গীতায় অবতারতত্ত্ব: ১৪



২. Embedded (এমবেডেড / পরিবেশ-নিবদ্ধ): আমরা কোনো শূন্যস্থানে বাস করি না। প্রতিটি মানুষ পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরে প্রোথিত। তাই চেতনা সবসময়ই প্রেক্ষিতনির্ভর—বাহ্য জগত ও সমাজ-সংগঠনের প্রভাব ছাড়া তা বোঝা যায় না।

৩. Enactive (এনঅ্যাক্টিভ / ক্রিয়ামূলক): জানা মানে করা—চেতনা ক্রিয়াশীল। জ্ঞান কোনো নিস্তরঙ্গ বা স্থির অবস্থা নয়; তা গঠিত হয় ক্রিয়া ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আমরা কর্মে লিপ্ত থাকি বলেই জ্ঞান বিকশিত হয়।

৪. Extended (এক্সটেন্ডেড / প্রসারিত): চেতনা দেহের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়; ভাষা, প্রতীক, প্রযুক্তি, বই, যন্ত্র—এসবের মাধ্যমেও জ্ঞান নিজেকে প্রসারিত করে। যেমন একটি লিখিত মন্ত্র বা একটি গণনা যন্ত্র—চেতনার সম্প্রসারিত অঙ্গ।

এই চারটি স্তর একত্রে প্রমাণ করে যে, জ্ঞান কোনো আলাদা “মনের ভেতরের” প্রক্রিয়া নয়, বরং দেহ, পরিবেশ ও ক্রিয়ার এক জীবন্ত আন্তঃসম্পর্ক।

তন্ত্রদর্শনে এই সমগ্রতাকেই বলা হয় শক্তি—যিনি চেতনার গতিশীল প্রকাশ। শক্তি বা কালী কেবল ব্রহ্মের বাহ্য রূপ নন; তিনিই ব্রহ্মের নৃত্য, ব্রহ্মের স্পন্দ। তিনি বিলীন নন, বরং ব্রহ্মরূপেই নিত্য উদ্‌ভাসিত। এই শক্তিই হল চেতনার সেই অন্তহীন ক্রিয়া, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় একত্রে মিলিত।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই গীতা, উপনিষদ ও শ্রীমদ্‌ভাগবত এক সুরে বলে—“যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি” (গীতা ৬.৩০)—অর্থাৎ, যিনি সর্বত্র আমাকে দেখেন এবং সর্বত্র আমারই প্রতিফলন অনুভব করেন, তিনিই সত্যদ্রষ্টা। এই উপলব্ধি-ই অদ্বৈত চেতনার সারস্বরূপ, যা বিজ্ঞান, দর্শন, তন্ত্র, সুফিবাদ ও মরমীবাদের সকল ধারাকে একত্রে বাঁধে—এক ঐক্য-অন্তর্দৃষ্টি, যেখানে জানার, মানার ও থাকার মধ্যে আর কোনো ভেদ থাকে না।

শেষপর্যন্ত, সমস্ত দর্শন, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত উপাসনা এই এক সত্যেই এসে মিশে যায়—চেতনার সর্বব্যাপী অভিন্নতায়। জানার, মানার, উপাসনার, এমনকি বেঁচে থাকার সব ভেদ যখন বিলুপ্ত হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই সেই পরম চিত্‌—যিনি জগৎ, যিনি জ্ঞান, যিনি আমি।

ভগবান নিজেই সাকার হয়ে, মানুষের মতো রূপ ধারণ করে, মানুষের বোধগম্য ভাষায় ও রূপে প্রকাশিত হন—যেন মানুষ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে, ভালোবাসতে পারে, ও তাঁর মধ্য দিয়ে অব্যক্ত পরম ব্রহ্মে প্রবেশ করতে পারে। এই কারণেই অবতাররূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করা হয়েছে ভক্তিযোগের সেতুবন্ধন হিসেবে—অব্যক্তের কঠিন উপলব্ধির পথে সাকার ভক্তিই প্রথম ধাপ।

