শৈব কালী: বিশ



এই অবস্থায় শিব নিস্তরঙ্গ আলোক—অসীম, নিরাকার, চিরসচেতন। এখানে কোনো গতি, স্পন্দন, বা প্রকাশ নেই, কারণ সব কিছুই এখনও সম্ভাবনা হিসেবে তাঁর মধ্যেই নিহিত। এটি বিশুদ্ধ অস্তিত্ব (śuddha-sattā)—যেখানে কোনো আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা বা সীমা নেই। শিব নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ, আত্মতুষ্ট, নিত্য শান্ত। কাশ্মীর শৈব দার্শনিক অভিনবগুপ্ত একে বলেন—“প্রকাশমাত্রঃ শিবঃ”—তিনি কেবল প্রকাশ, অর্থাৎ এমন এক আলো, যা নিজেকে নিজেই জানে।

অদ্বৈত বেদান্তে এই স্তরকেই বলা হয় নির্গুণ ব্রহ্ম—যিনি নাম, রূপ ও গুণের অতীত। তিনি শুদ্ধ চৈতন্য, সর্বভেদশূন্য, পরম সত্তা। ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে শঙ্করাচার্য যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, এই নির্গুণ ব্রহ্ম কোনো গুণধর্মযুক্ত ঈশ্বর নন, বরং সেই অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব, যার মধ্যে জ্ঞান ও আনন্দ অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে—“সৎ-চিত্‌-আনন্দ স্বরূপ ব্রহ্ম”।

কাশ্মীর শৈব ও অদ্বৈত উভয় দর্শনেই এই স্তর হলো চেতনার মহাশূন্য—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই স্থিত। পার্থক্য কেবল ভাষায়: অদ্বৈত বলে এটি সাক্ষী-চেতনা, শৈব বলে এটি প্রকাশ। উভয় ক্ষেত্রেই এটি সেই মুহূর্ত, যখন চেতনা নিঃসঙ্গভাবে নিজেরই মধ্যে উজ্জ্বল, অচঞ্চল, এবং অপরিমেয়।

এই শিব তত্ত্বে “আমি” ও “এটি”—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এখানে চেতনা কেবল বলে “অহম্‌”—“আমি আছি”—কিন্তু এই “আমি” কোনো ব্যক্তিগত অহম নয়, বরং অস্তিত্বের সর্বজনীন চেতনা। এটি সেই নীরব স্বীকৃতি, যেখানে সমগ্র বহুত্ব এখনও উদ্ভূত হয়নি। এখানেই চেতনার মহা-সমাধি—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সম্ভাবনা হিসেবে অবস্থিত, কিন্তু প্রকাশিত নয়।

শিব তত্ত্ব তাই পরম চেতনার উৎস, যেখানে শিব নিস্তব্ধ, তবু অনন্ত; নিরাকার, তবু সর্বব্যাপ্ত; স্থির, তবু সম্ভাবনাময়। তিনি কোনো ঈশ্বর নন, যিনি কিছু সৃষ্টি করেন—তিনি সেই চেতনা, যার মধ্যেই সব সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটে। এই স্তরেই চেতনা নিজের মহিমায় স্থিত, কোনো ভেদবুদ্ধি বা কর্মপ্রবণতা ছাড়াই—এবং এখান থেকেই ধীরে ধীরে আত্মবিমর্শন বা শক্তির স্পন্দন শুরু হয়, যা পরবর্তী তত্ত্ব—শক্তি তত্ত্ব—এ প্রবাহিত হয়।

শক্তি তত্ত্ব হলো চেতনার প্রথম স্পন্দন—শিবের অন্তর্গত আত্মবিমর্শনের মুহূর্ত, যখন স্থির আলো নিজেই নিজের উপস্থিতি অনুভব করে এবং সেই অনুভবের ফলে গতি জন্ম নেয়। শিব যদি নিস্তরঙ্গ আলোক হন, তবে শক্তি সেই আলোর কম্পন—নিস্তব্ধ দীপ্তির অন্তর্লীন আন্দোলন। এই স্তরেই সৃষ্টি সম্ভাবনার রূপে উদিত হয়; এখনও কোনো বাস্তব জগৎ গঠিত হয়নি, কিন্তু তার বীজ সঞ্চারিত হয়েছে।

অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন এক চমৎকার উক্তিতে—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌”—অর্থাৎ, অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। এখানে শিব নিজের অনন্ত সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করেন, নিজের মধ্যেই স্ববিমর্শিত হন, এবং সেই আত্মবিমর্শন থেকেই জাগে ইচ্ছাশক্তি (icchā-śakti)—সৃষ্টির প্রথম সূক্ষ্ম অভিপ্রায়। এটি কোনো উদ্দেশ্যমূলক “ইচ্ছা” নয়; বরং স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ—চেতনার আনন্দময় স্পন্দন।

