এখানে “পূর্বতন” শব্দটি মানে “কারণতাত্ত্বিক অগ্রগণ্যতা”। ঈশ্বর, যিনি ব্যক্ত বা সৃষ্টির কর্তা রূপে প্রকাশিত, সেই প্রকাশের উৎস বা আদ্যভূমি হলো শব্দব্রহ্ম। যেমন ঢেউ সমুদ্র থেকে ওঠে, কিন্তু সমুদ্রই ঢেউয়ের কারণ; তেমনি ঈশ্বর হলেন চেতনার ব্যক্ত রূপ, আর শব্দব্রহ্ম সেই চেতনার অব্যক্ত ধ্বনি-রূপ—যেখান থেকে ঈশ্বর, সৃষ্টি ও সমস্ত জ্ঞান সম্ভূত।
তন্ত্র ও কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই ধারণা আরও গভীর। এখানে “শব্দব্রহ্ম” মানে “নাদ” বা “স্পন্দ”—চেতনার আদ্য-কম্পন। শিবচেতনা যখন নিজে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কম্পিত হয়, তখনই সৃষ্টি ও ঈশ্বর ধারণা উভয়ই প্রকাশ পায়। তাই অভিনবগুপ্ত বলেন—“নাদঃ পরব্রহ্মণো মুখম্”—নাদই পরব্রহ্মের মুখ, অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ (তন্ত্রালোক, ১.৪৫)। অর্থাৎ, ঈশ্বর যিনি চেতনার সচেতন কেন্দ্র, সেই চেতনার প্রথম উচ্ছ্বাস বা ধ্বনি হলো শব্দব্রহ্ম। তাই নীরব পরচেতনার (পরম বা তুরীয় চেতনা) প্রথম প্রকাশই নাদ বা শব্দ; ঈশ্বর সেই নাদের স্বচেতন রূপ।
“শব্দব্রহ্ম ঈশ্বরেরও পূর্বতন” মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের আগে শব্দ ছিল, বরং এ-ই যে—চেতনার আদ্য প্রকাশ (শব্দ) থেকেই ঈশ্বরের চেতনা স্বরূপভাবে উদ্ভাসিত হয়। শব্দব্রহ্ম এখানে সেই পরম চেতনার ধ্বনি-রূপ সম্ভাবনা, আর ঈশ্বর সেই সম্ভাবনার ব্যক্ত সচেতন রূপ। একে যদি রূপকের ভাষায় বলা যায়, তবে—শব্দব্রহ্ম হল সুর, আর ঈশ্বর সেই সুরের সংগীত।
তাই উপনিষদে যখন বলা হয় “ওংকারই ব্রহ্ম” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ ১-২), তখন তার অর্থ এ-ই—ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ধারণা, সৃষ্টি ও মুক্তি—সবই শব্দব্রহ্ম নামক এক আদ্য চেতনা-ধ্বনির মধ্যেই নিহিত। শব্দই ব্রহ্ম, শব্দই প্রকাশ, শব্দই ঈশ্বরের মুখ। তাই বলা হয়, শব্দব্রহ্ম ঈশ্বরেরও পূর্বতন, অর্থাৎ ঈশ্বর, বিশ্ব ও মানব—সবই সেই অনন্ত চেতনা-ধ্বনির নিজস্ব লীলা।
অদ্বৈত বেদান্তে শব্দব্রহ্মকে বলা হয়েছে ব্রহ্মের “ব্যক্ত” রূপ—যিনি “নির্বিশেষ” (বিশেষণহীন) অবস্থায় নিরাকৃতি চেতনা, তিনিই যখন “বিশেষিত” অবস্থায় প্রকাশ পান, তখন তাঁর প্রথম চিহ্ন হয় শব্দ। শঙ্করাচার্য তৈত্তিরীয় উপনিষদ ভাষ্যে বলেন—“শব্দব্রহ্মণো হি পরো ব্রহ্মণো জ্ঞাপনম্”—শব্দব্রহ্ম হল সেই মাধ্যম, যা পরব্রহ্মকে প্রকাশ করে।
তন্ত্র ও কাশ্মীর শৈব মতে, শব্দব্রহ্মের ধারণা একটি গভীর দার্শনিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল, যেখানে শব্দকে কেবল শ্রবণযোগ্য ধ্বনি হিসেবে দেখা হয় না, বরং চেতনার নিজস্ব কম্পন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মতবাদ অনুসারে, জগৎসৃষ্টি এবং তার প্রকাশের মূলে রয়েছে শব্দ। এটি একটি সর্বজনীন শক্তি, যা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন।
শব্দব্রহ্মের এই ধারণাটি চারটি স্তরে বিভক্ত: পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এই স্তরগুলো চেতনার নিরাকার অবস্থা থেকে স্থূল উচ্চারিত ধ্বনি পর্যন্ত শব্দের প্রকাশের ক্রমকে ব্যাখ্যা করে।
