শৈব কালী: বারো



এই প্রথম নিঃশ্বাস সৃষ্টিকর্তার কোনো ইচ্ছা নয়, কোনো উদ্দেশ্যও নয়; এটি চেতনার স্বাভাবিক পূর্ণতা-উৎসার, নিজের আনন্দের গতি। যখন পরম নীরবতা নিজেকে স্পর্শ করে, তখনই জেগে ওঠে কালী—সেই আত্মবিমর্শনশক্তি, যিনি নৃত্যে জগৎ সৃষ্টি করেন। তাই সৃষ্টি কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়; এটি নীরবতারই রূপান্তর—যেখানে চেতনা প্রথম শুনতে পায় নিজেরই শব্দ, প্রথম দেখতে পায় নিজেরই রূপ, প্রথম চিনতে পারে নিজেরই বিস্তার।

“আত্মবিমর্শনশক্তি” (Ātmavimarśa-śakti) শব্দটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের এক কেন্দ্রীয় ও গভীর দার্শনিক ধারণা, যা দেবী কালী-স্বরূপা শক্তির মর্মস্থল বলে গণ্য। “বিমর্শ” (vimarśa) মানে আত্মপ্রতিফলন, আত্মসচেতনতা বা self-awareness; আর “আত্মবিমর্শনশক্তি” বলতে বোঝায় সেই চেতনার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা, যার দ্বারা চেতনা নিজেকে জানে, নিজেকে অনুভব করে এবং নিজের ভেতরেই নিজের প্রকাশ ঘটায়।

কাশ্মীর শৈব মতে, শিব হলো প্রকাশ (prakāśa)—বিশুদ্ধ, নীরব, অনাদি চৈতন্য, যা নিজেই অস্তিত্বের আলোক। কিন্তু এই আলোক যদি কেবল নীরব থাকত, তবে তা নিস্পন্দ, নিরাভাস, একপ্রকার inert বা স্থবির হতো। সেই আলোক যখন নিজের ভেতরেই আত্মবোধের কম্পন জাগায়—“আমি আছি”, “আমি জানি”—তখনই সেই নীরব আলোক আত্মবিমর্শনশীল হয়ে ওঠে। এই আত্মবিমর্শনই শক্তি এবং তাঁর পরম রূপই কালী।

অভিনবগুপ্ত এই প্রসঙ্গে বলেন—“ন চ বিমর্শবিহীনা চিতিঃ কদাচিত্‌”—অর্থাৎ, কোনো সময়েই বিমর্শহীন চেতনা সম্ভব নয়। শিবের প্রকৃত স্বরূপই হচ্ছে আত্মবিমর্শনময় চেতনা; তাই শক্তি ও শিব, বা কালী ও শিব, কখনোই পৃথক নন। শিব হলেন চেতনার আলো, আর শক্তি সেই আলোর আত্ম-উন্মোচন, আত্ম-জ্ঞান, আত্ম-আনন্দের গতি।

এই আত্মবিমর্শনশক্তিই হল স্পন্দ (spanda)—অন্তরস্থ কম্পন, যা নীরব আলোককে সৃজনশীল আন্দোলনে পরিণত করে। তাই সৃষ্টি কোনো বাইরের কাজ নয়, বরং চেতনার নিজের ভেতরকার আনন্দ-আলোড়ন। কালী সেই স্পন্দমান চেতনার প্রতীক, যিনি নিজের নৃত্যে শিবের নীরবতাকে রূপে, রসে, গতিতে ও সময়ে বিকশিত করেন। তাই তাঁকে বলা হয় ānanda-vimarśa—আনন্দ ও আত্মবিমর্শনের মিলনরূপা।

