কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীর অভ্যন্তরে যে ত্রিমুখী তত্ত্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল—ত্রিক, প্রত্যভিজ্ঞা ও ক্রম—তা কেবল একাধিক দার্শনিক শাখার সমষ্টি নয়, বরং চেতনা-বিজ্ঞানের এক ক্রমোন্নত অন্তর্দর্শন। এই তিনটি ধারা, যদিও ভাষা ও উপস্থাপনায় পৃথক, পরম চেতনার অদ্বৈত অভিজ্ঞতাকে তিন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে। ত্রিক ব্যাখ্যা করে চেতনার ত্রিত্বমূলক প্রকৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা ব্যাখ্যা করে আত্মচেতনার পুনঃস্মৃতি, আর ক্রম প্রকাশ করে চেতনার অভ্যন্তরীণ বিকাশ ও লয়ের স্পন্দন।
ত্রিক দর্শনের কেন্দ্রে আছে “ত্রি”—অর্থাৎ শিব, শক্তি ও নর। এখানে শিব হলেন পরম চেতনা; শক্তি সেই চেতনার প্রকাশশক্তি, আর নর বা জীব সেই চেতনার আংশিক প্রকাশ, যিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ সত্তা বলে ভাবেন। কিন্তু বাস্তবে, এই তিনটি কোনো পৃথক সত্তা নয়—তারা এক চেতনার তিনটি কার্যরূপ। শিব নিস্তব্ধ সম্ভাবনা, শক্তি সেই সম্ভাবনার স্পন্দন, আর নর সেই স্পন্দনের অভিজ্ঞতাকারী। এইভাবে ত্রিক দর্শন বোঝায় যে, সৃষ্টির বহুত্ব আসলে ঐক্যেরই প্রকাশ—চেতনার নিজস্ব আনন্দলীলার বহুবিধ প্রতিফলন।
এই ঐক্যবোধক তত্ত্ব প্রত্যভিজ্ঞায় এসে আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক রূপ লাভ করে। প্রত্যভিজ্ঞা (‘স্বীকৃতি’ বা ‘পুনরায় জানা’) দর্শনের মূলভিত্তি স্থাপনকারী গ্রন্থ ‘ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা’-র আদি পঙ্ক্তিগুলিতে আচার্য সোমানন্দ-এর শিষ্য উৎপলদেব বলেন, মুক্তি কোনো নতুন প্রাপ্তি নয়—এটি এক “প্রত্যভিজ্ঞা”, অর্থাৎ আত্মস্মৃতি। জীবের মধ্যে যে পরম চেতনা অবিরত জেগে আছে, সে নিজেকে চিনতে না পারার কারণেই বন্ধন জন্মায়। মুক্তি মানে সেই ভুলে থাকার অবসান—নিজেকে চিনে ফেলা: “আমি-ই সেই শিব।” এই চিন্তা কোনো বৌদ্ধিক তর্ক নয়, বরং এক প্রত্যক্ষ অনুধাবন, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই নিজেকে অভিজ্ঞ করে। প্রত্যভিজ্ঞা মতবাদের এই আত্মচেতনা-তত্ত্ব অদ্বৈতবাদের সঙ্গে আশ্চর্য সাযুজ্য রাখে, তবে এখানে ব্রহ্ম ও আত্মা নয়, শিব ও সংবিত—এই দুই শব্দে সেই একই সর্বচেতনার বোধ প্রকাশিত হয়।
এই কারিকাগুলির মূল লক্ষ্য হলো, জীবাত্মাকে তার স্বয়ং শিব-স্বরূপকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া বা স্বীকৃতি এনে দেওয়া। এটি প্রমাণ করে যে, পরম চেতনা (সংবিৎ বা পরমশিব) এবং ব্যক্তিগত চেতনা (জীব) আসলে এক ও অভিন্ন, কেবল অবিদ্যা (অজ্ঞান) বা মায়া-র কারণে এই পার্থক্য প্রতীয়মান হয়। এটি কাশ্মীর শৈববাদের অদ্বৈতবাদী (non-dualistic) অবস্থানকে দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে, যা ত্রিকা বা ত্রিক নামেও পরিচিত। গ্রন্থটি শিবের পরম স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya) শক্তিকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূলে স্থাপন করে। এই কারিকাগুলির ওপরই অভিনবগুপ্ত (Abhinavagupta) তাঁর বিখ্যাত টীকা ‘ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিমর্শিনী’ রচনা করেন, যা প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনকে আরও উচ্চ স্তরে উন্নীত করে এবং এটিকে ভারতীয় দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
