এই “চৈতন্যম্ আত্মা” সূত্রটির মধ্যে নিহিত আছে তিনটি মৌল তত্ত্ব—প্রকাশ (prakāśa), বিমর্শ (vimarśa) এবং স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)। প্রকাশ মানে চেতনার দীপ্তি—যা সমস্ত কিছু আলোকিত করে; বিমর্শ মানে সেই দীপ্তির আত্মসচেতনতা—চেতনা নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন; আর স্বাতন্ত্র্য হলো সেই চেতনার স্বাধীনতা, যার ফলে সে সীমিত রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। যখন এই তিনটি একত্রে অভিব্যক্ত হয়, তখনই পরম শিবচেতনার মহাবিশ্ব প্রকাশিত হয়।
এই সূত্রের অর্থ তাই কেবল দার্শনিক নয়, অভিজ্ঞতাগতও। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আত্মা কোনো বস্তু নয়, কোনো ‘অহং’-এর অধীন সত্তাও নয়; বরং সেই স্বয়ং-উজ্জ্বল চেতনা, যার মধ্যেই জগৎ প্রতিফলিত। যে-মুহূর্তে সাধক উপলব্ধি করেন—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সেই চৈতন্য”—সেই মুহূর্তেই সে নিজের সীমা ভেঙে শিবচেতনার ঐক্যে পৌঁছায়। এই আত্মবোধই জীবন্মুক্তির সূচনা, আর এই সূত্রই কাশ্মীর শৈবদর্শনের প্রথম ও চূড়ান্ত জাগরণ।
এই একটি সূত্রই জীবন্মুক্তির সারমর্ম প্রকাশ করে। শিব কোনো দেবতা নন, তিনি স্বয়ং চেতনা; আর সেই চেতনা প্রতিটি জীবের মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু এই চেতনা যখন নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, চিন্তা ইত্যাদির সীমায় আবদ্ধভাবে দেখে, তখনই জন্ম নেয় বন্ধন। এই বন্ধন বাস্তব নয়; এটি কেবল আত্ম-আবরণ—চেতনার নিজের অসীমতা ভোলার প্রবণতা। আর মুক্তি মানে সেই আবরণ অপসারণ—আত্ম-উন্মোচন, যেখানে চেতনা নিজেকে নিজের মতো করে চিনে ফেলে।
এই উপলব্ধি ঘটে জ্ঞানের মাধ্যমেই, কিন্তু তা বৌদ্ধিক জ্ঞান নয়; এটি প্রত্যক্ষ আত্ম-অভিজ্ঞতা, যা “প্রত্যভিজ্ঞা”—নিজের ঈশ্বরত্বকে পুনরায় চিনে নেওয়া। যখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, জগৎ কোনো পৃথক বস্তু নয়, বরং তাঁরই চেতনার স্পন্দন, তখন দ্বৈততা বিলুপ্ত হয়। অভিনবগুপ্ত বলেন—“যঃ প্রপঞ্চে শিবম্ পশ্যেত্, শিবম্ চ প্রপঞ্চগতম্”—যঃ (Yaḥ): যিনি; প্রপঞ্চে (prapañce): প্রপঞ্চের মধ্যে (এই দৃশ্যমান জগতের মধ্যে); শিবম্ (śivam): শিবকে; পশ্যেত্ (paśyet): দর্শন করেন/দেখেন; শিবম্ চ (śivaṁ ca): এবং শিবকেও; প্রপঞ্চগতম্ (prapañcagatam): প্রপঞ্চে স্থিত/জগতের মধ্যে প্রবেশ করা রূপে (দেখেন)—অর্থাৎ, "যিনি এই দৃশ্যমান জগতের মধ্যে শিবকে দর্শন করেন, (তিনি) শিবকেও এই জগতে প্রবেশ-করা-রূপে দেখেন।" যে জগতে শিবকে দেখে এবং শিবে জগতকে দেখে, সেই ব্যক্তিই সত্য মুক্ত। এই অবস্থায় ব্যক্তি জানে, আনন্দ ও দুঃখ, লাভ ও ক্ষতি, জন্ম ও মৃত্যু—সবই একই চেতনার নৃত্য, একই স্পন্দনের পরম ছন্দ।
এই শ্লোকটি কাশ্মীর শৈবদর্শন-এর অদ্বৈতবাদী (Non-dualistic) অবস্থানকে অত্যন্ত সংক্ষেপে এবং স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি মূলত অভিন্নতা (Identity) এবং অন্তর্ভুক্তির (Inclusion) তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।
১. অভিন্নতার উপলব্ধি (The Realization of Identity): এই শ্লোকটি দুইভাবে শিব ও জগতের অভিন্নতা ঘোষণা করে—
জগৎ = শিব: প্রথম অংশ ("যিনি প্রপঞ্চে শিবম্ পশ্যেত্") ইঙ্গিত করে যে, সাধক যখন এই বহুত্বময় জগৎ (Prapañca) বা সৃষ্টির দিকে তাকান, তখন তিনি একে শিব ছাড়া অন্য কিছু মনে করেন না। জগৎ হলো শিবের প্রকাশ মাত্র।