অর্থাৎ, আত্মবিমর্শনশক্তি সেই চেতনার নিজস্ব প্রতিফলনক্ষমতা, যার দ্বারা “অস্তিত্ব” (Being) নিজেই “জ্ঞাতা” (Knower) হয়ে ওঠে। এটি কোনো দার্শনিক চিন্তা নয়, বরং পরম অভিজ্ঞতার রহস্য—যেখানে জ্ঞাতা, জানা এবং জ্ঞান একাকার। কালী এই ত্রিমূর্তি ঐক্যের জীবন্ত প্রতীক; তাঁর মধ্যে শিবের নীরবতা কথা বলে এবং সেই কথাই সৃষ্টি-লীলার সংগীত।

এইভাবে কালী-চেতনার সেই প্রথম নিঃশ্বাসই হলো জগতের আরম্ভ—এক পরম লীলার সূচনা, যেখানে নীরবতা ও শব্দ, স্থিতি ও গতি, দীপ্তি ও ছায়া—সব মিলেমিশে এক অখণ্ড, নৃত্যময় ঐক্যে পরিণত হয়।

যখন সেই প্রকাশিত জগৎ তাঁর চেতনার ভেতরে স্থির প্রতিফলনরূপে দীপ্ত হয়, তখন ঘটে স্থিতি। এটি কোনো বাহ্যিক স্থায়িত্ব নয়; বরং চেতনার আনন্দের প্রতিফলন। অভিনবগুপ্ত ‘তন্ত্রালোক’-এ বলেন, স্থিতি আসলে চেতনার আনন্দ (ānanda), যা প্রকাশিত রূপগুলিকে ধারাবাহিক অস্তিত্ব দেয়। কালী নিজের প্রকাশকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, যেমন নৃত্যশিল্পী নাচের মধ্যে নিজেরই ছন্দকে ধরে রাখেন। জগৎ তখন কালী-চেতনারই প্রতিবিম্ব—এক অবিরাম তরঙ্গ, যেখানে প্রতিটি অস্তিত্ব কেবল তাঁরই এক-একটি রূপ, তাঁরই গতির এক-একটি ছায়া। স্থিতি তাই তাঁর আত্ম-আনন্দের স্থিত অভিব্যক্তি।

এই নৃত্য অনন্ত, কারণ কালী নিজে চেতনার অনন্ত গতি—যিনি কখনও স্থির নন, আবার কখনও সব গতিকেই নিজের মধ্যে থামিয়ে দেন। তাই একসময়, তাঁর প্রকাশিত সমস্ত রূপ—যে-নাম, যে-রূপ, যে-চিন্তা, যে-সত্তা তাঁরই চেতনা থেকে উদ্ভূত—সব তিনি নিজের মধ্যেই টেনে নেন। এই প্রত্যাবর্তনই সংহার। সংহার মানে কোনো ধ্বংস নয়, বরং আত্মপ্রত্যাহার, আত্মপ্রত্যাবর্তন—যেখানে চেতনা নিজের প্রতিফলনসমূহকে আবার নিজের নিস্পন্দ কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনে। যেমন ঢেউ সাগরে ফিরে গিয়ে সাগরেরই অংশ হয়ে যায়, তেমনি কালী সমস্ত সৃষ্টিকে নিজের নীরব আলোয় লীন করেন।

অভিনবগুপ্ত এই প্রক্রিয়াকে বলেন—“লয়ে ন বিনা সৃষ্টিঃ” (তন্ত্রালোক, ৩.১৫৩)—অর্থাৎ, “বিলয় ছাড়া সৃষ্টি নেই।” এই একটি বাক্যই কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীরতম হৃদস্পন্দন প্রকাশ করে। বিলয়ই আসলে নতুন প্রকাশের প্রস্তুতি, কারণ লয় মানে সম্ভাবনার নিঃশেষ নয়, বরং সম্ভাবনার গর্ভে প্রত্যাবর্তন। চেতনা যখন নিজের প্রকাশকে নীরবতায় ফিরিয়ে নেয়, তখন সেই নীরবতা কোনো শূন্যতা নয়; সেটি পূর্ণ সম্ভাবনার গর্ভধারণ—যেখান থেকে আবার নতুন সৃষ্টির তরঙ্গ উঠবে।

