এখানেই জগদ্ধাত্রীর সূক্ষ্ম তাৎপর্য প্রকাশ পায়—এই শক্তি যদি নিছক প্রাবল্য, উন্মত্ততা বা প্রাকৃত গতি হয়ে থাকে, তবে তা কেবল কালী; কিন্তু যদি সেই শক্তি আত্মসচেতন, ধ্যানমগ্ন, ও জ্ঞানে স্থিত হয়—তবে সে জগদ্ধাত্রী। এই স্থিত, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিই “শিবময় শক্তি”—অর্থাৎ শক্তি, যা নিজেকে নিজের উৎসে ফিরিয়ে এনে চেতনার সঙ্গে একাত্ম করে। কুলার্ণব তন্ত্র (১.১১)-এ বলা হয়েছে—“শক্তিশ্চেতনা শক্তিঃ, শিবঃ চেতনবর্জিতঃ। শক্তিচেতনা যত্র, তত্র শিবঃ স্বয়ং স্থিতঃ।” অর্থাৎ শক্তিই চেতনা; শিব চেতনাহীন হলে নিস্তেজ, কিন্তু যেখানে শক্তি চেতনায় রূপান্তরিত হয়, সেখানেই শিব স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত হন।
এই চেতনায় পরিণত শক্তিই জগদ্ধাত্রী। তিনি শক্তির তৃতীয় স্তর—স্থিতির মূর্তি। কালী হলেন প্রাবল্য, দুর্গা হলেন ক্রিয়া, আর জগদ্ধাত্রী সেই ক্রিয়ার স্থিতিশীল কেন্দ্র—জ্ঞান, ধৃতি ও আত্মসংযমের রূপ। তাঁর শুভ্রতা এখানে প্রতীক আত্মবোধের, তাঁর স্থির দৃষ্টি প্রতীক ধ্যানের, আর তাঁর চারভুজ ও সিংহবাহিনী রূপ প্রকাশ করে শক্তির ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রিত দীপ্তি।
আভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ এই স্তরটিকে বলেছেন “শক্তির স্বাধিষ্ঠান”—অর্থাৎ সেই অবস্থান, যেখানে শক্তি নিজেরই মহাজ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে কর্ম আর বহির্মুখ নয়, অন্তর্মুখ; গতি আর বিশৃঙ্খলা নয়, সুষম। এই অবস্থায় শক্তি আর শিব আলাদা নয়; তারা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য—যা ব্রহ্মসংহিতা (৫.৪৪)-এ বলা হয়েছে, “শক্তি শক্তিমতঃ অভেদঃ।”
“শক্তি বিনা শিব শবঃ”—এই সূত্রটি কেবল তান্ত্রিক নীতি নয়; এটি জগদ্ধাত্রীর দর্শনের ভিত্তি। আর “শিবময় শক্তি” মানে সেই পরিপূর্ণ সুষমা—যেখানে শক্তি জ্ঞান হয়ে ওঠে, আর জ্ঞান শক্তিতে রূপ নেয়। এই অবস্থাতেই শক্তি সত্যিকার “শিবময়” হয়—অর্থাৎ তিনি শান্ত, জ্ঞানের দীপ্তিতে আলোকিত, এবং চেতনার অভ্যন্তরস্থ স্থিতির মূর্তি।
জগদ্ধাত্রী তাই কেবল দেবী নন; তিনি সেই অন্তঃস্থ বোধ, যা প্রাবল্যের তেজকে ধৈর্যে পরিণত করে, অন্ধকারের শক্তিকে আলোকিত চেতনায় রূপান্তরিত করে। তাঁর তত্ত্বে শক্তি ও শিব, কর্ম ও ধ্যান, গতি ও স্থিতি—সব মিলিত হয় এক চিরন্তন সাম্যে। এখানেই শাক্ত তত্ত্ব তার পরিপূর্ণতা লাভ করে—যেখানে শক্তি আর অন্ধ নয়, জ্ঞানময়; আর চেতনা কেবল স্থির নয়, স্পন্দনময়।
