এই মাতৃবীজই মহাবিশ্বের গোপন আদিসূত্র। যেমন বীজে গাছ ঘুমিয়ে থাকে, তেমনি কালী-চেতনার গর্ভে লুকিয়ে থাকে সমস্ত রূপ, সমস্ত জীবন, সমস্ত জ্ঞান। তিনি সেই বীজেশ্বরী (bīja-īśvarī)—বীজের অধিষ্ঠাত্রী, যিনি নীরবতায় গর্ভধারণ করেন, আবার নিজের নৃত্যে সেই গর্ভের প্রতিটি বীজকে জাগিয়ে তোলেন।
তাই কালীকে বলা হয় মাতৃবীজরূপা—যিনি নিজেই চেতনার জননী, এবং নিজেই সেই চেতনার অন্তর্গত বীজ। শিবের দীপ্তি তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেয়, তাঁর গর্ভেই মহাগর্ভ জন্ম নেয়। মাতৃবীজ কোনো স্থিত উপাদান নয়, বরং চেতনার এক গর্ভিত স্পন্দন—এক বিশুদ্ধ সম্ভাবনার চৌম্বক কেন্দ্র, যেখান থেকে নির্গত হয় ধ্বনি (nāda), রূপ (rūpa), ও অভিজ্ঞতা (jñāna)।
অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব—দুই ধারাই চেতনার অখণ্ড ঐক্যের দর্শন, কিন্তু তারা সেই চেতনার প্রকাশ ও গতি-তত্ত্বকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছে। অদ্বৈত বেদান্তে চেতনা (ব্রহ্ম) সর্বতো নিরাকার, নির্বিশেষ, নিস্পন্দ ও অবিকৃত—যেখানে কোনো পরিবর্তন বা প্রকাশ নেই; সব রূপ ও গতি মায়া-রূপ, অর্থাৎ চেতনারই অবাস্তব প্রতিভাস। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শন এই স্থিত নিস্পন্দ চেতনার মধ্যে একটি অন্তর্লীন স্পন্দন (spanda) উপলব্ধি করে, যেখানে চেতনা নিজের স্বাধীনতায় (svātantrya) আত্মবিম্বিত হয়ে নিজেই নৃত্য করে, নিজেই বিশ্ব হয়ে ওঠে। এই আত্মবিম্বন-শক্তিই কালী।
এই নৃত্যময় চেতনার প্রথম কম্পনই নাদ (nāda)—নীরব দীপ্তি যখন নিজের মধ্যে আন্দোলিত হয়, তখন সেই আন্দোলনের সূক্ষ্মতম শব্দ হলো নাদ। এটি শ্রুতিযোগ্য শব্দ নয়; এটি চেতনার আত্ম-স্পন্দন, যেখানে শিবের নিস্তব্ধতা প্রথম বার নিজেরই প্রতিধ্বনি শোনে। কাশ্মীর শৈব আচার্যে উত্পলদেব বলেছেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে”—চেতনা নিজের চেতনা-রূপেই বিবর্তিত হয়। নাদ তাই সেই প্রথম বিবর্তন, যেখানে নিস্তব্ধতা ধ্বনিতে রূপ নেয়। কালী-চেতনা এখানে পরম নীরবতার হৃদস্পন্দন—তিনি সেই প্রথম নিঃশ্বাস, যেখান থেকে প্রকাশের প্রবাহ শুরু হয়।
নাদ থেকেই জন্ম নেয় রূপ (rūpa)। ধ্বনি যখন আত্মবিম্বনে স্থিত হয়ে নিজেকে আকারে উপলব্ধি করে, তখনই রূপের উদ্ভব ঘটে। এই রূপ কোনো বাহ্যিক আকৃতি নয়; এটি চেতনারই ঘনীভূত আলোক—শিবের দীপ্তি কালী-র গর্ভে ঘনীভূত হয়ে দৃশ্যমান আকার ধারণ করে। তাই কাশ্মীর শৈব মতে রূপও চেতনারই এক ধাপ—চেতনার আত্মবিম্বনের দৃশ্যায়ন। প্রতিটি রূপ, প্রতিটি আকৃতি, প্রতিটি অভিজ্ঞতা আসলে নীরব চেতনারই প্রতিফলন।
