শৈব কালী: সাতানব্বই



এই নিস্পন্দ চেতনা-ই কালী—যিনি স্থিতির মধ্যেও গতি, নীরবতার মধ্যেও শব্দ। তিনিই সেই চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সমস্ত ক্রম (sequence)-এর উৎপত্তি, এবং আবার সমস্ত ক্রমের বিলয় নিহিত। তাঁর মধ্যে সমস্ত প্রকাশের ধ্বনি নিজ উৎসে ফিরে যায়—যেন শব্দসমুদ্র আবার নিজের নিস্তব্ধ গভীরে মিশে যায়। সময়, শব্দ, ইচ্ছা—সব তাঁর হৃদয়ের নিঃস্পন্দ নীরবতায় বিলীন।

এই স্তরেই উদ্‌ভাসিত হয় অনাখ্যা (Anākhyā)—যার অর্থ “নামের অতীত”, “ভাষার অগ্রাহ্য”, “অবর্ণনীয়”। এটি এমন এক পরম নীরবতা, যা কোনো শূন্যতা নয় বরং এক শোষণময় নিস্তব্ধতা—যেখানে সমস্ত রূপ ও ক্রিয়া নিজের উৎসে ফিরে যায়।

কালী কেবল “সময়ের দেবী” নন; তিনি ক্রমের উৎস ও অনাখ্যার বিলয়বিন্দু—এক চিরন্তন বৃত্ত, যেখানে সৃষ্টি ও লয়, গতি ও স্থিতি, নৃত্য ও নীরবতা একাকার। সেই একত্বচেতনাই অবশেষে ঘোষণা করে—“অহম্‌ কালী” (Aham Kālī)—“আমি-ই কালী”—অর্থাৎ আমি-ই সেই কালাতীত, স্থিত অথচ চিরজাগ্রত চেতনা, যার মধ্যে সমস্ত সৃষ্টি, সময় ও ভাষা একসঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে দীপ্ত হয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে চৌষট্টি তত্ত্বের (ষট্‌ষষ্টি তত্ত্ব) মহাজাগতিক সংশ্লেষই হলো সৃষ্টি-ক্রম (৩৬ তত্ত্ব) এবং লয়-ক্রম (২৮ দেবী-তত্ত্ব)-এর দার্শনিক ভূমিকা ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট।

কাশ্মীর শৈব দর্শন, যা বিশ শতকে ত্রিক স্কুল এবং প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের মতো অদ্বৈতবাদী শৈব-শাক্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যগুলির জন্য একটি সম্মিলিত পরিভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, মূলত নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি কাশ্মীর অঞ্চলে উদ্ভূত হয়। এই দর্শন বস্তুজগৎ ও চেতনার কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য ‘তত্ত্ব’ (Tattva) নামক নীতি বা মৌল উপাদানের ওপর নির্ভর করে। ‘তত্ত্ব’ শব্দটির অর্থই হলো ‘সেই সত্তা’ বা ‘বাস্তবতা’।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারতীয় দর্শনে তত্ত্বসংখ্যার বৃদ্ধি এক ধারাবাহিক দার্শনিক বিবর্তনের ফল। যেখানে সাংখ্য দর্শন মহাজাগতিক প্রকাশকে ২৫টি তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছে, পরবর্তীকালে শৈব দর্শন, বিশেষত কাশ্মীর শৈববাদ, এই সংখ্যা ৩৬-এ উন্নীত করে। এই ৩৬ তত্ত্ব মহাবিশ্বের কাঠামো এবং পরম শিবের স্ব-সংকোচন (Sṛṣṭi-Krama) বা অবতরণের ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে। ত্রিক দর্শনের প্রধান শাস্ত্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে উল্লেখযোগ্য মালিনীবিজয়োত্তর তন্ত্র (Mālinīvijayottara Tantra), সিদ্ধযোগেশ্বরীমাতা (Siddhayogeśvarīmata) এবং অনামক তন্ত্র (Anāmaka Tantra)।