ক্রমপন্থা এই দুই দর্শনেরই বিকশিত রূপ—এক চলমান ধ্যানতত্ত্ব, যেখানে চেতনার অনুক্রমিক উন্মোচনকে ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতামূলক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। ক্রম-মতে, মহাবিশ্ব কোনো স্থির সৃষ্টি নয়; এটি চেতনার এক ক্রমোন্নত উন্মোচন—প্রকাশ, স্থিতি, সংহার, গোপন ও অনুগ্রহ—এই পাঁচ চিরন্তন ক্রিয়ার ছন্দে প্রবাহিত। এই দর্শনে, কালী সেই পরম শক্তি, যিনি সময়, ক্রম ও চেতনার সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে পরম নীরবতায় অবস্থান করেন। তিনি শিবের গতিশীল শক্তি—যিনি নিজের মধ্যে বিশ্বকে সৃষ্টি করেন, আবার নিজের মধ্যেই তা শোষণ করেন।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি মৌলিক ধারণা—শিব (Śiva) ও সংবিত (Saṁvit)। এই দুটি শব্দ আলাদা হলেও, তাদের মধ্যে কোনো দ্বৈততা নেই; বরং একটিই অন্যটির প্রতিফলন। “শিব” বলতে বোঝানো হয় পরম চেতনা—এক সর্বব্যাপী, স্ব-ভাস্বর, অনন্ত সত্তা, যা সমস্ত অস্তিত্বের উৎস। আর “সংবিত” মানে সেই চেতনারই স্বরূপ, তার স্ব-অবগত শক্তি—যার দ্বারা চেতনা নিজেকে জানে এবং নিজেকে প্রকাশ করে।
অভিনবগুপ্তের উক্তি—“শিবঃ সংবিত্ স্বাতন্ত্র্যময়ী”—কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র অধিবিদ্যার মূলসূত্রের মতো। এই সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিহিত আছে পরম বাস্তবতার দুই মৌলিক স্বরূপ: সংবিত্ (Saṁvit)—অর্থাৎ চেতনা, এবং স্বাতন্ত্র্যময়ী (Svātantryamayī)—অর্থাৎ স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ।
অভিনবগুপ্ত এই উক্তির মাধ্যমে বলেন, শিবই চেতনা, আর সেই চেতনা স্বয়ং স্বাধীন। এটি কোনো নির্জীব বা স্থির চেতনা নয়, বরং এমন এক সচল, আত্মজাগ্রত ও সৃষ্টিশীল সত্তা, যিনি নিজের অন্তর্গত ইচ্ছাশক্তি দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করেন, জানেন এবং পুনরায় নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করেন।
এই “স্বাতন্ত্র্য” (svātantrya) বা স্বাধীনতা কাশ্মীর শৈব দর্শনের সবচেয়ে মৌল ও বিপ্লবী ধারণা। এখানে শিব কোনো যান্ত্রিক ঈশ্বর নন, যিনি নিয়তির দ্বারা পরিচালিত হন, বা কোনো বাহ্যিক কারণে কিছু করেন। বরং তিনি এমন এক পরম চেতনা—যিনি নিজের কারণ নিজেই, যিনি নিজের ইচ্ছাতেই প্রকাশিত হন এবং নিজের ইচ্ছাতেই লয়প্রাপ্ত হন। তাঁর কোনো বাহ্য উপাদান নেই, কোনো বাহ্য উদ্দেশ্যও নেই।
‘সংবিত’ মানে কেবল “জ্ঞান” নয়, বরং সেই আত্ম-প্রতিফলিত জ্ঞান—যা নিজেই নিজের বোধ, নিজেরই আলোয় উদ্ভাসিত। শিব কোনো বস্তু বা সত্তাকে জানেন না, কারণ তাঁর বাইরে কিছু নেই। তিনি নিজেকে জানেন, আর এই আত্মজ্ঞানই সমস্ত জ্ঞানের মূল। এই আত্ম-জানাই মহাবিশ্বের রূপে বহুমাত্রিকভাবে প্রকাশিত হয়—যেখানে প্রতিটি বস্তু, চিন্তা, অনুভূতি, স্পন্দন শিবেরই আত্মপ্রকাশ।
এখানেই নিহিত কাশ্মীর শৈবদর্শনের অদ্বৈততার সূক্ষ্মতা। শিব জ্ঞাতা (knower), জ্ঞেয় (known) এবং জ্ঞান (knowledge)—এই তিন কোনো আলাদা সত্তা নয়, বরং একক চেতনার আত্ম-প্রতিফলনের তিন দিক। যেমন একটি আয়নায় মুখ প্রতিফলিত হয়—কিন্তু মুখ, প্রতিফলন ও আয়না—সবই আসলে এক আলোয় প্রতিষ্ঠিত—তেমনি শিব নিজের মধ্যেই জ্ঞানের এই ত্রিত্বকে ধারণ করেন, কিন্তু কখনোই বিভক্ত হন না।
