমে পড়েছে চোখের কাছে!


আবারও, আমার সবচাইতে বড়ো জয়টা ছিল এই যে, আমি আমার ভালো মানুষ বাবাকে অনেক খুশি করতে পেরেছি। সাফল্য বলতে, আমার কাছে এটাই মনে হয়েছিল। আমি ভর্তি হয়েছিলাম ইতিহাসে, আমার বাকি বন্ধুদের একজন বাংলায়, একজন অ্যারাবিক স্টাডিজে, বাকি দুইজন গণিতে।


পরবর্তীতে বিভাগ পরিবর্তন করে আমি চলে গেলাম জার্নালিজমে, এবং পরে অনুষদ পরিবর্তন করে অপেক্ষমাণ তালিকার ১১তম প্রার্থী হিসেবে এমন একটা বিভাগে ভর্তি হলাম, যে বিভাগ আমার পুরো জীবনটাকেই পাল্টে দিয়েছে। সেটা হচ্ছে আমার প্রিয় মার্কেটিং বিভাগ। আমার স্বপ্নের রথটা মেঘে মেঘে উড়তে শুরু করল যেন!


শুরু হলো আমার নতুনজীবনের নতুন পথচলা। আমি স্বপ্ন দেখতে শিখছিলাম। আমার স্বপ্নগুলি বড়ো হতে লাগল। বড়ো থেকে আরও বড়ো, আকাশছোঁয়ার দিকে। আমি আমার জীবনে এই প্রথম স্বপ্ন দেখতে শিখলাম। আমার মতো একটা ছেলেকেও জীবন স্বপ্ন দেখায়! আহা জীবন, আহা জীবন!


নতুন পরিবেশ, নতুন সব কিছু। রাজশাহী ভার্সিটির অমন গোছানো পরিবেশ, মার্কেটিং বিভাগের অত চমৎকার ফ্যাকাল্টি ও সুযোগসুবিধা আমাকে মুগ্ধ করে রাখল। আমি নিজের উপর থেকে যে আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, তা আবারও ফিরে পেলাম। নিজেকে নতুন করে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। মন খারাপ হলে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই বাবাকে ফোন করে ফেলতাম। বাবাও বলতেন, তুই পারবি। তুই আগেও পেরেছিস, তুই সামনেও পারবি। তুই হেরে যেতে পৃথিবীতে আসিসনি। হেরে যেতে এলে তো বহুআগেই হেরে বসে থাকতিস। তোর গন্তব্য অনেক অনেক অনেক দূরে। পথের এখনও অনেক বাকি। তুই কল্পনাই করতে পারছিস না যে চেষ্টা করলে তুই কতদূরে চলে যাবি!


আমার সারাজীবনে শোনা শ্রেষ্ঠ কথাগুলি আমার বাবার। বাবার কাছে গেলে যেন মৃতমানুষও জেগে উঠবে! বাবার সাথে কথা বললে মনে হতো, এই পৃথিবীতে আমার চাইতে বেশি সৌভাগ্য নিয়ে কেউ জন্মায়নি, কেননা আমার বাবাটা ওদের কারও বাবা নয়।


ভার্সিটিতে ভর্তির পর এমন একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, যিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে আকাশে পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে হয়, কীভাবে সিন্ধুর মধ্যে মুক্তো খুঁজতে হয়, কীভাবে জীবনের প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয়, কীভাবে অসংখ্য কাজের মধ্য থেকে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ কোনটি তা বুঝতে হয়। তিনি প্রফেসর ড. রথীন্দ্রনাথ মজুমদার। যদি এ জীবনে আমার বাবার পর আর কারও পায়ের ধুলোয় আমি আমার স্থান বিবেচনা করি, তিনি হচ্ছেন এই রথীন্দ্রনাথ স্যার। যদি কখনও এমন পরিস্থিতি আসে, আমার নিজের শরীরের কোনও অংশ দিয়েও এঁদের বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে, আমি হাসতে হাসতে তা দিয়ে দেবো।


