শৈব কালী: তেইশ



বুদ্ধি—বিচারশক্তি: বুদ্ধি হলো আত্মার সেই শক্তি, যার মাধ্যমে সে পার্থক্য করতে শেখে—সত্য ও মিথ্যা, ভালো ও মন্দ, করণীয় ও অকরণীয়। এটি নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি (niścayātmikā vṛtti)—যে-শক্তি অনিশ্চয়তার পর স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বুদ্ধি পুরুষের সীমিত জ্ঞানের প্রকাশ, যা বিদ্যা ও কলা কঞ্চুকের প্রভাবে সংকুচিত হয়েছে। কাশ্মীর শৈব দর্শন একে বলে আত্মার “প্রথম প্রতিফলন”—যেখানে চেতনা নিজের জ্ঞানক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিণত করে।

সাংখ্য দর্শনে এই বুদ্ধিকেই বলা হয়েছে “মহৎ”—প্রকৃতির প্রথম বিকার। এটি সত্ত্বগুণ প্রধান, তাই এটি স্বচ্ছ ও আলোকময়, কিন্তু পরম চেতনার মতো সর্বজ্ঞ নয়। এর কাজ হলো সমস্ত অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত জ্ঞানে রূপান্তর করা—যাতে কর্তা-ভোক্তা জীব দিকনির্দেশ পায়।

অহংকার—“আমি”-ভাব: অহংকার হলো সেই অন্তর্গত শক্তি, যার মাধ্যমে আত্মা বলে ওঠে—“আমি আছি।” এটি অভিমানাত্মিকা বৃত্তি (abhimānātmikā vṛtti)—যার ফলে আত্মা নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। কলা কঞ্চুকের প্রভাবে আত্মা এখানে “কর্তা” ও “ভোক্তা”—এই দুই ভূমিকায় প্রবেশ করে। এই অবস্থায় সে ভাবে—“আমি কাজ করছি,” “আমি ভোগ করছি,” “আমি আলাদা।”

অহংকার রাজসিক গুণ-প্রধান; তাই এটি গতিশীল ও বহির্মুখী। এটি চেতনার সেই রূপ, যা ক্রিয়ার প্রেরণা দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে সীমাবদ্ধতার জন্মও ঘটায়। অহংকার ছাড়া কোনো অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়, কারণ “আমি”-বোধ ছাড়া কর্তা-ভাব তৈরি হয় না; তবে এই “আমি”-বোধই যখন অজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তা বন্ধনের মূল হয়ে দাঁড়ায়।

বুদ্ধি আর অহংকার—এই দুই একত্রে আত্মার জাগ্রত চেতনা-প্রক্রিয়ার মূলভিত্তি। বুদ্ধি বিশ্লেষণ করে, অহংকার সেই বিশ্লেষণকে “আমার সিদ্ধান্ত” বলে ধারণ করে। এর পরেই মন ও চিত্ত এসে এই সিদ্ধান্ত ও অনুভূতিগুলিকে সংরক্ষণ ও পুনরাবৃত্তি করে, যা চেতনার সীমিত অভিজ্ঞতার পরিসর গঠন করে।

মনস (Manas): চিন্তা, ইচ্ছা ও সংবেদনের কেন্দ্র—মনস হলো অন্তঃকরণের সেই অঙ্গ, যা চিন্তা (thought), ইচ্ছা (will), ও সংবেদন (sensation)—এই তিন প্রক্রিয়াকে সংযুক্ত রাখে। এটি ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য প্রথমে গ্রহণ করে এবং পরে সেগুলিকে বুদ্ধি-র কাছে প্রেরণ করে বিচার বা বিশ্লেষণের জন্য। তাই মনসকে বলা হয় সংকল্প-বিকল্পাত্মিকা বৃত্তি (saṅkalpa-vikalpātmikā vṛtti)—অর্থাৎ, যে-শক্তি ক্রমাগত বিকল্প, চিন্তা ও ইচ্ছার দোলাচল সৃষ্টি করে।

