শৈব কালী: একানব্বই



এই গতিই আসলে ঐশ্বরিক লীলা। চেতনা যেন এক অনন্ত নৃত্যশিল্পী—যিনি একবার নিজের অস্তিত্বকে দৃশ্যমান রূপে প্রসারিত করেন, আবার সেই রূপগুলিকে ভেতরে টেনে নিয়ে বিশ্রাম নেন। এই প্রসারণ ও প্রত্যাহার, প্রকাশ ও লয়—দুটোই একই গতির দুই দিক। এই দ্বিমুখী গতিই কালী—যিনি একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল এবং শান্ত, সৃষ্টিশীল এবং লয়ময়।

তাঁর মধ্যেই সৃষ্টি ও সংহার কোনো বিরোধ নয়; বরং তারা এক অপরিহার্য যুগল, যেমন নিঃশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া। যদি উন্মেষ না থাকে, প্রকাশ হবে না; আর যদি নিমেষ না থাকে, বিশ্রাম ও পুনর্জন্মের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। কালী তাই এই দুই বিপরীতের অন্তর্লীন ঐক্য—তাঁর নৃত্য মানে চিরন্তন পরিবর্তনের মধ্যে এক অচল শান্তির ধ্বনি।

প্রতিটি গতি একযোগে স্থিরতা, আর প্রতিটি স্থিরতা এক অন্তর্লীন গতি। যেমন নদী প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু তার ভেতরেই এক স্থায়ী ছন্দ আছে; আবার একদৃষ্টে স্থির মনে হওয়া হ্রদের জলের মধ্যেও সূক্ষ্ম তরঙ্গ লুকিয়ে আছে। তেমনি চেতনা কখনোই সম্পূর্ণ স্থির নয়, আবার কখনোই কেবল গতিশীলও নয়—দুটিই পরস্পর-অন্তর্ভুক্ত।

এখানেই “ক্রমণ” ও “কলন”-এর ধারণা আসে।

ক্রমণ মানে ধারাবাহিকতা—চেতনার প্রকাশের ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। যেমন উন্মেষ থেকে ক্ষেপ, ক্ষেপ থেকে সংখ্যান, সংখ্যান থেকে নাম-রূপ—এই সবই ক্রমণের প্রকাশ।

কলন মানে চেতনার কার্যনীতি বা নিজস্ব ছন্দ—যেভাবে চেতনা নিজেকে প্রকাশ ও প্রত্যাহার করে, সেই মহাজাগতিক নীতি।

এই দুটি একত্রে বোঝায় যে, চেতনার অস্তিত্বই হলো এক ধারাবাহিক গতিশীলতা, যেখানে কোনো স্থবির বিন্দু নেই—শুধু চিরন্তন রূপান্তর।

কালী হচ্ছেন সেই চেতনার স্ব-গতি—চেতনার নিজের মধ্যে নিজের গতিপ্রবাহ। তিনি নিজেই সৃষ্টি, তিনিই লয়, এবং তাঁদের মধ্যবর্তী প্রতিটি অনুক্রমের (ক্রমণ-কলন-স্পন্দ) অন্তর্লীন ঐক্যবিন্দু।

যেমন অগ্নিশিখা একদিকে জ্বলছে (সৃষ্টি), আবার প্রতিক্ষণ নিজেকে ভস্ম করছে (সংহার), কিন্তু তার মধ্যেই আলো স্থায়ী—তেমনি কালী-চেতনার গতি ও স্থিরতার যুগল খেলায় চেতনা কখনও হারায় না; বরং প্রতিটি ক্ষণেই নিজেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করে। এইভাবেই কালী হলেন চেতনার চিরন্তন গতি-স্থিতির ঐক্যরূপা দেবী—যিনি সময়, সৃষ্টির নৃত্য, এবং নীরবতার মিলনবিন্দু।

