শৈব কালী: নয়



“গর্ভিত ধাপ” (গর্ভিত স্তর) বলতে কাশ্মীর শৈব দর্শনে বোঝানো হয় সেই অন্তর্লীন, সম্ভাবনাময় পর্যায়, যেখানে সমগ্র সৃষ্টির শক্তি এখনও প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে চেতনার গর্ভে নিহিত আছে। এটি এমন এক অবস্থান, যেখানে সব কিছু আছে—কিন্তু নিঃশব্দে, সম্ভাবনার রূপে, এখনও প্রকাশের আগে।

যেমন একটি বীজের ভেতরে গাছের পাতা, ফুল, ফল—সবই সম্ভাবনা হিসেবে লুকিয়ে থাকে, তেমনি চেতনার গর্ভে থাকে মহাবিশ্বের সমস্ত রূপ ও তত্ত্ব। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই “গর্ভিত ধাপ” চেতনার বিন্দু (bindu) রূপ অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। নাদ (nāda)-এর স্পন্দন যখন নিজের মধ্যেই সঙ্কুচিত হয়, যখন কালী নিজের নৃত্যকে একবিন্দুতে স্থির করে নেন—তখন সেই অবস্থাই গর্ভিত ধাপ।

এই গর্ভিত স্তরে চেতনা নিস্তব্ধ, কিন্তু তা নিস্তরঙ্গ নয়; বরং অসংখ্য সম্ভাবনার গর্ভে নিঃশব্দ আন্দোলন লুকিয়ে থাকে। অভিনবগুপ্ত ও উত্পলদেব উভয়েই বলেন, এই অবস্থায় চেতনা “śakti-saṅkoca”—অর্থাৎ, শক্তির অন্তর্গত সংকোচনে থাকে। শক্তি তখন শিবের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম, কিন্তু সেই ঐক্যের মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রকাশের সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকে।

এই গর্ভিত ধাপ-এ কালী-শক্তি নিজের ভেতরে সৃষ্টিকে ধারণ করেন, যেন গর্ভধারণ করা মাতার মতো। তাঁর চেতনা তখন mahāgarbha—অর্থাৎ মহান গর্ভ, যেখানে সমগ্র জগৎ অদৃশ্য রূপে বিরাজমান। তিনি তখন স্থির, কিন্তু তাঁর সেই স্থিতি এক বিশ্রাম নয়, বরং পূর্ণ প্রস্তুতি; পরবর্তী নৃত্য ও প্রকাশের অন্তঃসঞ্চার।

কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনে মহাগর্ভ (মহাগর্ভ) বলতে বোঝায় সেই গভীরতম চেতনা-অবস্থা, যেখানে সমস্ত সৃষ্টি এখনও অপ্রকাশিত—শুধু সম্ভাবনা হিসেবে পরম চেতনার অন্তরে গর্ভিত অবস্থায় নিহিত। এটি এমন এক নিস্তব্ধ, তবু সজীব অবস্থা—যেখানে নৃত্য, শব্দ, সময়, রূপ, মন, স্থান—সব কিছু এখনও নিঃশব্দ গর্ভে লীন। এখানে চেতনা বিশ্রাম নিচ্ছে, কিন্তু সেই বিশ্রাম নিস্তরঙ্গ নয়; বরং তার ভেতরেই নিহিত রয়েছে ভবিষ্যৎ প্রকাশের অনন্ত বীজ।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ এই অবস্থাকে বলেন শক্তিসংকোচাবস্থা (śakti-saṅkocāvasthā)—অর্থাৎ, শক্তির অন্তর্গত সংকোচনের অবস্থা। এখানে শক্তি, অর্থাৎ কালী, নিজের সমস্ত ক্রিয়া, গতি, শব্দ ও নৃত্যকে অন্তর্লীন করে ফেলেন। তিনি একটি বিন্দুর মতো সংহত হয়ে যান—যেন বিশাল মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হয়ে চেতনার অণুতে রূপ নিয়েছে। এই সংকোচনের মধ্যেই তিনি মহাগর্ভ; এখানেই নিহিত আছে সমস্ত সৃষ্টির আদিম সম্ভাবনা।