শিব = জগৎ: দ্বিতীয় অংশ ("শিবম্ চ প্রপঞ্চগতম্") ইঙ্গিত করে যে, সাধক যখন শিবকে দেখেন বা ধ্যান করেন, তখন তিনি শিবকে কেবল অতীন্দ্রিয় (Transcendent) বা জগতের ঊর্ধ্বে স্থিত রূপে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন যে, শিব স্বয়ং তাঁর স্বাধীন ইচ্ছায় (Svātantrya) জগতে প্রবেশ করেছেন বা জগৎরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
২. মুক্তি (Liberation): এই উপলব্ধিই কাশ্মীর শৈবমতে মুক্তির (Mokṣa) চাবিকাঠি। যিনি শিব ও জগতের এই পরস্পরব্যাপী অভিন্নতা উপলব্ধি করেন, তিনি মায়ার (Māyā) সৃষ্ট দ্বৈততা (duality) থেকে মুক্ত হন। তিনি বোঝেন যে—শিব শুধু স্রষ্টা নন, তিনি স্বয়ং সৃষ্টি। সৃষ্টিকে পরিত্যাগ করে শিবকে খোঁজা বৃথা; শিব সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ, সাধকের কাছে জীব ও ব্রহ্ম, জগৎ ও শিব, বস্তু ও চৈতন্য—সবই এক হয়ে যায়। এটাই হলো প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā, স্বীকৃতি)-এর মূল সার।
কাশ্মীর শৈব-মতে, মুক্তি কখনও জগৎ থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং জগতের মধ্যেই ঈশ্বরত্বের উপলব্ধি। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্রিয়ায় পরম চেতনার ছোঁয়া অনুভব করেন। তিনি কাজ করেন, কিন্তু কর্তা হিসেবে নয়; তিনি ভোগ করেন, কিন্তু ভোক্তা হিসেবে নয়; তিনি জগতের মধ্যে থাকেন, অথচ জগৎ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর সমস্ত আচরণ হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত—চেতনার প্রাকৃতিক প্রকাশ। এই স্বাধীনতা—স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)—হলো জীবন্মুক্তির প্রধান লক্ষণ।
স্পন্দতত্ত্ব অনুযায়ী, জীবন্মুক্তি মানে চেতনার স্পন্দনকে প্রত্যক্ষ করা। ভট্ট কল্লট বলেন—“স্পন্দে স্থিতঃ মুক্তঃ”—স্পন্দে (Spande): স্পন্দ-এ (পরম চেতনার স্পন্দনে বা সূক্ষ্ম স্পন্দনে); স্থিতঃ (sthitaḥ): স্থিত বা প্রতিষ্ঠিত; মুক্তঃ (muktaḥ): মুক্ত বা স্বাধীন—অর্থাৎ, "যিনি স্পন্দে স্থিত (প্রতিষ্ঠিত) হন, তিনিই মুক্ত হন।" জীবন্মুক্ত ব্যক্তি জানেন যে তাঁর প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি ক্রিয়া চেতনারই এক অন্তঃকম্পন। তাই তাঁর কাছে জীবন ও মুক্তি, জাগরণ ও সমাধি, গতি ও স্থিতি—সব এক হয়ে যায়।
এই উক্তিটি স্পন্দ কারিকা এবং স্পন্দ নির্ণয়-এর মূল শিক্ষাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে। এটি মুক্তিলাভের জন্য কোনো বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান বা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজনীয়তাকে নাকচ করে দেয়, বরং অভ্যন্তরীণ উপলব্ধির ওপর জোর দেয়।
স্পন্দ হলো পরম শিবের (Parama Śiva) সেই সূক্ষ্ম স্পন্দন বা গতিশীল চেতনা, যা সৃষ্টির ইচ্ছা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এটি কোনো যান্ত্রিক কম্পন নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরে চেতনারই আত্ম-সচেতন আলোড়ন (Svapratyavamarśa)। সহজ কথায়, এটি হলো 'আমি আছি' এই ধরনের জীবন্ত, প্রবহমান অনুভূতি, যা পরম সত্তা এবং জীবসত্তা—উভয়ের মূলে বিদ্যমান।
