তাঁর স্তোত্রম্ বা স্তবে তাঁকে আহ্বান করা হয়েছে নানা গুণে—“আধার ভূতা” (যিনি সমগ্র সৃষ্টির ভিত্তি), “ধৃতিরূপা” (যিনি স্থিতির মূর্তি), “ধুরন্ধরা” (যিনি ভার বহন করেন), “ধ্রুবপদা” (যিনি অপরিবর্তনীয়), “শক্তিস্থা”, “শক্তরূপা” ও “শক্তবিগ্রহা”—যিনি নিজেই শক্তির সাকার রূপ—নির্গুণ ব্রহ্মের সগুণ রূপ।
এসব উপাধি ও আহ্বান মিলিয়ে স্পষ্ট হয়, জগদ্ধাত্রী কেবল এক দেবী নয়; তিনি সেই মহাশক্তি, যিনি সৃষ্টিকে ধারণ করেন, জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করেন, এবং মানবচেতনার অন্তর্গত স্থিতি ও শুদ্ধির প্রতীক হয়ে থাকেন। তাঁর পূজা তাই জ্ঞানের, স্থিতির ও সংযমের সাধনা—যেখানে দেবী নিজেই চেতনার আলোকময় ধ্রুব বিন্দু।
জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাসে স্মৃতি-সাহিত্য এক অপরিহার্য উৎস, যা প্রমাণ করে যে, এই দেবীর আরাধনা কোনো সাম্প্রতিক সামাজিক উদ্ভাবন নয়, বরং বহু শতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠিত এক শাস্ত্রসংগঠিত প্রথা। প্রথম নির্দিষ্ট পাঠ্যউল্লেখ পাওয়া যায় স্মার্ত শূলপাণি রচিত কালবিবেক-এ (প্রায় ১৩৭৫-১৪৬০ খ্রিঃ)। এই গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে, অর্থাৎ দীপাবলির পরবর্তী শুভ কালপর্বে। এই উল্লেখটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি জগদ্ধাত্রী-উপাসনার সময়-নির্ধারণকে বৈদিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে যুক্ত করে এবং প্রমাণ করে যে, দেবীর আরাধনা এক স্বীকৃত স্মার্ত-ধর্মীয় আচাররূপে গৃহীত ছিল।
“দীপাবলির পরবর্তী শুভ কালপর্বে” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে সেই বিশেষ সময়কে, যা হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথি—অর্থাৎ দীপাবলির (অমাবস্যা তিথি) কয়েক দিন পরের নবমী।
হিন্দু ক্যালেন্ডারে দীপাবলি পড়ে কার্ত্তিক অমাবস্যা-তে। তার পরের দিনগুলি (শুক্লপক্ষ) ধীরে ধীরে আলোর বৃদ্ধি ও শান্তির প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। এই সময়কে “শুভ কালপর্ব” বলা হয়, কারণ এটি একান্তভাবে সত্ত্বগুণ-প্রধান—অর্থাৎ শান্তি, স্বচ্ছতা ও আধ্যাত্মিক স্থিতির সময়।
শাস্ত্র-মতে, কার্ত্তিক শুক্ল নবমী সেই তিথি, যেদিন দেবী জগদ্ধাত্রী আরাধনা সর্বাধিক ফলদায়িনী বলে ধরা হয়। কালবিবেক-এ এই সময়কেই “জগদ্ধাত্র্যুপাসনায় যোজ্য তিথি” বলা হয়েছে। কারণ, দীপাবলির অমাবস্যায় যখন কালী (অন্ধকার-নাশিনী শক্তি) পূজিতা হন, তখন তার কয়েক দিন পরের নবমী-তিথিতে পূজিতা হন জগদ্ধাত্রী—যিনি আলোর, স্থিতির ও নিয়ন্ত্রিত শক্তির প্রতীক।