ত্রিক দর্শনের মূল ভিত্তি হলো প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā)—অর্থাৎ ‘স্বয়ং-স্বীকৃতি’ বা নিজের শিবস্বরূপকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করা। এই দর্শনে ৩৬ তত্ত্ব হলো সেই কাঠামো, যার মাধ্যমে পরম চেতনা (পরমশিব) নিজেকে সীমিত করে জাগতিক রূপ ধারণ করে। কিন্তু যখন এই কাঠামোটি ৬৪ তত্ত্বের সংশ্লেষে (ষট্‌ষষ্টি তত্ত্ব) উন্নীত হয়, তখন তা কেবল একটি দার্শনিক মানচিত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি কৌল ও ক্রম ঐতিহ্যের যোগিক মুক্তিপথকে অন্তর্ভুক্ত করে।

কৌল (Kaula) মানে কুল বা ঐক্য। এটি সেই পথ, যেখানে শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, কাম—সব কিছুকেই চেতনার প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এখানে কোনো কিছু অস্বীকার নয়, বরং সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শিবচেতনা উপলব্ধি করা হয়। তাই কৌল পথ শরীরকেন্দ্রিক, অন্তর্মুখী এবং ঐক্যমুখী—যেখানে শিব ও শক্তি, পুরুষ ও প্রকৃতি, জ্ঞান ও ভোগ—সব এক হয়ে যায়।

ক্রম (Krama) মানে ধারা বা ক্রমান্বয়ে বিকাশ। এটি চেতনার ধাপে ধাপে উন্মেষ ও প্রত্যাবর্তনের পথ। এখানে কালী সময়শক্তি হিসেবে পূজিতা—যিনি চেতনার প্রতিটি স্তর ভেদ করে শেষপর্যন্ত সব কিছু নিজের মধ্যে লয়ে নেন। ক্রমা তাই লয়, ধ্যান ও অন্তর্জাগরণের পথ, যেখানে সময়ই শক্তি, আর কালী সেই সময়ের চূড়ান্ত রূপ।

কৌল হলো ঐক্যের সাধনা—“সবই এক”, আর ক্রম হলো সেই একতার প্রবাহ—“সবই একের ধারা”।

এই ৬৪ তত্ত্বের ধারণাটি প্রমাণ করে যে, কাশ্মীর শৈববাদ একটি ‘পরম-অদ্বৈত’ (Parama-Advaita) কাঠামো প্রদান করে, যা সৃষ্টি (Ontology) এবং মুক্তির প্রক্রিয়া (Soteriology) উভয়কেই একীভূত করে। ৩৬ তত্ত্ব হলো স্থিতিশীল মহাজাগতিক বাস্তবতা (Prakāśa)। এই স্থিতিশীল কাঠামোর উপর যখন ২৮টি সূক্ষ্ম দেবী-তত্ত্বের গতিশীল প্রক্রিয়া (Vimarśa) আরোপিত হয়, তখন এই সমন্বিত কাঠামোটি সম্পূর্ণ যোগিক পথচিত্র হিসেবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়াটি চেতনার সংকোচন (বন্ধন) জানা এবং সক্রিয় শক্তির মাধ্যমে দ্রুত লয় (মুক্তি) অর্জনের ওপর জোর দেয়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, ৩৬ তত্ত্বকে তাদের চেতনার মাত্রার ভিত্তিতে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।

শুদ্ধ তত্ত্ব (Śuddha Tattvas): এগুলি ১ থেকে ৫ নম্বর তত্ত্ব, যা পরম সত্তার অভ্যন্তরীণ দিকগুলিকে বর্ণনা করে। এগুলি বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সর্বজনীন অভিজ্ঞতার স্তর। এই তত্ত্বগুলি শৈব তত্ত্ব নামেও পরিচিত এবং বিশ্বাস করা হয় যে, এগুলি পরম শিব কর্তৃক সৃষ্ট।

শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্ব (Śuddhāśuddha Tattvas): এগুলি ৬ থেকে ১২ নম্বর তত্ত্ব। এই সাতটি তত্ত্ব সীমিত আত্মা বা পুরুষের (Puruṣa) জন্ম এবং তার সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