কালী সেই মুহূর্তে নিজের ভেতরে বিশ্রাম নেন। তাঁর এই অন্তর্মুখী বিশ্রামই সংহারের আসল রূপ—যেখানে চেতনার তরঙ্গ নিস্তরঙ্গতায় ফিরে যায় এবং সেই নিস্তরঙ্গতাই আবার পরবর্তী সৃষ্টির জন্য প্রস্তুত হয়। এটি যেন এক গভীর শ্বাস—যেখানে নিশ্বাস নেওয়া হলো সৃষ্টি, প্রশ্বাস হলো সংহার। কালী এই শ্বাস-প্রশ্বাসের নীরব অন্তরঙ্গতায় বিরাজ করেন; তাঁর প্রতিটি বিলয় আসলে নতুন জীবনের সম্ভাবনা বয়ে আনে।

এভাবেই কালী চিরন্তন চেতনার স্পন্দনরূপে সৃষ্টির ও বিলয়ের মধ্যে অবিরাম ছন্দ সৃষ্টি করেন—যেখানে সংহার কোনো সমাপ্তি নয়, বরং পূর্ণতার মধ্যে প্রত্যাবর্তন এবং সেই পূর্ণতা থেকেই আবার নতুন প্রকাশের সূচনা। কালী তাই নৃত্যময় শূন্যতার দেবী, যিনি নিস্তব্ধতার মধ্যেই সৃষ্টির সম্ভাবনা ধারণ করেন—যেমন নীরবতার ভেতরে লুকিয়ে থাকে সংগীতের উৎস, তেমনি তাঁর নীরব লয়ই আসলে অনন্ত নৃত্যের আদিম ছন্দ।

কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনের দৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্য-ক্রীড়া (svātantrya-krīḍā) হল সেই একমাত্র সত্য, যার ভেতরে সমগ্র সৃষ্টির গতিবিধি, জীবনের ওঠা-নামা, জ্ঞান ও অজ্ঞান, প্রকাশ ও লয়—সবই এক অনন্ত চেতনার স্বাধীন লীলার পর্বমাত্র। এখানে চেতনা (শিব) কোনো দূরবর্তী স্রষ্টা নয়, যিনি উদ্দেশ্য নিয়ে জগৎ গড়েছেন; বরং তিনি স্বয়ং চৈতন্যময়, পূর্ণ ও স্বতঃপ্রভা। তাঁর মধ্যে কিছুই অপূর্ণ নয়, কোনো কামনা বা প্রয়োজন নেই; তবুও তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন—এটাই “ক্রীড়া” বা লীলা।

“স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)” শব্দের মধ্যে নিহিত আছে তাঁর পরম স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা কেবল ইচ্ছার স্বাধীনতা নয়, বরং অস্তিত্বের সেই মৌলিক স্বতঃসিদ্ধতা, যা কারও দ্বারা নির্ধারিত নয়, কোনো কারণ বা ফলের ধারায় আবদ্ধ নয়। সেই চেতনা নিজের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করে—তাই তাঁর ক্রিয়া লীলাময়, প্রচেষ্টা-শূন্য, অনন্ত আনন্দে ভরপুর। তন্ত্রালোক-এ অভিনবগুপ্ত এই সত্যটিকেই ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—“সর্বমিদং শম্ভোরেকতনত্র স্বাতন্ত্র্যলীলানাট্যম্‌।”—“এই সমগ্র জগৎই শম্ভুর একক তন্তুর উপর বোনা স্বাতন্ত্র্যলীলার নাট্যমঞ্চ।”

অর্থাৎ, যা-কিছু আছে—রূপ, শব্দ, ভাব, সময়, জীব, জগৎ—সবই সেই এক চেতনার নাট্যরূপী আত্মপ্রকাশ। এই জগৎ কোনো বন্ধন নয়, কোনো ভ্রমও নয়; বরং এটি পরম চেতনার স্বয়ং-প্রকাশের খেলা, যেখানে তিনি নিজের অসীমতাকে নানা রূপে আস্বাদন করেন।