মনসের প্রকৃতি অস্থির ও চঞ্চল। এটি কখনও স্থির থাকে না, সর্বদা এক চিন্তা থেকে অন্য চিন্তায়, এক ইচ্ছা থেকে অন্য ইচ্ছায় চলাচল করে। ভগবদ্‌গীতা (৬.৩৪)-তে বলা হয়েছে—“চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বালবদ্‌ দৃঢ়ম্‌”—মন অতি চঞ্চল, অদম্য ও প্রাবল্যশালী। তাই এটি একদিকে সংবেদনের কেন্দ্র, অন্যদিকে কামনা ও বাসনারও উৎস।

কাশ্মীর শৈব দৃষ্টিতে, মনস চেতনার সেই তরঙ্গায়িত স্তর, যেখানে আত্মা নিজেকে অসংখ্য ইচ্ছা ও বিকল্পের প্রবাহে দেখতে পায়। এটি চেতনার সৃষ্টিশীল গতি—যা একদিকে প্রকাশের মাধ্যম, অন্যদিকে বন্ধনেরও কারণ। যখন মনস ইন্দ্রিয়ের দিকে টানে, তখন তা জড়তায় নিমজ্জিত হয়; আর যখন তা আত্মার দিকে মুখ ফেরায়, তখন তা যোগ ও প্রত্যভিজ্ঞার পথ।

মনস সাত্ত্বিক হলে তা স্থির, ধ্যানময় ও স্বচ্ছ হয়; রাজসিক হলে অস্থির ও বাসনাময় হয়ে ওঠে। তাই সাধনার উদ্দেশ্য হলো মনসকে শুদ্ধ করা—চিন্তা ও ইচ্ছাকে পরম চেতনার পথে পরিচালিত করা।

চিত্ত (Citta): স্মৃতি ও সংস্কারের আধার—চিত্ত হলো অন্তঃকরণের সবচেয়ে গভীর স্তর—স্মৃতি (memory), সংস্কার (impressions) ও অবচেতন প্রবণতার (latent tendencies) ভাণ্ডার। এটি সেই স্থান, যেখানে আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা, আনন্দ, দুঃখ, ইচ্ছা, ও কর্মফল সূক্ষ্মরূপে সঞ্চিত থাকে। যোগদর্শনে পতঞ্জলি বলেছেন—“চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ যোগঃ”—অর্থাৎ, চিত্তের তরঙ্গ বা বিকার শান্ত করাই যোগ।

চিত্ত আসলে মনস, বুদ্ধি ও অহংকার—এই তিনেরই সংমিশ্রণ বা গভীর অবচেতন অংশ। যখন মনস চিন্তা করে, বুদ্ধি সিদ্ধান্ত দেয়, অহংকার বলে “আমার সিদ্ধান্ত”—তখন তাদের ফল চিত্তে সঞ্চিত হয়। এই সঞ্চিত অভিজ্ঞতাগুলিই সংস্কারে রূপ নেয়, এবং সেই সংস্কার থেকেই ভবিষ্যৎ চিন্তা, আচরণ ও কর্মের ধারা নির্ধারিত হয়।

কাশ্মীর শৈব মতে, চিত্ত কোনো পৃথক সত্তা নয়; এটি চেতনারই প্রতিফলিত স্তর—যেখানে পূর্বজন্মের কর্ম ও অভিজ্ঞতা সূক্ষ্মরূপে নিহিত থাকে। এখানেই আত্মা নিজের সীমাবদ্ধ ইতিহাস ধারণ করে—যা তাকে ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতায় প্রেরণা দেয়।