সেই ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে আমার জীবনে, সবই আমার কল্পনাকেও হার মানায়। অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি হতে দেরি হলেও আমাদের ক্লাস শুরু হতে দেরি হয়নি। খুব দ্রুতই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। আমি পড়াশোনার প্রতি ভীষণ মনোযোগী হয়ে উঠলাম। জীবনের এত এত পরিবর্তনে আমি দিনে দিনে নতুন এক অনন্য মানুষ হয়ে উঠছিলাম। মনের মধ্যে শক্তি ও হৃদয়ে আন্তরিকতা থাকলে যেকোনও কাজেই আপনাআপনি মনোযোগ চলে আসে। হঠাৎ করেই, আমার পড়তে ভালো লাগত, আমার স্বপ্নের জন্য পরিশ্রম করতে ভালো লাগত। সবাই আমাকে দেখলে আঁতেল ডাকত, আরও কত কী যে বলত! বলুক না! আমি সত্যি সত্যি ওগুলিই! আমি শুধু হাসতাম। বাবার কাছ থেকে, কাউকে কিছু না বলে হাসতে শিখেছিলাম।


খুব ভালো লাগছিল নতুন কোনও পরিবেশে নিজেকে নতুনভাবে খাপ খাইয়ে নিতে। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বন্ধুদের সাথে পরিচয় হলো। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম, নিজেকে ওদের কাছ থেকে শিখতে দিচ্ছিলাম। জীবনে কিছু করতে চাইলে নিজেকে শিখতে দিতে হয়, নিজের মাথাটা নত করে রাখতেই হয়। খোলামনে, কৌতূহলী চিত্তে, নিবিষ্ট মনোযোগে নানান নতুন ধারণা, নতুন জীবনদর্শন, নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলছিলাম।


প্রথম যেদিন ক্লাস করতে যাই, তার এক সপ্তাহ পর রাজ্জাক স্যারের বেসিক মার্কেটিং-এর টিউটোরিয়াল। সেখানে আমার মার্কস ছিল ৮.৫, কেউ কেউ অবশ্য দশে দশও পেয়েছিল। তবে আমি যে মার্কসটা পেয়েছি, ওতেই আমি অসম্ভব রকমের খুশি। বাবাকে ফোন করে জানালাম। বাবা বুঝে হোক না বুঝে হোক, বলে ফেললেন, ‘যে দশ পেয়েছে, তার দিকে তাকাস না, নিজের দিকে তাকা। যা পেয়েছিস, তা-ই তোর জন্য ভালো। ওটাকে দশে নিয়ে যা। কাউকে ছোঁয়ার দরকার নেই, শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে যা। তা হলেই হবে!’ মনে মনে স্থির করলাম, পরের পরীক্ষায় যে করেই হোক, এর চাইতে বেশি পাব।


নিয়মিত ক্লাসে যেতাম। অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, হলে ফিরে পড়াশোনা,…এইসব কিছুই নিজের সবটুকু সামর্থ্য ঢেলে দিয়ে কড়া নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে করতে থাকি। আমি আমার নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতাম এটা ভেবে যে, আমি পড়াশোনায় কোনও ফাঁকি দিচ্ছি না। একদম কণামাত্রও না। লাইফে চিট-ডে বলে কিছু নেই। ওসব নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বানানো কিছু শব্দ। লাইফে আছে কেবলই ডে, আর লস্ট-ডে। এর বাইরে কিছু নেই। আমি নিজের কাছে স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম, একমাত্র অসুস্থ হয়ে না গেলে আমার লাইফে কখনও কোনও লস্ট-ডে থাকবে না। আমার সাথে পেয়েছিলাম চারজন বন্ধু ও তিনজন বান্ধবীকে, আমরা এই আটজন মিলে নিয়মিত গ্রুপস্টাডি করতাম, পড়াশোনার প্রতি সর্বোচ্চ পরিমাণে আন্তরিক থাকতাম।


এভাবেই আমার দিনগুলি ভালোই চলছিল। এর মাস পাঁচেক পর আমাদের মিডটার্ম পরীক্ষা শুরু হলো।


