কালী কেবল কোনো দেবী নন, বরং চেতনারই সর্বোচ্চ রূপ, যিনি সব জানার উৎস এবং জানার মধ্যেও স্বাধীন। শৈব দর্শনে বলা হয়েছে, চেতনার যেসব শক্তি আছে—সৃষ্টি করা, রক্ষা করা, ধ্বংস করা, গোপন রাখা এবং অনুগ্রহ করা—এই সব শক্তিই একে একে শেষে কালী-র মধ্যেই মিলিয়ে যায়। অর্থাৎ তিনিই সব শক্তির কেন্দ্র ও শেষ আশ্রয়।
তাঁকে বলা হয় অধিষ্ঠাত্রী সংবিত্ (adhishṭhātrī saṁvit)—মানে সেই চেতনা, যিনি সর্বত্র বিদ্যমান এবং সব কিছুর ভিতর থেকে কাজ করেন। কিন্তু তিনি কখনও দুই ভাগে বিভক্ত নন—তিনি একই সঙ্গে জানেন (জ্ঞাতা) এবং জানার বিষয় (জ্ঞেয়) হিসেবেও বিদ্যমান। তাই তাঁকে বলা হয় পরম জ্ঞাতা (parama-jñātā)—সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারিণী, যিনি জানেন, কিন্তু জানার কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়; বরং নিজের অস্তিত্বের মাধ্যমেই সব কিছু জানেন।
এই অবস্থায় কালী কোনো আলাদা দেবী নন; তিনিই পরমেশ্বর, অর্থাৎ শিবচেতনারই জীবন্ত প্রকাশ—যিনি নিজেকে প্রকাশও করেন (সৃষ্টি), আবার নিজেকেই টেনে নেন (লয়)। এই কারণেই ক্রম দর্শনে কালীকে বলা হয় শুদ্ধ সংবিত্ (śuddha-saṃvid)—অর্থাৎ এমন এক চেতনা, যা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ, যার সঙ্গে কোনো চিন্তা, ধারণা বা সীমাবোধ জড়িত নেই।
তাঁকেই বলা হয় শুদ্ধ বিদ্যা (Śuddhā Vidyā)-র অধিষ্ঠাত্রী, অর্থাৎ সেই অবস্থায় চেতনা নিজেরই জ্ঞান—যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের কোনো পার্থক্য থাকে না। এখানে “জানা” মানে কোনো ধারণা নয়, বরং এক সরাসরি অনুভব—যেখানে জানা আর থাকা, আলোক আর প্রতিফলন, অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞ—সব এক হয়ে যায়।
“শুদ্ধ বিদ্যা” শব্দটির দুটি অর্থ আছে—
এক, লক্ষ্যরূপে, অর্থাৎ মুক্তি বা আত্ম-উপলব্ধির চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা—যেখানে আত্মা নিজেকে নিজের সত্য রূপে চিনে ফেলে।
দুই, উপায়রূপে, অর্থাৎ সেই সত্য-অনুসন্ধান বা সৎ-তর্ক, যা আমাদের এই উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়।
কালী এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটির প্রতীক—তিনি সেই চূড়ান্ত উপলব্ধি, যেখানে চেতনা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে নিজেকে নিজের মধ্যে চিনে ফেলে। এই জানা কোনো বুদ্ধির কাজ নয়, এটি এক শুদ্ধ বোধ (śuddha vedana)—যেখানে কর্তা, কর্ম, জ্ঞানী, জ্ঞেয়—সব মিলেমিশে যায় এক নিঃশব্দ দীপ্তিতে।