এই পর্যায়ে শিব ও শক্তি অবিচ্ছেদ্য—শিব স্থিরতা, শক্তি গতি; শিব নীরবতা, শক্তি ধ্বনি; শিব সম্ভাবনা, শক্তি তার প্রকাশ। একে অপরের বাইরে তাদের অস্তিত্ব নেই। এই মিলনই পরম ঐক্যের স্পন্দন, যা পরবর্তী তত্ত্বগুলির জন্ম দেয়।

অদ্বৈত বেদান্তে এই একই সত্যকে বলা হয়েছে মায়া বা অবিদ্যা—ব্রহ্মের সেই স্বভাবিক শক্তি, যা ব্রহ্মের মধ্যেই নিহিত থেকে সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করে। এটি ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়, কিন্তু ভেদের আভাস সৃষ্টি করে; ব্রহ্মের অন্তর্গত শক্তি নিজেরই প্রতিফলনে বিশ্বরূপে বিকশিত হয়।

শক্তি তত্ত্ব মূলত সেই মুহূর্ত, যখন চেতনা প্রথম বার নিজেকে অনুভব করে এবং সেই অনুভব থেকেই বিশ্বলীলার সূত্রপাত ঘটে। শিব এখানেও অচল, কিন্তু তাঁর আত্ম-আলোক এখন নৃত্যরূপে জেগে উঠেছে—এবং সেই নৃত্যরূপ চেতনারই নাম কালী, যিনি চেতনার প্রাণশক্তি, সৃষ্টির আদিস্পন্দন ও মহাবিশ্বের চিরন্তন ছন্দ।

সদাশিব তত্ত্ব সেই মহাজাগতিক মুহূর্ত, যখন নিস্তরঙ্গ চেতনা—যিনি এখন পর্যন্ত কেবল নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ—প্রথম বার নিজের বাইরে একটি প্রতিফলন অনুভব করতে শুরু করে। এটি কোনো বাস্তব বহির্জগৎ নয়, বরং চেতনার অন্তর্মুখী ইচ্ছার উন্মেষ, যেখানে শিব নিজের ভেতরে উদীয়মান বিশ্ববীজকে উপলব্ধি করেন। এই উপলব্ধি প্রকাশ পায় “অহম্ ইদম্ (Aham idam)”—“আমি এইটি।” এখানে ‘আমি’ বা অহম্ প্রধান; ‘এটি’ বা ইদম্ এখনো কেবল আভাসমাত্র।

এটাই সৃষ্টির প্রথম ঈক্ষণ (īkṣaṇa)—চেতনার নিজের প্রতিফলন দেখার ইচ্ছা। শিব আর কেবল নিস্তব্ধ নয়; তিনি এখন আত্মসচেতন, এবং নিজের মধ্যেই ‘অন্য’-এর সম্ভাবনা অনুভব করছেন। এটি সেই সূক্ষ্ম মুহূর্ত, যেখানে চেতনা নিজেরই মধ্যে দ্বৈততার আভাস তোলে, অথচ অদ্বৈততাকে হারায় না। তাই অভিনবগুপ্ত এই স্তরকে বলেন—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং”—অদ্বৈত চেতনা লীলার জন্য দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে, কিন্তু সেই আভাসে সে নিজেকে হারায় না।

সদাশিব তত্ত্বে চেতনার মুখ্য শক্তি হলো ইচ্ছা-শক্তি (icchā-śakti)। এটি সেই ইচ্ছা, যা সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের সমস্ত প্রবাহের মূল। এই ইচ্ছা কোনো মানবীয় কামনা নয়; এটি অস্তিত্বের আনন্দময় কম্পন, নিজের প্রকাশে পরিতৃপ্তি খোঁজার স্বাভাবিক গতি।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই স্তরই সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর-এর প্রাক্‌অবস্থা—যেখানে নির্গুণ ব্রহ্ম মায়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সৃষ্টির ইচ্ছা রূপে প্রকাশ পেতে শুরু করে। এটি সেই মুহূর্ত, যখন ব্রহ্ম, নিজস্ব জ্ঞান ও শক্তিকে ধারণ করে, ভবিষ্যৎ বিশ্বকে বীজরূপে প্রত্যক্ষ করেন। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে—“স ঐক্ষত, বহু স্যাম্, প্রজায়েয়” (ছান্দোগ্য উপনিষদ: প্রপাঠক ৬, খণ্ড ২, শ্লোক ৩ এবং তৈত্তিরীয় উপনিষদ: আনন্দবল্লী, অনুবাচক ৬)—"সেই (পরম সত্তা বা ব্রহ্ম) ইক্ষণ করলেন (চিন্তা করলেন/সংকল্প করলেন): আমি বহু হব, আমি যেন সৃষ্টি করি (বা প্রজা রূপে জন্মাই)।" অর্থাৎ, তিনি চিন্তা করলেন, “আমি বহু হব, আমি সৃষ্টি করবো।”