এই পবিত্র ক্ষণ হচ্ছে—অমাবস্যার অন্ধকার থেকে সূর্যোদয়ের মতো যে-সময়ে প্রকৃতি ও চেতনা উভয়েই পুনরায় আলোকিত ও স্থিতিশীল হয়, সেই আলোক-পর্বের নবমী, যেখানে কালী-র উগ্র শক্তি রূপান্তরিত হয়ে জগদ্ধাত্রীর শান্ত শক্তিতে পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে এই আচার-সংহিতা আরও সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় বৃহস্পতি রায়মুকুটের ‘স্মৃতি-রত্নহার’-এ ও শ্রীনাথ আচার্য চূড়ামণির ‘কৃত্যন্ত তত্ত্বার্ণব’-এ। এই দুই গ্রন্থেই কার্তিক-শুক্লা-নবমীকে দেবী-পূজার নির্দিষ্ট সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা নির্দেশ করে যে, পঞ্চদশ শতকেই জগদ্ধাত্রী পূজা ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত এক প্রথা হয়ে উঠেছিল। স্মার্ত সাহিত্যের এই ধারা তখনকার ব্রাহ্মণ্য আচারশাস্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে স্থানীয় শাক্ত উপাসনাকে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিল।
পরবর্তীকালে ষোড়শ-শতকের আচারশাস্ত্রকার স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্ট তাঁর ‘দুর্গোৎসব-তত্ত্ব’-এ এই পূজার বিশেষ উল্লেখ করেছেন। তিনি দেবী-দুর্গার উপাসনার প্রসঙ্গে কার্ত্তিক নবমী-তিথিতে জগদ্ধাত্রী পূজার বিধানকে একটি পরিশুদ্ধ “উত্তর-দুর্গা” রূপে বর্ণনা করেন—যা শক্তিপূজার রজোগুণ থেকে সত্ত্বগুণে উত্তরণের প্রতীক।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, যিনি সপ্তদশ শতকে ‘বৃহৎতন্ত্রসার-এর প্রণেতা, তাঁর তান্ত্রিক আলোচনায় জগদ্ধাত্রীকে দুর্গার এক বিশেষ রূপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, দেবী দুর্গার তিন রূপ—চণ্ডিকা, কালী ও জগদ্ধাত্রী—তিনটি গুণের প্রতীক: তমঃ, রজঃ ও সত্ত্ব। জগদ্ধাত্রী সেই রূপ, যেখানে শক্তি ধ্বংসাত্মক নয়, বরং সংযত, নিয়ন্ত্রিত এবং জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত।
চণ্ডিকা শব্দটি সংস্কৃত “চণ্ড” ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘প্রচণ্ড’, ‘প্রবল’, ‘অতিশয় তেজস্বিনী’। তাই চণ্ডিকা মানে সেই দেবী, যিনি প্রচণ্ড শক্তি ও তেজের প্রতীক—যিনি রক্ষাকারিণী, সংহারিণী এবং করুণাময়ী তিন রূপেই প্রকাশমান।
শাস্ত্র মতে, “চণ্ডিকা” আসলে দুর্গা দেবীর এক বিশেষ রূপ, যার মাহাত্ম্য দেবী মহাত্ম্যম্ (বা চণ্ডী পাঠ)-এ বর্ণিত। এই পাঠের বারো অধ্যায় মিলিয়ে যা “মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এর অংশ, তাতে দেবীর তিনটি প্রধান আভাস বা প্রকাশ দেখা যায়—
মহামায়া (যিনি বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে রাখেন),
দুর্গা বা চণ্ডিকা (যিনি অসুরসংহারিণী শক্তি),
অম্বিকা (যিনি মাতৃরূপে স্নেহময়ী)।