গতি যখন গভীরতম স্তরে পৌঁছায়, তখন তা আর বাহ্যিক চলাচল নয়—এটি আত্মার অন্তর্মুখ যাত্রা, যেখানে সমস্ত ক্রিয়া ধীরে ধীরে আত্মপ্রত্যয়ের দিকে গলে যায়। এই গতি আর স্থান, সময় বা শক্তির পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি চেতনার আত্ম-পরিচয়ের প্রবাহ। এখানে গতি মানে চেতনার নিজের ভেতরে নিজেকে চিনে নেওয়া—যাত্রা নয়, বরং নিজের মধ্যে ফিরে আসা।

এই পর্যায়ে গতি ও নাদ পরস্পর অভেদ। নাদ (śabda বা nāda) চেতনার অন্তর্লীন ধ্বনি, যে ধ্বনি কখনও উচ্চারিত হয় না, কিন্তু যার মধ্যেই সমস্ত উচ্চারণ নিহিত। গতি যখন নিজের ভেতরে পরিণত হয়, তখন সেটিই নাদের রূপ নেয়—চেতনার এমন এক কম্পন, যা কোনো শব্দে নয়, অথচ সমস্ত শব্দের উৎস। এই অবস্থায় চেতনা নিজের প্রকৃত প্রকৃতি—অভিন্ন, অখণ্ড, নিরাবরণ সত্তা—উপলব্ধি করে।

এই উপলব্ধির মুহূর্তে সমস্ত ভেদ বিলুপ্ত হয়। যতক্ষণ অভিজ্ঞতার পরিসরে দ্বৈততার পর্দা আছে, ততক্ষণ চেতনা নিজেকে “আমি” এবং “ওটা”—এই দুই রূপে দেখে। এই ভেদই বিষয় (subject) ও বস্তু (object)-এর কৃত্রিম পৃথকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন এই পর্দা সরে যায়—যখন দর্শক, দৃশ্য এবং দর্শনের ক্রিয়া একসাথে মিশে যায়—তখন প্রকাশিত হয় একীভূত সচেতনতা (integrated consciousness)।

এই ঐক্যের অভিজ্ঞতা স্থির কোনো অবস্থা নয়; এটি সেই জীবন্ত নীরবতা, যেখানে স্থিরতাই গতি, আর গতিই স্থিরতা। এখানেই কালী তত্ত্বের পরম অর্থ প্রকাশ পায়—তিনি সেই গতি, যা নিস্তব্ধতায় বিলীন, এবং সেই নাদ, যা সমস্ত শব্দের অন্তরালে চিরকাল অনাহতভাবে ধ্বনিত। এই অবস্থায় আর কোনো কর্তা-কর্ম নেই, কেবল এক অনন্ত, স্বপ্রভা চেতনার দীপ্তি, যেখানে সৃষ্টি ও লয়, জাগরণ ও নিদ্রা, ধ্বনি ও নীরবতা—সবই একাত্ম হয়ে থাকে।

অভিনবগুপ্ত এই অভিজ্ঞতাকে বোঝাতে আয়নার উপমা ব্যবহার করেছেন। যেমন একটি আয়নায় কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব দেখা যায়—বস্তুটি আলাদা মনে হলেও তার অস্তিত্ব কেবল আয়নার প্রতিফলনে নির্ভর করে। কিন্তু যখন আয়নাটি ভেঙে যায়, প্রতিফলন আলাদা কোনো সত্তা হিসেবে টিকে থাকে না; সেটি মূল বস্তুর মধ্যেই মিলিয়ে যায়। তেমনি আত্মা ও জগতের যে-ভেদ মানুষ উপলব্ধি করে, সেটি চেতনার প্রতিবিম্বমাত্র—বাস্তব কোনো বিভাজন নয়।