এই শুদ্ধ বিদ্যা কোনো মানসিক বা বুদ্ধিগত স্তর নয়; এটি সেই সাক্ষী চেতনা (sākṣī saṁvit)-এর অভিজ্ঞতা, যিনি সব কিছু দেখেন, কিন্তু কিছুতেই জড়ান না—যিনি থেকে সব ঘটে, কিন্তু যিনি নিজে সবসময় অক্ষত, শান্ত ও নিস্পাপ থাকেন।
এখানে কালীকে “কাল-ক্ষয়ঙ্করী”, “অনাখ্যা” বা “অনাখ্যা-পরমেশ্বরী” বলা হচ্ছে এই কারণে যে, তিনি সেই অতি-অনুক্রমিক নীতির প্রতীক, যেখানে সময়, মাপ, সংখ্যা এবং আগে-পরে—সব অনুক্রমিক চিহ্ন একেবারেই অর্থ হারায়। “অতি-অনুক্রমিক” বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন এক চেতনা-স্তর, যেখানে কোনো ক্রমধারা চলেই না; সময় সেখানে প্রবাহ নয়, বরং এক অখণ্ড উপস্থিতি। তাই কালীকে এখানে সময়ের ওপারের শক্তি হিসেবে ধরা হয়—যেখানে সময়ের সম্ভাবনাও জন্ম নেয়ার আগেই বিলীন।
এই স্তরে “অস্তি/নাস্তি”—অর্থাৎ “আছে/নেই”—এই দ্বন্দ্বও অপ্রযোজ্য হয়ে যায়, কারণ “অস্তিত্ব” আর “অনস্তিত্ব” দুটিই ক্রম, তুলনা এবং মানসিক ধারণার উপর দাঁড়িয়ে। কালী সেই ধারণা-মুদ্রাকে উলটে দেন; তিনি কেবল অস্তিত্বাত্মক বা যুক্তিতাত্ত্বিক অতিক্রম নন, বরং নাম-রূপ-ভাবনার অতীত পরম স্তব্ধতা (পরম-স্তব্ধতা)—এক এমন নীরব সত্যানুভব, যেখানে ভাবনার ভাষা থেমে যায় কিন্তু চেতনার দীপ্তি নিভে না।
এইজন্য তাঁকে বলা হয় “অনাখ্যা”—যাকে বলা যায় না, সংজ্ঞায় ধরা যায় না। অনাখ্যা মানে শূন্যতা নয়; এটি শোষণময় নীরবতা—যেখানে সমস্ত প্রকাশ নিজ উৎসে ফিরে যায়, যেমন ঢেউ ফিরে গিয়ে সমুদ্রই হয়। এখানে পরা বাক্ (পরা-বাক্)—যেখানে শব্দ-অর্থ এখনও অখণ্ড—তারও ঊর্ধ্বে এক নিবিড় অপ্রকাশ, তবু সেখানে ভাসা (দীপ্তি/আলোক) নিভে যায় না। ফলে “অনাখ্যা” ও “ভাসা”—নীরবতা ও আলোক—ধারণাগতভাবে আলাদা হলেও অভিজ্ঞতায় একাকার।
এই অভিন্নতা-অনুভবই তান্ত্রিক প্রতীকে ত্রয়োদশ দেবী (ত্রয়োদশ-দেবী) রূপে ধরা হয়—যেখানে দ্বৈততার সব জোড়া (অস্তিত্ব/অনস্তিত্ব, কাল/অকাল, শব্দ/নীরবতা, প্রকাশ/প্রত্যাহার) এক চূড়ান্ত ঐক্যে গলে যায়। সেই ঐক্যে কালী শুধু “সময় নাশকারিণী” নন; তিনি সময়ের জন্মের আগের মৌন-আলো—একাই নীরব, একাই দীপ্ত, যেখানে সৃষ্টির প্রসার আর লয়ের প্রত্যাহার এক শ্বাসে মিলেমিশে থাকে।
এই চেতনা-ই কালী—যিনি একসাথে জ্ঞাতা (knower), জ্ঞান (knowledge) ও জ্ঞেয় (known); যিনি নিজের অন্তর্লীন নীরব আলোকেই সমস্ত বিশ্বকে উদ্ভাসিত করেন এবং পুনরায় সেই আলোর মধ্যেই সব কিছু শোষণ করেন।