বিশেষ করে “চণ্ডিকা” নামে দেবীকে বলা হয়েছে দশ মহাবিদ্যা-র মধ্যেও এক তেজঃপূর্ণ রূপ—চণ্ডী বা চামুণ্ডা, যিনি চণ্ড ও মুন্ড নামক দুই অসুরকে বধ করেছিলেন। এই ঘটনা থেকেই ‘চামুণ্ডা’ নামটি এসেছে—চণ্ড+মুণ্ড।
তাত্ত্বিক অর্থে, চণ্ডিকা হলো চেতনার সেই স্তর, যেখানে জ্ঞান (বোধ) ও ক্রিয়া (শক্তি) একত্র হয়ে অজ্ঞান ও দুষ্টপ্রবৃত্তির বিনাশ ঘটায়। তিনি কেবল বাহ্যশক্তির দেবী নন, বরং মানুষের অন্তর্গত প্রতিবোধশক্তি—যা জড়তা, ভয়, অবসাদ বা অজ্ঞানকে ধ্বংস করে আত্মজ্ঞানকে জাগিয়ে তোলে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে চণ্ডিকা-রূপকে বলা হয় উগ্র-বিমর্শ-শক্তি—অর্থাৎ, এমন এক শক্তি, যা সীমাবদ্ধ চেতনার অন্তর্গত পর্দা ছিঁড়ে ফেলে পরম স্পন্দন-চেতনা উদ্ঘাটন করে। আবার শাক্ততত্ত্বে, তিনি “প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনা”—যেখানে মায়ার আবরণ বিদীর্ণ হয় এবং পরম চিত্-আনন্দ প্রকাশ পায়।
“প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনা”—এই ধারণাটি কাশ্মীর শৈব ও শাক্ত দর্শনের মর্মস্থল। এখানে “বেদনা” শব্দটি কোনো কষ্ট বা অনুভূতির নয়; এটি এসেছে সংস্কৃত ধাতু “বিদ্” থেকে, যার অর্থ জানা। তাই “বেদনা” মানে হলো জ্ঞান বা সচেতনতা, সেই চেতনা, যা জানে এবং নিজের জানাকে জানে। কিন্তু আমাদের সাধারণ জ্ঞান সবসময় মিশ্রিত—ইন্দ্রিয়, মন, স্মৃতি, ভাষা, ভাবনা—এসবের সাহায্যে আমরা কিছু উপলব্ধি করি। এই উপলব্ধিতে সর্বদা তিনটি বিভাজন থাকে—জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান। আমি যে জানি, যা জানি, আর জানার যে-প্রক্রিয়া—এই তিনটি আলাদা থেকে যায়। এই বিভাজনই দ্বৈততার জন্ম দেয়।
“শুদ্ধবেদনা” মানে সেই অবস্থা, যেখানে এই তিন বিভাজন সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়—যেখানে জাননেওয়ালা, জানা জিনিস এবং জানার মাধ্যম—সব এক হয়ে যায়। তখন চেতনা আর কোনো বস্তু, ভাবনা বা প্রতীক দ্বারা আবৃত থাকে না; সে নিজেই নিজের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায় এই অবস্থা হলো “প্রকাশ-বিমর্শ”-এর ঐক্য। “প্রকাশ” মানে আলোকরূপ চেতনা, আর “বিমর্শ” মানে সেই চেতনার আত্মবোধ বা আত্মপ্রতিফলন। অভিনবগুপ্ত বলেন—“চিতঃ স্বয়ংবোধরূপাত্”—চেতনা স্বভাবতই নিজের বোধরূপ; সে নিজেই নিজের প্রত্যক্ষ, কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন তার নেই। আবার তন্ত্রালোক-এ তিনি লেখেন—“প্রকাশো বিমর্শশ্চৈতদেকং পরং মহঃ”—প্রকাশ ও বিমর্শ এই দুই মিলে গঠিত হয় পরম দীপ্তি বা মহাশক্তি। এই দীপ্তিই প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনা—যেখানে চেতনা নিজেকে নিজেই প্রতিফলিত করে, এবং সেই প্রতিফলনই আনন্দরূপ হয়ে ওঠে।
