এই পাঁচ শক্তি কোনো বিচ্ছিন্ন শক্তি নয়; তারা এক চেতনার পাঁচ ভঙ্গি, এক সংগীতের পাঁচ সুর। তাদের সম্মিলিত ঐক্যেই কালিকার রূপ সম্পূর্ণ হয়—তিনি একই সঙ্গে আনন্দ, জ্ঞান, ইচ্ছা, ক্রিয়া ও চেতনার নিরন্তর প্রবাহ।
তাই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে বলা হয়—“কালিকা শিবস্য হৃদয়ম্”—কালিকা শিবের হৃদয়। কারণ, শিবের নিস্তব্ধ চেতনা কেবল তাঁর মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। শিব যেন নীরব সুর, আর কালিকা সেই সুরের স্পন্দন; শিব অচল আকাশ, আর কালিকা সেই আকাশের বিদ্যুৎ, যা প্রতিমুহূর্তে জেগে ওঠে ও আলোকিত করে তোলে সমস্ত জগৎ।
অভিনবগুপ্ত এই তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে বলেন—কালিকার আনন্দতাণ্ডব-এর প্রতিটি গতি শিবচেতনার প্রকাশ; তাঁর প্রতিটি স্থিরতা শিবের নিত্য উপস্থিতি। সৃষ্টি ও বিলয়, উন্মেষ ও নিমজ্জন—সব তাঁর নৃত্যে একসঙ্গে ঘটে।
কালিকা হলেন পরাশক্তির পরম প্রতীক—তিনি চেতনার জাগরণ, আনন্দের উৎস, ইচ্ছার উন্মেষ, জ্ঞানের দীপ্তি, এবং ক্রিয়ার প্রবাহ—সব একত্রে এক অনন্ত নৃত্যে। তাঁর নৃত্যেই চেতনা নিজেকে চিনে, নিজেকে ভালোবাসে, আর নিজের দীপ্তিতে জগতকে আলোকিত করে তোলে। শিবের হৃদয়ে, কালিকার নৃত্যে—সেখানেই চেতনার চূড়ান্ত ঐক্য।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালিকা-র ধারণা মূলত চেতনার অন্তর্লীন শক্তি ও তার আত্মপ্রকাশের রূপে উদ্ভাসিত। এই শক্তিকে অভিনবগুপ্ত “পরাশক্তি”—অর্থাৎ সর্বোচ্চ, এক ও অবিভাজ্য শক্তি—রূপে বর্ণনা করেছেন। শিবচেতনা নিজে যখন নিজের স্বরূপে জেগে ওঠে, তখন সেই উদ্ভাসনই কালিকা।
অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ বলেন—
“শক্তিঃ শিবস্যাভিন্না হি স্বাত্মানম্ ব্যজ্যতে যদা,
তদা বিসৃজ্যতে বিশ্বং কালিকাযাঃ স্ফুরত্তয়া।।” (Tantrāloka 12.13)
অর্থাৎ, শক্তি শিব থেকে কখনও পৃথক নয়; যখন শিব নিজের আত্মসত্তাকে প্রকাশ করেন, তখন সেই প্রকাশই কালিকা, এবং তাঁর “স্ফুরণ”—অর্থাৎ, চেতনার স্পন্দনশীল দীপ্তি—থেকেই বিশ্ব বিকশিত হয়। এখানে “স্ফুরত্তয়া” শব্দটি (স্ফুরণ = চৈতন্যের সূক্ষ্ম কম্পন) নির্দেশ করে সেই নিত্য স্পন্দ (Spanda)—চেতনার প্রাথমিক গতিশীলতা। শিবচেতনা নিস্তব্ধ ও নিরাকার, কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেই এক অনন্ত স্পন্দন নিহিত; কালিকা সেই স্পন্দনেরই রূপ।
এই ধারণাটিকে অভিনবগুপ্ত আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেন তাঁর পরা-ত্রিশিকা-বিবরণ-এ—
“পরা হি শক্তিঃ সর্বশক্তীনাং মাত্রিকা,
সা চিদানন্দরূপিণী কালিকা প্রকাশতে।।” (Parā-Triśikā-Vivaraṇa 1-2)
অর্থাৎ, পরা-শক্তিই সকল শক্তির জননী; তিনিই চিত্-আনন্দ-রূপিণী কালিকা, যিনি নিজের মধ্যেই প্রকাশিত হন। এখানে “চিত্-আনন্দ-রূপিণী” মানে চেতনা (cit) ও আনন্দ (ānanda) আলাদা নয়—চেতনা নিজের মধ্যেই আত্মসন্তুষ্ট, আর সেই আত্মসন্তুষ্টি থেকেই জন্ম নেয় আনন্দ। এই আনন্দই পরম চেতনার স্বরূপ, আর সেই আনন্দের উচ্ছ্বাসই শক্তির প্রকাশ।
অভিনবগুপ্ত একই গ্রন্থে বলেন—
“ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়া-শক্তীনাং পরা তত্ত্ব-সংহতিঃ,
সা এব কালিকা।”
অর্থাৎ, ইচ্ছা (icchā), জ্ঞান (jñāna) ও ক্রিয়া (kriyā)—এই তিন শক্তির ঐক্যই পরাশক্তির চূড়ান্ত রূপ, যিনি কালিকা।
