শৈব কালী: ছেষট্টি



এই দৃষ্টিতে, “শব্দব্রহ্ম” কোনো ধর্মীয় ধারণা নয়, বরং এক সর্বজনীন ভাষাতাত্ত্বিক ও চেতনতাত্ত্বিক সত্য—যেখানে শব্দ, অর্থ, এবং সত্তা এক অভিন্ন সত্তায় গলে যায়, যেমন নদী সমুদ্রে মিলিত হয়, এবং তার ধ্বনিতরঙ্গে সমগ্র অস্তিত্ব একসঙ্গে বলে ওঠে—“শব্দোহম্‌ ব্রহ্মাহম্‌।”

বেদান্ত মতে, শব্দব্রহ্ম তিন স্তরে প্রকাশিত—নাদ, বিন্দু ও বীজ। নাদ মানে চেতনার স্পন্দন, বিন্দু মানে সেই স্পন্দনের কেন্দ্রীভবন, আর বীজ মানে সমস্ত সম্ভাবনার বীজরূপ—যেখান থেকে রূপ, শব্দ ও ভাবের উদ্ভব। আধুনিক কগনিটিভ বিজ্ঞানও বলছে, চিন্তা, ভাষা ও চেতনা একে অপরের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কিত; তাই শব্দব্রহ্ম কোনো পুরোনো তত্ত্ব নয়, এটি চেতনা-বিজ্ঞানের চিরন্তন ভিত্তি।

শব্দব্রহ্ম দর্শন কেবল আধ্যাত্মিক নয়, এটি মনোবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব ও অস্তিত্ববিজ্ঞানের মিলনবিন্দু। এটি বলে, শব্দ কেবল উচ্চারণ নয়—এটি চেতনার কম্পন, যা ব্রহ্মের মতোই শাশ্বত, সৃষ্টিশীল ও মুক্তিদায়িনী। শব্দব্রহ্ম তাই শেষপর্যন্ত এক উপলব্ধি—যেখানে আমরা শুনতে পাই, সমস্ত অস্তিত্বের গভীরে একই অনন্ত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—“ওঁ”—যা সব শব্দের উৎস, সব চেতনার একমাত্র স্পন্দন।

শব্দব্রহ্ম ও মায়াব্রহ্ম—এই দুই ধারণা ভারতীয় দার্শনিক চিন্তার দুই ভিন্ন অথচ আন্তঃসম্পর্কিত স্তর। উভয়ই “ব্রহ্ম” বা পরম চেতনার ব্যাখ্যা, কিন্তু তাদের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। শব্দব্রহ্ম হলো চেতনার প্রকাশমান দিক, আর মায়াব্রহ্ম হলো চেতনার আবৃত বা বিভ্রান্ত দিক। একদিকে শব্দব্রহ্ম ব্রহ্মের স্পন্দন, নাদ বা শব্দরূপে আত্মপ্রকাশ; অন্যদিকে মায়াব্রহ্ম সেই ব্রহ্ম, যিনি মায়ার আচ্ছাদনে নিজেকে সীমিত রূপে প্রকাশ করেছেন।

শব্দব্রহ্মের ধারণা মূলত বেদ ও উপনিষদের ভাবনা থেকে উদ্ভূত। ঋগ্‌বেদে বলা হয়েছে “বাক্‌দেবী” বা বাক্‌শক্তি সৃষ্টির উৎস। “শব্দব্রহ্মণি নিঃশ্বাসিতা বেদাঃ”—"শব্দব্রহ্মের (পরম সত্তার শব্দময় রূপ) নিঃশ্বাসই হলো বেদসমূহ।" এখানে শব্দ মানে কেবল উচ্চারিত ধ্বনি নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত কম্পন, সেই আদিস্পন্দন, যা থেকে ধ্বনি, রূপ ও ভাবের জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। শব্দব্রহ্ম হলো তাই চেতনার সক্রিয় প্রকাশ, যেখানে শুদ্ধ ব্রহ্ম নিজেরই দীপ্তিকে ধ্বনি ও ভাবের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে, মায়াব্রহ্মের ধারণা অদ্বৈত বেদান্তে। শঙ্করাচার্য মায়াকে বলেছেন “অনির্বচনীয়া অবিদ্যা”—যা না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব। মায়াব্রহ্ম মানে সেই ব্রহ্ম, যিনি মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে সগুণ ঈশ্বররূপে প্রকাশিত হন। এখানে ব্রহ্ম তাঁর নিজস্ব নির্বিকার অবস্থায় নেই; তিনি জগৎ ও জীবরূপে বহুরূপ ধারণ করেছেন। মায়াব্রহ্ম হলো তাই চেতনার আচ্ছন্ন অবস্থা—যেখানে একত্বের মধ্যে বহু প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