অশুদ্ধ তত্ত্ব (Aśuddha Tattvas): এগুলি ১৩ থেকে ৩৬ নম্বর তত্ত্ব। এই ২৪টি তত্ত্ব মন, ইন্দ্রিয় এবং স্থূল উপাদান নিয়ে গঠিত জাগতিক বাস্তবতা, যা সীমিত আত্মার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। এই ২৪টি তত্ত্ব সাংখ্য দর্শনের আত্মা তত্ত্বের সমতুল্য।

চৌষট্টি তত্ত্ব’ বলতে কাশ্মীর শৈব দর্শনে সেই ৬৪টি স্তর বা পর্যায়কে বোঝানো হয়, যেখানে চেতনা ক্রমান্বয়ে নিজের প্রকাশ ঘটায়—অদ্বৈত, বিশুদ্ধ স্তর থেকে শুরু করে জগৎ, মন ও বস্তু পর্যন্ত। এই ৬৪ স্তরকে বলা হয় ষট্‌ষষ্টি তত্ত্ব (Ṣaṭṣaṣṭi Tattva)। এটি মূল ৩৬ তত্ত্বের একটি বিস্তৃত রূপ, যেখানে চেতনার গতি বা স্পন্দন আরও সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

সৃষ্টির ক্রমে ৩৬টি প্রধান তত্ত্ব পরম শিব থেকে পৃথিবী পর্যন্ত চেতনার অবতরণকে নির্দেশ করে। বিশুদ্ধ চেতনার স্তরে শিব ও শক্তি অবিচ্ছেদ্য।

১. শিব তত্ত্ব—চেতনার নিস্তরঙ্গ দীপ্তি, বিশুদ্ধ আত্মজ্ঞান।

২. শক্তি তত্ত্ব—চেতনার আত্মবিমর্শন বা স্পন্দন।

৩. সদাশিব তত্ত্ব—“আমি আছি” এবং “এ-ও আছে”—এই দ্বৈত উদ্‌ভাসের প্রথম আভাস। এই স্তরে অভিজ্ঞতার ‘এই’ (Idam) দিকটি অস্পষ্ট থাকে, যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ছবির প্রাথমিক রূপরেখা।

৪. ঈশ্বর তত্ত্ব—বহির্মুখী প্রকাশ; চেতনা নিজেকে বিশ্বরূপে দেখে। এই স্তরে ‘এই’ (Idam) দিকটি আরও সংজ্ঞায়িত হয়: ‘এই আমি’ (Idam Aham)।

৫. শুদ্ধ বিদ্যা তত্ত্ব—“আমি এবং এটি”—এই দুইয়ের ঐক্যসামঞ্জস্য।

মিশ্র স্তরে চেতনা আংশিকভাবে সীমিত হতে শুরু করে।

৬. মায়া তত্ত্ব—বিভেদের বীজ, সীমাবোধের সূচনা। মায়া হলো মূল আবরণ বা বিভ্রমের শক্তি, যা পরম সত্তার প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে এবং পরিমাপহীনকে পরিমেয় করে তোলে।

৭-১১. পঞ্চ কঞ্চুক—চেতনার ওপর আরোপিত পাঁচটি সীমা: কাল (সময়), নিযতি (দিক), রাগ (আসক্তি), বিদ্যা (সীমিত জ্ঞান), কালা (সীমিত কর্মশক্তি)।

১২. পুরুষ—ব্যক্তিগত আত্মা বা সীমাবদ্ধ চেতনা।

১৩. প্রকৃতি—মূল প্রকৃতি, যেখান থেকে মন, ইন্দ্রিয় ও দেহের উত্থান।

অশুদ্ধ তত্ত্বে চেতনা জগত ও মানসিক কাঠামোয় পরিণত হয়।

১৪. বুদ্ধি—বিচারবোধ।

১৫. অহংকার—‘আমি’-বোধ।

১৬. মন—চিন্তার গতি।

১৭-২১. জ্ঞানেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, ঘ্রাণ, রসনা, ত্বক।