পরা শব্দ: এটি শব্দের সর্বোচ্চ এবং সূক্ষ্মতম স্তর। পরা মানে "সর্বোচ্চ" বা "অতিক্রান্ত"। এই স্তরে শব্দ অনাদি, অনন্ত এবং অরূপ। এটি নিখাদ নীরব চেতনা, যেখানে কোনো দ্বৈততা বা বিভেদ নেই। এটি পরমাত্মা বা শিবের সঙ্গে অভিন্ন। পরা শব্দ চেতনার গভীরতম স্তরে অবস্থিত, যেখানে কেবল শুদ্ধ অস্তিত্ব বিদ্যমান। এটি সমস্ত সৃষ্টির বীজ এবং সমস্ত শব্দের উৎস, কিন্তু এটি কোনো প্রকার শব্দ বা কম্পন হিসেবে অনুভূত হয় না। এই স্তরটি যোগীরা গভীর ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারেন।
পশ্যন্তী শব্দ: পরা শব্দের পরে আসে পশ্যন্তী, যার অর্থ "যে দেখে" বা "যে প্রকাশমান"। এই স্তরে শব্দ বাঙ্ময় নয়, তবে এটি অনুভব করা যায়। এটি ভাবের কম্পন। পশ্যন্তী স্তরে চেতনা একটি অব্যক্ত রূপে স্পন্দিত হতে শুরু করে, যা ভবিষ্যতের চিন্তা বা ধারণার প্রাথমিক রূপ। এখানে শব্দ অর্থ বা ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু এখনও সুস্পষ্ট বাক্য বা ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়নি। যোগীরা এই স্তরে শব্দের দর্শন লাভ করেন, যেখানে চিন্তা বা ধারণাগুলি একটি চিত্রের মতো উদ্ভাসিত হয়। এই স্তরটি স্বপ্নের অবস্থার মতো, যেখানে ধারণাগুলি মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিদ্যমান, কিন্তু বাহ্যিকভাবে প্রকাশিত নয়।
মধ্যমা শব্দ: পশ্যন্তী থেকে মধ্যমা স্তরে নেমে আসার সময় শব্দ আরও স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হয়। মধ্যমা মানে "মাঝামাঝি" বা "মধ্যবর্তী"। এই স্তরে শব্দ মানসিক উচ্চারণের রূপ নেয়। এটি অভ্যন্তরীণ চিন্তা, মনন বা ভাষাগত ধারণা, যা এখনও মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি। আমরা যখন মনে মনে কথা বলি বা কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করি, তখন তা মধ্যমা স্তরের অন্তর্গত। এই স্তরে শব্দের স্পষ্ট অর্থ এবং কাঠামো থাকে, কিন্তু এটি শ্রবণযোগ্য নয়। এটি ভাষা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেখানে ব্যাকরণগত কাঠামো এবং শব্দার্থের সংযোগ ঘটে।
বৈখরী শব্দ: এটি শব্দের স্থূলতম এবং প্রকাশ্য স্তর। বৈখরী মানে "যা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে" বা "যা প্রকাশিত"। এটি উচ্চারিত ধ্বনি, যা আমরা শুনতে এবং বলতে পারি। আমরা যখন কথা বলি, গান করি বা যে-কোনো ধরনের শব্দ উৎপন্ন করি, তখন তা বৈখরী স্তরের প্রকাশ। এই স্তরে শব্দ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় এবং বাহ্যিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। বৈখরী শব্দই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
এই সমগ্র সোপানমালা-ই শব্দব্রহ্মের প্রকাশপথ। এই চারটি স্তর দেখায় যে, কীভাবে পরম চেতনা বা ব্রহ্ম ধীরে ধীরে নিজেকে শব্দ এবং ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে। তন্ত্র ও কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই প্রক্রিয়াকে জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়া হিসেবেও দেখা হয়, যেখানে ব্রহ্ম তার অব্যক্ত অবস্থা থেকে নিজেকে ব্যক্ত রূপে প্রকাশ করেন। এই ধারণাটি কেবল শব্দ বা ভাষার উৎস ব্যাখ্যা করে না, বরং সৃষ্টির রহস্য এবং চেতনার গভীরতা উন্মোচন করে।