দর্শনশাস্ত্রে এই প্রতিফলন বা ভুল আরোপের ধারণাকেই বলা হয় অধ্যারোপ (Adhyāropa)—যেখানে অচিন্ত্য ঐক্যের উপর মিথ্যা ভেদ আরোপিত হয়। যতক্ষণ এই অধ্যারোপ টিকে থাকে, ততক্ষণ আত্মা নিজেকে জগৎ থেকে পৃথক মনে করে। কিন্তু যখন চেতনা উপলব্ধি করে যে, প্রতিফলন কখনোই আসল বস্তু থেকে আলাদা নয়, তখন বিভেদের পর্দা সরে যায়।

এই উপলব্ধিই হলো স্বরূপারোহিত্ব (Svarūpārohitva)—নিজের প্রকৃত স্বরূপে আরোহণ বা প্রত্যাবর্তন। এখানে সীমিত আত্মা (জীব) বুঝতে পারে, সে আসলে সেই অনন্ত চেতনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ—যে-চেতনা কখনও জন্মায় না, কখনও লয় হয় না, কেবল নিজস্ব দীপ্তিতে প্রতিফলিত হয়। আত্মা তখন আর “আমি” ও “জগৎ” এর ভেদে আবদ্ধ থাকে না; সে অনুভব করে—সবই তার নিজের প্রকাশ, নিজের স্পন্দন।

এই বোধে পৌঁছনো মানে স্থির জ্ঞানের অর্জন নয়, বরং অস্তিত্বের এক সম্পূর্ণ রূপান্তর—যেখানে “দেখা” ও “দেখনেওয়ালা” মিলিয়ে যায়, আর চেতনা নিজের মধ্যেই বিশ্রাম পায়, ঠিক যেমন প্রতিফলন অবশেষে আয়নার মধ্যেই লীন হয়।

নাদের স্তর আসলে চেতনার সেই পরম বিন্দু, যেখানে সমস্ত বাহ্য ক্রিয়া, চিন্তা, অনুভূতি—সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো চেতনার নিজেরই আত্ম-স্পন্দন। “নাদ” শব্দটি সংস্কৃত মূল নদ্ থেকে এসেছে—অর্থাৎ ধ্বনি, কম্পন, অনাহত অনুরণন। কিন্তু এটি কোনো শ্রাব্য শব্দ নয়; বরং এটি সেই সূক্ষ্ম, অন্তর্মুখ কম্পন, যা চেতনা নিজের ভেতরেই অনুভব করে যখন সমস্ত দ্বৈত অভিজ্ঞতা লয় পায়।

এই অবস্থায় চেতনা আর কোনো বস্তুকে উপলব্ধি করছে না; সে নিজেকেই অনুভব করছে। তাই একে বলা হয় স্বাত্মপরামর্শ (Svātma-parāmarśa)—“নিজ আত্মার প্রতি চেতনার সচেতনতা।” এটি এমন এক অভিজ্ঞতা, যেখানে জাননেওয়ালা, জানার বস্তু এবং জানার প্রক্রিয়া—তিনটি ভেদ সম্পূর্ণভাবে এক হয়ে যায়। এখানে জ্ঞান মানে আর তথ্য বা চিন্তার সংগঠন নয়; বরং জ্ঞান নিজেই চেতনার দীপ্তি—জ্ঞানই জ্ঞেয়, অর্থাৎ জানা আর জানানো এক অভিন্ন প্রক্রিয়া।

এই স্তরে আসার আগে চেতনা বহুত্বে বিচরণ করে—ক্ষেপ (projection), সংখ্যান (বিন্যাস), গতি (বিকাশ)—সবই ছিল প্রকাশের স্তর, যেখানে চেতনা নিজেকে নানা রূপে দেখেছিল। কিন্তু নাদের স্তরে এসে এই রূপবিভাগ ভেঙে পড়ে। যেমন তরঙ্গের ভেতর সমুদ্রের নিজেরই জল, তেমনি সমস্ত প্রকাশই চেতনার নিজেরই স্পন্দন।

