মনের প্রকৃত গভীরতর কেন্দ্র হলো অবচেতন (unconscious mind)। ফ্রয়েডের মতে, এ স্তরই মানবব্যক্তিত্বের চালিকা শক্তি—এখানে সঞ্চিত থাকে দমিত আকাঙ্ক্ষা, ভয়, প্রবৃত্তি, যৌন ও আগ্রাসী তাড়না, শৈশবের অভিজ্ঞতা, অপরাধবোধ ও সংকোচের মতো নানা মানসিক উপাদান। এগুলি সচেতন স্তরে সরাসরি প্রকাশ পায় না, কারণ সমাজ, নৈতিকতা ও যুক্তির প্রভাবে সেগুলি দমন করা হয়েছে; তথাপি এরা অদৃশ্যভাবে মানুষের আচরণ, স্বপ্ন, ভাষার ভুল এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়। ফ্রয়েড বলেছিলেন, “The unconscious is the true psychical reality”—অবচেতনই মানসিক বাস্তবতার প্রকৃত রূপ, যার গহ্বর থেকে আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা ও চিন্তার স্রোত উৎসারিত হয়।
এই ত্রিস্তর-গঠনমূলক ধারণা পরবর্তী মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এটি শুধু মানবচেতনার ব্যাখ্যা দেয়নি, বরং মানুষের নৈতিকতা, শিল্পসৃষ্টি, ধর্মীয় অনুভব ও সামাজিক আচরণের বিশ্লেষণের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। ফ্রয়েডের এই মডেল থেকে আমরা বুঝতে পারি—মানুষ কেবল যুক্তিনির্ভর প্রাণী নয়; বরং তার অস্তিত্বের ভিতরে এক বিশাল অবচেতন জগৎ ক্রমাগত কার্যকর, যা অদৃশ্যভাবে তার প্রতিটি চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্তের পেছনে ছায়ার মতো কাজ করে যাচ্ছে।
বৌদ্ধ যোগাচার দর্শনের আলয়-বিজ্ঞান (Ālaya-Vijñāna) ধারণা এই অবচেতনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। আলয়-বিজ্ঞান হলো সেই গভীর চেতনাস্তর, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা ও কর্মফল বীজরূপে সঞ্চিত থাকে এবং উপযুক্ত সময়ে অঙ্কুরিত হয়ে পুনরায় প্রকাশিত হয়। ফ্রয়েড যেমন বলেছিলেন, অবচেতনে জমা থাকা অভিজ্ঞতাগুলি মানুষের আচরণে অজান্তেই প্রতিফলিত হয়, যোগাচার তত্ত্বও বলে—আলয়-বিজ্ঞানে সঞ্চিত বীজই আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও পুনর্জন্ম নির্ধারণ করে। এইভাবে আলয়-বিজ্ঞান এক অর্থে অবচেতন মনেরই এক আধ্যাত্মিক সংস্করণ, যেখানে মানসিক স্মৃতি ও কর্মফল উভয়ই সমন্বিত থাকে।
ইয়ুং এই ধারণাকে আরও প্রসারিত করে বলেন, মানুষের অবচেতন কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সমষ্টিগত (Collective Unconscious)—এটি এক সর্বজনীন চেতনা, যেখানে মানবজাতির আদিরূপ বা Archetypes সংরক্ষিত। মাতৃত্ব, মৃত্যু, আলো, অন্ধকার, বীরত্ব, ভয়—এইসব অভিজ্ঞতার প্রতীকী রূপগুলি প্রত্যেক মানুষের অবচেতনে প্রোথিত। যোগাচার দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সমষ্টিগত অবচেতনও আলয়-বিজ্ঞানের সম্প্রসারিত রূপ, যেখানে সমস্ত জীবের অভিজ্ঞতা এক মহাজাগতিক চেতনা-ভাণ্ডারে যুক্ত।
এভাবে দেখা যায়, চিত্তসন্তান, “stream of consciousness”, এবং “unconscious”—এই তিনটি ধারণা মূলত একই সত্যকে তিন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করছে। বৌদ্ধ দর্শন বলে—চেতনা এক অবিচ্ছিন্ন স্রোত, যেখানে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই, কেবল প্রবাহ আছে; উইলিয়াম জেমস বলেন—মন হলো এক অভিজ্ঞতার ধারা, যা কখনও থেমে থাকে না; আর ফ্রয়েড ও ইয়ুং বলেন—এই ধারার নিচে আরও এক গভীর স্তর আছে, যেখানে লুকিয়ে থাকে মানবমনের আসল চালিকাশক্তি।