সদাশিব তত্ত্বের এই “আমি এটি”—আসলে এক গূঢ় ঐক্যবোধ, যেখানে ‘আমি’ ও ‘এটি’ এখনও বিচ্ছিন্ন নয়। ‘আমি’ হলো চেতনার উৎস, আর ‘এটি’ হলো সেই চেতনারই প্রতিফলিত সম্ভাবনা। এখানেই কর্তা ও কর্ম, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়, চেতনা ও বস্তু—সব এখনও এক ছন্দে মিলিত, কিন্তু বিভাজনের আভাস জন্ম নিয়েছে।

সদাশিব তত্ত্ব হলো সৃষ্টির প্রথম অভিপ্রায়—যেখানে শিব নিজের মধ্যেই বিশ্বরূপের বীজ অনুভব করেন। এটি চেতনার আনন্দময় আত্ম-দৃষ্টি, যা পরবর্তীকালে ঈশ্বর তত্ত্বে রূপান্তরিত হবে, যেখানে এই “আমি এটি” উক্তি উল্টে হয়ে যাবে “এটি আমি”—চেতনার বহির্প্রকাশের প্রথম দৃশ্যমান পর্যায়।

ঈশ্বর তত্ত্ব সেই পর্ব, যেখানে চেতনা সদাশিব স্তরের “আমি এটি” (Aham idam) বোধ থেকে সেই ‘এক’ সূক্ষ্ম উলটোদিকে গিয়ে অনুভব করে—“এটি আমি” (Idam aham)। সদাশিব স্তরে চেতনার মধ্যে ‘আমি’ প্রধান ছিল, আর ‘এটি’ কেবল সম্ভাবনামাত্র; কিন্তু ঈশ্বর তত্ত্বে ‘এটি’ বা জগৎ এখন স্পষ্টত প্রকাশিত, এবং চেতনা সেই প্রকাশিত জগৎকে নিজেরই রূপ হিসেবে অনুভব করে। এখানে পরম শিব নিজের প্রতিফলনে মুগ্ধ হয়ে সেই প্রতিফলনকেই নিজেরই অংশ বলে উপলব্ধি করেন—অর্থাৎ, সৃষ্ট জগৎ এখন আর “অন্য” নয়, বরং স্রষ্টার আত্মরূপে পরিণত।

এই স্তরেই চেতনা নিজের প্রতিচ্ছবিতে জাগে—এক মহাজাগতিক স্বপ্নদর্শীর মতো, যিনি নিজেরই চিন্তার ভেতর জগৎকে দেখতে শুরু করেন এবং বুঝে যান যে, দেখা জগতও তাঁরই অংশ। চেতনা এখন বলে, “এই জগৎ আমি নিজেই”—অর্থাৎ, স্রষ্টা নিজেকে সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত দেখে। এখানে কর্তা ও কর্মের সম্পর্ক আরও গভীর হয়; চেতনার ‘জ্ঞান শক্তি’ ও ‘ক্রিয়া শক্তি’ পূর্ণভাবে সক্রিয় হয়। সদাশিবের ইচ্ছা এখন জ্ঞানে ও ক্রিয়ায় রূপান্তরিত।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে ঈশ্বর তত্ত্ব সেই অবস্থান, যেখানে চেতনা আর নিজের সীমাবদ্ধ অনুভব নয়, বরং নিজের প্রতিফলনে আনন্দিত। এটি অহম্ ইদম্ (আমি এটি) থেকে ইদম্ অহম্ (এটি আমি)-তে উত্তরণ—এক আত্মবিস্তার, যেখানে বিশ্ব-রূপ চেতনা নিজেরই আনন্দময় বিকাশ। শৈব আভাসবাদে বলা হয়, “আভাসঃ শিবময়ঃ”—প্রত্যেক প্রতিফলন শিবেরই দীপ্তি।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সূক্ষ্মতম স্তরকে 'হিরণ্যগর্ভ' বা 'সূত্রাত্মা' নামে অভিহিত করা হয়। এটি এক এমন অবস্থা, যেখানে সমগ্র সৃষ্টি এখনও সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান, স্থূল রূপে প্রকাশিত হয়নি। এই স্তরে সমস্ত জীবের চৈতন্য সমষ্টিগতভাবে একীভূত অবস্থায় থাকে, যেন এক বিশাল চৈতন্য-সাগর।