স্পন্দে স্থিত হওয়ার অর্থ হলো—জাগতিক অভিজ্ঞতাগুলির (যেমন: সুখ, দুঃখ, রাগ, চিন্তা, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান) দ্বারা বিচলিত না হয়ে, সেগুলির মূলে যে অপরিবর্তনীয় চৈতন্য বা স্পন্দন রয়েছে, তা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা। সাধক যখন বুঝতে পারেন যে, তাঁর ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞান এবং কর্ম সবই সেই এক স্পন্দ শক্তির প্রকাশ, তখন তিনি নিজেকে কর্মের ফল থেকে মুক্ত করেন। এভাবেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসে। এটি হলো অবিচ্ছিন্ন আত্ম-সচেতনতা-র সেই অবস্থা, যেখানে মনের চাঞ্চল্য (Vṛtti) বা গতি থামে না, কিন্তু মন সেই চাঞ্চল্যের মূল উৎস (স্পন্দ) সম্পর্কে সচেতন থাকে।
স্পন্দে স্থিত হওয়ার ফল হলো মুক্তি (Mukti বা Jīvanmukti)। যিনি স্পন্দে স্থিত, তিনি জীবনকালের মধ্যেই মুক্ত হন। তাঁর কাছে সৃষ্টি আর বন্ধন থাকে না, বরং তা শিবের লীলা বা নিজ আত্মারই প্রকাশ রূপে প্রতিভাত হয়। এই মুক্তি হলো দ্বৈততা থেকে মুক্তি—আমি এবং অন্যের (subject-object dichotomy) পার্থক্য থেকে মুক্তি। সমস্ত জাগতিকতা বিলুপ্ত না হয়েও, তার বন্ধন করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়।
এই উক্তিটি যোগীকে শেখায় যে, মুক্তি কোনো দূরবর্তী লক্ষ্য নয়; এটি সর্বদা বিদ্যমান চেতনার স্পন্দনে মনোযোগ নিবদ্ধ করার একটি তাৎক্ষণিক সুযোগ মাত্র।
“Subject-Object Dichotomy” বা কর্তা-বস্তু বিভাজন (বাংলায়: জ্ঞাতা-জ্ঞেয় দ্বৈততা) দর্শনের এক মৌল সমস্যা, যা চেতনা ও অভিজ্ঞতার প্রকৃতি বোঝার কেন্দ্রে অবস্থান করে। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই বিভাজনকে বলা হয় দ্বৈতাভাসনা (dvaitābhāsanā)—অর্থাৎ, চেতনা যখন নিজেকে কর্তা (subject) ও বস্তুর (object) দুই ভিন্ন সত্তা হিসেবে উপলব্ধি করে, তখনই বিভেদের মায়া জন্ম নেয়।
‘দ্বৈতাভাসনা’ বলতে বোঝায়, কীভাবে অদ্বৈত চেতনা নিজের মধ্যেই “আমি” ও “অন্য”—এই বিভাজনের আভাস রচনা করে। এই বিভাজন কোনো বাস্তব বা সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) সত্য নয়; এটি চেতনার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের এক খেলা, এক আত্ম-প্রতিফলন। চেতনা (সংবিত্) প্রকৃতপক্ষে এক, অবিভাজ্য ও স্ব-উজ্জ্বল—সে নিজেই নিজের আলোয় জ্বলে এবং নিজেরই মধ্যে সবকিছু উদ্ভাসিত করে। কিন্তু যখন সেই চেতনা নিজের প্রতি সচেতন হয়—অর্থাৎ, যখন সে নিজেকে জানার অভিপ্রায়ে নিজের প্রতিচ্ছবি রচনা করে—তখনই তার মধ্যে জন্ম নেয় এক সূক্ষ্ম প্রতিফলন, যেখানে সে নিজেকে “জ্ঞাতা” রূপে অনুভব করে এবং নিজেরই প্রতিফলনকে “জ্ঞেয়” বা “বস্তু” রূপে দেখে। এই আত্মপ্রতিফলনের আভাসই হলো দ্বৈতাভাসনা।
অভিনবগুপ্ত এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করেছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে—“সা হি পরমা সংবিত্ স্বাতন্ত্র্যময়ী, স্ববিমর্শনাত্ স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসম্ উৎপাদ্য ক্রীড়য়ৈব” (ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-ভিমর্শিনী, খণ্ড ১, সূত্র ৪২)। এই উক্তিটির মধ্যে নিহিত রয়েছে কাশ্মীর শৈব দর্শনের এক গভীর অধিবিদ্যাগত সত্য। পরম সংবিত্ বা চেতনা কোনো নিষ্ক্রিয় সত্তা নয়; বরং তিনি স্বয়ং স্বাতন্ত্র্যময়ী—অর্থাৎ স্বাধীনতা-স্বরূপ। এই স্বাধীনতাই তাঁকে এমন এক আত্ম-সচেতন শক্তিতে পরিণত করে, যিনি নিজের মধ্যে নিজেকে জানেন, নিজের মধ্যেই নিজেকে প্রকাশ করেন।