অতএব, এই তিনটি চিন্তাধারাই একে অপরের পরিপূরক। চিত্তসন্তান তত্ত্ব চেতনার আধ্যাত্মিক ধারাবাহিকতাকে ব্যাখ্যা করে, জেমস তার মনোবৈজ্ঞানিক প্রবাহকে দেখান, আর ফ্রয়েড–ইয়ুং সেই প্রবাহের গভীর অবচেতন স্তর উন্মোচন করেন। একত্রে তারা শেখায়—মানবচেতনা কোনো স্থির বিন্দু নয়; এটি এক অনন্ত প্রবাহ, যেখানে স্মৃতি, কর্ম, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির বীজ ক্রমাগত জন্ম নিচ্ছে ও লয় পাচ্ছে।
এই উপলব্ধিই মানুষের আত্মপরিচয়ের সীমাকে ভেঙে দেয়। যখন কেউ বুঝতে পারে যে, “আমি কোনো স্থির সত্তা নই, আমি এই চেতনার প্রবাহ নিজেই”—তখনই সে মুক্তির পথে প্রবেশ করে। এই উপলব্ধি একাধারে বৌদ্ধ জাগরণের, পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানের, এবং আধুনিক চেতনা-দর্শনের মিলনবিন্দু—যেখানে মন, চেতনা ও আত্মা এক মহাস্রোতের মতো একে অপরের মধ্যে মিশে যায়।
তবে বৌদ্ধ দর্শনে এই ধারাটি শুধু মনস্তাত্ত্বিক নয়, আধ্যাত্মিকও। মুক্তি বা নির্বাণ মানে এই প্রবাহের সত্য প্রকৃতি উপলব্ধি করা। যখন সাধক দেখে—“আমি কোনো স্থায়ী আত্মা নই; আমি এক নিরবচ্ছিন্ন চেতনা-স্রোতের অংশ”—তখন তার সমস্ত আসক্তি, অহংকার ও মায়া বিলীন হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, “আমি” আলাদা কেউ নই, আমি সেই চেতনারই এক তরঙ্গ, যা অনাদি থেকে অনন্ত পর্যন্ত প্রবাহিত।
কাশ্মীর শৈব দর্শন এই ধারণাকে আরও উর্ধ্বস্তরে নিয়ে যায়। সেখানে চিত্তসন্তান মানে ব্যক্তিগত চেতনা নয়, বরং শিবচেতনার স্পন্দন (Spanda)—যেখানে চেতনার এই প্রবাহ আসলে শিবের লীলা, পরম চৈতন্যের অনন্ত উদ্ভাস।
চিত্তসন্তান তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, চেতনা স্থির নয়, এটি এক নিরবচ্ছিন্ন সৃজনপ্রবাহ। প্রতিটি অভিজ্ঞতা, চিন্তা, ও কর্ম এই প্রবাহের অংশ, এবং মুক্তি মানে এই স্রোতের মধ্যেই নিজের সীমাহীন চেতনা স্বরূপকে চিনে ফেলা। এই উপলব্ধি—যে “আমি কোনো সত্তা নই, আমি চেতনার প্রবাহ নিজেই”—এটাই বৌদ্ধ মননশীলতার ও ধ্যান-দর্শনের পরম চূড়া।
আলয়-বিজ্ঞান কেবল কর্মফল সংরক্ষণ করে না, এটি সব অভিজ্ঞতার পেছনের মৌলিক চেতনা হিসেবে কাজ করে। আমরা যখন দেখি, শুনি, চিন্তা করি—এইসব ক্রিয়াগুলির ভিত্তিতে লুকিয়ে থাকে সেই গভীর চেতনাস্তর, যা তাদের সম্ভব করে তোলে। তাই এটি অবচেতনা (unconscious)-এর মতো, কিন্তু পশ্চিমা মনোবিজ্ঞানের “unconscious”-এর চেয়ে অনেক বিস্তৃত ও গভীর। সিগমুন্ড ফ্রয়েড বা কার্ল ইয়ুং যে অবচেতন মনের ধারণা দিয়েছিলেন, যোগাচার সেই ধারণা বহু শতাব্দী আগে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাষায় প্রকাশ করেছিল।
এই তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আলয়-বিজ্ঞানের রূপান্তর বা Ālaya-parāvṛtti—যখন যোগী বা বোধিসত্ত্ব নিজের চেতনাকে বিশুদ্ধ করে, তখন এই সংরক্ষক চেতনা রূপান্তরিত হয় জ্ঞানবিজ্ঞানে (Jñāna-vijñāna)। সমস্ত অজ্ঞানের বীজ বিলীন হয়ে যায়, এবং আলয়-বিজ্ঞান তখন আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নয়, বরং সার্বজনীন চেতনার প্রকাশ। এই অবস্থাই হলো বোধি (Bodhi) বা মুক্তি—যেখানে চেতনা বুঝতে পারে, “আমি আলাদা কেউ নই, আমি সেই চেতনারই অন্তহীন প্রবাহ।”