শব্দব্রহ্ম মানে সেই ব্রহ্ম, যিনি শব্দরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, এবং শব্দরূপেই আবার নিঃশব্দে ফিরে যান। যেমন ওম্ (ওঁ) শব্দে “অ-উ-ম” ধ্বনি তিন অবস্থাকে (জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি) নির্দেশ করে, আর শেষে যে-নিঃশব্দতা (তুরীয়) থাকে সেটিই ব্রহ্ম। তাই বলা হয়—“শব্দব্রহ্মণি নিষ্টিতঃ যোগী পরব্রহ্মাভবেত্”—যিনি শব্দব্রহ্মে স্থিত হন, তিনি পরব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন (মাহানির্বাণ তন্ত্র, ৫.৪২)।
তাই, শব্দব্রহ্ম হলো চেতনার সেই রূপ, যেখানে ব্রহ্ম ধ্বনি-রূপে সৃষ্টিকে ধারণ করেন এবং ধ্বনি-রূপেই মুক্তির পথ খুলে দেন—একেই বলা হয়: “নাদই ব্রহ্ম, বাক্ই শিব, ওম্ই চেতনার প্রথম স্পন্দন।”
“বরাভয়” (বর-অভয়) শব্দযুগলটি ভারতীয় তন্ত্র, শৈব ও শাক্ত দর্শনের অন্যতম গভীর প্রতীক। এটি কোনো সাধারণ হাতের ভঙ্গি নয়, বরং চেতনার দ্বিমুখী অভিব্যক্তি—একদিকে অভ্যন্তরীণ নির্ভয়তা, অন্যদিকে বহির্মুখ অনুগ্রহ। দেবমূর্তির দুটি হাতের এই ভঙ্গি, যেখানে এক হাতে অভয়মুদ্রা এবং অন্য হাতে বরমুদ্রা, সেই যুগল অবস্থাকেই বলা হয় বরাভয়। এটি মূলত চেতনার পরম ঐক্যের দুই দিক—স্ব-মুক্তি (ভয়হীনতা) এবং বিশ্ব-মুক্তি (করুণা)।
অভয়মুদ্রা মানে “ভয় কোরো না”—এটি আত্মার নির্ভীক নিশ্চয়তার প্রতীক। দেবদেবীর ডান হাত বুকের সমান্তরে উর্ধ্বমুখী, তালু সামনের দিকে প্রসারিত থাকে—যেন সমগ্র জগৎকে আশ্বস্ত করছে। এই আশ্বাস বাহ্যিক নিরাপত্তা নয়; এটি আত্মচেতনার গভীর ঘোষণা—যে-চেতনা অদ্বৈত, সেখানে কোনো “অন্য” নেই, তাই কোনো ভয়ও নেই। যে-মুহূর্তে জানা যায়, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩.১৪.১), যার অর্থ—নিশ্চয়ই এই সব কিছু ব্রহ্ম, তখন ভয় সম্পূর্ণ বিলীন হয়। অভয়মুদ্রা এই পরম ভয়হীনতার দৃশ্যরূপ—যেখানে আত্মা বলে ওঠে, “আমি শিব, আমি চেতনা, আমি পরম শূন্য।”
বরমুদ্রা মানে “বর দান করা”—এটি চেতনার করুণার বা অনুগ্রহের প্রকাশ। দেবতার বাম হাত নিচের দিকে প্রসারিত, তালু সামনের দিকে—যেন তিনি আশীর্বাদ দিচ্ছেন, জীবন, জ্ঞান বা মুক্তি বিলিয়ে দিচ্ছেন। এটি সেই চেতনার রূপ, যা নিজের পূর্ণতা থেকে অন্যের মধ্যে প্রবাহিত হয়। কাশ্মীর শৈব দর্শনে শিবের পঞ্চকৃত্যের শেষটি হলো “অনুগ্রহ” (anugraha)—যেখানে শিব সমস্ত সৃষ্টিকে নিজের মধ্যে লীন করে আবার তাদের জাগিয়ে তোলেন, যেন তারা নিজের প্রকৃত সত্তা চিনতে পারে (তন্ত্রালোক, ১.৮৭)। বরমুদ্রা সেই অনুগ্রহশক্তির দৃশ্যমান প্রতীক—চেতনার নিজস্ব অসীমতা অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া।
অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা মিলেই তৈরি হয় “বরাভয়”—যা একযোগে চেতনার স্থিতি ও প্রসারণ, সংহৃতি ও প্রকাশ, অন্তঃপ্রত্যয় ও বহিঃকরুণার প্রতীক। এক হাতে দেবতা বলেন—“ভয় নেই, আমি আছি,” আর অন্য হাতে বলেন—“আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি।” এই দ্বিমুখী ভঙ্গিই চেতনার পরম পূর্ণতা।
