যোগাচার মতে, প্রতিটি জ্ঞানের মধ্যে দুটি দিক সক্রিয় থাকে—বিষয়াকার (viṣayākāra) এবং স্বাকার (svākāra)। বিষয়াকার হলো জ্ঞানের সেই দিক, যেভাবে জ্ঞান কোনো বস্তু বা বিষয়ের রূপ ধারণ করে; আর স্বাকার হলো জ্ঞানের সেই অন্তর্গত দিক, যেভাবে জ্ঞান নিজেরই রূপকে আলোকিত করে। এই দুই রূপ পৃথক নয়; বরং একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, যেমন আগুন ও তার উষ্ণতা একসঙ্গে বিদ্যমান। যখন আমি কোনো দৃশ্য দেখি, তখন শুধু দৃশ্যই দেখি না—একই সঙ্গে অনুভব করি যে, “আমি দেখছি।” এই “আমি দেখছি”-র অনুভবই সেই চেতনার অন্তর্গত স্বসংবেদনরূপ দিক।
স্বসংবেদন (svasaṃvedana)—অর্থাৎ, চেতনার নিজেকে নিজে জানার ক্ষমতা—ভারতীয় দর্শনের এক গভীর ও বহুমাত্রিক তত্ত্ব, যা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ও আত্ম-উপলব্ধির প্রকৃতি নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। শব্দতত্ত্বে sva মানে ‘নিজস্ব’, আর saṃvedana মানে ‘অভিজ্ঞতা’ বা ‘অনুভব’; সুতরাং স্বসংবেদন মানে এমন এক চেতনা, যা নিজের উপস্থিতিকে নিজের মধ্যেই অনুভব করে, নিজের আলোকেই নিজের প্রমাণ হয়। তবে এই ধারণা ভারতীয় দর্শনের প্রতিটি শাখায় একভাবে গৃহীত নয়; বরং বৌদ্ধ যোগাচার, অদ্বৈত বেদান্ত, সাংখ্য-যোগ, ন্যায়-বৈশেষিক ও জৈন দর্শন—প্রত্যেকেই এর ব্যাখ্যা, সীমা ও সত্যতা নিয়ে আলাদা অবস্থান গ্রহণ করেছে।
প্রথমেই বৌদ্ধ যোগাচার দর্শনের কথা বলা যাক। এখানে স্বসংবেদন তত্ত্ব (svasaṃvedana-vāda) জ্ঞানের মূল ভিত্তি। আচার্য বসুবন্ধু ও ধর্মকীর্তি বলেন—প্রতিটি চেতনা কেবল বস্তুর প্রতিফলন নয়, বরং নিজের প্রতিফলনও বহন করে। ধর্মকীর্তি তাঁর প্রমাণবার্ত্তিক-এ ঘোষণা করেন—“জ্ঞানং স্বসংবেদনম্” (jñānaṃ svasaṃvedanam), অর্থাৎ, জ্ঞান নিজেই নিজের প্রমাণ। কারণ, যদি জ্ঞানকে জানার জন্য আরেকটি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তবে তা আবার অন্য এক জ্ঞানের প্রয়োজন করবে, এবং এভাবে অনন্ত প্রত্যাবৃত্তি (anavasthā-doṣa) ঘটবে। এই দোষ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, জ্ঞান নিজেই নিজের মধ্যে নিজেকে অনুভব করে—যেমন আলো নিজের দ্বারা নিজেকে আলোকিত রাখে। যোগাচার মতে, এই আত্ম-উপলব্ধিই চেতনার স্বরূপ; চেতনা কোনো নির্জীব প্রতিফলন নয়, বরং স্বয়ং-জাগ্রত অভিজ্ঞতা। তাই তাঁদের মতে, জ্ঞানের প্রতিটি মুহূর্তেই বিষয়াকার (viṣayākāra)—বাহ্যবস্তুর প্রতিফলন, এবং স্বাকার (svākāra)—নিজের আত্ম-অভিজ্ঞতা—দুটোই একসঙ্গে প্রকাশ পায়।