শেষপর্যন্ত, জ্ঞান ও ভক্তি একে অপরের পরিপূরক। ভক্তি যদি রূপের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখে, জ্ঞান সেই রূপের মধ্য দিয়েই রূপাতীতকে চেনে। তাই শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন, “আমি ধনঞ্জয়, আমি হিমালয়, আমি মকর, আমি সাগর”—তখন তিনি শুধু নিজের ঐশ্বর্য জানান না; তিনি আমাদের শেখাচ্ছেন, এই সারা জগৎ তাঁরই বিস্তার, আর ভক্ত ও অবতার—উভয়েই সেই এক চেতনার ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গমাত্র।

গীতার এই অংশটি—বিশেষ করে একাদশ অধ্যায়ের (বিশ্বরূপ দর্শন যোগ) এবং চতুর্থ অধ্যায়ের (জ্ঞানকর্মসংন্যাস যোগ)—দৈব পরিকল্পনার ধারণাকে এমন এক দার্শনিক উচ্চতায় স্থাপন করে, যেখানে “অবতার” আর কোনো “অলৌকিক হস্তক্ষেপ” নয়, বরং বিশ্বের নিজস্ব ধর্মগত নিয়মের অন্তর্নিহিত প্রতিক্রিয়া।

শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্রে অর্জুনকে বলেন—“দ্রোণং চ ভীষ্মং চ জয়দ্রথং চ কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান্‌। ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠা যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান্‌।। (গীতা ১১.৩৪)” এর অর্থ এই—“দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ, কর্ণ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধারা আমার দ্বারাই পূর্বেই নিহত হয়েছে; অতএব তুমি কেবল তাদের বধের নিমিত্ত হও। ভয় কোরো না, যুদ্ধ করো; রণে তুমি তোমার শত্রুদের উপর জয়লাভ করবে।”

এই শ্লোকের তাৎপর্য বোঝার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বেদান্তদর্শনের আলোকে এক এক করে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি দর্শনই এই শ্লোকের ভেতরে ব্রহ্ম, জীব, কর্ম ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করেছে, অথচ শেষপর্যন্ত সব ব্যাখ্যাই এক পরম সত্যে মিলিত হয়েছে।

অদ্বৈত বেদান্তে, শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কৃষ্ণ এখানে ব্যক্তিগত ঈশ্বররূপে নয়, বরং সেই সর্বব্যাপী পরমচেতনার রূপে কথা বলছেন—যিনি কর্মের পরিণতি ও জগতের গতিধারার অন্তর্নিহিত কারণ। “ময়া হতান্‌” মানে এখানে “আমার দ্বারা”—অর্থাৎ ব্রহ্মরূপ চেতনার দ্বারা—এই সমস্ত ক্রিয়া ইতিমধ্যেই সংঘটিত। জীবের “আমি করছি” এই ধারণা অবিদ্যার ফল; কারণ প্রকৃত কর্তা একমাত্র ব্রহ্ম, যিনি প্রত্যেকের মধ্যে ক্ষেত্রজ্ঞরূপে অবস্থান করছেন। তাই কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন—তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র; কর্ম করো, কিন্তু কর্তার অহং ধারণ কোরো না। যুদ্ধ, মৃত্যু, বিজয়—সবই ব্রহ্মরূপ সত্যচেতনার লীলার অঙ্গ। অদ্বৈত দৃষ্টিতে এই শ্লোক আত্মানাত্ম-বিভেদের বিলুপ্তির শিক্ষা দেয়—যেখানে কর্তা, কর্ম, ও ক্রিয়া—তিনটিই এক চেতনার তরঙ্গমাত্র।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে, রামানুজাচার্য এই শ্লোককে “অন্তর্যামী ঈশ্বরতত্ত্ব”-এর নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন। কৃষ্ণ এখানে সেই ঈশ্বর, যিনি প্রতিটি জীবের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে তাঁদের কর্মফল পরিচালনা করেন। “ময়া হতান্‌” অর্থাৎ আমার ইচ্ছা ও ধর্মনিয়ম অনুযায়ী তাঁদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যন্ত্রগত নয়—জীবের কর্মও এখানে কারণ, কারণ ঈশ্বর সেই কর্মকেই নিজের ইচ্ছার উপকরণ করেন। তাই অর্জুনকে কৃষ্ণ বলছেন—তুমি যুদ্ধ করো, কারণ সেই কর্মও ঈশ্বরসেবারই রূপ। এখানে কর্মকে ভক্তির সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে; কর্ম তখন আর সংসারবন্ধন নয়, হয়ে ওঠে ঈশ্বরসাধনা।