উপনিষদীয় স্তরে একই তত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩.৪.২) যাজ্ঞবল্ক্য বলেন—“ন তত্র দ্বিতীয়মস্তি”—সেখানে কোনো দ্বিতীয় কিছু নেই। অর্থাৎ যে-অবস্থায় জানার বিষয়, জাননাকারী এবং জানার প্রক্রিয়া আলাদা থাকে না, সেটিই পরম চেতনা। কেনোপনিষদেও বলা হয়েছে—“যেন মনঃ প্রমথ্য তদেব ব্রহ্ম”—যে-চেতনা মনকে প্রেরণা দেয়, তাকেই ব্রহ্ম বলে; মন নয়, ইন্দ্রিয় নয়—বরং চেতনা নিজেই নিজের প্রত্যক্ষ।
শাক্ত দর্শনের ভাষায় এই চেতনার শুদ্ধ, প্রত্যক্ষ রূপই দেবী ত্রিপুরা, চামুণ্ডা বা চণ্ডিকা। ত্রিপুরারহস্যে বলা হয়েছে—“বোধমাত্রমিদং বিশ্বং, নান্যৎ কিঞ্চিদসত্ত্যতঃ”—এই বিশ্ব কেবল বোধমাত্র, চেতনারই প্রকাশ; এর বাইরে আর কিছুই সত্য নয়। তাই দেবী আসলে সেই চেতনার প্রতীক, যা নিজেকে আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে, মায়ার পর্দা ছিঁড়ে নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। দেবী মহাত্ম্যম্-এ তাঁকে বলা হয়েছে—“যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”—অর্থাৎ যে-দেবী সকল জীবের মধ্যে বুদ্ধি বা সচেতনতারূপে অবস্থান করছেন, তাঁকেই প্রণাম। এই “বুদ্ধিরূপা দেবী” আসলে সেই প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনারই রূপ, যা প্রতিটি জীবের অন্তরে চেতনা হিসেবে প্রকাশিত।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থাটি হলো এক নিঃশব্দ ও সম্পূর্ণ সচেতন উপস্থিতি—যেখানে চিন্তা, স্মৃতি, ইচ্ছা বা ভয়ের কোনো আন্দোলন থাকে না। মনের সমস্ত তরঙ্গ তখন স্তব্ধ হয়ে যায়, যেন এক স্থির হ্রদের উপর সূর্যালোক নিঃশব্দে পড়ছে। সেখানে কোনো “আমি” আলাদা সত্তা হিসেবে থাকে না; থাকে শুধু দেখা, শুধু জানা, আর শুধু থাকা—এই তিনটি অভিজ্ঞতা একাকার হয়ে যায়। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় “বিশুদ্ধ সচেতনতাস্থা” বা “অদ্বৈত চেতনা”—যেখানে ‘বিষয়’ ও ‘বিষয়-জ্ঞানী’ এই বিভাজন সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়, এবং চেতনা নিজের মধ্যেই নিজের প্রতিফলন উপলব্ধি করে।
এই প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনাই দেবী চণ্ডিকার আসল প্রতীক। তিনি সেই শক্তি, যিনি অজ্ঞান ও দ্বৈততার পর্দা ছিঁড়ে আত্মবোধ জাগিয়ে তোলেন। তাই চণ্ডিকা কখনো ভয়ংকর, কখনো করুণাময়ী—কারণ তিনি চেতনার সেই পরম শক্তি, যা মায়ার আবরণ ভেদ করে নিজের দীপ্তিতে নিজেকে জানে।