অদ্বৈত বেদান্তে স্বসংবেদনের ধারণা আরেক অর্থে গভীরতর ও সর্বব্যাপী। শঙ্করাচার্য বলেন—চেতনা (cit) কখনও অচেতন নয়, সে সর্বদা নিজের দ্বারা নিজেরই প্রকাশ। এই ধারণা স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা (svayaṃ-prakāśa-caitanya) তত্ত্ব নামে পরিচিত। পার্থক্যটি সূক্ষ্ম—যোগাচারে প্রতিটি জ্ঞান-ক্ষণের মধ্যে নিজের জাগরণ থাকে, কিন্তু বেদান্তে চেতনা জ্ঞানের পেছনের চিরস্থায়ী আলো—যা কখনও সৃষ্টি বা বিলয় পায় না। যখন আমরা বলি “আমি জানি,” তখন সেই জানার ভিত্তি, জানার ক্রিয়া ও জানার আত্মা—তিনটিই আসলে একই চেতনার প্রকাশ। তাই বেদান্তে আত্মা বা ব্রহ্ম চিরজাগ্রত, চির-আলোকিত; সে কখনও নিজের অভাবে থাকে না, কারণ সে স্বয়ংপ্রমাণ। শঙ্কর বলেন, চেতনার প্রমাণ দেওয়ার জন্য অন্য কিছু প্রয়োজন হয় না; বরং সমস্ত প্রমাণই চেতনার আলোয় ঘটে। এখানে স্বসংবেদন মানে—চেতনা নিজের স্বরূপে স্বয়ং অবস্থিত, স্বয়ংজ্ঞানময়, এবং নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ। এটি কোনো জ্ঞানক্রিয়া নয়, বরং অস্তিত্বের স্বরূপ।
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে স্বসংবেদন তত্ত্বকে স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করা হয়নি; তারা বলে—জ্ঞান ও আত্মা পৃথক সত্তা। আত্মা নিজে অচেতন; চেতনা তার গুণমাত্র। আমরা যখন নিজের চেতনা সম্পর্কে জানি—যেমন “আমি জানি যে, আমি জানি”—সেটি প্রথম জ্ঞানের পরে দ্বিতীয় জ্ঞান দ্বারা সম্ভব। তাই ন্যায়-মতে স্বসংবেদন নয়, বরং অনুভাবিত বা অনুমিত আত্মজ্ঞান ঘটে; আত্মা নিজে চিরসচেতন নয়, বরং জ্ঞান তার অবস্থা বা গুণ। এই মতকে যোগাচারীরা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ এটি অনন্ত প্রত্যাবৃত্তির দোষে পতিত।
সাংখ্য-যোগ মতে, স্বসংবেদন ঘটে পুরুষ (puruṣa)-এর মাধ্যমে, যা চেতনার বিশুদ্ধ সাক্ষী। কিন্তু এখানে চেতনা সক্রিয় নয়, সে “দ্রষ্টা” বা “দর্শক”—নিজের দ্বারা নিজের প্রতিফলন নয়, বরং প্রকৃতির প্রতিফলন দ্বারা নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। “দ্রষ্টা দৃশ্যমাত্র”—এই উক্তিটি ভারতীয় দর্শনের অন্তর্গত এক গভীর তত্ত্ব, যা চেতনা-তত্ত্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। এর দ্বারা বোঝানো হয়, দ্রষ্টা বা চৈতন্য-সত্তা এবং দৃশ্য বা জগতের মধ্যকার সম্পর্কের মৌলিক প্রকৃতি। এই উক্তিটি কোনো একক শাস্ত্রের নির্দিষ্ট শ্লোক নয়; বরং এটি বহু দর্শন-প্রণালির অভিন্ন অভিজ্ঞতার সারাংশ, বিশেষত যোগদর্শন ও অদ্বৈত-বেদান্তের মিলিত তত্ত্ব।
