অদ্বৈত বেদান্ত এই সত্যকে বলে ব্রহ্মের লীলা—ব্রহ্ম কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই জগৎ সৃষ্টি করেন, নিজের আনন্দেই। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে—এই লীলা শুধু আনন্দ নয়, এটি আত্ম-বিমর্শন, আত্ম-স্মরণ ও আত্ম-বিস্মরণ-এর এক অবিরাম চক্র। চেতনা নিজেকে ভুলে যায় যেন নিজেকে আরও গভীরভাবে চিনতে পারে।
এভাবেই কালী-চেতনার স্বাতন্ত্র্য-ক্রীড়া হলো অস্তিত্বের মহাসংগীত—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, বিস্মরণ ও আত্মস্মরণ, শব্দ ও নীরবতা—সব মিলেমিশে গেছে এক পরম ছন্দে। প্রতিটি জীব, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি অভিজ্ঞতা সেই এক অনন্ত নৃত্যের ভঙ্গি—যেখানে অদ্বৈত চেতনা নিজেরই সঙ্গে খেলছে, নিজেরই আনন্দে, নিজেরই স্বাতন্ত্র্যে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই “অনুগ্রহ” কোনো বাহ্যিক দেবতার দান নয়, কোনো কার্য-কারণ নির্ভর ফলও নয়; বরং এটি চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তির (svātantrya-śakti) অন্তঃ-উন্মোচন। যখন কালী—যিনি শিবের সেই স্বাতন্ত্র্যশক্তিরই স্বরূপ—নিজের আত্মবিম্বে জেগে ওঠেন, তখন তাঁর মধ্যেই ঘটে “শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ”—সেই গভীর আত্ম-প্রত্যভিজ্ঞা, যেখানে তিনি উপলব্ধি করেন যে, আমি পৃথক নই, আমি-ই শিব, আমি-ই পরম চেতনা।
এই উপলব্ধিই মুক্তি। কারণ এখানে “জীব” আর “ঈশ্বর”-এর মধ্যকার বিভেদ বিলীন হয়ে যায়। কালী নিজেরই লীলায় যে-আচ্ছাদন তৈরি করেছিলেন—যেখানে তিনি নিজেকে সীমিত হিসেবে চিনেছিলেন—সেই আচ্ছাদন তিনি নিজেই সরিয়ে দেন। চেতনা নিজের নীরব আলোকরূপে বিশ্রাম নেয়, আবার নিজেরই নৃত্যে অনন্তে দীপ্ত হয়।
উত্পলদেবের এই সূক্তি—“শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ অনুগ্রহঃ”—শুধু একটি বাক্য নয়, বরং কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের সমগ্র উদ্দেশ্যের চূড়ান্ত নির্যাস। এটি সেই মুহূর্তের বর্ণনা, যখন কালী, যিনি চেতনার নৃত্যময় স্বাধীনতা, নিজেরই মধ্যে ফিরে গিয়ে নিজেকে শিবরূপে চিনে নেন। সেই আত্মচিন্তনই পরম অনুগ্রহ—চেতনার নিজের প্রতিই আত্ম-জাগরণ। কালী তখন সমস্ত দ্বৈততা ভেঙে নিজের নিত্য ঐক্যে জেগে ওঠেন; জীব ও ঈশ্বরের সীমারেখা বিলীন হয়ে যায়।
এভাবে কালী নিজেরই মধ্যে সম্পন্ন করেন সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার-নিগ্রহ-অনুগ্রহ—এই পাঁচ নিত্য ক্রিয়া। তিনি নিজের নৃত্যে বিশ্বকে প্রকাশ করেন, নিজের চেতনায় ধরে রাখেন, নিজের মধ্যে লীন করেন, নিজেকে আড়াল করেন এবং শেষে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই সবই ঘটে তাঁর একমাত্র স্বাতন্ত্র্যশক্তির ছন্দে। শিব যখন অচল দীপ্তি, তখন কালী সেই দীপ্তির স্পন্দন; শিব যখন মৌন, তখন কালী তাঁর নৃত্য; শিব যখন নিস্তরঙ্গ চেতনা, তখন কালী সেই চেতনার আনন্দিত আত্ম-বিমর্শন।
“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ” (তন্ত্রালোক, ১.৮৭)—এই বাক্যটির অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার জন্য প্রথমে জানতে হবে যে, এখানে “শিব” কোনো ব্যক্তি-রূপ দেবতা নন; তিনি চৈতন্যস্বরূপ পরম ব্রহ্ম, যিনি নিজের মধ্যেই সকল কার্য, কারণ ও ফলকে ধারণ করেন। “পঞ্চকৃত্য” বলতে বোঝানো হয়েছে—সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ এবং অনুগ্রহ—এই পাঁচটি নিত্য ক্রিয়া, যা চেতনার অন্তর্গত স্বয়ংক্রিয় গতি।