স্বাতন্ত্র্য-ক্রীড়া (svātantrya-krīḍā)—এই শব্দযুগল কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনের হৃদয়তত্ত্ব, যার দ্বারা বোঝানো হয় যে সমস্ত সৃষ্টিই পরম চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত, আনন্দময় স্বাধীন লীলা। এখানে “চেতনা” কোনো নিস্তরঙ্গ, জড়, নিস্প্রাণ নীরবতা নয়—তিনি নিজেই জীবন্ত, পরিপূর্ণ, আত্ম-সচেতন, এবং তাই তাঁর মধ্যেই আনন্দের অবিরাম গতি। এই গতি কোনো বাহ্য উদ্দেশ্য বা অভাবের পূরণের জন্য নয়; এটি স্বয়ং-সিদ্ধ আনন্দের ছন্দ।

“স্বাতন্ত্র্য” মানে পূর্ণ স্বাধীনতা—যেখানে কোনো বাইরের কারণ, বাধ্যবাধকতা বা নির্ভরতা নেই। আর “ক্রীড়া” মানে খেলা, যা কখনও উদ্দেশ্যমূলক নয়, বরং আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। যেমন একটি শিশু আনন্দে খেলতে শুরু করে—তার কোনো কারণ লাগে না; তার খেলা নিজের আনন্দেরই প্রকাশ—তেমনি চেতনা, নিজের পূর্ণতায় পরিপূর্ণ হয়েও, নিজের আনন্দেই নিজেকে নৃত্যে প্রকাশ করে। সেই নৃত্যই কালী।

অদ্বৈত বেদান্ত বলে—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মৈব নাপরঃ। অর্থাৎ, জগৎ কোনো স্বাধীন বাস্তব নয়; এটি ব্রহ্মের মায়াময় প্রকাশ। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শন এই মায়া-ভাবকে অস্বীকার করে বলে—জগৎ মিথ্যা নয়; বরং এটি চেতনার স্বাতন্ত্র্যলীলারই বাস্তব প্রতিফলন। এখানে কালী সেই শক্তি, যিনি শিবের নিস্তব্ধ দীপ্তিকে আন্দোলিত করেন; তাঁর প্রতিটি স্পন্দনই সৃষ্টির একেক সম্ভাবনা, প্রতিটি নৃত্যভঙ্গিই জগতের একেক প্রকাশ।

যেমন, সমুদ্রের তরঙ্গ। সমুদ্র নিজেই গভীর, স্থির, অসীম। কিন্তু তারই অন্তর্গত গতিশক্তি থেকে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, আবার তরঙ্গই ফিরে যায় সমুদ্রে। সমুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি করে কোনো প্রয়োজনে নয়—সে সৃষ্টি করে কারণ তার স্বভাবই গতি, তারই আনন্দের স্বরূপ সেই তরঙ্গ। তেমনি কালী—অসীম চেতনার সেই অন্তর্গত গতি—যিনি নিজেই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহের ছন্দে বিশ্বকে গড়ে তোলেন, আবার নিজের মধ্যেই ফিরিয়ে নেন।

প্রথমে তিনি নিজের অসীম দীপ্তি ছড়িয়ে দেন—এটাই সৃষ্টি (sṛṣṭi)। যেমন আলো নিজেরই দীপ্তিতে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি কালী নিজের নৃত্যে সময়, স্থান, মন ও রূপের স্তরগুলো প্রকাশ করেন। তারপর তিনি সেই ছড়ানো দীপ্তিকে স্থিত করেন—স্থিতি (sthiti); যেন নদীর স্রোত কোনো এক মুহূর্তে যেন থেমে যায়, নদী তবু প্রবহমান থাকে। এরপর তিনি সমস্ত রূপকে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে নেন—লয় (saṃhāra)—যেমন সন্ধ্যাবেলায় আলো মিলিয়ে যায় নিজের উৎসসূর্যে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এর পরে আসে লীলার সবচেয়ে সূক্ষ্ম দিক—নিগ্রহ (nigraha) ও অনুগ্রহ (anugraha)।