তত্ত্বগতভাবে, শব্দব্রহ্ম চেতনার প্রকাশশক্তি বা বিমর্শশক্তির প্রতীক, আর মায়াব্রহ্ম হলো চেতনার আবরণশক্তির প্রতীক। শব্দব্রহ্মে চেতনা নিজের মধ্যেই কম্পিত হয়ে ধ্বনি, রূপ ও অর্থ সৃষ্টি করে; মায়াব্রহ্মে সেই চেতনা নিজের দীপ্তিকে ঢেকে ভুলে যায়, ফলে জগৎ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। একদিকে শব্দব্রহ্ম চেতনার স্বরূপে উন্মুক্ত, অন্যদিকে মায়াব্রহ্ম সেই চেতনার ছায়ারূপে আবৃত।

এই দুই তত্ত্বের পার্থক্য বোঝা যায় তাদের অভিমুখে। শব্দব্রহ্ম হলো বহির্মুখ প্রবাহ—ব্রহ্মের স্বপ্রকাশ; চেতনা ধ্বনি ও কম্পনের মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বরূপে বিস্তার করে। মায়াব্রহ্ম হলো অন্তর্মুখ আচ্ছাদন—চেতনার নিজ দীপ্তি ভুলে যাওয়া, যেখানে অদ্বৈত চেতনা দ্বৈতের বিভ্রমে আটকে যায়। তাই বলা যায়, শব্দব্রহ্ম হলো অদ্বৈতের প্রকাশ, আর মায়াব্রহ্ম হলো অদ্বৈতের বিভ্রম।

বেদান্তে মায়াকে বলা হয়েছে দুই রূপে—আবরণশক্তি ও বিক্ষেপশক্তি। আবরণশক্তি সত্যকে আড়াল করে, বিক্ষেপশক্তি মিথ্যা প্রতিভাস সৃষ্টি করে। শব্দব্রহ্মেও এই দুই স্তর দেখা যায়—বীজনাদ ও বৈখরী। বীজনাদ হলো চেতনার অন্তর্গত স্পন্দন, যা এখনও প্রকাশিত নয়; বৈখরী হলো বহির্প্রকাশিত শব্দ। এভাবে দেখা যায়, মায়া ও শব্দ একই চেতনার দুই দিক—একটি আচ্ছাদন, অন্যটি প্রকাশ।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মায়াব্রহ্ম হলো অবচেতনের ঘনত্ব, যেখানে চেতনা নিজের প্রকৃত দীপ্তি উপলব্ধি করতে পারে না। এটি সেই মনস্তত্ত্ব, যেখানে মানুষ “আমি” ও “আমার” ধারণায় আবদ্ধ। শব্দব্রহ্ম হলো সেই স্তর, যেখানে মন নিজের মধ্যকার স্পন্দন শুনতে শেখে—ধ্বনির মধ্য দিয়ে চেতনা নিজের নীরব উৎসকে উপলব্ধি করে। ইউং-এর ভাষায় এটি আত্মার আদি-রূপের অনুরণন—যেখানে মানুষ নিজের অন্তর্গত ব্রহ্মস্বরূপে জাগ্রত হয়। আধুনিক নিউরোসায়েন্সও বলছে, মন্ত্র বা শব্দের পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্কের তরঙ্গরীতি পরিবর্তন করে চেতনার প্রশান্তি আনে; এটি মায়ার অন্ধকার ভেদ করে চেতনার জাগরণ ঘটায়।

