স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্ট তাঁর দুর্গোৎসব-তত্ত্ব-এ এই সম্পর্কটিই ইঙ্গিত করেছেন—দুর্গাপূজা যেখানে ক্রিয়া ও কর্মের তীব্রতা, সেখানে কার্ত্তিক-শুক্ল-নবমীর পূজা (জগদ্ধাত্রী-আরাধনা) হলো সেই শক্তির স্থিত ও ধ্যানময় অবস্থা। অর্থাৎ, দুর্গা-শক্তি যদি হয় গতিশীলতা, তবে জগদ্ধাত্রী-শক্তি সেই গতির সুষমা, জ্ঞানের স্থিতিবিন্দু।
তন্ত্রের দৃষ্টিতে, উত্তর-দুর্গা মানে কেবল সময়গত “পরবর্তী” নয়, বরং চেতনার বিবর্তনে পরিণত দুর্গা—যেখানে রজঃ থেকে সত্ত্বে উত্তরণ ঘটে। তাই জগদ্ধাত্রীকে বলা হয় “দুর্গা-রূপিণী ধৃতি-মূর্তি”—তিনি সেই দুর্গা, যিনি যুদ্ধশেষে স্থিতি এনেছেন, ক্রিয়ার পর জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর শক্তিকে শান্তিতে রূপান্তরিত করেছেন।
“উত্তর-দুর্গা” বলতে বোঝানো হয়—দুর্গার অন্তর্মুখ রূপ, যেখানে শক্তি আর লড়াই নয়, বরং আত্মসংযম, স্থিরতা ও ব্রহ্মচেতনার অধিষ্ঠান।
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে দেখা যায়, জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ১৮শ শতকে কৃষ্ণনগর ও হুগলি অঞ্চলে জনসাধারণের পূজা হিসেবে প্রসার পেলেও, দেবী জগদ্ধাত্রীর উপাসনা অনেক পুরোনো এবং শাস্ত্রীয় উৎস ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উভয়ই এই পূজার প্রাচীনতাকে পালযুগ পর্যন্ত প্রসারিত করে।
প্রথমত, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টি-আকর্ষক নিদর্শনটি হলো অষ্টম শতাব্দীর এক সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি, যা বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং বর্তমানে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এই প্রতিমাটি জগদ্ধাত্রী ভাবনার এক প্রাচীন ও প্রতীকসমৃদ্ধ রূপ হিসেবে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে দেবীকে দেখা যায় সিংহের উপর আসীন—হাতে অস্ত্র, কিন্তু মুখমণ্ডলে যুদ্ধের উগ্রতা বা ক্রোধের পরিবর্তে এক গভীর শান্তি ও অন্তর্লীন জ্ঞানের দীপ্তি।
শিল্পতাত্ত্বিকভাবে, এটি কোনো বিজয়োল্লাসী দৃশ্য নয়, বরং এক অন্তর্মুখী শক্তির প্রকাশ, যেখানে দেবী “বিজেত্রী” নন, বরং “ধারকী”—যিনি বিশ্বকে ধারণ করছেন, রক্ষা করছেন ও ভারসাম্যে রাখছেন। মহিষাসুরমর্দিনীর প্রচলিত রূপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এখানে কোনো অসুরবধ বা সংঘর্ষ নেই; বরং এক শান্ত, স্থিত ও চৈতন্যময় শক্তির প্রতীকী রূপায়ণ ঘটেছে। এই শান্ত অথচ বলিষ্ঠ ভঙ্গিমাই জগদ্ধাত্রীর চিরন্তন ধারণাকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে—যেখানে শক্তি আর ধ্বংসের প্রতিশব্দ নয়, বরং “স্থিতি” বা “ধারণা”-র প্রতীক।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুরূপ সিংহবাহিনী দেবীমূর্তির উপস্থিতি ইঙ্গিত করে এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার, যা বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় পরম্পরার সংমিশ্রণে বিকশিত হয়েছিল। নালন্দা থেকে উদ্ধার-হওয়া একটি পোড়ামাটির সিলমোহরে দেখা যায় আট-হাতযুক্ত এক দেবী—সম্ভবত দুর্গার প্রাথমিক রূপ—যিনি সিংহের উপর আসীন এবং হাতে বিভিন্ন অস্ত্র ধারণ করেছেন। এই মূর্তির কাল আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধ। শিল্পরীতিতে এখানে যেমন বৌদ্ধ মৃৎশিল্পের প্রভাব রয়েছে, তেমনি স্পষ্টভাবে হিন্দু তন্ত্রসংলগ্ন দেবীচেতনার সুরও ধরা পড়ে। এটি ইঙ্গিত করে যে, তৎকালীন ভারতে “ধারণশক্তি”—অর্থাৎ এমন এক দেবী, যিনি বিশ্বকে ভারসাম্যে রাখেন ও সৃষ্টির মধ্যে স্থিতি ঘটান—এই ধারণা ইতিমধ্যেই প্রচলিত ছিল। এই ধারণাই পরবর্তী কালে, বাংলার শাক্ত ঐতিহ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, “জগদ্ধাত্রী” নামে এক স্বতন্ত্র প্রতীকে রূপান্তরিত হয়।