২২-২৬. কর্মেন্দ্রিয়—বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

২৭-৩১. তন্মাত্রা—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ।

৩২-৩৬. মহাভূত—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের চৌষট্টি তত্ত্ব বা ষট্‌ষষ্টি তত্ত্ব এক মহাজাগতিক ও আধ্যাত্মিক মানচিত্র, যেখানে চেতনার পূর্ণ বিকাশ ও প্রত্যাবর্তনের সমগ্র প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই তত্ত্বসমূহ মূলত ৩৬টি প্রধান তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত আরও ২৮টি সূক্ষ্ম দেবী-তত্ত্ব নিয়ে গঠিত।

প্রথমে আসে দশ মহাবিদ্যা, যাঁরা চেতনার দশটি মৌলিক শক্তির প্রতীক। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা—এই দশ দেবী হচ্ছেন চেতনার সৃষ্টিশক্তি, স্থিতিশক্তি, বিলয়শক্তি, তিরোধানশক্তি ও অনুগ্রহশক্তির দশটি মৌলিক বিকিরণ।

কালী হলেন সময় ও ধ্বংসের শক্তি এবং সব কিছুর গ্রাসকর্ত্রী; তারা মুক্তিদাত্রী, যিনি বিপদ থেকে উদ্ধার করেন; ষোড়শী বা ত্রিপুরসুন্দরী ষোলোটি কলা বা পূর্ণতার দেবী এবং সৌন্দর্য ও ঐক্যের প্রতীক; ভুবনেশ্বরী জগৎ বা ব্রহ্মাণ্ডের ধারক ও শাসক; ভৈরবী উগ্রতা ও তপস্যার শক্তি; ছিন্নমস্তা আত্মত্যাগ ও যোগশক্তির প্রতীক; ধূমাবতী বিধ্বংসী শক্তির পর অবশিষ্ট শূন্যতা; বগলামুখী শত্রুকে স্তব্ধ করার শক্তি; মাতঙ্গী প্রকৃতি, সংগীত ও জ্ঞানের শক্তি; এবং কমলা সমৃদ্ধি, সম্পদ ও পূর্ণতার শক্তি।

এর পরে ক্রমপন্থায় বর্ণিত হয়েছে দ্বাদশ কালিকা—চেতনার বারোটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াধর্মী স্তর, যেগুলি সৃষ্টি থেকে লয় পর্যন্ত চেতনার ছন্দময় গতি প্রকাশ করে।

সৃষ্টি কালী হলো সৃষ্টি বা প্রকাশের প্রক্রিয়ার প্রতীক, যা চেতনার বহির্মুখী হওয়াকে বোঝায়। এরপর আসে রক্ত কালী, যা ভোগের আসক্তি এবং রক্তের মতো তীব্র আকর্ষণকে প্রতীকায়িত করে। স্থিতিনাশ কালী স্থিতিশীলতার ক্ষয় বা বিলুপ্তির মাধ্যমে স্থায়িত্বের বোধ হারানোকে বোঝায়। যম কালী নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আরোপকারী শক্তি হিসেবে চেতনার সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। সংহার কালী ধ্বংস বা সংহারের প্রক্রিয়ার প্রতীক, যা চেতনার বস্তুকে গুটিয়ে নেওয়াকে বোঝায়। মৃত্যু কালী জীবনের সমাপ্তি ও রূপান্তরের মাধ্যমে সময়ের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। রুদ্র কালী বিধ্বংসী ক্রোধ ও শক্তির মাধ্যমে চেতনার চরম অস্থিরতা ঘটায়।