এ দিক থেকে, “শিবঃ সংবিত্ স্বাতন্ত্র্যময়ী” বাক্যটি কেবল দার্শনিক নয়, অস্তিত্বগতও। এটি জানায় যে, চেতনা স্বভাবতই স্বাধীন, এবং স্বাধীনতা স্বভাবতই চেতনা। এই স্বাধীনতা (svātantrya) বা পরম ইচ্ছাশক্তি (icchā-śakti)-ই সমগ্র সৃষ্টির ভিত্তি—যা থেকে উদ্ভূত হয় প্রকাশ (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোধান (tirodhāna) ও অনুগ্রহ (anugraha)।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র অধিবিদ্যা (Metaphysics of Kashmir Śaivism) এক গভীর ও সমন্বিত চেতনা-তত্ত্ব, যা অস্তিত্ব, জ্ঞান, ঈশ্বর, জগৎ, ও মুক্তি—এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এক অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়। এই দর্শনের মূল বক্তব্য এক বাক্যে প্রকাশ করা যায়—“শিবঃ সংবিত্ স্বাতন্ত্র্যময়ী”—অর্থাৎ, শিবই পরম চেতনা (saṁvit), এবং সেই চেতনা স্বাতন্ত্র্যময়ী (svātantryamayī), অর্থাৎ স্বতঃসিদ্ধ স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ।
এই এক বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে সমগ্র কাশ্মীর শৈব-অধিবিদ্যার বীজ। কাশ্মীর শৈব দর্শনের এই বর্ণনায় যে-ধারণাটি প্রকাশ পায়, তা হলো—শিব কোনো ব্যক্তিগত দেবতা নন, বরং চেতনার স্বরূপ-সত্তা (Consciousness itself as Being)। শিব মানে সেই চেতনা, যা সর্বব্যাপী, স্বয়ং-ভাস্বর (self-luminous) এবং স্বাতন্ত্র্যময়ী (endowed with absolute freedom)। তিনি কারও দ্বারা সৃষ্ট নন, এবং তাঁর কোনো বাহ্যিক কারণ নেই; বরং তিনিই সেই পরম কারণ, যাঁর মধ্যেই সব কারণের সম্ভাবনা নিহিত।
যখন বলা হয়—শিব নিজের ইচ্ছাশক্তিতে (icchā-śakti) অসীম থেকে সীমিত, অচল থেকে চলমান, নিরাকার থেকে রূপময় হয়ে ওঠেন—তখন তার অর্থ এ নয় যে, শিব কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান; বরং এই কথাটি বোঝায়, পরম চেতনা নিজেকে নানা আকারে প্রকাশ করেন, তবু কখনও নিজের সারসত্তা হারান না। এটি “পরিণাম নয়, প্রকাশ (not transformation but manifestation)।” যেমন একটি আয়নায় অসংখ্য রূপ প্রতিফলিত হতে পারে, কিন্তু আয়না নিজে অপরিবর্তিত থাকে, তেমনি শিব-চেতনা অসংখ্য রূপে প্রকাশ পেলেও তিনি নিজে অচল, স্বরূপতঃ এক ও পূর্ণ।
এই চেতনার দুটি মুখ—প্রকাশ (prakāśa) ও বিমর্শ (vimarśa)—কাশ্মীর শৈব অধিবিদ্যার মূলনীতি।
প্রকাশ (Prakāśa) মানে চেতনার দীপ্তি, তার আলোকময়তা, যা দ্বারা সব কিছু উদ্ভাসিত হয়। এটি অস্তিত্বের দিক (being-as-light): যে-কারণে কিছু “আছে”, তা-ই প্রকাশ (‘I am’ ভাবটি)।
বিমর্শ (Vimarśa) মানে সেই আলোকের আত্ম-সচেতনতা, নিজের প্রতি প্রত্যাবর্তন—“আমি আছি”, “আমি জানি”, এই অনুভব (‘I can’ ভাবটি)। যদি প্রকাশ শুধু আলো হয়, তবে বিমর্শ হলো সেই আলোর আত্মদৃষ্টি। আলো কেবল তখনই “সচেতন” হয়, যখন সে নিজের আলোকিত হওয়ার বোধে জাগ্রত হয়।
অভিনবগুপ্ত এই সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করতে বলেন: “যদি প্রকাশ থাকে কিন্তু বিমর্শ না থাকে, তবে তা জড় (inert); কারণ আলো নিজের অস্তিত্ব জানে না। আর যদি বিমর্শ থাকে, কিন্তু প্রকাশ না থাকে, তবে কোনো কিছু প্রকাশই পাবে না। তাই চেতনা হলো প্রকাশ-বিমর্শের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য—একই দীপ্তি, যা নিজেকে জানে।”