যোগদর্শনে পতঞ্জলির যোগসূত্র-এ পুরুষকে বলা হয়েছে শুদ্ধ দ্রষ্টা, চির-সাক্ষী, যিনি প্রকৃতির সকল ক্রিয়াকলাপ কেবল প্রত্যক্ষ করেন কিন্তু তাতে নিজে জড়ান না। প্রকৃতি বা দৃশ্য হলো সমস্ত মানস-বস্তু, রূপ-রস-গন্ধ-চিন্তা, যা কেবল পুরুষের জন্যই প্রকাশিত। দ্রষ্টা যদিও নিজে শুদ্ধ, তথাপি চিত্ত-প্রত্যয়ের অনুপাশক, অর্থাৎ প্রত্যক্ষকারী মাত্র। এখানে পুরুষ কখনোই কর্মী নন; তিনি শুধু সচেতন সাক্ষী।
“চিত্ত-প্রত্যয়ের অনুপাশক”—এই শব্দবন্ধটি পতঞ্জলির যোগসূত্র (২.২০)-এর মধ্য দিয়ে পুরুষ বা দ্রষ্টার প্রকৃত অবস্থাকে প্রকাশ করে। সূত্রটি হলো—“দ্রষ্টা দৃশ্যমাত্রঃ শুদ্ধোপি প্রত্যয়অনুপশ্যঃ।” এর আক্ষরিক অর্থ—“দ্রষ্টা কেবল দৃশ্যের প্রত্যক্ষকারী; তিনি শুদ্ধ, কিন্তু চিত্ত-প্রত্যয়গুলির অনুপাশক।” এখানে চিত্ত মানে মন বা মানসিক অবয়বসমষ্টি, আর প্রত্যয় মানে মানসিক ভাব, চিন্তা বা অভিজ্ঞতার নির্দিষ্ট রূপ। অর্থাৎ, চিত্ত-প্রত্যয় হলো সেই সব মানসিক তরঙ্গ, যেগুলি ধারাবাহিকভাবে চেতনার সামনে উদ্ভাসিত হয়—ভাবনা, ইচ্ছা, অনুভূতি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি রূপে।
“অনুপাশক” শব্দটি এসেছে anu + paś ধাতু থেকে—যেখানে paś মানে দেখা, আর anu মানে অনুসরণ করা। সুতরাং “অনুপাশক” বলতে বোঝায় এমন একজন দর্শক, যিনি কেবল দেখছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন, কিন্তু তাতে নিজেকে জড়াচ্ছেন না। পতঞ্জলি এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন আত্মা বা পুরুষের অবস্থা বোঝাতে—যিনি স্বয়ং কোনো কর্ম করেন না, কিন্তু চিত্তে যে-সমস্ত প্রত্যয় বা ভাব-রূপ তরঙ্গ ওঠে, তিনি তাদের কেবল দেখেন, যেন আয়না যেভাবে সব প্রতিফলন গ্রহণ করে, কিন্তু নিজে কখনও রং নেয় না।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে “চিত্ত-প্রত্যয়ের অনুপাশক” মানে এমন এক চেতনা, যা নিজে কখনও পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু মনোজগতের প্রতিটি পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করে। মন বা চিত্ত একেক মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে—কখনো রাগ, কখনো ভয়, কখনো আনন্দ, কখনো চিন্তা; কিন্তু যে সত্তা এগুলি প্রত্যক্ষ করছে, সেই দ্রষ্টা বা পুরুষ সবসময় অপরিবর্তনীয়, শুদ্ধ এবং স্বপ্রকাশ। যোগদর্শন বলে—এই দ্রষ্টা কখনও কার্য-কারণ-সম্পর্কে জড়িত নয়; তিনি কেবল উপস্থিতির মাধ্যমেই প্রত্যেক অভিজ্ঞতার সাক্ষী।
এখানেই আত্মা ও মন বা পুরুষ ও প্রকৃতির পার্থক্য স্পষ্ট হয়। চিত্ত-প্রত্যয় হলো প্রকৃতির ক্রিয়া—সেগুলি সময়সাপেক্ষ, গতিশীল, পরিবর্তনশীল। কিন্তু দ্রষ্টা, যিনি “অনুপাশক”, তিনি সময়াতীত, অক্রিয়, এবং সমস্ত ক্রিয়ার মধ্যে নিস্তব্ধ থেকে কেবল দেখেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরে অদ্বৈত বেদান্তে সাক্ষী-চৈতন্যের ধারণায় পরিণত হয়—যেখানে বলা হয়, আত্মা কেবল দ্রষ্টা; চিন্তা, ইচ্ছা, অভিজ্ঞতা—সবই চিত্তের তরঙ্গ, যা তাঁরই সামনে উদ্ভাসিত হয়ে মিলিয়ে যায়।