এরপর পরমার্ক কালী পরম সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনকে নির্দেশ করে, যা চেতনার অন্তর্মুখী হওয়া শুরু। কালাগ্নিরুদ্র কালী সময়ের অগ্নিস্বরূপ, যা সব কিছুকে দহন করে এবং সব কর্ম ও বন্ধন পুড়িয়ে দেওয়াকে বোঝায়। মহাকালী মহাজাগতিক ধ্বংস ও মহাপরিশুদ্ধির মাধ্যমে সময় ও স্থানের অতীত চেতনাকে প্রকাশ করে। ভৈরব কালী চূড়ান্ত চেতনা (শিব) এবং শক্তির মিলনকে প্রতীকায়িত করে, যা ভয়হীনতা ও ঐক্যকে নির্দেশ করে। এবং সবশেষে কালসংকর্ষিণী হলো সময়ের চূড়ান্ত আকর্ষণ বা সংকোচনশক্তি, যার মাধ্যমে চেতনা নিজের উৎস বা আত্মলয়ে বিলীন হয়।

এই বারো কালিকার পরে চেতনা প্রবেশ করে আরও সূক্ষ্ম স্তরে, যেখানে উদ্‌ভাসিত হয় ষোলোটি অন্তর্লয়ধর্মী শক্তি, অর্থাৎ ষোড়শ নিত্যা দেবী। এই নিত্যা দেবীগণ হলেন ললিতা ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর ষোলোটি রূপ—চন্দ্রকলার পনেরোটি ধাপের প্রতীক এবং ত্রিপুরসুন্দরী বা ষোড়শী বা ললিতাম্বা স্বয়ং, যা চেতনার ষোলো মাত্রা বা সম্পূর্ণতার পর্যায় নির্দেশ করে।

এই ষোলো দেবী এবং তাঁদের প্রতীকী অর্থ নিম্নরূপ:

১. মহা ত্রিপুরসুন্দরী (ষোড়শী): পরম শক্তি, ষোড়শ কলা বা পূর্ণতার উৎস (চন্দ্রকলার বাইরে, সর্বব্যাপী)।

২. কামেশ্বরী: আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাশক্তি।

৩. ভগমালিনী: আকর্ষণ, প্রেম বা মোহনের শক্তি।

৪. নিত্যক্লিন্না: সিক্ততা বা অবিরাম দয়া ও করুণার শক্তি।

৫. ভেরুণ্ডা: ভীতি বা উগ্রতার মাধ্যমে অশুভ ধ্বংসের শক্তি।

৬. বহ্ণিবাসিনী: অগ্নি বা তেজের শক্তি, শুদ্ধিকরণের ক্ষমতা।

৭. মহাবজ্রেশ্বরী: বজ্র বা অনমনীয় শক্তির দেবী।

৮. শৈবদূতী (রৌদ্রী): রুদ্রের দূত, জাগতিক বিষয়ে শিবের শক্তি।

৯. ত্বরিতা: দ্রুততা ও আশু ফলদানের শক্তি।

১০. কুলসুন্দরী: বংশ বা ধারার সৌন্দর্য ও ঐক্যের শক্তি।

১১. নিত্যা: চিরন্তনতা, সময়ের অমর প্রকৃতি।

১২. নীলপতাকা: বিজয়, সাফল্য ও সুরক্ষার প্রতীক।

১৩. বিজয়া: নিশ্চিত বিজয় লাভের শক্তি।

১৪. সর্বমঙ্গলা: সর্বক্ষেত্রে মঙ্গল ও শুভ ফলদাত্রী।

১৫. জ্বালামালিনী: উজ্জ্বলতা, দীপ্তি ও আত্মজ্যোতির শক্তি।

১৬. চিত্রা: রহস্যময়তা, বিচিত্রতা বা বিশুদ্ধ চেতনার ঝলক।

তাঁদের মধ্যে শেষ পনেরো জন চন্দ্রের পনেরো তিথির সঙ্গে সম্পর্কিত, আর ষোড়শী হলেন সেই পরম কলা, যেখানে সমস্ত কলা একাকার হয়ে যায়। এই ষোলো শক্তি চেতনার অন্তর্লীন দীপ্তি—যেখানে জ্ঞান, প্রেম, করুণা, শুদ্ধি, দীপ্তি ও নিঃশেষ ঐক্যের ধাপগুলি ক্রমান্বয়ে অভিজ্ঞ হয়।