দর্শনের দিক থেকে, মায়াব্রহ্ম ও শব্দব্রহ্ম—দুই-ই ব্রহ্মের দুই অবস্থা। মায়াব্রহ্ম হলো চেতনার ঘুমন্ত সম্ভাবনা—যেখানে ব্রহ্ম স্বপ্নে বিভোর, বিভ্রমে আচ্ছন্ন। শব্দব্রহ্ম হলো সেই চেতনার জাগ্রত গতি—যেখানে ব্রহ্ম নিজের অস্তিত্বে স্পন্দিত, সক্রিয়, সৃষ্টিশীল। একদিকে মায়া ব্রহ্মকে আচ্ছাদিত করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, অন্যদিকে শব্দ সেই আচ্ছাদন ছিঁড়ে ব্রহ্মের দীপ্তিকে প্রকাশ করে।

শেষপর্যন্ত, যখন মায়া বিলীন হয়, তখন মায়াব্রহ্মও মিলিয়ে যায়; তখন কেবল শব্দব্রহ্মের অনাহত ধ্বনি শোনা যায়—যে-ধ্বনি সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়েরও অতীত। আর যখন সেই ধ্বনিও নিস্তব্ধ হয়, তখন প্রকাশ পায় পরব্রহ্ম—অচিন্ত্য, নির্গুণ, নিস্তরঙ্গ চেতনা। তাই বলা যায়, মায়াব্রহ্ম হলো ব্রহ্মের আবৃত রূপ, শব্দব্রহ্ম হলো তাঁর প্রকাশিত রূপ—দুটোই এক সত্যের দুই দিক, যেমন নীরবতা ও ধ্বনি, ছায়া ও আলো, শূন্যতা ও পরিপূর্ণতা।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় মূলাধার মানুষের মৌলিক নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির কেন্দ্র। এখানেই জমে থাকে জীবনের প্রাথমিক ভয়—বাঁচা, থাকা, টিকে থাকা। কেউ যদি নিজের জীবন বা শরীর সম্পর্কে অতিরিক্ত আতঙ্ক বা অবিশ্বাস অনুভব করে, তা বোঝায়, মূলাধার চক্র অস্থিতিশীল। আবার যিনি নিজের শরীর, পরিবার, পরিবেশের সঙ্গে গভীর সংযোগে থাকেন, তাঁর মূলাধার স্থিত। তাই যোগ বা তন্ত্রে বলা হয়—মূলাধার সুষম থাকা মানে মানুষ “গ্রাউন্ডেড”, বাস্তবের মাটিতে স্থির থেকেও অন্তরে শান্ত ও সচেতন।

অদ্বৈত ও কাশ্মীর শৈব দর্শনের আলোকে, মূলাধার কেবল শরীরের কোনো কেন্দ্র নয়, এটি চেতনার ঘনতম বিন্দু, যেখানে অসীম ব্রহ্ম নিজেকে সীমাবদ্ধ দেহচেতনায় স্থাপন করে। এখানে পরম চেতনা “আমি দেহ” অভিজ্ঞতার আকারে নিজেকে প্রকাশ করে। কুণ্ডলিনীর উত্থান শুরু হয় এই বিন্দু থেকেই—যখন চেতনা ধীরে ধীরে নিজের এই ঘনত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সূক্ষ্ম ও বিশুদ্ধ স্তরে উত্তীর্ণ হয়।

এইভাবে মূলাধার হলো আত্মজাগরণের প্রথম সোপান, শক্তির নিদ্রিত আধার এবং চেতনার জীবনীশক্তির মূল কেন্দ্র। এখান থেকেই শুরু হয় কুণ্ডলিনীর যাত্রা—অন্ধকার থেকে আলোতে, জড় থেকে জ্ঞানে, দেহবোধ থেকে দেববোধে। মূলাধার স্থিত না থাকলে ঊর্ধ্বগামী যাত্রা অসম্ভব, কারণ মাটি দৃঢ় না হলে বৃক্ষ কখনও উচ্চে উঠতে পারে না। তাই মূলাধারই মানুষের ভিতরের সেই মাটি—যেখান থেকে আধ্যাত্মিক জাগরণের বৃক্ষ জন্ম নেয়।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এই নাদকেন্দ্রগুলি কেবল শরীরের শক্তিবিন্দু নয়, ব্রহ্মচেতনার বিকিরণরূপ সোপান। ব্রহ্মই যখন জড় ও জীবরূপে নিজেকে প্রকাশ করে, তখন তার সেই প্রকাশমান ধ্বনিই হলো “নাদ”—যা “ওঁ” শব্দে সংহত। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই নাদকেন্দ্রগুলিকে বলা হয় চেতনার স্পন্দনপথ—যেখানে পরাশক্তি (শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তি) নিজের লীলায় চলমান হয়ে ওঠে। অভিনবগুপ্ত বলেন, “নাদঃ কুণ্ডলিনী শক্তিঃ”—নাদই কুণ্ডলিনীর প্রকৃত রূপ, যা পরম চেতনার অনাহত ধ্বনিতে স্পন্দিত।

মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে, এই বত্রিশ নাদকেন্দ্রকে দেখা যায় মানুষের অন্তর্গত মনোশক্তির ত্রিশ দুটি স্তর হিসেবে—যেখানে ভয়, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, ত্যাগ, নীরবতা ইত্যাদি সব আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ক্রমান্বয়ে পরিশুদ্ধ ও রূপান্তরিত হয়। কুণ্ডলিনীর উত্থান মানে এই সব স্তরের মধ্য দিয়ে আত্মার এক অভ্যন্তরীণ বিবর্তন—নিম্ন প্রবৃত্তি থেকে সূক্ষ্ম প্রজ্ঞায় উত্তরণ।

বত্রিশ নাদকেন্দ্রের ধারণা তাই কেবল শারীরবৃত্ত নয়, এটি চেতনার সংগীত। প্রতিটি নাদ এক একটি ধ্বনি নয়, এক একটি জাগরণ—যেখানে চেতনা নিজেকেই শোনে, নিজের সীমা ভেঙে নিজের অসীমতায় মিলিয়ে যায়। এই ধ্বনিপথের চূড়ান্ত মিলন ঘটে সহস্রারে, যেখানে সব শব্দ, সব কম্পন, সব অনুভূতি মিলিয়ে যায় এক চিরনিঃশব্দ ওঁ-কারে—সেই অনাহত নাদেই কুণ্ডলিনী অবশেষে পরম শিবচেতনায় লীন হয়।

তত্ত্বদৃষ্টিতে এই ৩২ বীজধ্বনি চেতনার পূর্ণ চক্র নির্দেশ করে। প্রথম ষোলো ধ্বনিতে চেতনা প্রসারিত হয়—এগুলি হলো স্বরধ্বনি, আর পরের ষোলো ধ্বনিতে চেতনা সংকুচিত হয়ে রূপ ধারণ করে—এগুলি হলো ব্যঞ্জনধ্বনি। এভাবে চেতনা নিজের মধ্যেই একটি পূর্ণ বৃত্ত সম্পূর্ণ করে—প্রকাশ ও লয় একাকার হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায় এই ৩২ বীজধ্বনি হলো ব্রহ্মচেতনার “নাদ-বিন্দু-বীজ” তত্ত্ব—যেখানে নাদ মানে শব্দের স্পন্দন, বিন্দু মানে সেই স্পন্দনের কেন্দ্রীভবন, আর বীজ মানে তার সম্ভাবনা। কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়েছে, “স্পন্দই সমস্ত অস্তিত্বের মূল”—অর্থাৎ, জগতের সমস্ত কিছুই চেতনার এক স্পন্দনমাত্র, যার শব্দরূপ প্রকাশ এই বত্রিশ বীজধ্বনি।

“নাদ-বিন্দু-বীজ” তত্ত্ব ভারতীয় তান্ত্রিক ও যোগদর্শনের এক গভীর চেতনতত্ত্ব, যা শব্দব্রহ্মের অন্তর্নিহিত গঠন ও চেতনার প্রকাশধারা ব্যাখ্যা করে। এই তিনটি শব্দ—নাদ, বিন্দু ও বীজ—আসলে পরম চেতনার তিনটি অবস্থাকে নির্দেশ করে, যেখানে চেতনা নিজের নিস্তরঙ্গ নীরবতা থেকে স্পন্দিত হয়ে ধীরে ধীরে সৃষ্টির রূপ ধারণ করে। এই তিন স্তরকে বোঝা মানে হলো, কীভাবে ব্রহ্মচেতনা ধ্বনিরূপে জগতে আত্মপ্রকাশ করে এবং কীভাবে ধ্বনি আবার নিজের উৎসে ফিরে যায়—তারই অনন্ত ছন্দ উপলব্ধি করা।