অতএব “চিত্ত-প্রত্যয়ের অনুপাশক” মানে হলো—শুদ্ধ চেতনা বা আত্মা কোনো অভিজ্ঞতার স্রষ্টা নয়, বরং সমস্ত অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী। তিনি যেমন চিত্তের প্রতিটি তরঙ্গকে দেখেন, তেমনি জগতের প্রতিটি ঘটনারও নীরব দ্রষ্টা। তাঁর কাজ শুধু দেখা—কিন্তু সেই দেখা-ই মুক্তির সূচনা, কারণ যখন মানুষ বোঝে যে, সে কেবল দ্রষ্টা, তখন সে আর চিত্তের প্রত্যয়গুলির ওঠানামায় আবদ্ধ থাকে না; তখন তার অন্তরে স্থিরতা, নীরবতা ও মুক্তি একাকার হয়ে যায়।
অন্যদিকে, অদ্বৈত-বেদান্তে এই ধারণা আরও গভীর রূপ নেয়। সেখানে বলা হয়, দ্রষ্টা হলেন আত্মা বা ব্রহ্ম—যিনি অপরিবর্তনীয়, স্বপ্রকাশ চেতনা; আর দৃশ্য হলো সমগ্র পরিবর্তনশীল জগত, যা কেবল সেই চেতনারই প্রতিফলন। “যোঽপশ্যতি চক্ষুষঃ পশ্যতি”—এটি উপনিষদীয় দর্শনের এক গভীর উক্তি, যা মানুষের ইন্দ্রিয় ও চেতনার সম্পর্ককে মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরে। এই বাক্যের ভাবের উৎস নিহিত আছে কেন উপনিষদে, যেখানে বলা হয়েছে—“যদ্ চক্ষুষা ন পশ্যতি, ইয়েন চক্ষুঃ পশ্যতি তদ্ এভ ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি” (কেন উপনিষদ, ১.৪)। অর্থাৎ—“যাকে চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু যিনি চোখকে দেখতে সক্ষম করেন, সেই ব্রহ্মকেই জেনে নাও।” এই শিক্ষার মর্ম হলো, যা-কিছু দেখা যায়, তা সীমিত; কিন্তু যে দেখে, সেই চেতনা অসীম। চোখ কেবল একটি যন্ত্র, কিন্তু সেই যন্ত্রের কার্যকারিতা নির্ভর করে—যে-চেতনা তার মধ্যে আলোকিত থাকে, তার উপরই।
এই বাণীটি দ্বৈতার্থক—একদিকে এটি বলে যে, আত্মা চোখ দিয়ে দেখেন না, কারণ আত্মা কোনো ইন্দ্রিয়নির্ভর নয়; অন্যদিকে আবার আত্মাই চোখকে কার্যক্ষম করে তোলে, কারণ সেই চেতনা না থাকলে দেখা অসম্ভব। এই কারণে উপনিষদ মানুষকে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়জগৎ থেকে ফিরিয়ে অন্তর্মুখ করে—সেই অন্তর্লীন দ্রষ্টার দিকে, যিনি সমস্ত দেখার পেছনের নিস্তব্ধ আলোকস্বরূপ। কেন উপনিষদের অন্য শ্লোকে এরই পুনরুক্তি দেখা যায়—“শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যৎ, বাচো হ বৈ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ” (কেন উপনিষদ, ১.২)। অর্থাৎ, “যিনি কর্ণেরও কর্ণ, মনেরও মন, বাকেরও বাক, প্রাণেরও প্রাণ”—এই চৈতন্যই সব কার্যকলাপের নেপথ্য শক্তি, কিন্তু নিজে কখনো কোনো ক্রিয়ার অংশ নয়।