দ্বৈত বেদান্তে, মাধ্বাচার্যের মতে, কৃষ্ণ ও অর্জুন, ঈশ্বর ও জীব—চিরকাল পৃথক। কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান পরমাত্মা, আর জীব তাঁর ইচ্ছার অধীন এক সেবক। “ময়া হতান্‌” মানে, এই সমস্ত যোদ্ধারা ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিহত; তাঁদের মৃত্যু অবধারিত। অর্জুন এখানে কেবল এক যন্ত্র—“নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্‌।” ঈশ্বরই প্রকৃত কর্তা, আর জীবের কর্তব্য তাঁর আদেশ অনুসরণ করা। এই দৃষ্টিতে, গীতার এই শ্লোক ভক্তিযোগের মূর্ত প্রতীক—সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই এখানে জ্ঞানের পরিণতি।

ভেদাভেদ বেদান্তে, নিম্বার্কাচার্য বলেন, ঈশ্বর ও জীব একইসঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্ন। জীব ঈশ্বরের শক্তির অংশ, তাই তাঁর কর্মও ঈশ্বরেরই শক্তি-প্রকাশ। “ময়া হতান্‌”—এর অর্থ, ঈশ্বর নিজের শক্তির দ্বারা এই ঘটনাসমূহ ঘটিয়েছেন, কিন্তু সেই শক্তির প্রকাশ ঘটে জীবের মাধ্যমেই। তাই অর্জুনের কর্ম ঈশ্বরনির্ভর হলেও, তাঁর অংশগ্রহণ অপরিহার্য; ঈশ্বরের লীলা ততক্ষণ সম্পূর্ণ নয় যতক্ষণ জীব তাতে অংশ নিচ্ছে না। এখানে “কর্ম” এবং “ঈশ্বরসেবন” অভিন্ন হয়ে ওঠে।

শুদ্ধাদ্বৈত বেদান্তে, বল্লভাচার্য এই শ্লোককে প্রেমভক্তির দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেন। ঈশ্বরই একমাত্র কর্তা, আর জগৎ তাঁর আনন্দলীলা। যুদ্ধ, মৃত্যু, সৃষ্টি, বিনাশ—সবই তাঁর রসস্বরূপ প্রকাশ। “ময়া হতান্‌”—অর্থাৎ ঈশ্বর তাঁরই লীলাশক্তির দ্বারা এই সমস্ত পরিণতি ঘটিয়েছেন। অর্জুনের কর্তব্য কেবল সেই লীলায় অংশ নেওয়া, বিনা ভয়ে ও বিনা অহংকারে (বিনা আমিত্ব-ভাবে)। ঈশ্বরের হাতে নিজেকে সমর্পণ করাই এখানে মুক্তি।