“Ālaya-parāvṛtti” (আলয়-পরাবৃত্তি) যোগাচার (Yogācāra বা Vijñānavāda) বৌদ্ধদর্শনের একটি মৌলিক ধারণা, যা মানসচেতনার গভীরতম রূপান্তর বা অন্তর-পরিবর্তনের দিকটি নির্দেশ করে। শব্দটির গঠন বিশ্লেষণ করলে—“Ālaya” অর্থ ভাণ্ডার, আধার বা মূলচেতনাগার, আর “parāvṛtti” মানে উলটে যাওয়া, পরিণত হওয়া বা রূপান্তর। সুতরাং “Ālaya-parāvṛtti” বলতে বোঝায় আলয়-বিজ্ঞান বা মূলচেতনাগারের এক গভীর রূপান্তর—যার ফলে চেতনা নিজ স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করে।
যোগাচার মতে, সমস্ত জগৎই চিত্তমাত্র (cittamātra)—অর্থাৎ যা-কিছু আমরা অনুভব করি, দেখি বা চিন্তা করি, তা আসলে মনেরই প্রতিভাস; মনের বাইরে কোনো স্বাধীন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। এই মন বা চেতনারই এক গভীরতম স্তর আছে, যাকে বলা হয় Ālaya-vijñāna (আলয়-বিজ্ঞান)—“storehouse consciousness।” এখানে অতীত জীবনের সমস্ত বীজ (bīja) সঞ্চিত থাকে, যা পরবর্তী অভিজ্ঞতা, কর্মফল ও জন্মের কারণ হয়ে ওঠে। তাই আলয়-বিজ্ঞান হলো একপ্রকার চেতনার ভাণ্ডার, যেখানে অচেতন প্রভাব ও কর্মের সম্ভার সুপ্তভাবে বর্তমান থাকে।
কিন্তু যতক্ষণ না এই আলয়-বিজ্ঞান নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে, ততক্ষণ তা অবিদ্যা (অজ্ঞতা)-দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। এটি নিজেকে ব্যক্তি, বস্তু ও দ্বৈততার রূপে প্রকাশ করে—“আমি” ও “অন্য” এই বিভাজন সৃষ্টি করে। এই বিভাজনই দুঃখের মূল। যোগাচার দর্শনের সাধনার পরম লক্ষ্য হলো এই বিভাজনমূলক চেতনার উলটে যাওয়া বা রূপান্তর—Ālaya-parāvṛtti, অর্থাৎ আলয়-বিজ্ঞানের “পরাবৃত্তি”।
এই রূপান্তর মুহূর্তে আলয়-বিজ্ঞান আর ‘সংসার’-রূপ ভাণ্ডার থাকে না; তা রূপান্তরিত হয় অমলবিজ্ঞান (amalavijñāna) বা নির্মল চেতনায়—যেখানে আর কোনো দোষ, অবিদ্যা বা কর্মবীজ অবশিষ্ট থাকে না। তখন সমস্ত দ্বৈততা বিলীন হয়, জ্ঞান ও জ্ঞেয় একাত্ম হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় “nirvikalpajñāna”—যেখানে জ্ঞান আর কোনো বিকল্প বা ধারণা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এক অর্থে, আলয়-পরাবৃত্তি মানে মনের গভীরতম স্তরের self-reversal—মন নিজেকে চিহ্নিত করে, নিজের বীজধর্মী প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে, এবং চেতনা নিজের বিশুদ্ধ রূপে প্রতিস্থাপিত হয়।
অমলবিজ্ঞান (Amalavijñāna) যোগাচার দর্শনের সেই চূড়ান্ত মনোবোধ বা নির্মল চেতনার ধারণা, যেখানে মন নিজের সমস্ত বিকার, অবিদ্যা ও দমিত প্রবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। শব্দগতভাবে amala মানে “কলুষহীন”, “দাগহীন” বা “বিশুদ্ধ” এবং vijñāna মানে “চেতনা” বা “বোধ”—অতএব, অমলবিজ্ঞান হলো সেই পরিশুদ্ধ চেতনা, যা আর কোনো কর্মবীজের আধার নয়, বরং নিজেই সর্বব্যাপী জ্ঞানের বিশুদ্ধ আলো।