তাঁর মধ্যে সৃষ্টি ও লয় কোনো দুই ভিন্ন ঘটনা নয়—বরং একই চেতনার দুই শ্বাস, দুই দিক; এক নিঃশব্দ শ্বাসে মহাবিশ্বের জন্ম, আর পরের নিঃশ্বাসে তার বিলয়।
এই অনন্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দই কালী—পরম চেতনার চিরন্তন নৃত্য, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত উচ্চারণ করছে একই সত্য—“সো’হং”—আমি সেই।
আগমিক ঐতিহ্যের ধারায় বলা হয়েছে—এই জগৎ যে অসংখ্য রূপে, শক্তিতে ও অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত, তার উৎপত্তি কোনো বাহ্যিক সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা থেকে নয়; বরং তা এক অন্তর্নিহিত অনুক্রম বা ক্রম (Krama)-এর অবিরাম স্পন্দনের ফল।
এই ক্রম কোনো স্রোতের মতো, যা পরম চেতনার নিঃশব্দ গভীরতা থেকে উদ্ভূত হয়ে প্রতিটি স্তরে প্রকাশিত হয়—রূপ, শব্দ, ভাব ও অভিজ্ঞতার ধাপে ধাপে বিকাশের মধ্যে। আর সেই ক্রমেরই আদি উৎস এবং চূড়ান্ত বিলয়—উভয়ই নিহিত কালী-র মধ্যে। তিনি সেই সমস্ত কালের সময়হীন গর্ভ (Garbha of the Timeless Time), যাঁর হৃদয় থেকে সমস্ত অস্তিত্ব জেগে ওঠে, আবার নিজেই তাঁর মধ্যে ফিরে যায়।
এই বহুত্বের ধারাটি, যা সময় ও অভিজ্ঞতার বোধে এক ক্রমিক পরম্পরা রচনা করে, অবশেষে বিলীন হয় অনাখ্যা (Anākhyā)-র স্তরে—যেখানে আর কোনো নাম, রূপ, বা পার্থক্য অবশিষ্ট থাকে না। “অনাখ্যা” মানে সেই চেতনা, যা অপ্রকাশ্য, অচিহ্নিত এবং ভাষার ঊর্ধ্বে। সেখানে পার্থক্যের সমস্ত শর্ত লুপ্ত, কারণ পার্থক্যই ভাষার ভিত্তি, আর যখন পার্থক্য মুছে যায়, তখন ভাষাও থেমে যায়। অনাখ্যা সেই পরম অভিজ্ঞতা (śuddha-anubhava)-র প্রতীক—যেখানে সময়, স্থান ও ধারণা—সব সীমা বিলীন হয়ে যায়।
ক্রমপন্থা (Krama school)-এর বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার ও তত্ত্ববিশারদ জয়রথ “অনাখ্যা” ধারণাটিকে এমন এক পরম দর্শনের সূক্ষ্ম বিন্দু হিসেবে ধরেছেন, যেখানে ভাব, সময় ও অভিজ্ঞতার সমস্ত সীমানা মিশে যায়। তাঁর আলোচনায় দেখা যায়, কাশ্মীর শৈব দর্শনের মধ্যে এই অনাখ্যা ধারণা নিয়ে দুইটি প্রবল মতবিরোধী দৃষ্টিকোণ রয়েছে।
প্রথম দলের মতে, পরম বাস্তবতা (Paramārtha-tattva) দুইভাবেই ধরা যায়—একদিকে এটি সম্পূর্ণ নিরাকার, অতীন্দ্রিয়, ধারণাতীত, যেখানে কোনো প্রকাশ বা রূপের অস্তিত্ব নেই; অন্যদিকে, সেই একই বাস্তবতা বারো (কখনো ষোলো) কালিকা (Kālikāḥ) বা দেবী রূপে ধাপে ধাপে প্রকাশিত হয়—যেগুলো চেতনার বিস্তার বা অভিজ্ঞতার দ্বার উন্মোচনের বারোটি ধাপ। প্রতিটি কালিকা একটি নির্দিষ্ট চৈতন্যাবস্থা বা ক্রমের স্তর নির্দেশ করে—যার মধ্যে চেতনা বহির্মুখ হয়ে নিজেকে চিনতে শেখে।
