অহংকার চেতনার অসীম দীপ্তিকে সংকুচিত করে একটি ক্ষুদ্র “আমি”-র বোধ সৃষ্টি করে। সেই “আমি” মনে করে, সে আলাদা, পৃথক এবং স্বাধীন সত্তা—ফলে অনন্ত চেতনার প্রবাহ ভেঙে যায় সীমাবদ্ধ আত্মপরিচয়ে। মমতা ও আসক্তি সেই সংকোচকে আরও দৃঢ় করে, মানুষ তখন বস্তু, সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতাকে নিজের বলে আঁকড়ে ধরে। লোভ সেই আসক্তিকে তীব্র করে তোলে, আর ক্রোধ সেই লোভের প্রতিক্রিয়া—যখন চাওয়া পূরণ হয় না, তখন মন দহন হতে থাকে। ঈর্ষা অন্যের সুখে নিজের সংকীর্ণতা অনুভব করায়, আর ভয় সেই সংকীর্ণতারই বিপরীত ছায়া—যেখানে মন সর্বদা ক্ষতির আশঙ্কায় কাঁপে।
মোহ ও মায়া মনের দৃষ্টিকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়, ফলে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বোঝা যায় না। কাম ও তৃষ্ণা মনকে সর্বদা বহির্মুখ করে রাখে; মন তখন ভাবতে শেখে না, শুধু চাওয়া ও ভোগে লিপ্ত থাকে। দম্ভ, মদ, অভিমান ও ক্লেশ এই অহংকারের বাহ্যিক রূপ—দম্ভে আসে আত্মগরিমা, মদে (মত্ততা) আসে আত্মবিস্মৃতি, অভিমানে জন্ম নেয় কষ্ট, আর ক্লেশে মন ক্রমাগত অসন্তোষে জর্জরিত থাকে।
এই সমস্ত প্রবণতা একত্রে মনের প্রাকৃতিক প্রতিফলনশক্তিকে বিকৃত করে ফেলে। মন তখন আর চেতনার আয়না নয়, বরং এক কুণ্ঠিত পর্দা—যেখানে আলো পড়ে বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। চেতনার সীমাহীন দীপ্তি তখন আবৃত হয়ে যায়, মন ক্রমাগত দোলায়মান থাকে সুখ-দুঃখ, আশা-ভয়, রাগ-প্রেমের চক্রে। তাই যোগ ও বেদান্ত উভয়েই বলেছেন, এই বিকৃতিগুলোই “আবরণ”—যতক্ষণ পর্যন্ত মন এদের দ্বারা আচ্ছন্ন, ততক্ষণ আত্মার সত্য প্রতিফলন সম্ভব নয়।
যখন মানুষ আত্মবোধ, ধ্যান, মন্ত্রচর্চা বা অন্তর্দৃষ্টির আলোয় এই বিকৃতিগুলিকে চিনতে শুরু করে, তখন তারা ধীরে ধীরে মুছে যায়। মন আবার তার প্রাকৃতিক নির্মলতায় ফিরে আসে—যেখানে অহংকারের বদলে বিনয়, রাগের বদলে করুণা, লোভের বদলে তৃপ্তি, আর ভয়ের বদলে প্রশান্তি জেগে ওঠে। তখন চেতনা আবার নিজের দীপ্তিতে প্রতিফলিত হয়, এবং মানুষ উপলব্ধি করে যে, এসব দোষ, বিকার ও ক্লেশ কখনও স্থায়ী ছিল না—এগুলো ছিল কেবল আত্মবিস্মৃতির ছায়া। নিজেকে চিনে নেওয়া মানেই এই ছায়াগুলোর অপসারণ, আর সেই স্বচ্ছ অবস্থাই প্রকৃত মুক্তি।
দ্বিতীয় স্তরে যে-বিকৃতির কথা বলা হয়েছে, তা হলো প্রাণিক বিকৃতি—অর্থাৎ জীবনীশক্তির বা প্রাণশক্তির দোষ। চেতনার এক স্তর নিচে, প্রাণই হলো সেই সূক্ষ্ম সেতু, যা মন ও শরীরকে সংযুক্ত রাখে। যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে, “প্রাণশক্তিই জীবনের গতিশক্তি”—এটি সেই অদৃশ্য প্রবাহ, যা আমাদের শ্বাস, হৃৎস্পন্দন, স্নায়ুপ্রবাহ, অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়ের প্রতিক্রিয়া সব কিছুর মধ্যে ক্রিয়াশীল। যখন এই প্রাণশক্তি সুষম থাকে, তখন দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় নিখুঁতভাবে সমন্বিত হয়; কিন্তু যখন প্রাণের প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে, তখনই নানা রকম বিকৃতি জন্ম নেয়।