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনা অঞ্চলে আবিষ্কৃত একটি দশম শতাব্দীর চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী মূর্তি এই ঐতিহাসিক বিবর্তনের চূড়ান্ত সাক্ষ্য বহন করে। এখানে দেবীর মুখমণ্ডলে বা ভঙ্গিতে আর কোনো যুদ্ধোন্মাদনা নেই; বরং ধ্যানমগ্ন শান্তি, স্নিগ্ধ স্থিতি ও অন্তর্মুখী দীপ্তির প্রকাশ। দেবীর সিংহ বাহন এখানে শুধুমাত্র শক্তির প্রতীক নয়—এটি “স্থিতিশক্তি”-র প্রতিরূপ, অর্থাৎ সেই দেবশক্তি, যিনি গতির মধ্যেও স্থিরতা, পরিবর্তনের মধ্যে অবিচলতা এবং সৃষ্টি-ধ্বংসের চক্রে চিরন্তন ভারসাম্য রক্ষা করেন।
এই তিনটি প্রত্ননিদর্শন—বরিশালের অষ্টম শতাব্দীর মূর্তি, নালন্দার সপ্তম শতাব্দীর সিলমোহর, এবং কালনার দশম শতাব্দীর প্রতিমা—একত্রে এক সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক রেখা অঙ্কন করে। এই রেখা দেখায়, “জগদ্ধাত্রী” কোনো পরবর্তী যুগের আঞ্চলিক উদ্ভাবন নয়; বরং প্রাচীন ভারতীয় দেবীচেতনার সেই মূল ধারণারই শিল্পসম্মত বিকাশ, যেখানে শক্তি ধ্বংস নয়, ধারণা; বিজয় নয়, স্থিতি; আর জগৎ কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং এক ভারসাম্যপূর্ণ চেতনার প্রতিফলন।
এই দৃষ্টিতে জগদ্ধাত্রী তত্ত্ব গভীরভাবে সংযুক্ত বেদান্তের “ধাত্রী” ধারণার সঙ্গে—যিনি বিশ্বকে ধারণ করেন—এবং তন্ত্রের “স্থিতিশক্তি”-র তত্ত্বের সঙ্গে—যিনি চেতনার ভারসাম্য রক্ষা করেন। তাই প্রত্নতত্ত্ব, শিল্প ও দর্শনের মিলিত প্রেক্ষিতে দেখা যায়, জগদ্ধাত্রী কেবল বাংলার আঞ্চলিক দেবী নন; তিনি সেই প্রাচীন চেতনার উত্তরসূরী, যিনি সৃষ্টিকে ধারণ করেন জ্ঞানের স্থিতি ও করুণার দীপ্তিতে।
পালযুগে ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে গভীর পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, তা শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়—দর্শন, ধর্মতত্ত্ব এবং শিল্পকলার স্তরেও এক যুগান্তকারী সংমিশ্রণের সূচনা ঘটায়। এই সময়ে বৌদ্ধ ও শাক্ত তত্ত্বের পরস্পর সংলগ্ন ধারাগুলি একে অপরকে রূপান্তরিত করতে শুরু করে, ফলে সৃষ্টি হয় এক নতুন নান্দনিক ও দার্শনিক প্রতিমা-বিন্যাস। জগদ্ধাত্রী সেই সংমিশ্রণেরই এক উৎকৃষ্ট ফল—এক এমন দেবী, যিনি কালী বা দুর্গার উগ্র ক্রিয়াশক্তিকে রূপান্তরিত করেছেন এক সাত্ত্বিক ধৃতিতে, এক স্থিত চেতনার রূপে। তাঁর মুখে নেই যুদ্ধের উন্মাদনা, নেই রক্তলোলুপতা; বরং রয়েছে জ্ঞানের দীপ্তি, করুণার ভারসাম্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের গভীর স্থিরতা। এই রূপে আমরা দেখি বাংলার শৈল্পিক ঐতিহ্য ও দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির এক অনন্য সংযোগ, যেখানে “শক্তি” আর ধ্বংসের প্রতিশব্দ নয়—বরং ধারণ, নিয়ন্ত্রণ, ও আলোকের প্রতীক।