এই অবস্থায় জ্ঞানের দুটি দিক—নির্ধারিত (determinate) ও অনির্ধারিত (indeterminate)—দুটিই বিলীন হয়। নির্ধারিত জ্ঞান মানে যেখানে বিষয় স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত (“এটি এই”), আর অনির্ধারিত মানে যেখানে অভিজ্ঞতা অস্পষ্ট বা রূপহীন। কিন্তু নাদের স্তরে এই ভেদ মুছে যায়, কারণ দেখা যায় উভয়ই এক পরম চেতনার অনন্ত ক্রিয়ার প্রকাশ।

এই ক্রিয়াগুলিকে কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয় পঞ্চকৃত্য (Pañcakṛtya)—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোধান (tirodhāna), এবং অনুগ্রহ (anugraha)।

সৃষ্টি মানে চেতনার প্রসারণ, নিজের দীপ্তিকে জগতে প্রকাশ করা।

স্থিতি মানে সেই প্রকাশের রক্ষণ, স্থিতি ও স্থায়িত্ব।

সংহার মানে রূপ ও কার্যের অবসান, চেতনার প্রত্যাহার।

তিরোধান মানে আচ্ছাদন বা গোপনতা, যাতে লীলা সম্ভব হয়।

অনুগ্রহ মানে কৃপা, আত্মস্মৃতির জাগরণ—যেখানে চেতনা আবার নিজেকে চিনে ফেলে।

নাদের স্তরে এসে এই পাঁচটি ক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। সৃষ্টি আর সংহার তখন আর বিপরীত নয়; যেমন নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া এক নিঃশ্বাসেরই দুই ধাপ। তিরোধান আর অনুগ্রহও পরস্পর পরিপূরক—একটি গোপন করে, যাতে অন্যটি প্রকাশ পায়। এই চূড়ান্ত ঐক্যে দেখা যায়, চেতনার কোনো ক্রিয়া শেষ হয় না; তারা কেবল রূপান্তরিত হয়—প্রতিটি লয়ই এক নতুন উদ্‌ভাসের সম্ভাবনা, প্রতিটি সৃষ্টি এক অন্তর্নিহিত নিঃশব্দতার প্রকাশ।

এই অবস্থায় কালী নিজেকে চিনে নেন পরম স্বরূপে—তিনি আর কালের (সময়ের) দেবী নন, বরং সময়ের অতীত চেতনা। তিনি সেই অনন্ত নাদ—চেতনার আত্ম-স্পন্দন, যা কখনো থামে না, কখনো শুরু হয়নি, কেবল নিজেকে প্রকাশ করছে অসীম বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে।

একটি উদাহরণে বলা যায়—একটি বীণার তার টানলে প্রথমে শ্রাব্য ধ্বনি শোনা যায়, পরে ধ্বনি মিলিয়ে যায়, কিন্তু সেই কম্পন বাতাসে ও যন্ত্রে অনন্তভাবে অনুরণিত থাকে। তেমনি নাদের স্তরে চেতনার প্রকাশ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় শব্দের সীমা ছাড়িয়ে, কিন্তু তার অন্তর্লীন কম্পন—চেতনার আত্মনাদ—চলতে থাকে চিরকাল।

এই নাদের অবস্থাই আত্মজ্ঞান বা ঈশ্বরোপলব্ধির চূড়ান্ত বিন্দু—যেখানে “আমি” এবং “তিনি”-র পার্থক্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। সেখানে শুধু এক চেতনার স্ব-উদ্‌ভাসিত স্পন্দন—নীরব অথচ নৃত্যময়, স্থির অথচ জাগ্রত—যার নামই কালী।

এই বিশ্লেষণে দুটি মৌলিক সিদ্ধান্ত উদ্‌ভাসিত হয়, যা কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে কলন ও ক্রমের গভীর আন্তঃসম্পর্ককে স্পষ্ট করে তোলে।