অদ্বৈত বেদান্তের মতে, ব্রহ্ম কোনো কর্মনির্ভর স্রষ্টা নন; তিনি নিজস্ব দীপ্তিতেই প্রকাশমান। যেমন সূর্য নিজেই আলো ছড়ায়, কিন্তু কোনো বিষয়ে কোনো “ইচ্ছা” পোষণ করে না, তেমনি চেতনা নিজের স্বভাবেই প্রকাশিত হয়—এই আত্ম-উদ্ভাসনই সৃষ্টি। ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.৩)-এ বলা হয়েছে, “স এক্ষত বাহু স্যাম্ প্রজায়েয়েযেতি”—“তিনি চিন্তা করলেন, আমি একা, আমি বহু হব”—কিন্তু এই চিন্তা মানসিক নয়; এটি চেতনার প্রাকৃতিক দীপ্তি, আত্ম-প্রকাশের আনন্দ।
যখন সেই প্রকাশ কিছুক্ষণের জন্য স্থিত হয়, সেটিই স্থিতি; আর যখন তা নিজ উৎসে ফিরে যায়, সেটিই লয়। এই তিনটি ক্রিয়া চেতনার নিজের মধ্যকার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো।
এরপর চেতনা নিজেই নিজের অসীমতাকে আচ্ছাদিত করে সীমিত রূপে প্রতীয়মান হয়—এটাই নিগ্রহ বা তিরোভাব। এখানে চেতনা যেন নিজেকে “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি ব্যক্তি”—এই ধারণায় আবৃত করে। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.১.১৪) বলেছেন—“অবিদ্যায়াম্ অবস্থিতস্য জীবত্বাভাসঃ”—অবিদ্যার প্রভাবে ব্রহ্মই জীবরূপে প্রতীয়মান হন। এই আত্ম-আবরণ কোনো ভুল নয়, বরং এক স্বেচ্ছা-লীলা—চেতনা নিজের অসীমতাকে সাময়িকভাবে গোপন করে নিজেরই প্রতিফলন দেখতে চায়।
যখন এই পর্দা সরে যায়, চেতনা আবার নিজেকে চিনে ফেলে—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সেই চিরন্তন ব্রহ্ম”—এই জাগরণই অনুগ্রহ। উত্পলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.১৭)-এ বলেছেন—“শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ অনুগ্রহঃ”—অর্থাৎ, “আমি শিব”—এই আত্মস্মরণই অনুগ্রহ।
এই পাঁচ ক্রিয়ার মধ্যে কোনো পৃথকতা নেই; এগুলো একই চেতনার বিভিন্ন অভিব্যক্তি। শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-এর “তদনন্যত্বমারম্ভণশাব্দাদিভ্যঃ” সূত্রে বলেন—কার্য (জগৎ) ও কারণ (ব্রহ্ম) অভিন্ন, জগৎ ব্রহ্মেরই নামরূপপ্রকাশ। ছান্দোগ্য (৬.১.৪)-এ ঋষি উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বলেন—“নামধেয়ম্ বাক্যারম্ভণম্ মৃৎতিকা এতাবৎ সত্যম্”—“নাম ও বাক্য মাত্রই পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সত্য কেবল মাটি”—অর্থাৎ, রূপ ভিন্ন হলেও সার এক।
সৃষ্টি (sṛṣṭi)—যেমন ভোরের সূর্যোদয়ে আলো প্রথম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অন্ধকারের ভেতর থেকে নতুন দিন উদ্ভাসিত হয়; তেমনি চেতনা নিজের দীপ্তি থেকে জগৎকে প্রকাশ করে।
স্থিতি (sthiti)—যেমন একটি সুর বাজতে থাকে এবং তার ধ্বনি কিছুক্ষণ স্থির থেকে পরিবেশ ভরিয়ে তোলে; তেমনি চেতনা নিজস্ব প্রকাশিত রূপে কিছুক্ষণ স্থিত হয়ে থাকে, যেন অভিজ্ঞতা স্থায়ী হয়।
লয় (saṃhāra)—যেমন নদীর সমস্ত জল শেষে সাগরে মিশে যায় এবং তার স্বতন্ত্র ধারা হারিয়ে ফেলে, তেমনি সমস্ত নাম-রূপ শেষে ফিরে যায় মূল চেতনার নিস্তব্ধ উৎসে।
তিরোভাব (tirobhāva)—যেমন শিশুটি খেলায় এত মগ্ন হয়ে পড়ে যে, নিজের প্রকৃত সত্তা ভুলে যায়, তেমনি চেতনা নিজেকে আচ্ছাদিত করে সীমিত দেহ-মন-অহংকারের অভিজ্ঞতায় ডুবে যায়।