ভার্সিটিতে ভর্তির সময় যেভাবে যতটা ডেডিকেশন দিয়ে আমি পড়াশোনা করেছিলাম, ঠিক একইভাবে একই ডেডিকেশন দিয়ে আমি ফার্স্ট-সেমিস্টার থেকেই পড়তে লাগলাম। নিজেকে প্রস্তুত করার সকল আয়োজন চলছিল আমার ভেতরে ভেতরে।


মিডটার্মটা বেশ ভালোই দিলাম। যেদিন রেজাল্ট দিলো, সেদিনই ঘটল আমার জীবনের সকল মোড় ঘুরিয়ে-দেওয়া এক আশ্চর্য ঘটনা! নিজেকে তো বটেই, সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার রেজাল্ট এল---সিজিপিএ চারে চার, অর্থাৎ সব বিষয়েই এপ্লাস!


নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে আবার আমার এক ব্যাচ সিনিয়র মাসুম ভাইকে দিয়ে চেক করিয়ে নিয়েছিলাম। না, রেজাল্ট ঠিকই আছে। ওটাই! যা পরিবর্তন হবার নয়, তা শতবার চেক করলেও একই থাকে। আমার রেজাল্ট শুনে ড. রথীন্দ্রনাথ স্যার অবাক হয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, এটা তো কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বাচ্চাদের মতো একটা রেজাল্ট!


কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবাকে ফোন করে রেজাল্টের কথা জানিয়েছিলাম। বাবা সেদিন দরদর করে কেঁদে ফেলেছিলেন, আমার খুব মনে আছে। কিছু কিছু মানুষকে খুশি করা খুবই সহজ। আমার বাবা তো ওরকমই একজন মানুষ! সামান্য রেজাল্ট শুনেই কেমন হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন! বাবার এই আনন্দের কান্না শুনে সেদিন মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে আমার আসাটা সার্থক! এখন মরে গেলেও আমার কোনও দুঃখ নেই।


বাবা ফোনটা রাখার আগে বলেছিলেন, বাবা, এখন থেকে তোর রেজাল্ট এমনই হবে, দেখিস! তোর সাথে আমার আশীর্বাদ আছে। তুই ভয় করিস না কোনও কিছুতেই! কারও কোনও কথারই প্রত্যুত্তর দিবি না, শুধু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাক, ওতেই হবে!


বন্ধুবান্ধব শিক্ষক-শিক্ষিকা…সবাই অবাক আমার এমন একটা অবিশ্বাস্য রেজাল্ট দেখে। আমার আত্মবিশ্বাস ক্রমাগত বাড়তে লাগল। আমার ব্যক্তিগত আকাশটা আরও একটু করে বড়ো হয়ে গেল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। এই স্বপ্নটা আমার ভেতর দিন দিন স্থায়ীভাবে গেঁথে যাচ্ছিল। ভার্সিটির টিচার হওয়ার জন্য অন্যান্য যোগ্যতার পাশাপাশি একটা আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট লাগেই, তাই আমি রেজাল্টের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লাগলাম। আমি অনেক অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। আমার সমস্ত দৃষ্টি ও মনোযোগ ছিল রেজাল্টের দিকে, নিজের শরীরের বা অন্য কিছুর দিকে নয়।


আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষকদের একজন, ড. বেলায়েত হোসেন স্যার, বলেছিলেন, ‘সবে তো এক টার্ম! এখনও অনেক ইনিংস বাকি কিন্তু! দেখো, সামনে কী হয়। হাল ছেড়ো না।’ সেই উপদেশ আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সময়টুকুতে চলার পথের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়।