পালযুগে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনা এক নতুন মাত্রা লাভ করে। এই সময়ের রাজারা যদিও প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তবু তাঁদের রাজ্যে শাক্ত, বৈষ্ণব ও জৈন—এই তিন ধারাই সমান গুরুত্ব পায়। ধর্ম তখন কোনো একক প্রতিষ্ঠানের সীমায় আবদ্ধ ছিল না; বরং এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পরিসরে নানা তত্ত্ব, আচার ও সাধনার রূপ একে অপরকে প্রভাবিত ও পরিপূরক করে তুলেছিল। এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন নান্দনিক ও দার্শনিক বোধ—যেখানে দেবত্ব আর কেবল কোনো একধরনের বিশ্বাসের প্রতীক নয়, বরং চেতনার মহাশক্তির বহুমুখী প্রকাশ।
বৌদ্ধ তন্ত্র, যা পালযুগে বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল, সেই চেতনার রূপান্তরকে মন্ত্র, যন্ত্র, মণ্ডল এবং দেবী উপাসনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে চেয়েছিল। এই তন্ত্রধারায় “ধারিণী” ও “প্রজ্ঞাপারমিতা” নামের দেবীর ধারণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। “ধারিণী” শব্দটির অর্থ হলো ‘যিনি ধারণ করেন’; বৌদ্ধ প্রেক্ষিতে তিনি সেই শক্তি, যিনি সমস্ত বুদ্ধচেতনা ধারণ করেন ও স্মৃতিরূপে রক্ষা করেন। তিনি কেবল মন্ত্র বা বাণী নন, বরং সেই সর্বজনীন মাতৃশক্তি, যিনি সমগ্র বিশ্বচেতনাকে ধারণ করে রেখেছেন—অর্থাৎ সমস্ত জ্ঞানের ও করুণার আদিশক্তি।
এ ধারারই আরেক উৎকর্ষ হলো “প্রজ্ঞাপারমিতা”—যার অর্থ “জ্ঞান-পারমিতা” বা “সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা”। মহাযান বৌদ্ধ দর্শনে তাঁকে বলা হয়েছে “সর্ববুদ্ধ-জননী”, অর্থাৎ সব বুদ্ধত্বের উৎস। তাঁর রূপে দেখা যায় এক অনাসক্ত মমতা—যা জ্ঞান ও করুণার নিখুঁত ঐক্য। শিল্পকলায় তাঁকে প্রায়ই শান্ত ও দীপ্ত মুখমণ্ডলবিশিষ্ট মাতৃরূপে দেখানো হয়, হাতে ধর্মগ্রন্থ ও পদ্ম, যা জ্ঞানের বিশুদ্ধতার প্রতীক।
এই বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধারণাগুলি ধীরে ধীরে শাক্ত দর্শনের সঙ্গে সংলগ্ন হতে থাকে। শাক্ত তত্ত্বে “শক্তি” কেবল সৃষ্টির প্রেরণা নয়; তিনি একই সঙ্গে ধারণা, রক্ষা ও লয়ের ভিত্তি। এই দর্শনে দেবীকে বলা হয় “জগৎ-ধারিণী”—অর্থাৎ যিনি জগৎকে ধারণ করেন, ভারসাম্য রক্ষা করেন এবং চেতনার স্থিতি বজায় রাখেন। এখানে সৃষ্টি আর কোনো বাহ্য শক্তির খেলা নয়; দেবী নিজেই সেই পরম চেতনা, যিনি বিশ্বরূপে প্রকাশিত হয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে স্থিত রাখেন।
এই বৌদ্ধ “ধারিণী” ও “প্রজ্ঞাপারমিতা”র ধারণা যখন শাক্ত “জগৎ-ধারিণী” ভাবের সঙ্গে মিশে যায়, তখনই ধীরে ধীরে গঠিত হয় “জগদ্ধাত্রী”-র ভাবচিত্র। তিনি কোনো একক ধর্মের দেবী নন; তিনি সেই অন্তঃস্থিত শক্তির প্রতীক, যা জগৎকে ধারণ করে, রক্ষা করে এবং করুণায় স্থিত রাখে। তাঁর রূপে আমরা দেখতে পাই করুণার বৌদ্ধ ধারা, ধৃতির জৈন ধারার সংযম, আর শক্তিতত্ত্বের শাক্ত দর্শনের দীপ্ত ঐক্য।
এইভাবেই জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন এক সর্বজনীন মাতৃশক্তির প্রতীক—যিনি কালী বা দুর্গার উগ্র ক্রিয়াশক্তিকে রূপান্তরিত করেছেন সাত্ত্বিক ধৃতিতে, জ্ঞানের স্থিতিতে এবং করুণার ভারসাম্যে। তিনি আর কেবল শাক্ত ঐতিহ্যের দেবী নন; তিনি সেই চেতনার রূপ, যা সমস্ত বিভাজনের ঊর্ধ্বে, এবং যা নিজের আলোক দিয়ে জগৎকে ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্গঠন করে চলেছে চিরকাল।