নিগ্রহ বা তিরোভাব (tirobhāva) মানে কালী নিজেকে আচ্ছাদিত করেন—নিজের অসীমতা গোপন করেন, যেন অসীম চেতনা নিজেকে সীমিত জীবরূপে অনুভব করতে পারে। এটি কোনো অনিচ্ছাকৃত অজ্ঞান নয়; বরং এক স্বেচ্ছা-বিস্মরণ, এক আনন্দময় আত্ম-আবরণ। কালী জানেন, তিনি অসীম, তবু নিজেকে সীমিত হিসেবে অনুভব করেন—যেন এক নাট্যকার নিজেরই লেখা নাটকে নেমে এসে চরিত্রের পোশাক পরে মিশে যায়, চরিত্রের অনুভবগুলোকে সত্যি সত্যি উপভোগ করে। দর্শক জানে, নাট্যকার কে, কিন্তু চরিত্রটি জানে না—তেমনি চেতনা নিজেরই অভিনয়ে হারিয়ে যায়, যেন নিজেরই সত্য আবার আবিষ্কার করতে পারে।

এই তিরোভাব কালী-চেতনার নিমজ্জন দিক—যেখানে অসীমতা “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি আলাদা” এই সীমাবদ্ধতার ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে। এটি ভ্রান্তি নয়, বরং এক প্রকার আনন্দময় আত্ম-রসাস্বাদন। যেমন কেউ নিজেরই মুখোশ পরে আয়নায় নিজেকে চেনে না—কিন্তু সেই না-চেনার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ থাকে; পরে যখন মুখোশ খুলে যায়, তখন “আহা, আমি তো আমিই”—এই আনন্দেই মগ্ন হয়—তেমনি চেতনা নিজেরই আবরণ ভেদ করে নিজেকে চেনার আনন্দ উপভোগ করে।

এই চেনা মুহূর্তটাই অনুগ্রহ (anugraha)। এটি কোনো বাহ্যিক কৃপা নয়—চেতনার নিজের প্রতিই নিজের করুণা। যখন সীমিত জীবসত্তা হঠাৎ অনুভব করে—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সেই পরম চেতনা”—তখন কালী নিজেরই পর্দা সরিয়ে নিজের দীপ্তিতে ফিরে আসেন। উত্পলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.১৭)-এ বলেন—“শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ অনুগ্রহঃ।” অর্থাৎ, “আমি শিব”—এই আত্মস্মরণই অনুগ্রহ।

এখানে “প্রত্যবমর্শ (pratyavamarśa)” মানে কোনো চিন্তা বা যুক্তি নয়; এটি এক প্রত্যক্ষ আত্ম-জাগরণ, এক হঠাৎ আত্ম-স্মরণ। যেমন কেউ গভীর ঘুমে স্বপ্নে নিজেকে অন্য কেউ ভাবছে, হঠাৎ জেগে বুঝে ফেলে—“আহা, আমি তো এ নয়, আমি তো সেই মূল সত্তা”—এই জাগরণই অনুগ্রহ। “শিভোহম্‌—আমি শিব” কোনো তত্ত্ব নয়, এটি অভিজ্ঞতা—কালী তখন নিজেরই অসীম রূপে ফিরে আসেন।

এভাবে তিরোভাব ও অনুগ্রহ একে অপরের ছায়া। তিরোভাব হলো চেতনার নিঃশ্বাস—নিজেকে আড়াল করা; অনুগ্রহ হলো প্রশ্বাস—নিজেকে উন্মোচন করা। এই দুই গতির মধ্যে চেতনা নিজের লীলাকে সম্পূর্ণ করে। কালী হারান যেন নিজেকে আরও গভীরভাবে পেতে পারেন; তিনি সময়ে নিজেকে বেঁধে ফেলেন, আবার সময়কেই নিজের মধ্যে গ্রাস করেন।