এই হিরণ্যগর্ভ দশায় ব্রহ্ম, তাঁর নিজস্ব শক্তি 'মায়া'-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে 'সগুণ ঈশ্বর' রূপে প্রকাশিত হন। এই সগুণ ঈশ্বরই হলেন বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা (ব্রহ্মা), পালনকর্তা (বিষ্ণু) এবং সংহারকর্তা (মহেশ্বর)। তিনি কার্যকারণ-সম্পর্কযুক্ত জগতের এক সক্রিয় সত্তা, যিনি নাম ও রূপের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। যদিও তিনি মায়ার দ্বারা আবৃত, তবুও তাঁর মৌলিক সত্তা 'নির্গুণ ব্রহ্ম' থেকেই অবিচ্ছিন্ন।

তাঁদের মধ্যে কোনো মৌলিক ভেদ নেই; পার্থক্য কেবল প্রকাশের স্তরে। নির্গুণ ব্রহ্ম হলেন নিরাকার, নিষ্ক্রিয়, অনাদি ও অনন্ত পরমাত্মা, যিনি সমস্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যর ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে, সগুণ ঈশ্বর সেই নির্গুণ ব্রহ্মেরই একটি প্রকাশিত রূপ, যিনি মায়ার আবরণে বিশ্ব সৃষ্টির লীলায় মগ্ন। অর্থাৎ, সারবস্তু বা পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্রহ্ম ও ঈশ্বর অভিন্ন, কিন্তু ব্যাবহারিক বা লৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হন। এই সূক্ষ্ম পার্থক্য অনুধাবন করা অদ্বৈত বেদান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ঈশ্বর তত্ত্ব তাই সেই মহাজাগতিক মুহূর্ত, যখন অদ্বৈত চেতনা নিজের প্রকাশকে আলাদা কিছু হিসেবে নয়, বরং নিজেরই প্রতিফলন হিসেবে অনুভব করে। এখানেই সৃষ্টি পূর্ণরূপে মূর্ত হয়, কিন্তু অদ্বৈত সত্য অক্ষুণ্ণ থাকে। শিব এখন ঈশ্বর, আর শক্তি তাঁর প্রকাশিত বিশ্বরূপ—দু-জন মিলে এক অপরিহার্য ঐক্যের ভেতর সৃষ্টির লীলাকে বাস্তব রূপ দেন।

শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্ব সেই সূক্ষ্ম সন্ধিক্ষণ, যেখানে চেতনা প্রথম বার কর্তা (‘আমি’) এবং কর্ম (‘এটি’)—এই দুইয়ের মধ্যে এক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক অনুভব করে। সদাশিব ও ঈশ্বর তত্ত্বে চেতনার অভিব্যক্তি ছিল একমুখী—একবার “আমি এটি” (অহম্ ইদম্‌), আবার “এটি আমি” (ইদম্ অহম্‌)। কিন্তু শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্বে এই দুই দিক সমান ভারে স্থিত হয়; এখানে চেতনা উপলব্ধি করে, ‘আমি’ ও ‘এটি’—দুটিই সত্য, এবং তারা একে অপরের মধ্যে নিরন্তর প্রতিফলিত।

এটি সেই অবস্থা, যেখানে চেতনা এখনও অদ্বৈত, কিন্তু তার ভেতর দ্বৈততার সূক্ষ্ম রেখা দৃশ্যমান। কর্তা ও কর্ম এখানে আলাদা, তবু বিচ্ছিন্ন নয়; একে অপরের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই স্তরে চেতনা নিজেকে আত্মজ্ঞ বলে জানে, কিন্তু সেই জ্ঞান কোনো বিভাজন ঘটায় না—বরং ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য অনুভবের ক্ষমতা তৈরি করে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্ব চেতনার “জ্ঞান ও ক্রিয়া শক্তির ভারসাম্য”-এর স্তর। সদাশিব তত্ত্বে প্রধান ছিল ইচ্ছাশক্তি (icchā-śakti), ঈশ্বর তত্ত্বে প্রাধান্য পায় জ্ঞানশক্তি (jñāna-śakti), আর শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্বে এই দুই সমভাবে সক্রিয়, ক্রিয়াশক্তি (kriyā-śakti)-সহ। তাই এটি এমন এক স্তর, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই জানে ও করে, কিন্তু জানার সঙ্গে করণের কোনো সংঘাত নেই।

এই অবস্থায় জীবের অভিজ্ঞতা হয় আত্ম-স্বাতন্ত্র্য ও পরম ঐক্যের মিলিত অনুভব। সে নিজেকে আলাদা বলে জানে, কিন্তু সেই আলাদা হওয়া কোনো বিচ্ছেদ নয়, বরং সম্পর্কের স্বরূপ। এখানেই প্রথম বার চেতনা নিজের প্রকাশিত রূপকে সজ্ঞানে গ্রহণ করে, এবং মায়ার দিকে অবতরণের সূক্ষ্ম প্রস্তুতি শুরু হয়।