এই প্রেক্ষাপটে উল্লিখিত তিনটি নাম—বৌদ্ধ ধারিণী, জৈন ধৃতি দেবী, এবং বৈদিক ধৃতিরূপা দেবী—আসলে তিনটি ভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক ধারার মধ্যে “স্থিতি” বা “ধারণা”-র নীতিকে তিন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করে, যা পরে একত্রে জগদ্ধাত্রী তত্ত্বে মিলিত হয়েছে।
বৌদ্ধ তান্ত্রিক ঐতিহ্যে “ধারিণী” শব্দটি (সংস্কৃত ধাতু ধৃ থেকে, অর্থাৎ ধারণ করা বা ধরে রাখা) মানে এমন এক শক্তি বা মন্ত্র, যা স্মৃতি ও জ্ঞানের ধারক। এখানে ‘ধারিণী’ কেবল কোনো শব্দবন্ধ নয়; তিনি এক সচেতন দেবী, এক মাতৃচেতনা—যিনি সমগ্র বুদ্ধচেতনার ভিত্তি। বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মে এই ধারিণী দেবীর পরিচয় করুণার (karuṇā) সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, কারণ করুণা বা সর্বজীবের প্রতি অন্তর্নিহিত সহানুভূতি বুদ্ধত্বের অপরিহার্য গুণ। সেই করুণাশক্তিই জগৎকে ধারণ করে, তাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করে। তাই বৌদ্ধ ধারিণী মূলত “মহাকরুণার শক্তি”—যিনি বিশ্বকে নিজের অন্তরে ধারণ করে সকল জীবকে মুক্তির সম্ভাবনা প্রদান করেন।
অন্যদিকে, জৈন দর্শনে “ধৃতি দেবী” হলো সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। জৈন তত্ত্বে জীবের মুক্তির পথ হলো ইচ্ছা, রাগ, দোষ ও হিংসার সংযম। “ধৃতি” অর্থ “ধারণা” বা “অন্তরস্থিত স্থিরতা”—যে-শক্তি মানুষকে ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণ থেকে ফিরিয়ে এনে স্থির ও সমবেত রাখে। জৈন চিত্রকল্পে ধৃতি দেবীকে প্রায়ই শান্ত, স্নিগ্ধ ও স্থিত মুখে চিত্রিত করা হয়—যিনি মনোবিকার নিয়ন্ত্রণের দেবী। এই সংযম বা ধৈর্যের শক্তি এক প্রকারের অন্তর্গত স্থিতিশক্তি, যা মানবচেতনার ভারসাম্য রক্ষা করে।
তৃতীয়ত, বৈদিক ধৃতি বা ধৃতিরূপা দেবী, যিনি “ধারণা”-র আদিরূপ। ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদে “ধৃতি” মানে সেই মূল শক্তি, যা বিশ্বকে টিকিয়ে রাখে—যা গতি ও স্থিতির মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে। এই ধৃতি শক্তিই পরবর্তীকালে শাক্ত দর্শনে “স্থিতিশক্তি” নামে পরিগৃহীত হয়, অর্থাৎ এমন এক শক্তি, যিনি জগতের পরিবর্তনশীলতার মধ্যে চিরন্তন স্থিতির প্রতীক। তিনি সৃষ্টির ভিতরেই স্থিতি, আর স্থিতির মধ্যেই সৃজনের সম্ভাবনা ধারণ করেন।
এই তিন ধারার ভাবগত স্রোত মিলিত হয় জগদ্ধাত্রী রূপে। জগদ্ধাত্রী মানে “যিনি জগৎকে ধারণ করেন”—এই ধারণা বৌদ্ধ ধারিণীর করুণা, জৈন ধৃতির সংযম, এবং বৈদিক ধৃতির স্থিতিশক্তি—এই তিনের সম্মিলনে গঠিত। তাঁর রূপে করুণা ও জ্ঞান যেমন সমবেত, তেমনি শক্তি ও প্রশান্তিও একাকার। তিনি তেজস্বিনী অথচ শান্ত; ক্রিয়াশীল অথচ স্থিত; শক্তির প্রকাশ অথচ জ্ঞানের প্রতীক।
এই ঐক্যই তাঁকে বাংলার শাক্ত ঐতিহ্যে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে। তিনি কেবল যুদ্ধদেবী নন; তিনি সেই দেবী, যিনি চেতনার স্তরে করুণার মতো কোমলতা ও স্থিতিশক্তির মতো গভীর ভারসাম্য ধারণ করেন। তাই জগদ্ধাত্রীর রূপে আমরা দেখতে পাই বৌদ্ধ করুণা, জৈন সংযম ও বৈদিক স্থিতির এক সুনিপুণ মিলন—যেখানে শক্তি আর কেবল জয় নয়, বরং ধারণা; সৃষ্টি আর কেবল প্রপঞ্চ নয়, বরং এক স্থিত-চেতনার দীপ্তি।