জগদ্ধাত্রীর শ্বেত, প্রশান্ত, এবং যোগিক রূপ শৈল্পিক ও দার্শনিক উভয় স্তরেই এক মহত্তর বিবৃতি—তিনি দেখান, মহাশক্তির পরিণতি ক্রোধে নয়, বরং প্রজ্ঞায়; জগৎ ধারণের উপায় দমন নয়, বরং ধ্যানময় স্থিতি; এবং পরম শক্তি—শেষপর্যন্ত, জ্ঞানেরই অপর নাম।
জগদ্ধাত্রী দেবী সেই বিরল দেবরূপ, যিনি ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, মনোবিজ্ঞান ও সমাজচেতনার এক অনন্য সমন্বয় গঠন করেন। তিনি কেবল শক্তির দেবী নন, বরং চেতনার স্থিতিশীলতা ও জ্ঞানের শৃঙ্খলার প্রতিমূর্তি। কেনোপনিষদের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্ন—“কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ?”—যা মন ও প্রাণের অন্তর্গত চালিকাশক্তিকে খুঁজে পেতে চেয়েছিল, তারই জীবন্ত প্রতিকৃতি জগদ্ধাত্রী। তিনি অহংকার ও বিভ্রমের পর্দা সরিয়ে সেই পরম ব্রহ্মচেতনার প্রকাশ ঘটান, যিনি সব ক্রিয়া ও শক্তির মূল উৎস।
জগদ্ধাত্রীর তত্ত্ব অদ্বৈত বেদান্ত ও শাক্ত তন্ত্রের এক অনন্য সংহতি। অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম এক নিরাকার, অব্যয় চেতনা—যিনি নিস্পৃহ, নীরব, সর্বব্যাপী। কিন্তু তান্ত্রিক দর্শন এই চেতনার সক্রিয় রূপকে “শক্তি” নামে উপলব্ধি করে—যিনি প্রকাশ, স্থিতি ও প্রত্যাহারের মাধ্যমে বিশ্বকে ধারণ করেন। জগদ্ধাত্রী এই দুই দৃষ্টির মেলবন্ধন: তিনি সেই সত্ত্বগুণী চেতনা, যিনি বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, গতি ও স্থিতিকে একসাথে ধারণ করেন। তাঁর “ধাত্রী” রূপ দেখায়—বিশ্বের ধারকতা বলপ্রয়োগে নয়, বরং সচেতন স্থিরতার দ্বারা রক্ষিত। এই নীরব শক্তিই প্রকৃত বিশ্বাধার।
জগদ্ধাত্রীর আখ্যান কেবল আধ্যাত্মিক বা পৌরাণিক নয়; এটি মানবমনের গভীর স্তরে আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসচেতনতা ও মানসিক শৃঙ্খলার এক জীবন্ত প্রতীক। করীন্দ্রাসুর, যিনি হাতির রূপে প্রকাশিত অহংকারের প্রতীক, তাঁর বধ মানে বাহ্যিক যুদ্ধ নয়, বরং অন্তর্গত রূপান্তর—যেখানে প্রবৃত্তি চেতনার নিয়ন্ত্রণে এসে শুদ্ধ হয়ে ওঠে। হাতির প্রতীক এখানে নির্দেশ করে অন্ধ শক্তি, উদ্দামতা ও আত্মম্ভরিতা; আর দেবীর সিংহ সেই নিয়ন্ত্রিত তেজ, যা এই অহংকারকে বশে আনে।
এই দমন মানে ধ্বংস নয়, বরং রূপান্তর—যেখানে চেতনা নিজেই নিজের প্রতিক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই প্রক্রিয়াটিই “আবেগ-নিয়ন্ত্রণ” বা Emotional Regulation এবং “নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ” বা Executive Control-এর প্রতিরূপ। মন যখন নিজের আবেগ, রাগ, ভয় বা আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার আলোয় পর্যবেক্ষণ করতে শেখে, তখন সেই প্রবল আবেগ ধ্বংস হয় না—বরং ধীরে ধীরে শান্ত ও সুষম শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