অদ্বৈত বেদান্তে চিত্তকে আলাদা তত্ত্ব হিসেবে ধরা না হলেও, একে মন বা বুদ্ধির বৃত্তি হিসেবে দেখা হয়—অর্থাৎ, চেতনার সেই অংশ, যা অবিদ্যা-র প্রভাবে অভিজ্ঞতার ছাপ সংরক্ষণ করে। চিত্তই আমাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসের ধারক—আমাদের অভ্যাস, প্রবৃত্তি, ও প্রতিক্রিয়ার মূল। যখন এই চিত্ত শুদ্ধ ও শান্ত হয়, তখন সংস্কার নিঃশেষ হয়ে যায়, এবং আত্মা নিজের চিরন্তন চৈতন্যরূপে জেগে ওঠে।

এভাবে, মনস ও চিত্ত মিলে গঠন করে চেতনার গতিশীল অভ্যন্তর—যেখানে চিন্তা, ইচ্ছা, স্মৃতি ও সংস্কার একে অপরের সঙ্গে জড়িত হয়ে ব্যক্তিসত্তার অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। চেতনার এই সূক্ষ্ম স্তরগুলিই স্থূল জগতের অভিজ্ঞতার ভিত গঠন করে, এবং একই সঙ্গে মুক্তির জন্য আত্মস্মরণের পথও নির্দেশ করে।

জ্ঞানেন্দ্রিয়—জ্ঞানের দ্বারসমূহ: জ্ঞানেন্দ্রিয় বলতে বোঝায় সেই পাঁচটি সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়যন্ত্র, যেগুলির মাধ্যমে আত্মা বা পুরুষ বাহ্যিক জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং তথ্য আহরণ করে। এগুলি হলো চেতনার জ্ঞানের শক্তি (jñāna-śakti)-র বাহ্যিক প্রকাশ, যার মাধ্যমে জীব বাহ্যিক বস্তুর রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শ—এই পাঁচ গুণের অভিজ্ঞতা লাভ করে।

সাত্ত্বিক অহংকার হলো অহংকার বা “আমি”-বোধের সেই সূক্ষ্ম দিক, যা চেতনার জ্ঞানশক্তি (jñāna-śakti)-কে প্রকাশ করে।

অহংকার মূলত তিন গুণ—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এ তিনের সংমিশ্রণে গঠিত। এর প্রত্যেক গুণ অনুযায়ী এর ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ দেখা যায়—

১. সাত্ত্বিক অহংকার (Sāttvika Ahaṅkāra)—জ্ঞানের দিকে মুখ ফেরানো “আমি”-ভাব।

২. রাজসিক অহংকার (Rājasika Ahaṅkāra)—কর্ম ও ইচ্ছার দিকে প্রবণ “আমি”-ভাব।

৩. তামসিক অহংকার (Tāmasika Ahaṅkāra)—জড়তা ও অজ্ঞতার আচ্ছন্ন “আমি”-ভাব।

এদের মধ্যে সাত্ত্বিক অহংকার সবচেয়ে স্বচ্ছ, হালকা ও আলোকময়। এটি আত্মাকে জ্ঞানলাভের দিকে পরিচালিত করে, এবং বাহ্যিক জগতের সঙ্গে সচেতন সংযোগ স্থাপন করে। সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে, এই সাত্ত্বিক অহংকার থেকেই উৎপন্ন হয় জ্ঞানেন্দ্রিয় (শ্রবণ, দৃষ্টি, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ) ও মনস।

অর্থাৎ, পরম চেতনার “আমি জানি”, এই অনুভূতি যখন মায়া ও কঞ্চুকের প্রভাবে সীমিত হয়, তখনই সাত্ত্বিক অহংকার জন্ম নেয়—যে-“আমি” এখন আর সর্বজ্ঞ নয়, বরং ইন্দ্রিয় ও মন-এর মাধ্যমে খণ্ডিত জ্ঞান অর্জন করে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায়, সাত্ত্বিক অহংকার হলো চেতনার আলোকরূপ স্বপ্রকাশ (self-revealing cognition)—যেখানে আত্মা নিজের আলোকে জগৎকে চিনতে চায়। এটি বন্ধনের কারণ নয়, বরং অভিজ্ঞতার মাধ্যম। তাই বলা হয়, “সাত্ত্বিক অহংকারই জীবের জ্ঞান-দ্বার,” যার মাধ্যমে আত্মা নিজেকে ও জগতকে জানে, যদিও সে এখনও নিজের অসীম শিবস্বরূপ সম্পূর্ণভাবে স্মরণ করতে পারে না।