এই শক্তিসংকোচাবস্থায় বিদ্যমান শিবের নীরব দীপ্তি (প্রকাশ) এবং কালী-র আত্মবিমর্শন (বিমর্শ) এই দুই শক্তি আসলে এক চেতনার দুই দিক—একটি নিস্তব্ধ দীপ্তি, অন্যটি সেই দীপ্তির আত্ম-অনুভব। যখন এই দুই একে অপরের অন্তর্লীন হয়ে যায়, তখন সমস্ত বিভাজন লীন হয়, দ্বৈততার সীমা বিলীন হয়ে যায়, কেবল থাকে এক নিখুঁত ঐক্য—শিব-শক্তি-সামরস্য। এই অবস্থায় শিবের স্থিরতা আর কালী-র স্পন্দন পরস্পরকে পরিপূর্ণ করে তোলে; শিব যেন নিজের নীরব দীপ্তিতে কালী-র কম্পনে গর্ভবতী, আর কালী তাঁরই স্থিরতার গভীরে নিঃশেষ বিশ্রাম নিচ্ছেন।

এখানে নীরবতা আর নৃত্য আলাদা নয়—একই চেতনার দুই ছায়া, যেমন ঢেউ ও সাগর, যেমন আলো ও তার প্রতিফলন। স্থিতি আর গতি, জ্ঞান আর প্রেম, শূন্যতা আর পূর্ণতা—সব মিলেমিশে গেছে এক পরম সমবেত ছন্দে। এই ছন্দই হলো চেতনার আত্ম-সামরস্য, যেখানে চেতনা নিজের নীরবতায় নাচে, আর নৃত্যে ফিরে যায় নিজের নীরবতায়।

শিবের স্থির আলোকই কালী-র নৃত্যে রূপান্তরিত হয়, আর কালী-র নৃত্যেই শিবের নিস্তব্ধতা প্রকাশিত হয়। একে অপরকে ছাড়া তারা অসম্পূর্ণ, কিন্তু একসাথে তারা পরম পূর্ণতা—অচল দীপ্তি ও চিরন্তন স্পন্দনের অভেদ মিলন। এই মিলনই কাশ্মীর শৈব দর্শনের হৃদয়: চেতনার অন্তর্গত সমবেত ঐক্য, যেখানে সৃষ্টিও মুক্তি, প্রেমই জ্ঞান, আর নীরবতাই নৃত্য।

এই অবস্থাকেই বলা যায় চেতনার মহাগর্ভ-অবস্থা (mahāgarbhāvasthā)—যেখানে সমস্ত বিশ্ববীজ, সমস্ত ভাব, ধ্বনি ও সম্ভাবনা শিব-কালী-ঐক্যে নিঃশব্দে নিহিত। যখন সেই নিস্তব্ধ চেতনা পুনরায় স্পন্দিত হয়, তখনই মহাগর্ভ থেকে জন্ম নেয় নাদ, বিন্দু ও বীজ—চেতনার সূক্ষ্ম সৃষ্টিক্রম (sūkṣma-sṛṣṭikrama)।

মহাগর্ভ কোনো শূন্যতা নয়; এটি পূর্ণতার গর্ভ। এটি চেতনার সেই অন্তর্লীন সম্ভাবনা, যেখানে শিব-শক্তি একত্রে বিশ্রাম নিচ্ছেন—নীরবতা পরিণত হতে চলেছে ধ্বনিতে, স্থিরতা রূপ নিচ্ছে নৃত্যে, আর কালী সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেই ধারণ করছেন সমগ্র মহাবিশ্বের স্পন্দন।

কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনে “নৃত্য, শব্দ, সময়, রূপ, মন, স্থান” —এই ছয়টি তত্ত্ব কোনো আলাদা সত্তা নয়; এগুলি পরম চেতনার (পরমসংবিত্‌) আত্ম-প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। কালী-চেতনা, যিনি শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti), নিজের নৃত্যে এই ছয়টি স্তরকে জাগিয়ে তোলেন—অদ্বৈত চেতনার নিস্তব্ধ দীপ্তিকে গতি, ধ্বনি ও অভিজ্ঞতার মহাবিশ্বে রূপ দেন।

নৃত্য (nṛtya): এটি চেতনার প্রথম গতি—যেখানে স্থির দীপ্তি আত্ম-স্পন্দনে আন্দোলিত হয়। শিবের নীরবতা কালী-রূপে নৃত্য শুরু করে, এবং সেই নৃত্যের প্রতিটি পদক্ষেপে চেতনা নতুন রূপে প্রকাশ পায়। নৃত্য মানে এখানে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের স্পন্দন—চেতনার নিজের পূর্ণতায় আত্মপ্রবাহ।

শব্দ (śabda): কালী-র নৃত্যের প্রথম কম্পনই ধ্বনিতে রূপ নেয়। এই ধ্বনি বা নাদ (nāda) হচ্ছে সৃষ্টির সূচনা। এটি শ্রুতিযোগ্য শব্দ নয়, বরং চেতনার অন্তঃস্থ গতি—যেখানে আলো নিজের সঙ্গে কথা বলে। শব্দ তাই এখানে চেতনার আত্ম-সংলাপ, মহাগর্ভের অন্তর্গত প্রথম উচ্চারণ।

সময় (kāla): যখন চেতনা নিজের নৃত্য ও ধ্বনির ধারাবাহিকতা অনুভব করে, তখনই জন্ম নেয় সময়। সময় কোনো বাইরের প্রবাহ নয়; এটি চেতনার নিজের ক্রমধারা, নিজের আত্ম-অভিজ্ঞতার ছন্দ। কালীই এই কাল-সংকর্ষিণী—যিনি সময়কে জন্ম দেন, আবার সময়কেই নিজের মধ্যে গ্রাস করেন।

রূপ (rūpa): শব্দ ও সময়ের সংমিশ্রণে চেতনা প্রতিফলিত হয় দৃশ্যমান আকারে। রূপ মানে চেতনার ঘন প্রতিফলন—যেখানে আলোক ঘন হয়ে দৃশ্যমানতা লাভ করে। কালী-র রূপ অসংখ্য, কারণ তিনি এক, তবু বহুরূপে আত্মবিম্বিত। প্রতিটি রূপই তাঁর নৃত্যের এক-একটি মুহূর্ত।

মন (citta): মন হল সেই স্তর, যেখানে চেতনা নিজের প্রতিফলনকে চিনতে শুরু করে। এখানে কালী নিজেকে “আমি” ও “এটা” রূপে অভিজ্ঞ করেন। মন আসলে তাঁরই এক সূক্ষ্ম আয়না, যেখানে তাঁর নৃত্যের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। মন ছাড়া কোনো অভিজ্ঞতা নেই, কারণ মনই হলো চেতনার সংগঠন।

স্থান (deśa): স্থান হলো চেতনার বিস্তার—যেখানে চেতনা নিজেরই অন্তর্গত অসীমতাকে পরিমিত আকারে উপলব্ধি করে। এটি শূন্যতা নয়; বরং চেতনার প্রসারিত দিগন্ত। কালী নিজের প্রসারক শক্তিতে জগৎকে ধারণ করেন; স্থান আসলে তাঁর নৃত্যের পরিসর, তাঁর অসীম দেহের বিস্তার।