অন্য দলের মতে, এই বারো স্তর বা ক্রমেরও ঊর্ধ্বে রয়েছে একটি ত্রয়োদশ নীতি (Trayodaśa-tattva)—যাকে বলা হয় অনাখ্যা। এটি এমন এক স্তর, যেখানে ক্রম নিজেই বিলীন—অর্থাৎ যে-চেতনা সব অভিজ্ঞতার ধারাকে জন্ম দেয়, সেই চেতনারই অন্তঃনিবিষ্ট, অক্রমিক উপস্থিতি। এখানে চেতনা আর গতি নয়, বরং অখণ্ড নীরব দীপ্তি, যা সব ধাপের, সব ভাবের বাইরে।
জয়রথ উভয় মতকেই একত্রে গ্রহণ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যায়, প্রথম মত দেখায় বহুত্ব বা প্রকাশের কার্যকরী দিক—যেখানে পরমচেতনা ধীরে ধীরে নানা স্তরে নিজেকে প্রকাশ করে। আর দ্বিতীয় মত বোঝায় সেই ঐক্য বা অদ্বৈত সত্য—যেখানে সমস্ত প্রকাশ আসলে এক চেতনারই লীলা। এই দুই মিলে তৈরি হয় এক সমন্বিত দৃষ্টি—যেখানে বহুত্ব ও ঐক্য, প্রকাশ ও নীরবতা, কাল ও অকাল—সবই একই চেতনার দুই ভিন্ন মুখ।
এইজন্যই ক্রমপন্থা বলেছে, মহাবৈরব-চণ্ডোগ্র-ঘোর-কালী—অর্থাৎ “মহান, প্রখর, ভয়ংকর কালী”—এই ত্রয়োদশ স্তরের প্রতীক। তিনি চূড়ান্ত দেবী, কারণ তিনিই বলেন—“আমি পরমা দেবী, আমি প্রকাশ ও লয়ের ঊর্ধ্বে, আমি সমস্ত নাম ও রূপের পরিণতি।” তাঁর মধ্যেই প্রকাশ, প্রত্যাহার ও শূন্যতা একত্রে মিলিত।
এই অবস্থায় তিনটি মৌলিক অভিজ্ঞতার স্তর—বস্তু (viṣaya), জ্ঞাতা বা কর্তা (pramātā), এবং জ্ঞানের উপায় (pramāṇa)—সব একীভূত হয়ে যায়। আর “জ্ঞান” তখন কোনো ক্রিয়া নয়; তা নিজের প্রতিফলন নিজেই—স্ব-চেতনা (svasaṁvedana)। এখানে সব বহিরাবয়ব, সমস্ত পার্থক্য কেবল আনন্দ (ānanda)-র তরঙ্গমাত্র। জানা ও থাকা, প্রকাশ ও প্রতিফলন, অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞ—সব মিলেমিশে যায় এক নিঃশেষ পূর্ণতায়, যেখানে কালী আর কোনো রূপ নয়—তিনি চেতনার নিজেরই অন্তর্লীন জ্যোতি।
প্রমাতা (pramātā): যিনি জানেন বা যিনি জ্ঞানের কর্তা (The Knower/The Subject)
প্রমেয় (prameya): যা জানা যায় বা জ্ঞানের বিষয় (The Object of Knowledge)
প্রমাণ (pramāṇa): যে উপায়ে বা পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করা হয় (The Means of Knowledge)
স্বসংবেদন (svasaṁvedana): আত্মসচেতনতা, আত্ম-উপলব্ধি, বা চেতনা নিজেই নিজের বিষয় (Self-Awareness, Self-Cognition)