জীবের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের উৎস হলো সাত্ত্বিক অহংকার (sāttvika-ahaṃkāra)—অর্থাৎ, অহংকারের সেই অংশ, যা চেতনার জ্ঞানের দিকটি প্রকাশ করে। মায়ার প্রভাবে সীমিত আত্মা এখন নিজের জ্ঞানশক্তিকে বহির্মুখী করে, এবং এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে জগতের প্রতি সচেতনতা অর্জন করে।

১. শ্রবণ (Śrotra—কান): এটি শব্দগ্রহণের ইন্দ্রিয়। শব্দের মাধ্যমে জগৎকে প্রথম উপলব্ধি করা হয়, কারণ শব্দই চেতনার সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্পন্দন। শ্রবণ ইন্দ্রিয় আমাদের চারপাশের ভাষা, সংগীত ও প্রাকৃতিক ধ্বনি ধারণ করে।

২. দৃষ্টি (Cakṣus—চোখ): এটি রূপ, রং ও আকারের ইন্দ্রিয়। দৃষ্টি জগতের দৃশ্যমান রূপকে ধারণ করে এবং আলো ও ছায়ার মাধ্যমে উপলব্ধি তৈরি করে। চেতনা এখানে নিজের আলোকে বাহিরের বস্তুর প্রতিফলনে রূপান্তরিত করে।

৩. গন্ধ (Ghrāṇa—নাক): এটি গন্ধগ্রহণের ইন্দ্রিয়। সুবাস ও দুর্গন্ধের মাধ্যমে এটি বস্তু-পরিচয়ের সূক্ষ্ম দিক উপলব্ধি করে। গন্ধ হলো স্থূল উপাদানের সূক্ষ্মতম গুণ, যা আমাদের বস্তুর পরিচয় ও স্মৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

৪. স্বাদ (Rasanā—জিহ্বা): এটি স্বাদের ইন্দ্রিয়। খাদ্য ও পানীয়ের স্বাদের মাধ্যমে আমরা আনন্দ বা বিতৃষ্ণার অভিজ্ঞতা লাভ করি। এটি জীবনের সংরক্ষণে অপরিহার্য, কারণ স্বাদ থেকে পুষ্টি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই আসে।

৫. স্পর্শ (Tvak—ত্বক): এটি স্পর্শের ইন্দ্রিয়। শীতলতা, উষ্ণতা, কোমলতা, কঠোরতা ইত্যাদি অনুভূতির মাধ্যমে আমরা বস্তুর প্রকৃতি বিচার করি। স্পর্শই জীবনের সবচেয়ে প্রাথমিক ইন্দ্রিয়—যার মাধ্যমে আত্মা প্রথম জগতের সংস্পর্শ অনুভব করে।

এই পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় পরস্পরের পরিপূরক। তারা মিলিতভাবে বাহ্যজগতের এক সামগ্রিক ধারণা নির্মাণ করে এবং চেতনার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রকে বহির্মুখ করে তোলে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো কোনো জড় উপাদান নয়; এগুলি চেতনারই সীমিত প্রতিফলন—যার মাধ্যমে শিবচেতনা নিজের প্রকাশকে জ্ঞানের অভিজ্ঞতা হিসেবে উপভোগ করে।

অদ্বৈত বেদান্তে এই ইন্দ্রিয়গুলিকে বলা হয় “জ্ঞানের উপাধি (upādhi)”—অর্থাৎ, চেতনার জ্ঞানের মাধ্যম। যদিও পারমার্থিক দৃষ্টিতে এরা মায়াময় ও পরিবর্তনশীল, তবু ব্যাবহারিক জগতে (vyāvahārika satta) এগুলিই জ্ঞানের একমাত্র দ্বার—যার মাধ্যমে জীব নিজের ও জগতের মধ্যে সম্পর্ক অনুভব করে।