এভাবে দেখা যায়, অদ্বৈত বলে—ব্রহ্মই একমাত্র কর্তা; বিশিষ্টাদ্বৈত বলে—ঈশ্বর অন্তর্যামী কর্তা; দ্বৈত বলে—ঈশ্বর সর্বশক্তিমান প্রভু; ভেদাভেদ বলে—ঈশ্বরের শক্তিই জীবের কর্মরূপ; শুদ্ধাদ্বৈত বলে—ঈশ্বরের লীলায় জীব আনন্দের অংশগ্রাহী। অর্থ আলাদা হলেও সুর এক—সব কর্ম, সব ক্রিয়া, সব ফল শেষপর্যন্ত এক পরম চেতনার দ্বারা পরিচালিত। কৃষ্ণের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গীতা শেখায় যে, কর্ম থেকে পালানো নয়, বরং কর্মের মধ্য দিয়েই আত্মোপলব্ধি সম্ভব—যেখানে কর্তা ও কর্মফল উভয়ই ব্রহ্মতত্ত্বে লীন হয়, এবং মানুষ উপলব্ধি করে—“আমি কর্তা নই, আমি সেই সাক্ষী, যে অনন্ত চেতনা, যার দ্বারা সব কিছু ঘটে।”

শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন—“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌।।”—(ভগবদ্‌গীতা ৪.৭)—অর্থাৎ, “হে ভারত, যখনই ধর্মের অবনতি ও অধর্মের উত্থান ঘটে, তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ করি,”—তখন তিনি কোনো মানবসদৃশ দেবতার আবির্ভাবের কথা বলছেন না, বরং ব্রহ্মচেতনার স্বয়ংক্রিয় আত্মপ্রকাশের নীতি ব্যাখ্যা করছেন। এখানে “আমি” মানে সেই সর্বব্যাপী চেতনা—যিনি কাল, ধর্ম, প্রকৃতি ও সৃষ্টির অন্তর্নিহিত গতিশক্তি। এই “আত্মানং সৃজামি”—অর্থাৎ “নিজেকেই সৃষ্টি করি”—বাক্যটি অদ্বৈত তত্ত্বে এক গভীর প্রতীকি অর্থ ধারণ করে; কারণ চেতনা কখনও সত্য অর্থে সৃষ্টি হয় না, বরং নিজের আচ্ছাদিত রূপ থেকে উদ্‌ভাসিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেন, ঈশ্বর বা ব্রহ্ম কোনো পৃথক সত্তা নন; তিনি সেই একক পরমচেতনা, যিনি অবিদ্যার কারণে বহুরূপে প্রতীয়মান হন। “সৃজামি” মানে এখানে “উন্মোচিত হই”—ব্রহ্ম নিজের মধ্যেই নানা রূপ, নীতি ও কালের ধারা সৃষ্টি করে। যেমন সূর্য উদয়-অস্তে নিজে নড়ে না, কিন্তু তার আলো নানা রূপে প্রকাশিত হয়—তেমনি চেতনা অপরিবর্তিত থেকেও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়, যাতে ধর্মের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হয়। তাই “অবতার” আসলে ব্রহ্মের অবতরণ নয়, বরং ব্রহ্মচেতনার আত্মপ্রকাশ—যেমন জ্ঞান যখন অজ্ঞানকে বিদীর্ণ করে, তখনই ঈশ্বররূপ সত্য প্রকাশিত হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনে রামানুজাচার্য বলেন, ঈশ্বর সর্বব্যাপী অন্তর্যামী; তিনি কেবল বাইরের শক্তি নন, বরং প্রতিটি জীব ও ঘটনার অন্তরে অবস্থান করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করেন। “যদা যদা হি ধর্মস্য”—মানে, যখন সমাজ, মন, ও জগতে ধর্মের নীতি তথা আইন—অর্থাৎ সত্য, ন্যায়, করুণা, শৃঙ্খলা—দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ঈশ্বর নিজের অন্তর্গত শক্তিকে জাগিয়ে তোলেন, এবং সেই জাগরণই অবতাররূপে প্রকাশিত হয়। এখানে “অবতার” মানে ঈশ্বরের দেহধারণ নয়; বরং তাঁর সত্তার নির্দিষ্ট ঐশ্বর্যরূপ কার্যপ্রকাশ—যেখানে চেতনা, নীতি, ও ধর্ম একত্রে সক্রিয় হয়।