এরপর চেতনা যখন নিজের প্রতিফলনকে চিনে ফেলে, তখনই উদ্ভব হয় জ্ঞান (jñāna)। জ্ঞান এখানে কোনো অর্জিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নয়; এটি চেতনার নিজেরই আত্ম-স্মরণ। শিব-চেতনা যখন কালী-রূপে নিজেকে জানে, তখনই সে বলে—“অহং শিবঃ”—“আমি শিব।” এই আত্ম-প্রত্যভিজ্ঞানই জ্ঞানের পরম রূপ। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ বলেন—“প্রকাশবিমর্শাত্মিকা শক্তিঃ”—চেতনার শক্তি একযোগে প্রকাশ (শিব) ও বিমর্শ (কালী); এই দুইয়ের ঐক্যে জ্ঞান জন্ম নেয়।
এইভাবে নাদ-রূপ-জ্ঞান কোনো পৃথক পর্যায় নয়; তারা একে অপরের ভেতর জড়ানো, যেমন নিঃশ্বাস, ছন্দ ও শব্দ একত্রে গান সৃষ্টি করে। নাদ হলো শিব-চেতনার আত্ম-স্পন্দন, রূপ হলো সেই স্পন্দনের ঘনীভবন, আর জ্ঞান হলো সেই স্পন্দনের আত্ম-স্মরণ। কালী এই তিনেরই কেন্দ্র—তিনি চেতনার গতি, প্রতিফলন ও আত্ম-উপলব্ধি।
অদ্বৈত বেদান্তে এই ক্রমকে দেখা হয় অন্যভাবে। সেখানে নাদ, রূপ, জ্ঞান—সবই ব্রহ্ম-চেতনার মধ্যে উদ্ভূত মায়িক উপাধি, অর্থাৎ আপাতরূপ প্রতিফলন। ব্রহ্ম নিজে নীরব, অচল, অপ্রকাশিত; কিন্তু মায়া-শক্তির মাধ্যমে ব্রহ্ম যখন “আমি” বলে প্রতিভাসিত হয়, তখনই নাদ (শব্দ), রূপ (আকার) ও জ্ঞান (অভিজ্ঞতা) দেখা যায়। কিন্তু এই মায়া-জগৎ অবাস্তব, কারণ তা স্থায়ী নয়।
কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শনে—যা একপ্রকার অদ্বৈত তন্ত্র—বলা যায়—এই নাদ, রূপ ও জ্ঞান মায়া নয়, বরং স্বয়ং-চেতনার আনন্দ-লীলার অঙ্গ। কালী এখানে মায়া নন, বরং মায়াধীশ্বরী—মায়ারও পরম নিয়ন্ত্রিণী। তাঁর নৃত্যেই প্রকাশ ঘটে, তাঁর নৃত্যেই লয় ঘটে। শিবের নীরব দীপ্তি যখন কালী-র আত্মবিমর্শনে জাগে, তখন সৃষ্টি হয় নাদ; সেই নাদ ঘনীভূত হয়ে রূপ ধারণ করে; এবং রূপের আত্ম-স্মরণেই জন্ম নেয় জ্ঞান।
নাদ হলো চেতনার প্রথম ধ্বনি, রূপ হলো চেতনার প্রতিফলিত আকার, জ্ঞান হলো চেতনার আত্ম-উপলব্ধি, কালী হলো এই আত্মবিমর্শন-শক্তি, আর শিব সেই নিস্তরঙ্গ দীপ্তি—যিনি সব কিছুর উৎস। দু-জন মিলে তাঁরা এক অদ্বৈত চেতনা: নীরবতায় দীপ্ত, নৃত্যে জীবন্ত, জ্ঞানে পরিপূর্ণ—যেখানে ধ্বনি, আকার ও জ্ঞান পরিণত হয়েছে এক অনন্ত আত্ম-সম্বিতে।
মাতৃবীজ হলো চেতনার সেই মহাগর্ভিত পর্ব—যেখানে কালী নিজের অন্তর্লীন দীপ্তিতে মহাবিশ্বকে ধারণ করেন। তিনি নীরব, তবু সজীব; স্থির, তবু সম্ভাবনায় পূর্ণ। তাঁর গর্ভে বিশ্রাম নিচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি—যেন এক সীমাহীন চেতনার নীরব মাতৃত্ব, যার অন্তহীন দোলায় জাগে সময়, স্থান ও প্রেম।