এখানে “স্ববিমর্শনাত্” শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। “বিমর্শ” (vimarśa) মানে হচ্ছে আত্ম-সচেতনতা—চেতনার নিজের প্রতি চেতনা। শিব বা পরম সংবিত্ যখন নিজের দীপ্তিতে নিজেকে অনুভব করেন, তখন সেই আত্ম-বিমর্শ থেকেই সৃষ্টি হয় জ্ঞাতা (subject) ও জ্ঞেয় (object)-এর প্রতিফলন। কিন্তু এই প্রতিফলন কোনো বিভাজন নয়, কোনো ত্রুটি নয়; এটি কেবল তাঁর ক্রীড়া—তাঁর আনন্দময় আত্ম-উন্মোচন। চেতনা অসীম, কিন্তু সেই অসীমতাকে জানার আনন্দেই সে নিজেকে সীমার মধ্যে প্রকাশ করে, যেন এক অনন্ত নৃত্যের মতো।
অভিনবগুপ্ত এখানে এক মৌলিক দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন—চেতনা কখনোই নিস্পৃহ বা জড় নয়; তাঁর প্রকৃতি নিজেই স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল। তাই এই দ্বৈততার আভাস (দ্বৈতাভাসনা) কোনো অজ্ঞানের ফল নয়, বরং চেতনার স্বেচ্ছামূলক প্রকাশ—তাঁর স্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তি। চেতনা নিজের আনন্দে নিজেরই প্রতিরূপ সৃষ্টি করে, নিজেকে দেখে, নিজেকে চিনে। এভাবে, জগতের উৎপত্তি কোনো বাহ্যিক সৃষ্টির কাজ নয়; বরং এটি চেতনার আত্ম-প্রকাশ, তার নিজের স্বাতন্ত্র্যের নৃত্য।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে “দ্বৈততা” কোনো বিপরীত নয়, বরং অভিন্নতারই ছায়া—অদ্বৈত চেতনা নিজেকে দেখার আনন্দে নিজেকে দ্বৈত রূপে প্রতিফলিত করে, যেন একটি আয়নায় মুখ নিজেরই মুখ দেখতে পায়। কিন্তু সেই প্রতিফলন কখনোই পৃথক বাস্তব নয়—মুখ ও প্রতিচ্ছবি একই চেতনার অন্তর্গত এক অভিন্ন সত্য। এই উপলব্ধিই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় প্রত্যভিজ্ঞা-র পথে—যেখানে জানা যায়, “আমি-ই সেই”—আমি-ই জ্ঞাতা, আমি-ই জ্ঞেয়, আমি-ই জ্ঞান।
পরম সংবিত্ বা চেতনা নিজের স্বাধীনতার দ্বারা, নিজেরই আনন্দময় ক্রীড়া হিসেবে, দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। এখানে কোনো ত্রুটি বা অজ্ঞানের স্থান নেই; বরং এটি চেতনার আনন্দময় আত্মপ্রকাশ। চেতনা নিজের অসীমতাকে উপলব্ধি করতে চায়, এবং সেই উপলব্ধির উপায়ই হলো আত্ম-প্রতিফলন।
“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি” (ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা, ১.৫.৮)—উত্পলদেবের এই সূত্রটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র অধিবিদ্যা বোঝার এক মূল চাবিকাঠি। এখানে তিনি এক গভীর সত্য প্রকাশ করেছেন যে, চেতনা (চিত্ বা সংবিত্) কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত বা নির্ভরশীল নয়; সে নিজেই নিজের রূপে (চিদ্রূপতয়া) বিবর্তিত হয়, অর্থাৎ নিজ থেকেই নিজেকে প্রকাশ করে।
এই “বিবর্তন” বা প্রকাশ কোনো পরিবর্তন নয়; বরং এটি স্ব-উজ্জ্বল চেতনার নিজের দীপ্তির বিস্তার। চেতনা তার অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা ‘স্বাতন্ত্র্য’ (svātantrya) দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে এবং সেই প্রকাশের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বৈতাভাসনা, অর্থাৎ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সূক্ষ্ম প্রতিরূপ। এখানে “দ্বৈতাভাসনা” মানে প্রকৃত দ্বৈততা নয়, বরং তার আভাস, এক প্রতিফলনমাত্র। চেতনা নিজের মধ্যে নিজেকে দেখতে চায়—এই আত্মদর্শনের প্রক্রিয়াতেই জগতের আকার গঠিত হয়।