কর্মেন্দ্রিয়—ক্রিয়ার দ্বারসমূহ: কর্মেন্দ্রিয় হলো আত্মার সেই পাঁচটি সূক্ষ্ম যন্ত্র, যার মাধ্যমে সে বাহ্যিক জগতে কাজ করে এবং নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেয়। এগুলি চেতনার ক্রিয়াশক্তি (kriyā-śakti)-র প্রতিফলন, এবং এগুলির উৎস হলো রাজসিক অহংকার (rājasika ahaṅkāra)—অর্থাৎ অহংকারের সেই অংশ, যা কর্ম ও গতি-প্রবণ।

এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই বাহ্যজগতের সঙ্গে আমাদের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম; এদের দ্বারাই জীব “কর্তা” রূপে নিজের অভিজ্ঞতা লাভ করে।

১. বাক্‌ (Vāk—বাক্যন্ত্র): এটি কথাবলার অঙ্গ, যা চিন্তা ও ভাবকে শব্দে রূপান্তর করে। বাক্‌ই মন ও বুদ্ধির ভাবকে জগতে প্রকাশের প্রথম মাধ্যম। শৈব দর্শনে বাক্‌কে বলা হয়েছে “শক্তির প্রথম প্রকাশ”—যেখানে অন্তর্লীন চেতনা শব্দরূপে বাহিরে প্রকাশিত হয়।

২. পাণি (Pāṇi—হাত): এটি ধরা, ধরা দেওয়া, গ্রহণ ও সূক্ষ্ম কাজ সম্পাদনের অঙ্গ। এটি জীবের কর্মক্ষমতার প্রতীক—যার মাধ্যমে সে জগতের সঙ্গে ব্যাবহারিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

৩. পাদ (Pāda—পা): এটি চলাচলের অঙ্গ, যার দ্বারা জীব এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। পাদ জীবনের গতি ও প্রবাহের প্রতীক—চেতনা স্থবির থাকে না; সে সদা চলমান।

৪. পায়ু (Pāyu—মলদ্বার): এটি দেহের বর্জ্য নিষ্কাশনের অঙ্গ। এটি ভারসাম্য ও শুদ্ধতার রক্ষক—যেমন চেতনা অপ্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ত্যাগ করে বিকাশ লাভ করে, তেমনি দেহও পায়ুর মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য ত্যাগ করে।

৫. উপস্থ (Upastha—জননেন্দ্রিয়): এটি প্রজনন ও আনন্দের অঙ্গ। এটি জীবনের সৃষ্টিশক্তির প্রতিফলন—যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে পুনরুৎপন্ন করে ও আনন্দরূপে অনুভব করে।

এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় পরস্পর পরিপূরক। বাকের মাধ্যমে ভাব প্রকাশিত হয়, হাতের মাধ্যমে তা বাস্তবে রূপ পায়, পা দ্বারা ক্রিয়ার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়, পায়ু দ্বারা শুদ্ধতা রক্ষা হয় এবং উপস্থ দ্বারা সৃষ্টির চক্র অব্যাহত থাকে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়েছে, এগুলি কোনো জড় অঙ্গ নয়; এগুলি চেতনার নিজস্ব ক্রিয়াশক্তির সীমিত প্রতিফলন—যেখানে শিবচেতনা নিজেকে কর্মের রূপে প্রকাশ করে।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, কর্মেন্দ্রিয় হলো “ক্রিয়ার উপাধি (upādhi)”—যার মাধ্যমে চেতনা সংসারে কার্য সম্পাদন করে। পারমার্থিক সত্যে এরা মায়াময়, কারণ কর্তা ও ক্রিয়ার ভেদই আপাত; কিন্তু ব্যাবহারিক স্তরে এই কর্মেন্দ্রিয়গুলিই জীবের সমস্ত কর্ম, সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার বাহন।