যোগাচার মতে, চেতনার স্তরগুলি বহুস্তরীয়। প্রথম ছয়টি বিজ্ঞান (দৃষ্ট, শ্রুত, ঘ্রাণ, রস, স্পর্শ ও মনোবিজ্ঞান) ইন্দ্রিয়জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সপ্তম স্তর হলো মনস্ (manas)—যা সর্বদা “আমি”-বোধ বা অহংকারবৃত্তিতে নিমগ্ন। অষ্টম স্তর হলো আলয়-বিজ্ঞান (ālaya-vijñāna)—যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, প্রবৃত্তি ও কর্মফল “বীজ”রূপে সঞ্চিত থাকে। এই আলয়-বিজ্ঞানই সংসারের মূল, কারণ এটি “আমি” ও “অন্য” এই দ্বৈততার বীজ ধারণ করে। যতক্ষণ না এই আলয়-বিজ্ঞান অবিদ্যা-নির্মিত বীজগুলির ভারে আবদ্ধ, ততক্ষণ জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলতেই থাকে।
যোগাচার সাধনার চূড়ান্ত ধাপ হলো এই আলয়-বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত রূপান্তর—আলয়-পরাবৃত্তি, অর্থাৎ চেতনার মূল উলটে যাওয়া। এই “পরাবৃত্তি”-র পর আলয়-বিজ্ঞান আর কর্মবীজ সংরক্ষণ করে না; তার সমস্ত দোষ, আচ্ছাদন ও দ্বৈত প্রতীতি বিলুপ্ত হয়, এবং তখনই সেটি রূপান্তরিত হয় অমলবিজ্ঞানে—এক সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, নির্মল, নির্বিশেষ জ্ঞানে। এই অবস্থায় মন আর কোনো বস্তুকে ‘বাইরে’ দেখতে পায় না, কারণ দর্শক ও দৃশ্যের বিভেদই সেখানে মুছে গেছে।
এই অবস্থাকে যোগাচার শাস্ত্রে বলা হয়েছে নির্বিকল্পজ্ঞান (nirvikalpajñāna)। এখানে “নির্বিকল্প” শব্দের অর্থ—যে-জ্ঞান কোনো বিকল্প বা ধারণা, নাম-রূপ, চিন্তা বা পার্থক্যের আশ্রয় নেয় না। সাধারণ চেতনা সর্বদা কোনো-না-কোনো “বিকল্প” ধারণায় আবদ্ধ—যেমন, “এটি ফুল”, “আমি দেখি”, “এটি সুন্দর”—এই প্রতিটি বাক্যেই জ্ঞাতা (subject) ও জ্ঞেয় (object)-এর দ্বৈততা আছে। কিন্তু নির্বিকল্পজ্ঞান হলো সেই চেতনা, যেখানে জ্ঞান আর কোনো ধারণার দ্বারা সীমিত নয়, যেখানে দেখা ও দেখা বস্তু একাত্ম হয়ে যায়।
অর্থাৎ, এই জ্ঞান কোনো “কিছুকে” জানে না—এটি জানার প্রক্রিয়াই নিজের মধ্যে বিলীন করে দেয়, কারণ জ্ঞানই এখানে চূড়ান্ত বাস্তবতা। এতে আর “আমি জানছি” বা “আমার জ্ঞান হচ্ছে”—এই বিভাজন থাকে না। এই অবস্থা একধরনের স্বয়ম্ভূ বোধ (svasaṃvedana)—চেতনা নিজেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকিত করে।
স্বসংবেদন (svasaṃvedana) বা নিজচেতনা যোগাচার দর্শনের এমন এক গভীর তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—চেতনা কেবল অন্য কিছুকে জানে না, নিজেকেও নিজে জানে। “স্বসংবেদন” শব্দটি এসেছে “স্ব” (নিজস্ব) এবং “সংবেদন” (অভিজ্ঞতা বা অনুভব) থেকে; অর্থাৎ, এমন এক চেতনা, যা নিজের উপস্থিতিকেও নিজের দ্বারা অনুভব করে। এই ধারণার মূল বক্তব্য হলো—জ্ঞান বা চেতনা নিজেই নিজের প্রমাণ, তার অস্তিত্ব বোঝার জন্য কোনো বাহ্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।
মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতায় চেতনা সবসময় কোনো বস্তুর দিকে মুখ করে থাকে—আমি কিছু দেখি, শুনি, ভাবি বা অনুভব করি। কিন্তু যোগাচার আচার্যগণ বলেন, এই বস্তুমুখী জ্ঞানের মধ্যেই একটি গূঢ় স্তর কাজ করে, যা নিজের উপস্থিতিকেও উপলব্ধি করে। যেমন একটি প্রদীপ নিজের আলোয় অন্য বস্তুকে আলোকিত করে, কিন্তু সেই একই আলোয় নিজেকেও দৃশ্যমান রাখে, তেমনি চেতনা যখন কোনো বস্তুকে জানে, তখন সেই জানার মধ্যেই নিজের জানাকে অনুভব করে। এই “নিজেকে জানার” বোধই স্বসংবেদন।