এই বিকৃতিগুলির মধ্যে প্রথমেই দেখা যায় উদ্দীপনা ও ক্লান্তির দোলাচল। কখনো প্রাণ অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে—মন অস্থির, শরীর অতি উত্তেজিত; আবার কখনো প্রাণশক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়ে—ক্লান্তি, অনুৎসাহ, নিস্পৃহতা দেখা দেয়। এই দুই বিপরীত অবস্থাই প্রাণের অসম প্রবাহের ফল। যোগে বলা হয়, প্রাণবিকলতা বা প্রাণদৌর্বল্য—যেখানে শ্বাসের ছন্দ ভেঙে যায়, ফলে দেহ ও মন একে অপরের সঙ্গে তাল হারিয়ে ফেলে।
এরপর আসে অলসতা ও অতিসক্রিয়তা—একদিকে জড়তা, অন্যদিকে অযথা তৎপরতা। অলসতা প্রাণের স্থবিরতা, আর অতিসক্রিয়তা তার বিশৃঙ্খল গতি। এই দুটি অবস্থা প্রাণকে ভারসাম্যহীন করে তোলে; শরীর কখনো অতিরিক্ত নিদ্রালু, আবার কখনো অকারণে উত্তেজিত থাকে।
আকাঙ্ক্ষা ও অস্থিরতা প্রাণিক স্তরে সেই অতিরিক্ত কম্পনের প্রতীক, যেখানে প্রাণ ক্রমাগত কিছু-না-কিছু চায়। শরীর তখন স্থির থাকতে পারে না, মনও স্থিতি পায় না। এটি কামনা ও তৃষ্ণার সূক্ষ্ম শক্তির রূপ, যা ক্রমে মানসিক বিকৃতিতেও রূপ নেয়।
সংবেদনশীলতার অতিরিক্ততা বা অভাব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণদোষ। যখন ইন্দ্রিয়ের সংবেদনশীলতা বেশি হয়, তখন সামান্য স্পর্শ, শব্দ বা অনুভূতিও মনের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—এই অবস্থায় মানুষ সহজেই উত্তেজিত বা বিভ্রান্ত হয়। আবার, সংবেদনশীলতার অভাব হলে মন উদাসীন হয়ে পড়ে—অনুভূতি ম্লান, প্রতিক্রিয়া বিলম্বিত। এই দুই প্রান্তই প্রাণপ্রবাহের বিকৃতি।
এর সঙ্গে যুক্ত আছে ইন্দ্রিয়বিকার—যেখানে ইন্দ্রিয়গুলি তাদের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। চোখ অতিরিক্ত আলো বা অন্ধকারে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারে না, কান অনর্থক শব্দে অস্থির হয়, স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্পর্শের প্রতিক্রিয়াও বিকৃত হয়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ বাইরের প্রভাবের দাস হয়ে পড়ে, তার ইন্দ্রিয়শক্তি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারায়।
সবশেষে, প্রাণ-অসামঞ্জস্য বা prāṇa-asāmya হলো এই সমস্ত দোষের কেন্দ্রীয় কারণ। প্রাণের পাঁচ প্রধান রূপ—প্রাণ, আপান, উদান, সমান ও ব্যান—যখন একে অপরের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না, তখন সারাদেহের ভেতরে শক্তির প্রবাহে অমিল দেখা দেয়। শ্বাসের ছন্দ ভেঙে যায়, হৃৎপিণ্ডের গতি অস্থির হয়, মনের শান্তি নষ্ট হয়। যোগদর্শন বলে—যেখানে প্রাণবায়ু অস্থির, সেখানে মনও অস্থির; আর যেখানে প্রাণবায়ু স্থির, সেখানে মন স্বতঃশান্ত।
এই সমস্ত প্রাণিক বিকৃতি প্রায়শই দেহ ও মনের সংযোগে বিভ্রাট ঘটায়। দেহ তখন কিছু করতে চায় না, মন কিছু ভাবতে পারে না, আর ইন্দ্রিয়গুলি প্রায়শই বিকৃত প্রতিক্রিয়া দেয়। ফলস্বরূপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রাকৃতিক গতি পরিবর্তিত হয়, নাড়ির ছন্দে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনিয়মিত হয়। ইন্দ্রিয়ের প্রতিক্রিয়াও অতি সূক্ষ্ম বা অতি স্থূল হয়ে পড়ে—কখনো সামান্য উদ্দীপনায় প্রবল প্রতিক্রিয়া, আবার কখনও তীব্র উদ্দীপনায়ও কোনো সাড়া নেই।