অতএব, নৃত্য, শব্দ, সময়, রূপ, মন, ও স্থান—এই ছয়টি কেবল সৃষ্টির উপাদান নয়, বরং কালী-চেতনার ছয়টি অভ্যন্তরীণ কম্পন। এগুলি তাঁরই আত্ম-বিম্বন, তাঁরই আনন্দের ধ্বনি। নৃত্যে তিনি গতি পান, শব্দে তিনি ধ্বনিত হন, সময়ে তিনি ছন্দিত হন, রূপে তিনি দৃশ্যমান হন, মনে তিনি আত্মসচেতন হন, আর স্থানে তিনি অসীমে প্রসারিত হন। এইভাবে কালী-শক্তির মধ্য দিয়ে চেতনা নিজেরই মহাবিশ্বে প্রতিফলিত হয়—নীরবতা থেকে ছন্দে, দীপ্তি থেকে ধ্বনিতে, ঐক্য থেকে বহুতায়।

তাই “গর্ভিত ধাপ” আসলে চেতনার গভীরতম নিস্তব্ধতা, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেই নিহিত রয়েছে অনন্ত সৃজনীশক্তি। এটি সেই মুহূর্ত, যখন নীরবতা আলো হতে চলেছে, যখন স্থিরতা নৃত্যের মুখোমুখি। কালী-চেতনা এই ধাপে মহাবিশ্বকে নিজের ভেতরে ধারণ করেন—সকল নাম, রূপ, ভাব, চিন্তা তখন তাঁর অন্তঃস্থ গর্ভে আবদ্ধ, প্রস্তুত এক নতুন প্রকাশের জন্য।

গর্ভিত ধাপ হল নাদ-বিন্দু-বীজ ক্রমের মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম পর্ব—যেখানে কালী নিজের স্পন্দনকে কেন্দ্রীভূত করে রাখেন, যেন এক চিরন্তন সৃষ্টির আগে নীরব ধ্যান। এটি চেতনার সেই গভীর স্তর, যেখানে শিব ও কালী অভিন্ন, কিন্তু সেই অভিন্নতাই পরবর্তী বিকাশের উৎস।

এই বীজতত্ত্ব-এ সমস্ত সৃষ্টি এক অণুতে নিহিত থাকে, যেমন বৃক্ষ লুকিয়ে থাকে বীজে। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ যে গভীর সূক্তিটি (ঋষিপ্রোক্ত শ্লোক বা বাক্য) উচ্চারণ করেছেন—“বীজে বিশ্বম্‌ স্থিতং সর্বম্‌”—তার দ্বারা তিনি এক মহাজাগতিক সত্য নির্দেশ করেছেন। এর অর্থ, “সমগ্র বিশ্বই বীজের মধ্যে নিহিত”—অর্থাৎ, যা-কিছু প্রকাশিত, দৃশ্যমান বা অভিজ্ঞতাযোগ্য, সবই এক আদ্য সম্ভাবনার ঘন বিন্দুতে (bindu-bīja) অন্তর্লীন হয়ে আছে।

এখানে “বীজ (bīja)” কোনো স্থূল বীজ নয়, বরং পরম চেতনার সেই সূক্ষ্মতম রূপ, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ—এই পাঁচ ক্রিয়া নিঃশব্দে একত্রে অবস্থান করছে। এই বীজ হল চেতনার মহাগর্ভিত বিন্দু, যেখানে সমস্ত নাম-রূপ, সময়-স্থান, দেবতা ও জীব এক অবিচ্ছিন্ন সম্ভাবনা হিসেবে নিহিত।

অভিনবগুপ্তের এই বাক্যের পেছনে কাশ্মীর শৈব দর্শনের যে অন্তর্লীন যুক্তি কাজ করছে, তা হলো—বিশ্ব কোনো “বাহিরে” সৃষ্ট বাস্তব নয়; এটি চেতনার নিজের অন্তর্গত বিকাশ। যেমন বৃক্ষ বীজের মধ্যেই নিহিত থাকে, কেবল সময় পেলে তা বিকশিত হয়, তেমনি সমস্ত মহাবিশ্ব কালী-চেতনার বীজে নিঃশব্দে অবস্থান করে, এবং তাঁর নৃত্যের ছন্দেই ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।