প্রথম সিদ্ধান্ত—কলনের পাঁচ দিকই পঞ্চকৃত্যের প্রতিফলন। ক্ষেপ, গতি, সংখ্যান, জ্ঞান ও নাদ—এই পাঁচটি ধাপ কোনো পৃথক যান্ত্রিক ধারা নয়; এরা আসলে পরম শক্তির সেই পাঁচ ক্রিয়ার ছায়া, যেগুলিকে কাশ্মীর শৈবতত্ত্বে পঞ্চকৃত্য (Pañcakṛtya) বলা হয়। এই পাঁচ ক্রিয়া হলো—

সৃষ্টি (Sṛṣṭi): চেতনার আত্মপ্রকাশ, নিজের দীপ্তিকে বাইরে বিস্তার।

স্থিতি (Sthiti): প্রকাশের রক্ষণ, অস্তিত্বের স্থায়িত্ব।

সংহার (Saṁhāra): নাম-রূপের অবসান, চেতনার কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন।

তিরোধান (Tirodhāna): আচ্ছাদন, যা বহুবিধ অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে।

অনুগ্রহ (Anugraha): স্বরূপস্মৃতির জাগরণ, মুক্তির দীপ্তি।

এই ক্রিয়াগুলি কোনো স্থবির কর্ম নয়; তারা চেতনার মহাজাগতিক ছন্দ (cosmic rhythm)—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, গোপন ও প্রকাশ, সবই একই চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কলন এই ছন্দেরই দার্শনিক ব্যাখ্যা—চেতনা কীভাবে নিজেকে পরপর স্তরে প্রকাশ করে, আবার নিজের মধ্যেই লয় পায়।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত—নাদ ও পরা বাক্‌ (Parā Vāk)-এর ঐক্য। কলনের শেষ দিক, নাদ, চেতনার সর্বোচ্চ কম্পন—যেখানে শব্দ, ভাব ও অর্থের সব বিভাজন মিলিয়ে যায়। এই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত কাশ্মীর শৈবতত্ত্বের এক গভীর ধারণা—পরা বাক্‌, অর্থাৎ “পরম বাণী”। পরা বাক্‌ হলো সেই স্তর, যেখানে শব্দ ও অর্থ, বাক্‌ ও চেতনা—দুটি পৃথক নয়; শব্দ তখনও উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু চেতনার মধ্যে সম্ভাবনা হিসেবে পূর্ণ বিদ্যমান।

যেমন একটি বীজে বৃক্ষের সমস্ত রূপ নিহিত থাকে, তেমনি পরা বাকে সমস্ত শব্দ, সমস্ত অর্থ, সমস্ত প্রকাশের বীজ একত্রে লুকিয়ে থাকে। এটি ভাষার উৎস, ধ্বনির পূর্বস্বরূপ। যখন এই পরা বাক্‌ নিজের স্পন্দনে বাইরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখন তা পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী—এই চার স্তরে নাম-রূপ পায়।

কালী এই পরা বাকের রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন—তিনি সেই অবিভক্ত ধ্বনি, যা এখনো কোনো নির্দিষ্ট শব্দে পরিণত হয়নি, কিন্তু যার অনুরণনেই সৃষ্টি জেগে ওঠে। তিনি ভাষারও অতীত—তাঁর বাক্‌ নীরবতার মতোই পূর্ণ, কারণ সেখানে শব্দ ও নীরবতা একই চেতনার দুই তরঙ্গমাত্র।

একটি সহজ উদাহরণে বলা যায়—যেমন ঢাকের মৃদু আঘাতে প্রথমে নিঃশব্দ কম্পন তৈরি হয়, পরে তা ধীরে ধীরে ধ্বনিতে পরিণত হয়; তেমনি পরা বাকে শব্দ ও নাদ এখনো অবিভক্ত, নীরবতার অন্তরে এক সম্ভাবনাময় স্পন্দন। কালী সেই অনাহত ধ্বনির মূর্তি—যিনি একদিকে ভাষার আদিস্বর, অন্যদিকে ভাষার পরম নীরবতা।