এই তত্ত্বেরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায় আধুনিক নিউরোথিওলজি ও স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায়। নিয়মিত ধ্যান, মন্ত্রজপ ও শ্বাসনিয়ন্ত্রণের ফলে মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স—যা আত্মনিয়ন্ত্রণ, নৈতিক বোধ, মনোসংযম ও সহানুভূতির কেন্দ্র—সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর ফলে মানুষ নিজের চিন্তা ও আবেগের উপর অধিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, মানসিক স্বচ্ছতা ও করুণাবোধ বৃদ্ধি পায়।
জগদ্ধাত্রীর আরাধনা কেবল ধর্মীয় আচরণ নয়, এটি এক গভীর মানসিক প্রশিক্ষণপদ্ধতি—যা অহংবিনাশের মধ্য দিয়ে আত্মচেতনার বিকাশ ঘটায়। তিনি সেই অন্তর্গত শক্তি, যিনি জীবনশক্তিকে ধ্বংস করেন না, বরং চেতনার নির্দেশে সুষমায় স্থাপন করেন। তাঁর পূজার তত্ত্ব আমাদের শেখায়—মুক্তি মানে দমন নয়, বরং রূপান্তর; আর চেতনার আলোয় নিয়ন্ত্রিত শক্তিই প্রকৃত শান্তির পথ।
বাংলার ইতিহাসে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তন কেবল ধর্মীয় ঘটনাই নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যেও পূর্ণ। অষ্টাদশ শতকের অস্থির সময়ে, নবাবী শাসনের পতন ও ঔপনিবেশিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে “ধাত্রী”—অর্থাৎ শৃঙ্খলার ধারক—দেবীর পূজা ছিল এক প্রতীকী প্রতিশ্রুতি: বিশৃঙ্খলার মধ্যেও ন্যায় ও স্থিতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। পরবর্তীকালে সাহিত্যেও, বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ-এ, জগদ্ধাত্রী ভারতের গৌরবময় অতীতের প্রতীক হয়ে ওঠেন—সেই সত্ত্বগুণী সভ্যতা, যা জ্ঞান, ধৈর্য ও নৈতিক স্থিতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর প্রতিমা হয়ে ওঠে এক জাতীয় রূপক, যা বলে—মুক্তি কেবল সংগ্রামে নয়, বরং জ্ঞানের শৃঙ্খলায় নিহিত।
জগদ্ধাত্রী দেবী এক বহুমাত্রিক দর্শন—যেখানে বেদান্তের অদ্বৈত, তন্ত্রের সক্রিয় শক্তি, মনোবিজ্ঞানের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ও সমাজচেতনার ঐক্যবোধ একসূত্রে মিলিত হয়েছে। তিনি আমাদের শেখান যে, সত্যিকার শক্তি ক্রোধে নয়, জ্ঞানে; জয় অস্ত্রের নয়, আত্মসংযমের; এবং জগৎ ধারণের নীতি দমন নয়, বরং ধৃতির—অন্তর্গত স্থিরতার।
তাঁর রূপ তাই এক নীরব ঘোষণা—পরম শক্তি সর্বদা অন্তরে, শান্ত অথচ অটল, অদৃশ্য অথচ সর্বধারক। তিনি সেই “আধারভূতা”—যাঁর অদৃশ্য স্থিরতার উপর সমগ্র অস্তিত্বের তরঙ্গ নৃত্য করে, এবং সেই স্থিতিশীলতার মধ্যেই জগত, চেতনা ও জ্ঞানের অনন্ত ঐক্য পূর্ণতা লাভ করে।
জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা-তত্ত্ব ভারতীয় প্রতিমাশিল্পের মধ্যে এক অনন্য সেতুবন্ধ—যেখানে বৈদিক পৌরাণিক আখ্যান, উপনিষদীয় দার্শনিক সূক্ষ্মতা এবং তান্ত্রিক উপাসনার রূপগত প্রতীক—সব একত্রে মিলিত হয়েছে।
ঐশ্বরিক আখ্যান অনুযায়ী, এই তত্ত্বের উৎস কেন উপনিষদ-এর সেই প্রসিদ্ধ কাহিনীতে নিহিত, যেখানে দেবতারা মহাসংগ্রামের পর নিজেদের জয়কে নিজেদের বল বলে ভেবে অহংকারে মত্ত হন। তখন ব্রহ্মরূপী এক অদ্ভুত দেবী তাঁদের সামনে এক তৃণখণ্ড স্থাপন করেন, এবং বলেন—“এটি তুলতে পারো?”—কিন্তু অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র কেউই তা সরাতে পারেন না। অবশেষে দেবী, যিনি ব্রহ্মের সমতুল্য, তখন একটি সিংহের উপর আরোহণকারী উমা হেমবতী রূপে প্রকাশিত হন—যিনি শিবশক্তির প্রতীক—এবং দেবতাদের বোঝান যে, তাঁদের শক্তি তাঁদের নয়, ব্রহ্মশক্তিরই প্রকাশ। এই কাহিনি শক্তির উৎস ও অহংকারের সীমা সম্পর্কে এক গভীর দার্শনিক শিক্ষা দেয়।
এই ঐশ্বরিক প্রতীকই পরে কাত্যায়নী তন্ত্র, দেবী-ভাগবত পুরাণ ও কৌলবিকাশ তন্ত্র-এর আখ্যানগুলিতে নতুন অর্থে প্রতিফলিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার পর দেবগণ পুনরায় অহংকারে পতিত হলে, দেবী তাঁদের জ্ঞানের শিক্ষা দিতে জগদ্ধাত্রী রূপে আবির্ভূত হন—সিংহবাহিনী, শুভ্রবর্ণা, শান্তদৃষ্টি, করীন্দ্রাসুরবধকারিণী। করীন্দ্রাসুর, যে হাতির রূপে দেবতাদের উপর আক্রমণ করেছিল, সেই হাতিই এখানে অহংকার (অহং-কার)-এর প্রতীক। দেবী সেই অহংকারকে দমন করেন, কিন্তু ধ্বংস করেন না; বরং সেটিকে নিজের চেতনার নিয়ন্ত্রণে এনে স্থিতিতে রূপ দেন।
দুর্গা যদি রজোগুণের, অর্থাৎ কর্ম, সাহস ও আবেগের দেবী হন, তবে জগদ্ধাত্রী হলেন সত্ত্বগুণের, অর্থাৎ স্থিতি, শান্তি ও জ্ঞানের দেবী। কাত্যায়নী তন্ত্র-এ বলা হয়েছে—“সত্ত্বরূপা জগদ্ধাত্রী, রজঃ-তমঃ-পরাজিতা।” অর্থাৎ, তিনি সেই চেতনা-শক্তি, যিনি রজঃ ও তমঃ-এর সীমা অতিক্রম করে বিশুদ্ধ সত্ত্বের দীপ্তিতে অবস্থান করেন।
তাঁর শৈল্পিক প্রতিমা-রূপ এই দর্শনেরই মূর্ত প্রতীক—শুভ্রবর্ণ, সিংহবাহিনী, হাতে শঙ্খ-চক্র-ধনুক-বাণ, আর পদতলে হাতি। এই রূপে তিনি কেবল দেবী নন, চেতনার স্থিতিশক্তি—যিনি জীবনধারার প্রবলতা ও অহংকারকে আত্মসংযমে রূপান্তরিত করেন। সিংহ তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সাহসের প্রতীক, হাতি অহংকারের, আর শুভ্র দেহ সত্ত্বগুণের জ্যোতির্ময় স্বচ্ছতার।
