রাগ (Rāga): এটি পূর্ণ তৃপ্তির সংকোচন। শিবচেতনা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বতঃসিদ্ধ আনন্দ (আনন্দ-স্বভাব); কিন্তু জীবাত্মা কখনও পরিতৃপ্ত নয়। তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়—সে কিছু চায়, কিছু পেতে চায়, কিছু অর্জন করতে চায়। এই রাগ কঞ্চুক চেতনার সেই পরিতৃপ্ত আনন্দকে বহির্মুখ করে আকাঙ্ক্ষার রূপ দেয়—যেন নিজের মধ্যে যা পরিপূর্ণ, সেটিকেই বাইরে খুঁজতে শুরু করে।
কাল (Kāla): এটি অনন্ত কালের সংকোচন। শিবচেতনা কালাতীত—তিনি কোনো সময়ের বৃত্তে আবদ্ধ নন; কিন্তু জীবাত্মা সময়ের ধারায় নিজেকে আবদ্ধ মনে করে। সে ভাবে, অতীত গেছে, ভবিষ্যৎ আসবে, বর্তমান ক্ষণস্থায়ী। এইভাবে কাল কঞ্চুক চেতনার কালাতীততার অনুভূতিকে রৈখিক সময়বোধে (past-present-future) রূপান্তরিত করে।
নিয়তি (Niyati): এটি স্বাধীনতার সংকোচন। পরম শিব সম্পূর্ণ স্বাধীন; তাঁর কোনো কর্মফল বা কারণের বাঁধন নেই। কিন্তু জীবাত্মা মনে করে, “আমি নিয়ম, ভাগ্য ও কারণের শৃঙ্খলে বাঁধা।” সে নিজের কর্মের ফল থেকে মুক্ত নয় বলে অনুভব করে। এইভাবে নিয়তি কঞ্চুক চেতনার অসীম স্বাধীনতাকে কার্যকারণ সম্পর্কের বন্ধনে পরিণত করে।
এই পাঁচটি কঞ্চুক মিলেই চেতনার ওপর অভিজ্ঞতার সীমারেখা টেনে দেয়—এরা শিবের ছয় গুণ (ṣaḍguṇa)—অর্থাৎ সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তি, সর্বতৃপ্তি, কালাতীততা, স্বাধীনতা ও চিরন্তন অস্তিত্ব—এর সংকুচিত রূপ। মায়া এই গুণগুলিকে সংকুচিত করে ব্যক্তিসত্তার অনুভবযোগ্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
অদ্বৈত বেদান্তে এই কঞ্চুকগুলির পৃথক তত্ত্বগত স্বীকৃতি নেই, কিন্তু তাদের কার্য একই—সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ব্রহ্ম যখন মায়ার আচ্ছাদনে পড়েন, তখনই তিনি “জীব” হিসেবে আবির্ভূত হন। বেদান্ত একে বলে উপাধি বা limiting adjunct, আর শৈব দর্শন একে বলে আত্ম-সংকোচনের প্রক্রিয়া (ātma-saṅkoca)।
পাঁচ কঞ্চুক হলো চেতনার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যশক্তিরই সীমিত প্রতিফলন—যেখানে অসীম শক্তি নিজেকে খণ্ডে রূপান্তরিত করে, যাতে চেতনা নিজের সীমার মধ্যে অসীমতার অভিজ্ঞতা নিতে পারে। এটি পরম শিবেরই লীলা—এক ঐশ্বরিক স্ব-সংকোচন, যা পরবর্তী স্তরে পুরুষ তত্ত্ব-এর আবির্ভাবে পূর্ণতা লাভ করে।
পুরুষ তত্ত্ব হলো সেই পর্যায়, যেখানে পরম, সর্বব্যাপী চেতনা নিজের অসীম স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে সীমিত করে “ব্যক্তি” বা “জীব” রূপে আত্মপ্রকাশ করে। মায়া ও পাঁচটি কঞ্চুকের আবরণে ঢাকা পড়ে, চেতনা এখন আর নিজেকে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, কালাতীত বা স্বতঃসিদ্ধ আনন্দরূপে অনুভব করে না; বরং সে বলে ওঠে—“আমি এ-ই”—এক সীমিত “আমি”-বোধের সূচনা ঘটে।
এখানেই আত্মার ব্যক্তিত্ববোধ (individualized consciousness) জন্ম নেয়। অসীম শিবচেতনা, যিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ, ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলেন, এখন নিজেকে “একজন অভিজ্ঞ সত্তা” হিসেবে দেখতে শুরু করেন—যিনি জানেন, করেন, ভোগ করেন, এবং প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন। এই “আমি”-ই হলো পুরুষ—চেতনার সীমিত আত্মরূপ।
উৎপলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-য় যে “স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি” ("স্বাধীনতা দ্বারা (বা স্ব-ইচ্ছা শক্তি দ্বারা) দ্বৈতের প্রতিভাস (দ্বৈততা) সৃষ্টি হয়।") বলেছেন, পুরুষ তত্ত্বে সেই দ্বৈতাভাসনা সম্পূর্ণ কার্যকর হয়ে ওঠে। চেতনা এখানে নিজের মধ্যে বিভাজন সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে—সে আর পরম শিব নয়, বরং জগতের অংশ, কর্মে নিযুক্ত, এবং ভোগের অধীন। এই অবস্থায় জীবাত্মা নিজেকে দেহ, মন, ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেখে—এবং বলে, “আমি এই শরীর,” “আমি এই চিন্তা,” “আমি এই সুখ-দুঃখ।”
এখান থেকেই জন্ম নেয় অহংকার (ahaṃkāra)—যে-বিভ্রমে আত্মা নিজেকে সীমিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে আত্মা হয়ে ওঠে কর্তা (যে কাজ করে) ও ভোক্তা (যে ফল ভোগ করে)। সে মনে করে, তার ক্রিয়াগুলিই বাস্তবতার মূল, অথচ ভুলে যায় যে, তার ক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা উভয়ই সেই চেতনারই লীলা, যিনি তার ভেতর নিত্য উপস্থিত।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, পুরুষ কোনো দেহ-মনযুক্ত সত্তা নয়, বরং এক সীমাবদ্ধ চেতনা (caitanya-śaṅkuca)—যিনি নিজের প্রকৃত অনন্ত সত্তাকে ভুলে গিয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র করে তুলেছেন। এই সীমাবদ্ধতা কিন্তু বাইরের নয়; এটি শিবেরই আত্ম-সংকোচন। তাই মুক্তি মানে কোনো নতুন সত্তা অর্জন নয়, বরং এই সংকোচনের মোহ ভেঙে নিজের প্রকৃত অসীম স্বরূপে প্রত্যভিজ্ঞা (recognition) লাভ করা।
অদ্বৈত বেদান্তে এই পুরুষ তত্ত্বই জীবাত্মা—মায়ার উপাধিতে আবদ্ধ ব্রহ্ম, যিনি নিজের প্রকৃত স্বরূপ ভুলে “কর্তা-ভোক্তা” হিসেবে সংসারে আবদ্ধ। যেমন ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ শঙ্কর বলেন, “তদনন্যত্বম্”—জগৎ বা জীব ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়, কেবল অবিদ্যার আচ্ছাদনে পৃথক বলে মনে হয়।
পুরুষ তত্ত্ব হলো সেই পর্যায়, যেখানে এক অদ্বৈত চেতনা নিজেকে সীমিত অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। এটি চেতনার আত্ম-বিস্মৃতির স্তর—যেখানে পরম “আমি” নিজেরই অন্তহীন দীপ্তিকে ভুলে “আমি ও এটি” এই বিভাজনের খেলায় নিমগ্ন হয়। তবে এই বিভাজনও আসলে তার নিজেরই লীলা; কারণ এই সীমাবদ্ধ পুরুষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই চিরন্তন শিব—যিনি সব সীমা অতিক্রম করে আবার নিজের অসীম স্বরূপে ফিরে যেতে প্রস্তুত।
প্রকৃতি তত্ত্ব হলো সীমাবদ্ধ আত্মা বা পুরুষের ভোগক্ষেত্র—যে-ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে সে নিজের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা লাভ করে, নিজের কর্ম, চিন্তা ও ভোগের নানা রূপ উপলব্ধি করে। এটি সেই স্তর, যেখানে চেতনা এখন সম্পূর্ণভাবে বহির্মুখ—যেখানে অসীম চৈতন্য (শিব) নিজেরই প্রতিফলনে নিমগ্ন হয়ে বিশ্ববস্তু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
প্রকৃতি শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘প্রকৃত স্বরূপ’ বা ‘মৌল কারণ’। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এটি হলো সেই আদ্য-উপাদান (primordial matrix), যেখান থেকে সমগ্র স্থূল জগৎ বিকশিত হয়। এটি তিনটি গুণ—সত্ত্ব (śuddhi বা জ্ঞান ও স্বচ্ছতা), রজঃ (ক্রিয়া ও গতি) এবং তমঃ (জড়তা ও আচ্ছাদন)—এই ত্রিগুণের সমন্বয়ে গঠিত। এই তিন গুণের পারস্পরিক ভারসাম্য ভঙ্গ হলেই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটে।
অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (৭.২৯)-এ বলেন—“গুণত্রয়বিভাগেন প্রকৃতিঃ কার্যকারণভূতা”—প্রকৃতি নিজেই কারণ ও কার্য উভয়, কারণ এর মধ্যে থেকেই বুদ্ধি, অহংকার, মন, ইন্দ্রিয়, তন্মাত্রা ও পঞ্চ মহাভূত—সব কিছু উদ্ভূত হয়।
পুরুষের দৃষ্টিতে প্রকৃতি এক বিশাল ভোগমঞ্চ (bhoga-kṣetra)—যেখানে জীবাত্মা তার অভিজ্ঞতা লাভ করে, আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে, শিক্ষা গ্রহণ করে, এবং ক্রমে নিজের প্রকৃত স্বরূপে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পায়। এটি যেন এক নাট্যমঞ্চ, যেখানে অভিনেতা (পুরুষ) নিজের ভূমিকাকে সত্য ভেবে অভিনয় করে, অথচ গভীরে সে সেই নাটকেরই স্রষ্টা ও দর্শক—এটি মায়ার লীলা-পরিসর।
কাশ্মীর শৈব দৃষ্টিতে, প্রকৃতি কেবল জড় উপাদান নয়; এটি চেতনারই শক্তির বহির্মুখ রূপ—এক জীবন্ত, স্পন্দমান সম্ভাবনা। স্পন্দ-কারিকা (১.৩)-এ বলা হয়েছে—“যতঃ প্রসূতিঃ সৃষ্টিস্তু স্বসংবিদ্রূপতা ধ্রুবা”—সৃষ্টির প্রতিটি উৎস চেতনারই স্থায়ী রূপ। প্রকৃতি সেই চেতনারই বিকাশ, তারই স্ববিমর্শন শক্তির বহির্প্রকাশ।
সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনেও প্রকৃতি স্বীকৃত, তবে সেখানে এটি এক স্বতন্ত্র, অচেতন উপাদান—যা পুরুষের (চেতনার) সংস্পর্শে এসে সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু কাশ্মীর শৈব মতে, প্রকৃতি নিজেও চেতনার অন্তর্গত—এটি কোনো জড় কারণ নয়, বরং শিবশক্তিরই এক প্রক্ষেপ। অর্থাৎ, প্রকৃতি হলো চেতনার রূপান্তর (pariṇāma), কোনো ভিন্ন সত্তা নয়।
প্রকৃতি তত্ত্ব তাই চেতনার সেই স্তর, যেখানে অসীম আত্মা নিজের সীমাবদ্ধ প্রতিচ্ছবিতে প্রবেশ করে; যেখানে ‘আমি’ (পুরুষ) ও ‘এটি’ (জগৎ)—এই দুইয়ের মিলনে অভিজ্ঞতার পূর্ণ পরিসর গঠিত হয়। এখান থেকেই সূচনা হয় অন্তঃকরণ—বুদ্ধি, অহংকার, মন—এবং সেইসঙ্গে ইন্দ্রিয় ও উপাদানের ক্রমবিকাশ, যা শেষপর্যন্ত জগৎ ও দেহরূপে স্থূল প্রকাশ লাভ করে।
এভাবে, প্রকৃতি তত্ত্ব হলো সেই মূল বীজক্ষেত্র, যেখানে শিবের চেতনা লীলারূপে জগতে প্রকাশিত হয়—যেখানে অনন্ত চেতনা সীমার আকারে, কিন্তু নিজেরই আলোয় জাগ্রত থেকে, জগৎ নামক আয়নায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে থাকে।
তৃতীয় স্তর—স্থূল জগতের স্তর (Aśuddha Tattvas) হলো সেই পর্ব, যেখানে চেতনা তার অন্তর্গত সূক্ষ্ম, আলোকময়, আত্মবিমর্শনশীল অবস্থান থেকে সম্পূর্ণভাবে বহির্মুখী (externalized) হয়ে যায়। এটি চেতনার লীলার সর্বশেষ স্তর—যেখানে পরম শিবচেতনা, যিনি এতদিন নিজের দীপ্তিতে নিজেকে চিনে আসছিলেন, এখন সেই দীপ্তিরই প্রতিফলন হয়ে “জগৎ” বা “বস্তু” রূপে প্রকাশিত হন।