আদি শঙ্করাচার্য তাঁর কেনোপনিষদ-ভাষ্যে এই সূত্রের ব্যাখ্যায় বলেন—“ন চক্ষুরাদি করণম্ ব্রহ্মণো দর্শনসাধনম্, কিত্তু ব্রহ্ম তেষামপ্যাশ্রয়ঃ”—ব্রহ্ম চোখ বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেখে না; বরং ইন্দ্রিয়গুলিই ব্রহ্মের চেতনার আশ্রয়ে কার্যক্ষম। অর্থাৎ, আত্মা কোনো কর্ম করে না, কিন্তু কর্মের সম্ভাবনা তাঁরই উপস্থিতিতে। এই উপলব্ধিই পরবর্তীতে অদ্বৈত-বেদান্তে “সাক্ষী-চৈতন্য” নামে পরিচিত হয়েছে—যিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়, মন, ও বুদ্ধিরও দ্রষ্টা। তিনি “চক্ষুষঃ পশ্যতি”—চোখেরও চোখ, মননেরও মনের মর্ম।
এই ধারণা কেবল কেনোপনিষদেই সীমাবদ্ধ নয়; বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে—“যো বৃত্তি নামনি চক্ষুষো চক্ষুরহ”—“যিনি চোখেরও চোখ” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩.৭.২৩)। একইভাবে দৃগ্দৃশ্যবিবেক-এও বলা হয়েছে—“রূপ দৃশ্য, চোখ দ্রষ্টা; চোখও দৃশ্য, মনই দ্রষ্টা; মনও দৃশ্য, শুদ্ধ চেতনা একমাত্র দ্রষ্টা” (দৃগ্দৃশ্যবিবেক, ১-৩)। এই সূত্রগুলির একটিই বার্তা—যা-কিছু দেখা যায় তা দৃশ্য, আর যে দেখেন, সেই চেতনা একমাত্র অচল দ্রষ্টা।
“যোঽপশ্যতি চক্ষুষঃ পশ্যতি” কেবল একটি কবিতার মতো দার্শনিক উক্তি নয়; এটি মানুষের অন্তর্মুখ হওয়ার আহ্বান। বাহ্যচোখ যে-জগৎ দেখে, তা পরিবর্তনশীল ও সীমিত; কিন্তু তার অন্তরে যে চৈতন্য-দ্রষ্টা বিরাজমান, তিনি অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত ও নিঃশব্দ। এই বাণী সেই সত্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষ চোখ দিয়ে নয়, চেতনার দ্বারা দেখে; এবং সেই চেতনা-দ্রষ্টাই সমস্ত দেখা, জানা ও বাঁচার নীরব পটভূমি, যিনি চিরন্তন ব্রহ্ম। দৃষ্ট ও দ্রষ্টার এই পার্থক্য মায়াজনিত; সত্যে দ্রষ্টা-দৃশ্য-বিভাগ লীন হয়ে যায় এক পরম অভেদে।
অতএব “দ্রষ্টা দৃশ্যমাত্র” বলতে বোঝানো হয়—যিনি দেখেন, সেই চৈতন্য চির-অপরিবর্তনশীল; আর যা-কিছু দেখা যায়, তা কেবল দৃশ্য বা অভিজ্ঞতার পরিবর্তনশীল ছায়া। জগতের সমস্ত রূপ-বৈচিত্র্য, আনন্দ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি—সবই দৃশ্যমাত্র, কিন্তু দ্রষ্টা তাদের দ্বারা কখনও কলুষিত বা পরিবর্তিত হন না।
এই উপলব্ধিই যোগ ও বেদান্ত—উভয়ের সাধনার লক্ষ্য: মানুষ যেন নিজেকে দেহ-মন-চিন্তার দৃশ্য থেকে পৃথক করে দ্রষ্টা-স্বরূপে স্থিত হতে শেখে; কারণ তখনই জানা যায় যে, পরিবর্তনশীল দৃশ্যজগৎ মিথ্যা, আর একমাত্র অচল চেতনা-দ্রষ্টাই সত্য।