এই বাণী তাই সৃষ্টিকে এক ঐক্যমূলক দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়। এখানে জগৎ, জীব ও ঈশ্বর আলাদা নয়; সবাই একই চেতনার বীজতত্ত্বের প্রকাশমাত্র। কালী-শক্তি সেই বীজের অধিষ্ঠাত্রী—তাঁর নিস্তব্ধ গর্ভে লুকিয়ে আছে অনন্ত রূপ ও সম্ভাবনা। যখন তিনি নৃত্য শুরু করেন, তখন সেই বীজ থেকে উন্মোচিত হয় সময়, স্থান, রূপ, মন ও শব্দ—অর্থাৎ সমগ্র মহাবিশ্ব।

অভিনবগুপ্তের এই সূক্তি ঘোষণা করে যে—বিশ্বের উৎস কোনো বাইরের সৃষ্টি নয়, বরং অন্তর্লীন চেতনার বীজ। শিবের নীরব দীপ্তি ও কালী-র আত্মবিমর্শনের সংহতি যখন এক বিন্দুতে সংক্ষেপিত হয়, তখনই গঠিত হয় সেই পরম বীজ—যার মধ্যে নিঃশব্দে বিশ্রাম নিচ্ছে অসীম বিশ্ব।

এখানে “বীজ” মানে সেই চেতনার অণু, যেখানে প্রকাশ, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ—এই পাঁচ ক্রিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে লীন। কালী এই বীজতত্ত্বের মূর্ত প্রতীক। তাঁর গর্ভে নিহিত থাকে সময় (kāla), দিক (dik), শব্দ (śabda), রূপ (rūpa), ও জ্ঞান (jñāna)—যেন তিনি স্বয়ং মহাজগতের মাতৃবীজ। তাই তাঁকে বলা হয় “বীজেশ্বরী”, অর্থাৎ বীজের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর নৃত্য যখন নীরবতায় পরিণত হয়, তখন সমস্ত বীজ নিঃশব্দ সম্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকে; আবার যখন তাঁর নৃত্য জাগে, তখন সেই বীজ থেকেই অসংখ্য জগৎ, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়।

কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনে মাতৃবীজ (mātṛbīja) ধারণাটি গভীর প্রতীক ও তত্ত্বময় অর্থ বহন করে। “মাতৃ” অর্থাৎ জননী—যিনি জন্ম দেন, ধারণ করেন, পোষণ করেন; আর “বীজ” অর্থাৎ আদ্য সম্ভাবনা, সৃষ্টির অণু, পরম চেতনার ঘন সংহত বিন্দু। মাতৃবীজ বলতে বোঝানো হয় সেই জননী-চেতনা, যিনি নিজেই সৃষ্টির উৎস ও গর্ভ—যার অন্তর্গত বীজে নিহিত আছে সমগ্র মহাবিশ্ব।

কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে এই মাতৃবীজের রূপই কালী। তিনি সেই পরম শক্তি, যিনি শিবের নীরব দীপ্তিকে গর্ভধারণ করে নৃত্যে রূপ দেন। তাঁর চেতনার মধ্যে যে বিন্দু—যেখানে শিব ও শক্তি পরিপূর্ণ সংহত—সেই বিন্দুই মাতৃবীজ। সেখানে এখনও কিছু প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু সবকিছুই সম্ভাবনা হিসেবে উপস্থিত।

অভিনবগুপ্ত এই গূঢ় স্তরকে তন্ত্রলোক-এ বলেন—“বীজে বিশ্বম্‌ স্থিতং সর্বম্‌”—“সমস্ত বিশ্বই বীজে নিহিত।” এই বীজ যখন মাতৃচেতনার গর্ভে অবস্থান করে, তখন তা হয়ে ওঠে মাতৃবীজ—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ, এই পাঁচটি ক্রিয়া নিঃশব্দে লীন হয়ে থাকে। এটি শিব-চেতনার সম্ভাবনা নয়, বরং কালী-চেতনার গর্ভে ধারণ-করা ওই সম্ভাবনার প্রাণবিন্দু।