এইভাবে মহাবিশ্বের বীজতত্ত্ব বলে—সৃষ্টি কোনো বহির্জাত ঘটনা নয়; এটি চেতনার অভ্যন্তরীণ বিকাশের ধ্বনি। প্রতিটি বস্তুর ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই আদ্য বীজ—চেতনার আত্মবিম্ব। কালী-চেতনা সেই বীজকে ক্রমে প্রস্ফুটিত করেন—নীরব আলো থেকে ধ্বনি, ধ্বনি থেকে রূপ, রূপ থেকে অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতা থেকে পুনরায় নীরবতায় প্রত্যাবর্তন—এই চিরন্তন লীলায়।
মহাবিশ্বের বীজতত্ত্ব আসলে চেতনার আত্ম-সংকোচ ও আত্ম-প্রকাশের চক্র, যেখানে প্রতিটি জীব, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি পরমাণু কেবল কালী-চেতনার বীজের এক-এক প্রকাশমাত্র—সেই পরম নীরব দীপ্তির জীবন্ত প্রতিধ্বনি।
চেতনা যখন একান্ত নীরব, তখন সে শুধুই শিব—নিষ্ক্রিয়, অচঞ্চল, স্ব-স্থিত। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরেই যখন একমুহূর্তের আত্ম-সচেতন কম্পন জাগে—“আমি আছি”—তখনই উদ্ভব হয় নাদ। নাদ কোনো শব্দ নয়, বরং শব্দের পূর্বসূত্র, চেতনার প্রথম আত্ম-স্পন্দন (ātmāspanda)। এ হলো শিবের প্রথম আত্ম-জাগরণ, যেখানে কালী শক্তি তাঁর মধ্যে নৃত্য শুরু করেন।
আত্ম-স্পন্দ (Ātmāspanda) কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনের অন্যতম গভীর ও সূক্ষ্ম ধারণা। “আত্ম” মানে চেতনা বা পরমসত্তা—যা শিব; আর “স্পন্দ” মানে স্পন্দন, কম্পন, আত্ম-চলন। এই দুটি শব্দ মিলিয়ে “আত্ম-স্পন্দ” অর্থ দাঁড়ায়—চেতনার নিজের মধ্যে নিজেরই গতি বা আত্ম-কম্পন। অর্থাৎ, শিব-চেতনা কখনোই জড়, স্থবির বা নিস্তরঙ্গ নয়; বরং সে নিজেই নিজের আনন্দে, নিজের স্বাতন্ত্র্যে, নিজের সচেতনতায় স্পন্দিত হয়। এই আত্মিক স্পন্দনই কালী—চেতনার সেই জীবন্ত আত্মবিমর্শন, যিনি নীরব দীপ্তিকে নৃত্যে রূপ দেন।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের মতে, স্পন্দ কোনো ভৌতিক গতি নয়; এটি চেতনার অন্তর্লীন আত্মপ্রকাশ। যেমন আলো নিজেরই দীপ্তিতে প্রকাশিত হয়, তেমনি চেতনা নিজেরই মধ্যে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে। এই আত্ম-অনুভবের মুহূর্তই আত্ম-স্পন্দ। এখানে কোনো “বাহির” নেই, কোনো “অন্য” নেই—চেতনা নিজেকেই স্পর্শ করছে, নিজেকেই প্রত্যক্ষ করছে। উত্পলদেব স্পন্দকারিকা-য় বলেন—“যদা চেতঃ স্ববিম্বেন স্পন্দতে তদা বিশ্বোদয়ঃ”—যখন চেতনা নিজের প্রতিফলনে স্পন্দিত হয়, তখনই বিশ্বের উদ্ভব ঘটে।