এই অবস্থাকে তন্ত্র ও যোগ উভয়ই প্রাণের অমিল বলে—যেখানে জীবনীশক্তি তার প্রাকৃতিক সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলে। তাই ধ্যান, প্রাণায়াম, নাড়ীশোধন ইত্যাদি যোগপদ্ধতির উদ্দেশ্য হলো এই প্রাণপ্রবাহকে পুনরায় সামঞ্জস্যে আনা। যখন শ্বাস আবার ছন্দে ফিরে আসে, তখন প্রাণ শান্ত হয়; প্রাণ শান্ত হলে মনও স্থির হয়; আর মন স্থির হলে চেতনা নিজের দীপ্তিতে জেগে ওঠে।
প্রাণিক বিকৃতি কোনো রোগমাত্র নয়—এটি আসলে জীবনের অভ্যন্তরীণ ছন্দভঙ্গ। চেতনা যখন নিজের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন প্রাণ তার সুর হারায়; আর যখন আত্মস্মরণ ঘটে, তখন প্রাণের প্রতিটি স্পন্দন আবার সেই আদ্য চেতনার ছন্দে ফিরে আসে—যেখানে জীবন ও চেতনা একাকার হয়ে যায়।
তৃতীয় স্তর হলো চৈতন্য বিকৃতি—অর্থাৎ বৌদ্ধিক ও আত্মিক দোষ। এগুলি মানুষের অস্তিত্বের সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্তরে কাজ করে, যেখানে “আমি আছি”, এই মৌলিক চেতনা নিজেকে জানে, কিন্তু নিজের প্রকৃত স্বরূপকে সঠিকভাবে চেনে না। এই বিকৃতি মন বা প্রাণের স্তরে নয়; এগুলি জ্ঞান বা বোধের স্তরে, যেখানে আত্মা নিজেরই দীপ্তি ভুলে গিয়ে সীমিত ব্যক্তিসত্তায় পরিণত হয়।
যোগদর্শন, বেদান্ত ও তন্ত্র—সব দর্শনেই বলা হয়েছে, এই স্তরের মূল দোষ হলো অবিদ্যা, অর্থাৎ আত্মবিস্মৃতি। অবিদ্যা মানে জ্ঞানের অভাব নয়, বরং সত্যের বিকৃত উপলব্ধি—যেখানে মানুষ অস্থায়ীকে স্থায়ী, সীমিতকে অসীম, দেহকে আত্মা, ও বহির্জগতকে চেতনার বাইরে মনে করে। এই বিভ্রান্তিই সব চৈতন্য বিকৃতির মূল।
অবিদ্যা থেকে জন্ম নেয় অবিবেক, অর্থাৎ সত্য ও অসত্যের পার্থক্য করার অক্ষমতা। বুদ্ধি তখন বিচারের শক্তি হারায়—যা নিত্য ও অনিত্য, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ, আত্মা ও অনাত্মার মধ্যে ভেদ করতে পারে না। এই অবস্থায় মানুষ জগতের ভোগ্যবস্তুকে চরম লক্ষ্য মনে করে, অথচ নিজের চেতনার উৎসকে উপেক্ষা করে।
এরপর আসে অস্মিতা, অর্থাৎ অহংকারের সূক্ষ্মতম রূপ—যেখানে “আমি”র বোধ আত্মার সঙ্গে একীভূত না হয়ে সীমিত সত্তায় পরিণত হয়। এটি একধরনের আত্মপরিচয়ের সংকোচন—অসীম চেতনা নিজেকে বলে, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”, “আমি ভাবনাকারী”। এই মিথ্যা আত্মবোধ থেকেই সৃষ্টি হয় দ্বৈততার বোধ—“আমি” ও “অন্য”, “ভেতর” ও “বাহির”, “সুখ” ও “দুঃখ”—এগুলো আসলে অস্মিতারই ছায়া।
অস্মিতা থেকেই জন্ম নেয় রাগ ও দ্বেষ। যখন মন কোনো বস্তু বা অভিজ্ঞতায় আনন্দ অনুভব করে, তখন সেটিকে আঁকড়ে ধরে—এটাই রাগ; আর যখন কোনো কষ্টদায়ক জিনিসের সঙ্গে সংস্পর্শে আসে, তখন সেটিকে দূরে ঠেলতে চায়—এটাই দ্বেষ। এই দুই শক্তি চেতনার স্থিতি নষ্ট করে, কারণ রাগে মানুষ ভবিষ্যতের প্রতি আসক্ত, আর দ্বেষে অতীতের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল। ফলে বর্তমানের চেতনা অস্থির হয়ে পড়ে।