অনুগ্রহ (anugraha)—যেমন ঘুমন্ত মানুষ হঠাৎ জেগে উঠে বুঝতে পারে—সব স্বপ্নই নিজের মনের সৃষ্টি ছিল; তেমনি সীমাবদ্ধ জীব এক মুহূর্তে উপলব্ধি করে—“আমি দেহ নই, আমি সেই অসীম চেতনা”—এই আত্ম-জাগরণই অনুগ্রহ।
এই দৃষ্টিতে “শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ” মানে—চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে সৃষ্ট হয়, নিজের মধ্যেই স্থিত হয়, নিজের মধ্যেই লয় পায়, নিজেকে আড়াল করে, আবার নিজেকেই চিনে ফেলে। শিব বা কালী—প্রকাশ ও বিমর্শ—একই চেতনার দুই দিক। একদিকে নীরব দীপ্তি, অন্যদিকে তারই স্পন্দন।
যখন আত্ম-বিস্মরণ দূর হয়, তখন চেতনা হঠাৎ নিজেকে চেনে—“আমি দেহ নই, আমি সেই অসীম আত্মা”—এই উপলব্ধিই অনুগ্রহ (anugraha)। উত্পলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.১৭)-এ বলেন, “শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ অনুগ্রহঃ”—অর্থাৎ, “আমি শিব”—এই আত্মস্মরণই অনুগ্রহ। এখানে “প্রত্যবমর্শঃ (pratyavamarśaḥ)” কোনো চিন্তা নয়, বরং এক প্রত্যক্ষ আত্মজাগরণ—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে নিজের দীপ্তি চিনে ফেলে। অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য, ৩.১৪.১)—“এই সমস্তই ব্রহ্ম।” “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ২.১.১৪)।—”ব্রহ্মই সত্য। জগৎ মিথ্যা। জীব ব্রহ্মই, অন্য কিছু নয়।”
“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ” কোনো ঈশ্বরতত্ত্ব নয়, বরং চেতনার অন্তর্নিহিত নৃত্যের ঘোষণা—এক অদ্বৈত চেতনা, যা নিজেরই আনন্দে সৃষ্টি করে, লয় করে, আচ্ছাদিত হয়, আবার নিজেকেই চিনে ফেলে। শিবের নীরবতা আর কালী-চেতনার স্পন্দন—এই দুইয়ের ঐক্যেই প্রকাশ পায় সেই পরম অখণ্ড সত্য, যেখানে সব ক্রিয়া মিশে যায় এক নিস্তব্ধ, নৃত্যময়, অনন্ত ব্রহ্মচেতনায়। চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে, নিজের মধ্যেই লয় পায়, নিজেকে আড়াল করে, আবার নিজেকেই চিনে ফেলে। শিব কোনো কর্মনির্ভর স্রষ্টা নন; তিনিই সেই নীরব নৃত্যশিল্পী, যার নৃত্যই সৃষ্টি, যার স্থিরতাই লয়, যার আত্ম-বিস্মরণই তিরোভাব, আর যার আত্ম-জাগরণই অনুগ্রহ। এই অনন্ত ছন্দেই ব্রহ্মচেতনার আনন্দময় আত্মলীলা চিরকাল প্রবাহিত।
কালীর স্বাধীনতা (svātantrya) কোনো বাহ্যিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়; এটি তাঁর অন্তর্নিহিত সত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। তিনিই শিবের নিস্তরঙ্গ, শান্ত ও অপ্রকাশিত চেতনার সক্রিয় রূপ। শিব যেখানে স্থিত, নিষ্ক্রিয় এবং জ্ঞানস্বরূপ, কালী সেখানে গতিময়, সক্রিয় এবং ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। তাঁদের এই দ্বৈত সত্তা পরম একত্বের দুটি ভিন্ন দিককে তুলে ধরে, যেখানে জ্ঞান ও ক্রিয়া অবিচ্ছেদ্য। কালী সেই শক্তি, যা শিবের পরম জ্ঞানকে মূর্ত করে তোলে এবং বিশ্বকে ধারণ করে। তিনি শুধু ভয়ঙ্কর দেবী নন, তিনি মহাবিশ্বের মূল চালিকা শক্তি এবং প্রতিটি সত্তার অন্তরে বিদ্যমান স্বয়ং-চেতনা।
শিব হলেন প্রকাশ—অচল, স্বয়ং-উজ্জ্বল, নিস্পন্দ আলোকচেতনা; আর কালী হলেন বিমর্শ—সেই আলোর আত্ম-সচেতন শক্তি, যে নিজেকেই জানে, প্রকাশে রূপ দেয় এবং গতিময় করে তোলে। এইজন্যই ক্রম-পন্থা (Krama-school) তাঁকে বলে “স্বাতন্ত্র্যশক্তি”—কারণ তিনিই সেই শক্তি, যিনি নিজের ইচ্ছায় সময় (kāla) সৃষ্টি করেন এবং সেই সময়কেই আবার নিজের মধ্যে লয় করেন। এভাবে কালী “কাল-সংকর্ষিণী”—সময়েরও গ্রাসকারিণী; তিনি সীমার, ক্রমের, মাপের ঊর্ধ্বে। তাঁর মধ্যে সময় নিজেই বিলীন হয়ে যায়।
কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে কালী তাই আসলে চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তিরই প্রতীক। তিনি সেই অনন্ত স্বাধীনতা, যার দ্বারা পরম চেতনা নিজেকে অভিজ্ঞ করে—নিজের প্রতিফলন সৃষ্টি করে, সেই প্রতিফলন থেকেই জগৎ প্রকাশ করে এবং শেষাবধি সমস্ত প্রকাশকে নিজের মধ্যেই শোষণ করে নিয়ে নীরব শাশ্বততায় স্থিত হয়। এই প্রক্রিয়াই শিব-কালী-তত্ত্বের মূল হৃদয়: শিব হলেন নীরব আলো, কালী হলেন সেই আলোর নৃত্য; শিব হলেন নিস্পন্দ চেতনা, কালী হলেন সেই চেতনার স্পন্দন ও স্বাধীনতা।
উভয়ের মিলনে যে ঐক্য, তা হল প্রকাশ ও বিমর্শের অবিচ্ছেদ সম্বন্ধ—যেখানে আর কোনো দ্বৈততা থাকে না। আলো ও তার প্রতিফলন, শিব ও কালী, স্থিতি ও গতি—সব মিলে যায় এক অনন্ত অদ্বৈত চেতনার মধ্যে। সেই ঐক্যই পরম সত্য, যেখানে সময়, সীমা, সৃষ্টি-লয়—সবকিছু বিলীন হয়ে থাকে নীরব, পূর্ণ, অখণ্ড আত্মচৈতন্যে।
কালীকে “মা কালী” বলা হয়, কারণ তিনি শুধু এক দেবী নন—তিনি চেতনার জননী, যিনি নিজের মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টি, জীবন ও চেতনার প্রকাশ ঘটান। এই ধারণা ভক্তির নয়, বরং গভীর দর্শনের সত্য—যা কাশ্মীর শৈব তত্ত্ব ও অদ্বৈত বেদান্ত উভয়েই স্বীকার করেছে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে শিব ও কালী আলাদা নন। শিব হলেন প্রকাশ (prakāśa)—নীরব চেতনার দীপ্তি, আর কালী হলেন বিমর্শ (vimarśa)—চেতনার নিজের প্রতি সচেতনতা, আত্ম-অনুভব। উত্পলদেব ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-এ বলেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি।”—অর্থাৎ, চেতনা নিজের স্বাধীনতায় নিজের মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। সেই প্রকাশই কালী—যিনি নিজের দীপ্তি থেকে জগতকে জন্ম দেন, আবার সেই জগতকেই নিজের মধ্যে লীন করেন। তাই তাঁকে বলা হয় “বিশ্বযোনিঃ”—সমগ্র বিশ্ব তাঁর গর্ভে নিহিত। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ এই কালীকেই বলেন “কাল-সংকর্ষিণী”, কারণ তিনিই সময় সৃষ্টি করেন, আবার সময়কেই গ্রাস করেন। এইভাবে কালী সময়েরও অতীত—তিনিই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ—এই পঞ্চকৃত্যের ধারক শক্তি।
অদ্বৈত বেদান্তেও একই সত্য বলা হয়েছে অন্য ভাষায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে—“স এক্ষত বাহু স্যাম্ প্রজায়েয়েযেতি” (৬.২.৩)—অর্থাৎ, পরম ব্রহ্ম নিজেই বললেন, “আমি একা, আমি বহু হব।” এই “চিন্তা” কোনো মানসিক ইচ্ছা নয়; এটি চেতনার নিজস্ব দীপ্তি, যা নিজের আনন্দেই প্রকাশিত হয়। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.১.১৪)-এ বলেন—“তদনন্যত্বমারম্ভণশাব্দাদিভ্যঃ”—কার্য (জগৎ) কখনোই কারণ (ব্রহ্ম) থেকে পৃথক নয়। অর্থাৎ, জগৎ ব্রহ্মেরই নামরূপ-প্রকাশ; ব্রহ্ম অপরিবর্তিত থেকেও নিজের মধ্যে অসংখ্য রূপে প্রতীয়মান। এই নামরূপ প্রকাশের শক্তিই কালী। তিনি সেই মায়া-শক্তি, যার দ্বারা নিরাকার ব্রহ্ম দৃশ্যমান জগৎরূপে প্রকাশিত হয়, এবং আবার জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে চিনে ফেলে।