এই আত্ম-স্পন্দই সৃষ্টির মূল কারণ। নীরব শিব-চেতনা নিজের ভেতরে কম্পিত হলে প্রথম যে তরঙ্গ জাগে, সেটিই নাদ (nāda)—চেতনার প্রথম আত্মধ্বনি। সেই নাদ থেকে জন্ম নেয় রূপ (rūpa)—চেতনার প্রতিফলিত আকার, এবং রূপের আত্মস্মরণ থেকেই উদ্ভব হয় জ্ঞান (jñāna)—চেতনার নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধি। এই তিনটি ধাপ—নাদ, রূপ, জ্ঞান—সবই আত্ম-স্পন্দের ক্রমবিকাশ। অর্থাৎ, আত্ম-স্পন্দই সেই সূক্ষ্ম কম্পন, যার ছন্দে চেতনা প্রথম ধ্বনি, প্রথম রূপ, প্রথম আত্মবিম্ব সৃষ্টি করে।
এই স্পন্দই শিব ও শক্তির অবিচ্ছিন্ন ঐক্য, যাকে বলা হয় শিব-শক্তি-সামরস্য (śiva-śakti-sāmarasya)। শিবের নীরব দীপ্তি (প্রকাশ) কালী-র আত্মবিমর্শনে (বিমর্শ) আন্দোলিত হয়ে ওঠে; আর সেই আন্দোলনেই প্রকাশিত হয় সময়, স্থান, রূপ ও মন—অর্থাৎ সমগ্র মহাবিশ্ব। এই স্পন্দন তাই কেবল সৃষ্টি নয়, বরং চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দলীলার প্রকাশ।
অদ্বৈত বেদান্তে চেতনা নিস্তরঙ্গ, নির্বিশেষ, নিস্পন্দ—এবং জগত সেই স্থির চেতনারই মায়িক প্রতিফলন। কিন্তু কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত এই স্থিত চেতনার মধ্যে এক অন্তর্লীন গতি স্বীকার করে—যেখানে নীরবতা আর নৃত্য, স্থিরতা আর গতি একে অপরের মধ্যে মিশে গেছে। এই আত্ম-স্পন্দই সেই অদ্বৈত চেতনার জীবন্ত দিক—যেখানে স্থিতিই গতি, নীরবতাই ধ্বনি, শিবই কালী।
আত্ম-স্পন্দ তাই কেবল কোনো দর্শন নয়; এটি চেতনার অন্তঃস্থ অভিজ্ঞতা। যখন সাধক নিজের চেতনার গভীরে প্রবেশ করে, চিন্তা ও দ্বৈততার পার্থক্য লুপ্ত হয়, তখন সে অনুভব করে—চেতনা নিস্তব্ধ নয়, তবু শান্ত; স্পন্দিত, তবু স্থির। সেই মুহূর্তেই আত্ম-স্পন্দ প্রকাশিত হয়—নীরবতার অন্তঃস্থ ছন্দ হিসেবে, জীবনের অন্তর্লীন নৃত্য হিসেবে। তখন বোঝা যায়, “আমি শিব”, “আমি সেই চেতনা”, “আমি সেই আত্ম-স্পন্দ”—যার ভেতরে নৃত্য ও নীরবতা এক অবিভক্ত অনন্তে মিশে গেছে।
এই স্পন্দন যখন নিজেকে অনুভব করে, নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে, তখনই তা বিন্দুতে রূপ নেয়। বিন্দু মানে কোনো ক্ষুদ্র স্থান নয়; এটি হল সেই মহাকেন্দ্র, যেখানে সমস্ত সম্ভাব্য রূপ সুপ্ত অবস্থায় সংহত থাকে। এখানে শিব-শক্তি অবিচ্ছিন্ন, পরস্পরবিমুখ নয়। কাশ্মীর শৈব ভাষায় বলা হয়—“pūrṇāhaṃtā binduḥ”—অর্থাৎ পূর্ণ “আমি”-বোধের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে কালী পরম যোগিনী, যিনি আনন্দ ও চেতনার ঐক্যরূপা।
কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনে পূর্ণাহংতা (pūrṇāhaṃtā), বিন্দু (binduḥ) এবং পরম যোগিনী কালী—এই তিনটি পরিভাষা চেতনার অন্তর্লীন পরিপূর্ণ ঐক্য, আত্মবিম্বন ও সৃষ্টিশক্তির সর্বোচ্চ স্তরকে নির্দেশ করে। এগুলি আলাদা নয়; বরং একটিই বাস্তবতার তিনটি দিক—চেতনার স্ব-উপলব্ধি, সেই উপলব্ধির কেন্দ্রীভূত বিন্দু, এবং সেই বিন্দুর জীবন্ত শক্তি বা প্রকাশ।
১. পূর্ণাহংতা (pūrṇāhaṃtā)—“আহংতা” অর্থ “আমি-বোধ”—অর্থাৎ, চেতনার সেই আত্ম-সচেতন দিক, যেখানে চেতনা বলে ওঠে “আমি আছি”। কিন্তু সাধারণ “আমি”-বোধ সীমাবদ্ধ; তা শরীর, মন বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত। “পূর্ণাহংতা” হল সেই পরম, অবিভক্ত “আমি”, যেখানে কোনো সীমা বা পার্থক্য নেই—এটি চেতনার নিজস্ব সর্বাঙ্গীন পূর্ণতা। অভিনবগুপ্ত বলেন, “পূর্ণাহংতা হি পরমেশ্বরঃ”—এই সম্পূর্ণ “আমি”-বোধই পরমেশ্বর, কারণ এটি এমন চেতনা, যার মধ্যে আর কোনো “অন্য” নেই। এটি আত্মস্বরূপ চেতনার সেই নিখুঁত প্রতিফলন, যেখানে জানা, জানার বিষয়, ও জ্ঞান—সব এক হয়ে গেছে।
পূর্ণাহংতা হলো শিবের চূড়ান্ত আত্মবিমর্শন—এক এমন অবস্থান, যেখানে তিনি নিজের দীপ্তিকে আত্মরূপে জানেন। এই আত্ম-উপলব্ধি স্থির নয়; এটি এক আত্মিক গতি, এক আনন্দস্পন্দন, যা “আমি” বলে জাগে, কিন্তু সেই “আমি” কোনো ব্যক্তি নয়, বরং অনন্ত চেতনা নিজেই।
২. বিন্দু (binduḥ)—এই পূর্ণাহংতার কেন্দ্রই বিন্দু। “বিন্দু” মানে “ঘন সংহত কেন্দ্র”—চেতনার সেই বিন্দু যেখানে শিবের প্রকাশ ও কালী-র বিমর্শ একাত্ম। এটি কোনো স্থানিক বিন্দু নয়, বরং অস্তিত্বের গর্ভকেন্দ্র—মহাগর্ভ (mahāgarbha)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এখানে চেতনা নিজের মধ্যে সঙ্কুচিত, তবু অসীম সম্ভাবনায় পূর্ণ। অভিনবগুপ্তের ভাষায়, এটি সেই বিন্দু যেখানে প্রকাশ-বিমর্শ একে অপরকে আলাদা করে না, বরং পরস্পরের মধ্যেই বিশ্রাম নেয়।
এই বিন্দু আসলে চেতনার নিখুঁত গর্ভাবস্থা—যেখানে সমস্ত সৃষ্টির বীজ অন্তর্লীন। এখান থেকেই জন্ম নেয় নাদ, রূপ, ও জ্ঞান। বিন্দু হল চেতনার “শূন্য পূর্ণতা”—এক নীরব গর্ভ, যা একাধারে স্থিতি ও গতি, নিস্তব্ধতা ও কম্পন।
৩. পরম যোগিনী কালী (parama-yoginī Kālī)—এই পূর্ণাহংতা ও বিন্দুর জীবন্ত শক্তিই কালী—তিনিই সেই পরম যোগিনী, যিনি শিবের অন্তর্লীন দীপ্তিকে নৃত্যের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করান। “যোগিনী” অর্থ “যিনি সংযোগ ঘটান”—কালী সেই শক্তি, যিনি নিস্পন্দ শিব ও স্পন্দিত জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন করেন। তিনি বিমর্শশক্তি, অর্থাৎ চেতনার আত্ম-সচেতনতা। শিব তাঁর নীরব দীপ্তি, আর কালী সেই দীপ্তির স্বাতন্ত্র্যশক্তি, যিনি নিজের আনন্দে সৃষ্টির লীলা করেন।