অবিদ্যা, অবিবেক, অস্মিতা, রাগ ও দ্বেষ—এই পাঁচটি ক্লেশ বা মানসিক-আধ্যাত্মিক দোষ পতঞ্জলি যোগদর্শনে “পঞ্চক্লেশ” নামে পরিচিত। এগুলি মানুষের অন্তরস্থিত মূল অস্থিরতার কারণ, যেগুলির ফলেই পরে আরও সূক্ষ্ম ও জটিল বিকৃতির জন্ম হয়। এখন এই পাঁচটি ক্লেশ ও তাদের শাখা বিকৃতিগুলো পরপর ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রথমত, অবিদ্যা—এটি হলো মূল অন্ধকার, যেখানে মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপকে ভুলে যায়। অবিদ্যা মানে কেবল জ্ঞানের অভাব নয়, বরং সত্যের বিকৃত উপলব্ধি। এখানে অনিত্যকে নিত্য বলে মনে হয়, অশুচিকে শুচি বলে ধরা হয়, দুঃখকে সুখ হিসেবে ভাবা হয়, আর অনাত্মাকে আত্মা বলে ভুল করা হয়। এই অবিদ্যার থেকেই সব বিভ্রান্তি ও বন্ধনের সূত্রপাত। এটি চেতনার অন্তর্নিহিত আলোয় পর্দা টেনে দেয়, ফলে মানুষ জগৎকে “বাহ্যিক” ও “অন্য” বলে অনুভব করে।
দ্বিতীয়ত, অবিবেক—অবিদ্যারই একটি পরিণত রূপ, যেখানে মানুষ সত্য ও মিথ্যা, চিরন্তন ও ক্ষণস্থায়ীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বুদ্ধির যে স্বাভাবিক বিচারের ক্ষমতা আছে, তা আবেগ ও অহংকারে ঢেকে যায়। ফলে মানুষ ক্ষণিক সুখের পেছনে দৌড়ায়, আর সত্য শান্তিকে উপেক্ষা করে। অবিবেক মনকে ভ্রান্ত পথে চালিত করে, কারণ সেটি সবসময় অবিদ্যার দ্বারা নির্দেশিত হয়।
তৃতীয়ত, অস্মিতা—অর্থাৎ “আমি”র বোধ। এটি অহংকারের সূক্ষ্মতম রূপ। এখানে আত্মা নিজেকে চেতনা হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অনুভব করে। “আমি দেহ”, “আমি চিন্তা করি”, “আমি অনুভব করি”—এমন সব ধারণাই অস্মিতার প্রকাশ। এতে চেতনার অসীম দীপ্তি সংকুচিত হয়ে এক ক্ষুদ্র “আমি”-র কেন্দ্রে বন্দি হয়। এই ক্ষুদ্রতা থেকেই জন্ম নেয় আত্মরক্ষা, প্রতিযোগিতা, ভয় ও আকাঙ্ক্ষা।
চতুর্থত, রাগ—এটি সেই আকর্ষণশক্তি, যা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার প্রতি মনকে বেঁধে রাখে। রাগ মানে কেবল প্রেম নয়, বরং কোনো সুখকর অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা। যখন চেতনা বহির্জগতের কোনো বস্তু বা সম্পর্কের মধ্যে সুখ খোঁজে, তখন রাগ তাকে সেই বস্তুর দাসে পরিণত করে। ফলে মন আর স্বাধীন থাকে না, বরং চাওয়া-পাওয়ার দোলায় দুলতে থাকে।
পঞ্চমত, দ্বেষ—এটি রাগের বিপরীত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একই শিকড় থেকে উৎপন্ন। যে-জিনিস মানুষকে কষ্ট দেয় বা অপ্রীতিকর মনে হয়, তার প্রতি তীব্র বিরাগ জন্মায়—এই বিরাগই দ্বেষ। রাগ মানুষকে আকর্ষণে বেঁধে রাখে, দ্বেষ তাকে প্রতিক্রিয়ায় বন্দি করে। একে অপরের ছায়া তারা; যেখানে রাগ আছে, সেখানেই কোনো-না-কোনো দ্বেষ লুকিয়ে থাকে।
এই পঞ্চক্লেশ—অবিদ্যা, অবিবেক, অস্মিতা, রাগ ও দ্বেষ—মিলিতভাবে মানুষের চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের ফলেই জন্ম নেয় আরও সূক্ষ্ম বিকৃতি—
মিথ্যাজ্ঞান হলো সেই বিকৃতি, যেখানে ভুল ধারণাকে সত্য বলে মনে হয়। যেমন, রজ্জু (দড়ি)-কে সাপ মনে করা, বা দেহকেই আত্মা ভাবা। এটি অবিদ্যারই প্রতিফলন।
ভ্রম হলো চেতনার বিভ্রান্ত প্রত্যয়, যেখানে মন বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে উপলব্ধি করে। এটি একপ্রকার চৈতন্য-অস্বচ্ছতা—চেতনা নিজের প্রতিফলনকে সত্য বলে ধরে ফেলে।
আসক্তি হলো বন্ধন। এটি রাগের ঘন রূপ, যেখানে মন কোনো অনুভূতি, বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে, বিচ্ছিন্ন হওয়া কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। এই বন্ধনই কর্মফলের চক্রকে ঘুরিয়ে রাখে।