প্রথম স্তর হলো নাদ। ‘নাদ’ শব্দের অর্থ ধ্বনি, কিন্তু এটি সাধারণ শ্রুতিযোগ্য শব্দ নয়; এটি অনাহত বা অশ্রুত ধ্বনি—যা কোনো দুই বস্তুর সংঘর্ষে নয়, বরং চেতনার নিজের অন্তর্গত স্পন্দনে উদ্ভূত। এটি পরব্রহ্ম বা মহাচেতনার প্রথম কম্পন, যে নিস্তব্ধতা নিজেকে জানার জন্য সামান্য আন্দোলিত হয়। যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে, “অনাহতনাদঃ পরমাত্মার স্বরূপম্”—অর্থাৎ, সেই অনাহত ধ্বনিই পরম আত্মার স্বরূপ। এই নাদ হলো সেই সূক্ষ্ম সুর, যা সর্বদা বর্তমান কিন্তু সাধারণ চেতনা তাকে শুনতে পায় না। এটি শিবচেতনার স্পন্দ, বা কাশ্মীর শৈবদর্শনের ভাষায় “স্পন্দতত্ত্ব”—চেতনা যখন নিজেই নিজের মধ্যে আলোড়িত হয়, তখন যে প্রথম তরঙ্গ জাগে, সেটিই নাদ।

এই নাদই পরবর্তী স্তরে রূপ নেয় বিন্দুতে। বিন্দু মানে বিন্দু বা কেন্দ্র—চেতনার একসংহত অবস্থান। যখন সেই নাদ বা স্পন্দন নিজের সম্ভাবনাকে এক কেন্দ্রে সঙ্কুচিত করে, তখন সৃষ্টি হয় বিন্দু। এটি চেতনার মহাকেন্দ্র, যেখানে সমস্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা সঙ্কুচিত অবস্থায় বিদ্যমান। এই বিন্দু হলো শিব-শক্তির ঐক্যবিন্দু—যেখানে দ্বৈততা এখনও প্রকাশ পায়নি, কিন্তু সেই সম্ভাবনা তার ভেতরে গোপনে নিঃশব্দে উপস্থিত।

যেমন একটি বীজে একটি বিশাল বৃক্ষের সমস্ত সম্ভাবনা নিহিত থাকে, তেমনি বিন্দুতেই জগতের সমস্ত প্রকাশ লুকিয়ে থাকে। তাই তন্ত্রে বলা হয়, “বিন্দুরূপম্‌ মহাদ্ব্যাপি শিবশক্তিস্বরূপকম্‌”—বিন্দুই সর্বব্যাপী শিবশক্তির মূল রূপ। কালী, ত্রিপুরসুন্দরী বা মহামায়ার কপালে যে তিল বা চন্দনচিহ্ন দেখা যায়, সেটিই এই বিন্দুর প্রতীক—চেতনার কেন্দ্রীভূত দীপ্তি।

এরপর আসে তৃতীয় স্তর—বীজ। বীজ মানে হলো সৃষ্টি-বীজ, বা সেই অক্ষরধ্বনি, যেখান থেকে শব্দ, অর্থ এবং রূপের উদ্ভব হয়। নাদ ও বিন্দুর সংযোগেই বীজের জন্ম। এটি হলো ধ্বনির প্রথম প্রকাশিত রূপ—চেতনার কম্পন যখন উচ্চারণে রূপান্তরিত হয়। “ওঁ”, “হ্রীঁ”, “শ্রীঁ”, “ক্রীঁ” ইত্যাদি মন্ত্রবীজ এই স্তরের প্রতীক। প্রতিটি বীজ একটি নির্দিষ্ট শক্তির বাহক—যেমন “ওঁ” হলো সর্ববীজ, যা সমস্ত ধ্বনি ও শব্দের উৎস।