দ্বৈত বেদান্তে মাধ্বাচার্যের মতে, ঈশ্বর ও জীব চিরকাল পৃথক; তাই “আমি নিজেকে সৃষ্টি করি” মানে, ঈশ্বর নিজের ইচ্ছায় জগতে অবতীর্ণ হন, যাতে অধর্মকে দমন করে ধর্মকে পুনরুদ্ধার করা যায়। এই অবতাররূপ ঈশ্বর সর্বশক্তিমান—তাঁর ইচ্ছাতেই জগৎ পরিচালিত। কিন্তু ঈশ্বরের এই অবতরণ কখনও মানবসীমাবদ্ধ নয়; এটি কেবল দেহধারণ নয়, বরং তাঁর অনুগ্রহরূপ প্রকাশ, যা জীবকে পুনরায় সত্যপথে ফিরিয়ে আনে।

ভেদাভেদ দর্শনে নিম্বার্কাচার্য বলেন, ঈশ্বর ও জীব অভিন্নও নন, ভিন্নও নন; তাই ঈশ্বরের এই আত্মপ্রকাশ আসলে তাঁর শক্তির জাগরণ। “সৃজাম্যহম্‌” মানে, ঈশ্বর নিজের শক্তিকে জীব ও প্রকৃতির মধ্যে সক্রিয় করেন। এই শক্তিই মহাকাল, যা যুগে যুগে ধর্মের ভারসাম্য রক্ষা করে।

শুদ্ধাদ্বৈত বেদান্তে বল্লভাচার্য এই শ্লোককে প্রেম ও আনন্দের লীলাতত্ত্বে ব্যাখ্যা করেন। ঈশ্বরের অবতার কেবল নৈতিক প্রতিকার নয়; এটি চেতনার আনন্দপ্রকাশ—যখন বিশ্বচেতনা ধর্মরূপ সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার মধ্যে পুনরায় নিজেকে অনুভব করে। এখানে ঈশ্বরের “আত্মানং সৃজামি” মানে—প্রেম, জ্ঞান, ও করুণার চেতনা যখন ঘুমন্ত হয়ে পড়ে, তখন ঈশ্বর নিজেই নিজের আনন্দরূপে জেগে ওঠেন।

শ্রীকৃষ্ণের “যদা যদা হি ধর্মস্য” শ্লোকটি আসলে সৃষ্টির এক আত্মনিয়ন্ত্রিত নীতির ঘোষণা—যেখানে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ধর্ম ও চেতনা পরস্পর-নির্ভর এক ঐক্যরূপ প্রক্রিয়ায় যুক্ত। ধর্মের গ্লানি মানে চেতনার অবরোধ, আর অবতার মানে সেই চেতনার নবোদ্‌ভব। তাই কৃষ্ণ এখানে দেবকীপুত্র নন; তিনি সেই মহাকাল, সেই অন্তর্যামী নীতি, যিনি সময়ে সময়ে নিজেরই অন্তর্নিহিত আলোয় অন্ধকার ভেদ করে জগৎকে পুনরায় সমতা, সঙ্গতি ও সত্তার পথে ফেরান।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে “অবতার” মানে কোনো বিশেষ দেহধারী সত্তার অবতরণ নয়, বরং প্রকৃতির স্বয়ং-সংশোধন—যেমন গ্রীষ্মের তাপে প্রকৃতির অন্তর্গত শক্তি থেকেই বর্ষার জন্ম হয়। বর্ষার জন্য আলাদা কোনো হুকুম বা নির্দেশ লাগে না; তাপ ও বাষ্পচাপের ভারসাম্য থেকেই মেঘ গঠিত হয়। তেমনি যখন অধর্ম বৃদ্ধি পায়, তখন ধর্মরক্ষার শক্তি প্রকৃতির মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়।