এইভাবে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনা মানে সেই চেতনার অবস্থা, যেখানে জানা, জানানো ও জানা-যাওয়া এক হয়ে যায়; যেখানে ব্রহ্ম, আত্মা ও বিশ্ব এক চিদানন্দরূপে একীভূত; এবং যেখানে ঈশ্বর স্বয়ং নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়ে আনন্দে নিজেকে চিনে নেন। এই তত্ত্বের ভিত্তি পাওয়া যায় ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিমর্শিনী (১.৫.৮), তন্ত্রলোক (১.৫৮), বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৪.২), কেন উপনিষদ (১.৫), ত্রিপুরারহস্য (পূর্বখণ্ড ১.৩২), এবং দেবী মহাত্ম্যম্ (৫.১৬)-এর স্তোত্রসমূহে। এইসব শাস্ত্র একত্রে ঘোষণা করে—চেতনার পরম সত্য হলো প্রত্যক্ষ শুদ্ধবেদনা, যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই তিনটি নয়, বরং এক চিরন্তন চিদানন্দই পরম বাস্তব।
এইজন্যই চণ্ডী পাঠ বা চণ্ডিকা উপাসনা কোনো করালদর্শন দেবীর বন্দনা নয়; এটি আসলে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া—যেখানে ভক্ত নিজের অন্তরের অসুর (অজ্ঞান, কাম, ক্রোধ, মোহ)-কে ধ্বংস করে আত্মপ্রকাশে পৌঁছায়। চণ্ডিকা মানে সেই শক্তি, যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের মধ্যেও স্থিত; যিনি ক্রোধেও করুণা, সংহারেও মুক্তি, এবং যিনি মানুষের অন্তরের অন্ধকারে জাগরণের দীপ্তি হয়ে উদিত হন।
এই ধারাবাহিক স্মৃতি-ঐতিহ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, জগদ্ধাত্রী-পূজা শাক্ত-তন্ত্রের এক গভীর প্রতিফলন হলেও এর সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে উঠেছিল স্মার্ত-ব্রাহ্মণিক ঐতিহ্যের মধ্যেই। এটি এমন এক আচার, যা তন্ত্রের শক্তি-তত্ত্ব এবং স্মার্ত শাস্ত্রের নীতি—উভয়কে একসূত্রে বেঁধে দেয়। তাই ১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত জগদ্ধাত্রী পূজা ক্রমে স্থানীয় দেবীপূজা থেকে পরিণত হয় এক সর্বজনীন শাস্ত্রসম্মত আচার-অনুষ্ঠানে, যা আজও বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্তর্গত জীবন্ত ঐতিহ্য।
“উত্তর-দুর্গা” শব্দবন্ধটির আক্ষরিক অর্থই হলো—দুর্গাপূজার পরবর্তী রূপ বা উত্তরণ-রূপে দেবী। অর্থাৎ, জগদ্ধাত্রী পূজাকে অনেক আচারশাস্ত্রকার ও তান্ত্রিক ব্যাখ্যায় “উত্তর-দুর্গা” বলা হয়েছে, কারণ এটি দুর্গাপূজার এক উচ্চতর, শান্ত ও সত্ত্বগুণ-প্রধান রূপান্তর।
শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে, দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী—এই তিন দেবীর মধ্যে এক গুণগত (গুণ-ত্রয়াত্মক) সম্পর্ক আছে। দুর্গা হলেন রজোগুণ-প্রধান শক্তি—কর্ম, সংগ্রাম ও উদ্যমের প্রতীক। কালী হলেন তমোগুণ-প্রধান—বিনাশ, রূপান্তর ও অন্তর্নিহিত গাঢ় শক্তির প্রতীক। আর জগদ্ধাত্রী হলেন সত্ত্বগুণ-প্রধান—স্থিতি, জ্ঞান ও শান্তির দেবী। তাই দুর্গার পর, যখন প্রকৃতিতে ও মানবমনে উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে এক প্রশান্ত ভারসাম্যের আবহ ফিরে আসে, তখন সেই সময়কার পূজা—জগদ্ধাত্রী-পূজা—দুর্গারই এক “উত্তর-রূপ”, অর্থাৎ “উত্তর-দুর্গা”।