এই অবস্থায় চেতনা যেন এক দীপ্ত আলোক নিজেকে ঘন ছায়ায় বদ্ধ করছে—আলো নিজেই নিজের আচ্ছাদন রচনা করছে, এবং সেই আচ্ছাদিত অবস্থা থেকেই স্থূল জগতের জন্ম। এখানে পরম “আমি” আর আত্মবোধে অবস্থান করে না; সে নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, ও বস্তুজগতের সঙ্গে একীভূত মনে করে। এর ফলে আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপ—যা পরম চেতনা—ভুলে যায়, এবং নিজেকে সসীম, জড়জগতের অংশ বলে অভিজ্ঞতা করে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, এই স্তর অশুদ্ধ তত্ত্বসমূহ (Aśuddha Tattvas)—যেখানে চেতনা জাগতিক অভিজ্ঞতার জগতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন। এখন আর “আমি” ও “এটি”-র মধ্যে সেই স্বচ্ছ ঐক্য নেই; এখানে “আমি দেখি,” “আমি করি,” “আমি ভোগ করি”—এই তিনস্তরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জেগে ওঠে। এই স্তরে চেতনার দীপ্তি আর অভ্যন্তরীণ নয়; তা বহির্মুখী এবং নিজেরই প্রতিফলনে বিভ্রান্ত।
অভিনবগুপ্ত এই প্রক্রিয়াকে চিদ্-আন্দোলন বলেছেন—চেতনার স্বাভাবিক স্পন্দন যখন নিজেকে বহির্দেশে প্রক্ষেপিত করে, তখনই স্থূল জগতের জন্ম। তাই তিনি বলেন, “ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—এই জগতে এমন কিছু নেই, যা স্পন্দনহীন। স্থূল জগতও সেই চেতনারই এক ঘনীভূত স্পন্দন, কিন্তু জীব তা বুঝতে পারে না; সে ভাবে, জগৎ আলাদা, আর সে তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র সত্তা।
অদ্বৈত বেদান্তেও এই স্তরকে বলা হয়েছে বহিরঙ্গ মায়া, যেখানে চেতনা নাম-রূপের আচ্ছাদনে নিমজ্জিত হয়ে ব্রহ্মস্বরূপ ভুলে যায়। ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ শঙ্কর বলেন—“তদনন্যত্বমারম্ভণশাব্দাদিভ্যঃ”—জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়; তবু মায়ার আচ্ছাদনে তা পৃথক বলে মনে হয়।
এই স্তরে আত্মসত্তা ‘কার্যকারণ সম্পর্ক’-এর জালে বন্দী হয়। চেতনা এখন কাজ ও ফল, কারণ ও পরিণাম, সুখ ও দুঃখের ধারাবাহিকতায় আবদ্ধ। এখান থেকেই জন্ম নেয় সংসারবোধ—যেখানে জীব ভাবে, সে দেহসত্তা; সে জন্মায়, বাঁচে, মরে, এবং তার বাইরে আর কোনো সত্তা নেই।
স্থূল জগতের স্তর আসলে চেতনার নিজেরই গভীর সম্ভাবনার এক বহিঃপ্রকাশ (externalization)। অর্থাৎ, চেতনা, যা এতদিন ভেতরে লুকোনো ছিল—নিজের নিস্তরঙ্গ, সূক্ষ্ম অবস্থায়—এখন তা সম্পূর্ণভাবে বাহিরে, দৃশ্যমান জগৎ রূপে প্রকাশিত হয়েছে।
এটি কোনো পতন নয়, বরং এক ঐশ্বরিক লীলা (divine play)—যেখানে পরম আত্মা নিজেই নিজের সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় আত্মা (বা জীব) ভাবে, “আমি এই জগৎ-এর অংশ”—সে দেহ, মন, সুখ-দুঃখ, কর্ম-ফল—সব কিছুকে নিজের বাস্তবতা বলে মানে।
কিন্তু আসলে গভীরে, তার সত্তা এখনও একই চেতনা, একই শিবরূপ দীপ্তি—যা কখনও নষ্ট হয়নি, শুধু সত্যকে ভুলে গেছে। এই স্তরের সাধনা হলো সেই ভুলে-যাওয়া সত্যটিকে পুনরায় স্মরণ করা (প্রত্যভিজ্ঞা)—নিজের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সেই চিরন্তন শিবচেতনা।
যখন জীব বুঝতে পারে, এই জগৎও আলাদা কিছু নয়—এটি তার নিজেরই চেতনার প্রতিফলন—তখনই সে উপলব্ধি করে, “আমি জগৎ নই, আমি সেই চেতনা, যার মধ্যে জগৎ প্রতিফলিত।” এখানেই মুক্তির শুরু।
অন্তঃকরণ চতুষ্টয় (Antaḥkaraṇa Catuṣṭaya)—অর্থাৎ বুদ্ধি, অহংকার, মন ও চিত্ত—এই চারটি সূক্ষ্ম মানসিক উপাদান মিলে গঠন করে জীবাত্মার অন্তর্দেহ বা অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াক্ষেত্র। এগুলিই চেতনার সেই সূক্ষ্ম যন্ত্রসমূহ, যাদের মাধ্যমে জীব চিন্তা করে, অনুভব করে, স্মরণ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এগুলিকে বলা হয় চেতনার অন্তর্মুখী প্রতিফলন (internalized reflection)—যেখানে অসীম চেতনা নিজেরই ভাব, বোধ ও কর্মকে সীমিত করে প্রকাশ করে।