আনন্দ (ānanda): শাশ্বত (Eternal) এবং শর্তহীন (Unconditional) পরমানন্দ বা পরম সুখ
এই অবস্থার প্রতীক নাম কাল-সংকর্ষিণী, যার অর্থ—যিনি “কালকে নিজের মধ্যে টেনে নেন”, অর্থাৎ সময়, ক্রম ও পরিমাপকে নিজের অন্তরে বিলীন করেন। তাঁকে আরও বলা হয় রুদ্র-রৌদ্রেশ্বরী (Rudra-Raudreśvarī)—অর্থাৎ “রুদ্রের প্রখর কর্ত্রী” বা “রুদ্রশক্তির পরম নিয়ন্ত্রী।” এই উপাধিটি পাওয়া যায় শ্রী-কাল-সংকর্ষিণী-পর্যায়-রুদ্র-রৌদ্রেশ্বরী নামক তান্ত্রিক গ্রন্থে। যদিও এর ব্যবহার গূঢ় তন্ত্রসাহিত্যের অন্তর্গত, এর দার্শনিক অর্থ স্পষ্ট—এটি চেতনার দুই দিকের ঐক্যের প্রতীক—শক্তি (śakti) ও ঈশিতৃত্ব (īśitṛtva)-এর মিলনবিন্দু।
śakti (শক্তি) মানে হচ্ছে চেতনার সৃজনশীল দিক—যে শক্তি সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোধান ও অনুগ্রহ সম্পাদন করে। আর īśitṛtva (ঈশিতৃত্ব) মানে “ঈশ্বরত্ব” বা “কর্তৃত্বশক্তি”—যে সর্বময় চেতনা সমস্ত কর্ম ও ফলের ওপর স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ রাখে। কাল-সংকর্ষিণী এই দুইয়ের ঐক্য—এখানে শক্তিই ঈশ্বর, ঈশ্বরই শক্তি; কর্তা ও ক্রিয়া আর ভিন্ন নয়। সৃষ্টির নৃত্যে দ্বৈততা বিলুপ্ত হয়ে যায়, কারণ করণকারিণী উভয়ই এক অনন্ত চেতনা।
এই ধারণাটি আরও সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ব্যোমচক্র (Vyoma-Cakra) গ্রন্থে—’ব্যোমচক্র’ অর্থ “আকাশচক্র” বা “চেতনার আকাশীয় বৃত্ত”। সেখানে বলা হয়েছে—এই স্তরটিকে বলা হয় “পঁয়ষট্টিতম নীতি”, অর্থাৎ এমন এক চেতনা-অবস্থা যা চৌষট্টি তত্ত্বের অন্তর্গত হয়েও তাদের অতিক্রম করে। এটি সেই চেতনা, যা সমস্ত গতির মধ্যে নিখাদ সামঞ্জস্য (samarasya)-রূপে স্থিত (উচ্চারণ সা-ম-রস্য—অর্থাৎ পূর্ণ ঐক্য বা অভেদ অবস্থা)। ব্যোমচক্র-এ একে বলা হয়েছে—“সামঞ্জস্যের পরম জোয়ারের অধিপতি”—যেখানে সব গতি, বিপরীত, ও দ্বন্দ্ব এক অভিন্ন চেতনায় গলে যায়।
এই স্তর কোনো ক্রিয়াশীল শক্তি-র নয়; এটি নিখাদ স্থিতিশীল সাম্যচেতনা—যেখানে ইচ্ছা, গতি ও পরিবর্তনের সূক্ষ্মতম তরঙ্গও নিস্তব্ধ। তাই একে বলা হয় কৃশা (kṛśā) ও কৃশতনু (kṛśatanu)।
kṛśā (কৃশা)—মানে “অত্যন্ত সূক্ষ্ম”, এমন এক চেতনা যা সমস্ত গতি ও ইচ্ছাকে অতিক্রম করেছে। kṛśatanu (কৃশতনু)—মানে “সূক্ষ্মদেহধারিণী” বা “অতি সূক্ষ্ম রূপধারী”। এটি এমন এক চেতনাবিন্দু, যেখানে আর কোনো কর্মের গতিবেগ নেই—শুধু নিস্পন্দ দীপ্তি।