এই দুই মুদ্রার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ দেখা যায় মহাকালীর মূর্তিতে। কালীর ডান দুই হাতে অভয় ও বর মুদ্রা—অর্থাৎ, একদিকে ভয়হীনতার আশ্বাস, অন্যদিকে অনুগ্রহের বরদান। আর বাম দুই হাতে তিনি ধারণ করেন খড়্গ ও ছিন্নমুণ্ডু—অর্থাৎ, মায়ার আবরণ ও অহংকারের ছেদ। এর অর্থ গভীরভাবে মনন করলে দেখা যায়—কালীর চার হাত আসলে এক চেতনার চার ক্রিয়া: সংহার, সৃষ্টি, রক্ষা ও অনুগ্রহ। বাম দুই হাতে তিনি অজ্ঞতার ছেদন করেন, আর ডান দুই হাতে তিনি সেই ছেদিত আত্মাকে আশ্বস্ত ও আশীর্বাদ করেন।
কালীর অভয়মুদ্রা তাই চেতনার “স্ব-অন্তর্গমন”—নিজেকে ভয়ের ঊর্ধ্বে জাগিয়ে তোলা; বরমুদ্রা হলো “প্রতিসংহৃত চেতনার উন্মোচন”—যেখানে মুক্ত চেতনা নিজের আলো অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এক হাতে তিনি বলেন, “ভয় কোরো না, মৃত্যু নেই”—অন্য হাতে বলেন, “এখন জাগো, আমি তোমাকে বর দিচ্ছি।” এই দুই মুদ্রা একত্রে প্রকাশ করে কালী-চেতনার অদ্বৈত রূপ—যেখানে মৃত্যু ও জীবন, সংহার ও অনুগ্রহ, নিঃশব্দতা ও ধ্বনি—সবই এক চিরন্তন নৃত্যের অংশ।
অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ বলেন—“অভয়ং স্থিতিরূপা সংবিত্, বরং প্রসাররূপা”—অর্থাৎ, অভয়মুদ্রা চেতনার স্থির স্বরূপ, আর বরমুদ্রা চেতনার প্রসারিত রূপ (তন্ত্রালোক, ৫.৪৮)। তাই কালী এই দুই মুদ্রা ধারণ করে ঘোষণা দেন—চেতনার কোনো ভয় নেই, চেতনার কোনো শত্রু নেই; সে নিজেই নিজের ছায়াকে ছিন্ন করে, আবার সেই ছায়াকেই আলো দিয়ে রূপান্তরিত করে।
কালীর বরাভয়মুদ্রা হলো সেই মহামুহূর্তের প্রতীক, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ জাগ্রত—ভয়হীন, উন্মুক্ত, প্রেমময় ও সর্বব্যাপী। এখানে মৃত্যু মুক্তি, অন্ধকার আলো, ধ্বংস সৃষ্টির আরেক রূপ। তাই কালীকে বলা হয় “অভয়-বরপ্রদায়িনী”—যিনি ভয় দূর করেন এবং বর দেন।
বরাভয় কেবল একটি মুদ্রা নয়, এটি চেতনার নিজস্ব পরিপূর্ণতা—যেখানে আত্মা নিজের ভয়হীনতায় স্থিত হয় (অভয়), এবং নিজের করুণায় জগৎকে আলোকিত করে (বর)। কালী এই দুইয়ের একত্র প্রতিমূর্তি—তিনি ভয়হীনতার আদর্শ, আবার করুণারও উৎস; ধ্বংসের দেবী, আবার মুক্তিরও দেবী। তাঁর বরাভয়মুদ্রা যেন প্রতিদিন আমাদের চেতনার সামনে ঘোষণা করে—“ভয় কোরো না, কারণ তুমি-ই চেতনা; আর এই জগৎ, তোমারই করুণার প্রতিফলন।”
তাঁর কোমরের মেখলা (কোমরের গহনা—'কোমরবন্ধ', 'কটিভূষণ' বা 'চন্দ্রহার') মৃত মানুষের বাহুর তৈরি; এটি কর্মের বন্ধন ছিন্ন করে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই আত্মনিয়ন্ত্রণই “চিত্তশুদ্ধি”, যা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পূর্বশর্ত।
শ্মশানভূমি, কালীর প্রিয় স্থান, তাঁর প্রতীকতত্ত্বের কেন্দ্রে। এটি মৃত্যু ও নাশের রাজ্য, কিন্তু তন্ত্রে এটি জাগরণের ক্ষেত্র। যেমন কাশ্মীর শৈবদর্শনে বলা হয়, “যত্র সংহার, তত্র উদ্ভব”—যেখানে লয়, সেখানেই চেতনার নবজন্ম। মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়, বরং পরম চেতনার পুনরাবির্ভাব। এই কারণে কালী শ্মশানে নৃত্য করেন—মৃত্যু ও জীবনের সীমা মুছে দিয়ে তিনি দেখান, লয়ই সৃষ্টি। হাইডেগারের ভাষায় এটি সেই Sein-zum-Tode—“being-toward-death”—যেখানে মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই নিজের সত্য সত্তাকে চিনে।