অবিশ্বাস্য রকমের পরিশ্রম করে রীতিমতো গাধার খাটুনি খেটে সারা পৃথিবীর সব আকর্ষণকে তুচ্ছ করে আমি টেবিলের সাথে লেগে থাকতাম। বাবার নির্দেশ মেনে কোনও টিউশনি করতাম না। যখনই পড়তে আমার ভালো লাগত না, তখনই মাথায় আসত, আমার স্বপ্নপূরণের জন্য পড়াশোনাটাই তো সবচেয়ে বেশি জরুরি, নইলে যে আমার স্বপ্ন ভেঙে যাবে, আমার বাবার কথা মিথ্যে হয়ে যাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার স্বপ্ন আমাকে দিনরাত ঘুমাতে দিত না। এই স্বপ্নটা আমাকে সারাক্ষণই টেবিলের সাথে আটকে রাখত। সারাদিন শুধু পড়া নিয়েই পড়ে থাকতাম। আমার পুরো অ্যাকাডেমিক লাইফে ক্লাসের পড়াশোনার বাইরে এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিনোদন বলে কিছুই কখনও ছিল না। অ্যাকাডেমিক যত বই, পেপার বা জার্নাল আছে, সেগুলির সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। স্যারদের আর ম্যামদের প্রতিটি ক্লাস খুব মনোযোগ দিয়ে করতাম যেন কোনও কিছুই কোনও অবস্থাতেই বাদ না পড়ে।


প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হলো, আমার রেজাল্ট এল ৩.৯৮।


এবার আমার আত্মবিশ্বাস একলাফে দ্বিগুণ তিনগুণ হতে হতে যেন কয়েকশো গুণ বেড়ে গেল। আমার স্বপ্নগুলি আমার চোখে আরও জ্যান্ত হয়ে উঠল। এমন রেজাল্ট আমাকে দুর্দান্ত রকমের পরিশ্রমী করে তুলল। সকল স্যার, ম্যাডাম ও কিছু বন্ধুর সহযোগী মনোভাবে এবং অনুপ্রেরণায় আমি আরও নিবেদিতপ্রাণ ও অক্লান্ত নিয়মনিষ্ঠ ছাত্র হয়ে উঠলাম।


এভাবে প্রতিটা সেমিস্টারেই ধারাবাহিকভাবে আমি খুব ভালো রেজাল্ট করতে শুরু করি। রেজাল্ট যতই ভালো হয়, উৎসাহ আমার ততই বাড়ে, তার সাথে স্বপ্ন আমার ততধিক অদম্য হতে থাকে।


দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে আমার রেজাল্ট ছিল যথাক্রমে ৩.৯৭, ৩.৯৫ ও ৩.৯৬।


যে আমি এসএসসি ও এইচএসসি’তে ফেল করে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে কোনওমতে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, সেই আমি আমার ডিপার্টমেন্টের সমস্ত অতীত-রেকর্ড ভেঙে ৩.৯৭ সিজিপিএ নিয়ে বিবিএ শেষ করলাম।


আমি তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার স্বপ্নে বিভোর। এমবিএ-তে আমার সিজিপিএ এল ৩.৯৮।


যতটুকু জেনেছি, আমার রেজাল্টটাই অদ্যাবধি মার্কেটিং বিভাগে বিবিএ ও এমবিএ’তে সবচাইতে ভালো রেজাল্ট। আমার মতো একটা ছেলের কাছে এটা সত্যিই অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য।


আহা, জীবন কত কিছু দেখায়! যে ছেলে আদৌ পড়াশোনা করতে পারবে কি না, তা নিয়েই সবার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, সে ছেলেই তার ভার্সিটিতে সর্বকালের সর্বসেরা রেজাল্টটি পকেটে পুরে বসে আছে!


আমার রেজাল্ট দেখে একবার চতুর্থবর্ষের ভাইভাতে পরীক্ষাকমিটির প্রধান ড. নজিবুর রহমান খান স্যার আমাকে বলেছিলেন, তোমার সম্পর্কে আমি জেনেছি। ইটস সিম্পলি অ্যা মিরাকল! এটা কীভাবে করলে, বাবা? তোমাকে দিয়েই হবে…আরও অনেক কিছু হবে! ওয়েট অ্যান্ড সি, ইয়াংম্যান!