এইভাবে, প্রকাশ ও বিমর্শ মিলেই চেতনার জীবন্ত সারসত্তা—যা স্থিরও নয়, চলমানও নয়; এটি এক স্পন্দন (spanda)—আত্ম-সচেতন দীপ্তির স্পন্দিত নৃত্য।
সুতরাং, যখন আমরা বলি “শিবই সংবিত্,” তখন এর অর্থ—শিব সেই চেতনা, যার দীপ্তি ও আত্মসচেতনতা একইসাথে প্রকাশিত। আর তাঁর এই স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতাই মহাবিশ্বের উৎস। বিশ্ব কোনো বাইরের সৃষ্টি নয়; এটি শিব-চেতনারই আত্ম-বিস্তার—প্রকাশ ও বিমর্শের নৃত্যে জন্ম-নেওয়া এক অনন্ত লীলা।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল হৃৎস্পন্দন হল স্পন্দন (Spanda)—এক এমন শব্দ, যা সাধারণত “কম্পন” বা “নাড়ন” হিসেবে অনূদিত হলেও, এখানে তা বাহ্যিক আন্দোলন নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত সজাগ নাড়ন, এক আত্ম-সচেতন দীপ্তির স্পন্দিত ছন্দ। এই ধারণার শিকড় নিহিত আছে প্রাচীন গ্রন্থ স্পন্দকারিকা-য়, যা আচার্য কল্লট (Kallaṭa) রচনা করেন তাঁর গুরু ভাসুগুপ্ত-এর শিবসূত্র ব্যাখ্যা করতে; পরে অভিনবগুপ্ত এই তত্ত্বকে দার্শনিক গভীরতায় উন্মোচন করেন তাঁর স্পন্দ নির্ণয় (Spanda Nirṇaya)-এ। স্পন্দন সেখানে মানে এমন এক সূক্ষ্ম চেতনা-কম্পন, যা স্থিরতা ও গতির, নিস্তব্ধতা ও শব্দের, একত্ব ও বহুত্বের নিখুঁত সংযোজন।
‘স্পন্দ নির্ণয়’ (Spanda Nirṇaya) কাশ্মীর শৈবদর্শনের অন্যতম প্রামাণ্য ও সূক্ষ্ম গ্রন্থ—যা আচার্য অভিনবগুপ্ত রচনা করেছিলেন মূল স্পন্দকারিকা (Spanda Kārikā)-র ব্যাখ্যা হিসেবে। মূল স্পন্দকারিকা লেখেন কল্লট (Kallaṭa), যিনি ছিলেন শিবসূত্র-এর (Śiva Sūtra) প্রবর্তক ভাসুগুপ্ত (Vasugupta)-র প্রধান শিষ্য। ‘স্পন্দ নির্ণয়’ সেই শাস্ত্রীয় ধারার দার্শনিক হৃদয়, যেখানে “স্পন্দ” বা “আত্ম-সচেতন চেতনার সূক্ষ্ম নাড়ন”—এই এক শব্দের মধ্যেই কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমস্ত অধিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ও মুক্তিতত্ত্ব একত্রিত হয়েছে।
অভিনবগুপ্ত তাঁর ‘স্পন্দ নির্ণয়’-এ প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন যে, “স্পন্দ” শব্দটি কোনো ভৌত কম্পন (physical vibration) বোঝায় না। এটি চেতনার এক অন্তর্লীন আত্ম-গতি (inner pulsation of consciousness)—যেখানে শিব, অর্থাৎ পরম চেতনা, নিজেই নিজের মধ্যে নাচেন, নিজেকে জানেন, এবং নিজেরই প্রকাশ হয়ে ওঠেন। প্রথম শ্লোকে তিনি বলেন—“স্পন্দঃ নাম স্বপ্রত্যবমর্শলক্ষণঃ চিদিচ্ছাশক্তির ঈষৎ চলনঃ।” (স্পন্দ নির্ণয়, কারিকা ১.১) অর্থাৎ—“স্পন্দ মানে সেই চেতনা, যার স্বরূপ নিজের প্রতি সচেতনতা, আর যার ইচ্ছাশক্তি সামান্য চলনের দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে।”
এখানে “চিদিচ্ছাশক্তি (Cid-Icchā-Śakti)” শব্দগুচ্ছটি গুরুত্বপূর্ণ। চেতনা (cit) নিজে নিস্তব্ধ, কিন্তু তার মধ্যেই ইচ্ছা (icchā)—অর্থাৎ আত্ম-প্রকাশের তাড়না—গোপনে কাজ করছে। এই সূক্ষ্ম নাড়নই স্পন্দন। এইভাবে অভিনবগুপ্ত স্পন্দকে “চেতনার অন্তর্নিহিত জীবন্ততা” হিসেবে ব্যাখ্যা করেন—যেখানে স্থিরতা ও গতি, প্রকাশ ও লয়—সব একাত্ম।