এইভাবে জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন শক্তির তৃতীয় স্তর—কালী শক্তির প্রবৃত্তি, দুর্গা শক্তির ক্রিয়া, আর জগদ্ধাত্রী শক্তির স্থিতি। তিনি সেই “বিশ্বধারিণী”—যিনি সৃষ্টিকে বহন করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন, আর জ্ঞানের শান্তিতে স্থিত করেন। তাঁর আরাধনা তাই কেবল আচার নয়, চেতনার শৃঙ্খলার সাধনা; অহং থেকে আত্মবোধে উত্তরণের প্রতীক।
জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল আঞ্চলিক বা লোকাচারভিত্তিক নয়; এটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থের এক গভীর ও দীর্ঘ ঐতিহ্যের অংশ, যার শেকড় বৈদিক ও উপনিষদীয় চিন্তায় প্রোথিত। অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে এই পূজা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও, তার মূল দর্শন ও প্রতিমা-তত্ত্ব বহু প্রাচীন গ্রন্থে বর্ণিত আছে—যা এই দেবীর ঐশ্বরিক ধারণাকে প্রমাণ করে।
বৈদিক ও পৌরাণিক উৎসে দেখা যায়, জগদ্ধাত্রীর ধারণা “বিশ্বধারিণী” বা “জগতের ধারক শক্তি” রূপে কেন উপনিষদে উপস্থিত। সেখানে দেবী উমা হেমবতী রূপে প্রকাশিত হয়ে দেবতাদের শেখান যে, শক্তির মূল উৎস ব্রহ্মচেতনা নিজেই—অর্থাৎ যে-শক্তি বিশ্বকে ধারণ করে, সেই চেতনা-শক্তিই জগদ্ধাত্রী। এই আখ্যান শক্তিকে অজ্ঞতার থেকে জ্ঞানে উত্তরণের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে।
পরবর্তীকালে দেবী ভাগবত পুরাণ (ষষ্ঠ স্কন্ধ, অধ্যায় ৯)-এ বলা হয়েছে—“সা জগদ্ধাত্রী দেবী বিশ্বম্ ধারণাত্ জগদ্ধাত্রী প্রখ্যাতা।” অর্থাৎ, যিনি সমগ্র বিশ্বকে ধারণ করেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী নামে পরিচিত। এখানে ‘ধারণা’ শব্দটি কেবল ভৌত ধারণা নয়; এটি সত্ত্বগুণের এক গুণগত প্রতীক—স্থিতি, ধৈর্য ও ধৃতির মূর্তি।
তান্ত্রিক ঐতিহ্যে কাত্যায়ণী তন্ত্র-এ তাঁকে “মহাদুর্গা জগদ্ধাত্রী চ শুদ্ধসত্ত্বরূপিণী।” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, তিনি দুর্গার এক উচ্চতর, পরিশুদ্ধ রূপ—যেখানে যুদ্ধ ও উগ্রতা প্রশমিত হয়ে স্থিতি ও জ্ঞানের দীপ্তিতে পরিণত হয়েছে। তাঁর রূপ সাদা বা শুভ্র, যা বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক, এবং তাঁর বাহন সিংহ, যা ধৈর্য ও নিয়ন্ত্রিত শক্তির প্রতীক।
মন্ত্র ও আহ্বানেও তাঁর এই দার্শনিক পরিচয় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তাঁর ধ্যানমন্ত্রে বলা হয়—“ওঁ মহাদেব্যৈ বিদ্মহে, সিংহবাহিন্যৈ ধীমহি, তন্নো দেবী প্রচোদয়াত্।” অর্থাৎ, “আমরা সেই মহাদেবীকে জানি, যিনি সিংহবাহিনী, আমরা তাঁকে ধ্যানে ধারণ করি, সেই দেবী আমাদের চেতনায় প্রেরণা দান করুন।” এখানে তিনটি স্তর আছে—বিদ্মহে (জ্ঞান), ধীমহি (ধ্যান) ও প্রচোদয়াত্ (প্রেরণা)—যা জগদ্ধাত্রীর ত্রিবিধ শক্তির (জ্ঞান, ধ্যান ও কর্ম) প্রতীক।