ভালো রেজাল্টের সুবাদে আমি এই পর্যন্ত ৬টি বৃত্তি পেয়েছি।


যা-ই হোক, শিক্ষাজীবন শেষ করে আমি কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। সেই শুরু থেকেই আমার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। কিন্তু বিধিবাম! আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিনা-অযোগ্যতাতেই থেমে গেলাম। শিক্ষক হবার জন্য যথাযথ যোগ্যতা নিয়ে আমি লেকচারার পদে অ্যাপ্লাই করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু থমকে দাঁড়াল আমার অনেক কষ্টে গড়ে তোলা পৃথিবীটা।


কিছু রাজনৈতিক জটিলতায় পড়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পথটা ভীষণ দুর্গম হয়ে উঠল। আমি বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া বোধহয় আমার কপালে লেখা নেই। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে, অনেক অনেক হতাশা নিয়ে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে পরীক্ষা দিলাম। এর মধ্যে আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্যও অ্যাপ্লাই করতে থাকি।


এমবিএ শেষ করে ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল আমি যখন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি, তখন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম---স্বপ্নের পথে প্রথমসোপান!...আমার স্বপ্ন তো ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। শিক্ষক হয়ে বাবাকে খুশি করা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হয়ে সেই স্বপ্নটা আংশিক পূর্ণ করলাম। বাবা কিন্তু সেই বরাবরের মতোই অনেক অনেক খুশি!


স্বপ্নকে কখনও ভেঙে যেতে দিতে নেই। কী আছে আর জীবনে! যদি এখন থেমেও যাই, এক অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই-বা কেন থামব? সামান্য হলেও পূর্ণ করেই নিই না! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আমার নাহয় এখনও অপূর্ণই থেকে গেল।


ওদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে আমার চাকরিটা হলো। আমি সেখানে জয়েন করে ফেলি। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আমার তখনও অধরাই থেকে গেল, তাই আমার মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আমি তো এই জীবনে তেমন কোনও বড়ো স্বপ্ন দেখিনি। বাবার মতোই আমিও অল্পে সুখী হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। তবে জীবনে একটাই আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। অথচ স্বপ্নটাই অপূর্ণ থেকে গেল…সে স্বপ্ন, যে স্বপ্নটার পেছনে আমি কোনও ধরনের ফাঁকি না দিয়ে শ্রম দিয়েছি গোটা পাঁচ পাঁচটা বছর। যে স্বপ্ন পূরণ করতে আমি দিনের পর দিন লড়ে গিয়েছি সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এসব মাথায় আসত এবং আমি কেমন জানি মানতে পারছিলাম না এসব। তবুও আমি দমে যাইনি। একজন প্রিয়দর্শীকে দমানো যায় না, তার মাথায় যে বাবার আশীর্বাদ আছে!


বাবা ছোটবেলায় শিখিয়েছেন, ‘চিতাবাঘের মতো স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলতে হয়, তবেই স্বপ্ন তোমাকে ধরা দেবে।’ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি শিক্ষক হবার জন্য আবার অ্যাপ্লাই করব। বাংলাদেশ ব্যাংকে জয়েন করার পরও আমার কোনও কিছুতেই স্বস্তিটা ঠিক আসছিল না।


যারা তাদের নিয়তের প্রতি সৎ ও পরিশ্রমী, ঈশ্বর কখনও তাদের নিরাশ করেন না। আমাকেও করেননি। ২০১৬ সালের শেষের দিকে আমার কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার যোগদানপত্র আসে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি আর বাবা দুজন মিলে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমাদের বুক আনন্দঅশ্রুতে ভেসে গিয়েছিল। আহা, আমার সারাজীবনে, কান্নার একটাই বন্ধু---আমার বাবা! আজও, কাঁদতে ইচ্ছে করলে ফোনটা বাবাকেই করি।


আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিই, তার কিছুদিনের মধ্যেই আমার কিছু আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ার কথা, সেটার মায়া ছেড়েই আমাকে চলে আসতে হয়েছে। অফিসে যেদিন আমার শেষদিন, তার দেড় সপ্তাহ পর আমার জার্মানিতে যাওয়ার কথা, ফরেনট্যুরে।


নিঃসন্দেহে, চাকরি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিটা অতিঅসাধারণ একটা চাকরি। কিন্তু আমার কাছে এই পৃথিবীর সকল অসাধারণত্বের চাইতেও আমার স্বপ্নের দাম অনেক অনেক অনেক বেশি। মরে তো একদিন যেতেই হবে! তো মরবই যখন, স্বপ্নটা পূরণ করে তারপরই নাহয় মরি!


সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিতে ইস্তফা দিলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলাম। আমার অনেক অনেক দিনের লালিতস্বপ্ন অবশেষে আগাগোড়াই পূরণ হয়ে গেল। বাবা, আমিও পেরেছি!


ব্যর্থতাকে পুঁজি করে, দুর্বলতাকে শক্তি করে জীবনের বন্ধুর পথে হেঁটে যেতে হয়। ঈশ্বর কখনও পরিশ্রমীদের নিরাশ করেন না। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর যদি আমি দমে যেতাম, যদি থেমে যেতাম, যদি নিজের ওসব ব্যর্থতাকে নিজের নিয়তি বা গন্তব্য বলে মেনে নিতাম, তবে আজকের এই দিনে একজন প্রিয়দর্শী কখনওই জন্মাত না। এসএসসি এইচএসসি দুটোতেই ফেল করে যে ছেলের পড়াশোনা করারই কথা ছিল না,…হ্যাঁ, আমিই সেই ছেলে!


সেই আমিই আজ ক্লাসভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়াই। আজ আমি সবাইকে বেঁচেথাকার উৎসাহ দিই, স্বপ্নদেখার পথটা দেখাই, হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় বলে দিই, ব্যর্থতাকে জয় করার অসংখ্য মন্ত্র শেখাই। সামনে পিএইচডি করতে আমেরিকায় যাব। তিনটা প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এই মুহূর্তে মাথায় আছে, সেগুলির যেকোনওটিতেই আমি চাইলেই যেতে পারি। ভাবছি, কোনটাতে যাব! হ্যাঁ, একসময় এই আমারই নিঃসঙ্গ কোনও গ্রহে হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।


স্বপ্ন যত আকাশছোঁয়াই হোক, পরিশ্রম আর সদিচ্ছা থাকলে যেকোনও দুরূহ স্বপ্নও সত্যি হবেই। প্রয়োজন শুধু আত্মবিশ্বাস, আর স্বপ্নবাস্তবায়নের সাহস। প্রতিটি স্বপ্নের পথই সব সময় দুর্গম। সহজ পথে স্বপ্ন থাকে না, থাকে জেব্রাক্রসিং! জীবনটা জেব্রাক্রসিংয়ের নিশ্চিন্ত রাস্তা নয়।


আমার জীবনে তো সব কিছুই হয়েছে দ্বিতীয়বারে, তাই জন্মটাও আর একবার হলো! এই আরকি! বাবা তো বলেইছিলেন, এই কপালে সব লেখা আছে! সময় হলে ঠিকই জানা যায়।


আজ আমি আপনাদের দায়িত্ব নিয়েই বলছি, ব্যর্থতা জিন্দাবাদ! আর এই ব্যর্থ ছেলেটাকে সফল করার পেছনে যাঁদের অসামান্য অবদান, তাঁদের আমি আমৃত্যুই দিনান্তের সকল প্রার্থনায় রাখব।


আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল মানুষ ও দার্শনিক আমার বাবা। অতটা দুঃসাহস, ধৈর্য ও বিশ্বাস নিয়ে বাবা সব সময় আমার পাশে না থাকলে, কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়াই আমার একমাত্র নিয়তি ছিল। বাবা আমার উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, আর আমি বিশ্বাসটা রেখেছিলাম আমার নিজের উপর। তো প্রিয় পাঠক, আপনাদের সাথে তো আমার বাবার পরিচয়ই হলো না! পরিচয়টা করিয়ে দিই, কেমন?


বাবার নাম: নরেশ তালুকদার
বাবার পেশা: কাঠমিস্ত্রি (আমার চোখে…জীবনমিস্ত্রি!)
বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতা: দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত
বাবা হিসেবে বাবার যোগ্যতা: আমাকে আজকের প্রিয়দর্শী করে গড়ে তোলা
বাবার প্রিয় কাজ: আমাকে ভালোবাসা ও রবীন্দ্রনাথ-পড়া


ঋণস্বীকার। ‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’ শব্দগুচ্ছটি আমি নিয়েছি কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ বইয়ের তৃতীয় প্রবন্ধের নাম---‘ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’…থেকে।