ইচ্ছাশক্তি হল চেতনার অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা, নিজের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করার তৃষ্ণা;
জ্ঞানশক্তি হল সেই আত্মসচেতন দীপ্তি, যা চেতনার “আমি আছি” বোধকে উদ্ভাসিত করে;
ক্রিয়াশক্তি হল সেই সৃজনশক্তি, যা জ্ঞানের আলোককে রূপে রূপে প্রকাশ করে।
এই তিন শক্তির সংহতি মানেই চেতনার পূর্ণ গতি—এবং এই সমন্বিত ঐক্যই কালিকার স্বরূপ। এই তত্ত্বের মূল শাস্ত্রীয় ভিত্তি পাওয়া যায় কাশ্মীর অঞ্চলে ৯ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত ও প্রসারিত, ত্রিক (Trika) শৈবধর্মের মূল আকর গ্রন্থ, মালিনী-বিজয়োত্তর-তন্ত্র-এ—
“শূন্যাত্ পূর্ণা পরা দেবী শক্তিরেকা সদাত্মকা,
তস্যাং সর্বং প্রতিষ্ঠিতং জগদেতচ্চরাচরম্।।” (আগম শাস্ত্র বা তান্ত্রিক গ্রন্থ Mālinīvijayottara Tantra, 1.35)
অর্থাৎ, পরা দেবীই একমাত্র শক্তি, যিনি একই সঙ্গে শূন্য ও পূর্ণ—শূন্য, কারণ তিনি নিরাকার ও সীমাহীন; পূর্ণ, কারণ তিনি সমস্ত সৃজনশীল সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। এই দ্বৈতবোধ-অতিক্রান্ত অবস্থা—যেখানে নীরবতা ও গতি, স্থিতি ও সৃষ্টির ছন্দ একীভূত—তা-ই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের “শূন্য-পূর্ণতা (Śūnya-Pūrṇatā)”। কালিকা এই শূন্য-পূর্ণ পরাশক্তি, যিনি একই সঙ্গে আত্মনিষ্ঠ (śūnya) ও প্রকাশনিষ্ঠ (pūrṇa)।
অভিনবগুপ্ত এই ঐক্যকে বর্ণনা করতে বলেন—“তদেতদৈক্যমানন্দমেব।” (তন্ত্রলোক, ৫.৪৩)
অর্থাৎ, এই ঐক্যই আনন্দ। শিব ও শক্তি, নীরবতা ও নৃত্য, শূন্যতা ও পূর্ণতার এই মিলনই পরম আনন্দ (Ānanda)—চেতনার স্বরূপানন্দ, যেখানে জানা ও হওয়া, অনুভব ও অস্তিত্ব, সব এক হয়ে যায়।
এইভাবে কালিকা কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে পরম চৈতন্যের জীবন্ত স্পন্দন রূপে প্রতিষ্ঠিত। তিনি চিত্-শক্তি, কারণ তিনি চেতনা-স্বয়ং; আনন্দ-শক্তি, কারণ তিনিই আনন্দময় আত্মবোধ; ইচ্ছা-শক্তি, কারণ তিনিই প্রকাশের তৃষ্ণা; জ্ঞান-শক্তি, কারণ তিনিই আত্ম-প্রকাশিত জ্ঞান; এবং ক্রিয়া-শক্তি, কারণ তিনিই সেই জ্ঞানের রূপায়ণ। তাঁর নৃত্যই আনন্দ-তাণ্ডব—যেখানে চেতনা নিজেকে অনুভব করে, নিজেকে চিনে, নিজেকেই রূপান্তরিত করে।
তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে—“কালিকা শিবস্য হৃদয়ম্”—কালিকা শিবের হৃদয়। কারণ তাঁর মধ্য দিয়েই শিবচেতনা নিস্তব্ধতা থেকে জাগরণে, নীরবতা থেকে সৃষ্টিতে, শূন্যতা থেকে পূর্ণতায় উত্তীর্ণ হয়। এই চেতনার নৃত্যই মহাজাগতিক সৃজনের ছন্দ, এবং এই ঐক্যই কাশ্মীর শৈব দর্শনের পরম সত্য — শিবের হৃদয়ে, কালিকার নৃত্যে।
দেবী কালিকা কাশ্মীর শৈব দর্শনে কোনো পৌরাণিক দেবী নন, বরং চিদাকাশের নৃত্যরূপা চেতনা, সেই মহাশক্তি, যিনি সকল বিপরীতকে মিলিয়ে দেন। ধ্বংস এখানে বিলয় নয়, উন্মোচন; অন্ধকার মানে অজ্ঞান নয়, গভীর সম্ভাবনা। যখন ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই কালিকা-চেতনা চিনে ফেলে—যখন বুঝতে পারে যে, সে-ই সেই নৃত্যমান স্পন্দন, যে শিব ও শক্তি একাকার—তখন তার জন্য মায়া, সময়, মৃত্যু—সব বিলীন হয়ে যায়।
সেই অবস্থাই মুক্তি; সেই অবস্থাই ভৈরবত্ব। আর এই উপলব্ধিরই নাম শিবোহম্—আমি শিব, আমি কালিকা, আমি সেই চেতনা—যার কোনো শুরু নেই, কোনো অন্ত নেই, কেবল এক চিরন্তন, উচ্ছ্বসিত নৃত্য—বিশুদ্ধ চিদানন্দের অসীম প্রকাশ।
কাশ্মীর শৈবধর্মে মুক্তি মানে কোনো স্থানে গমন নয়; বরং নিজের অন্তর্নিহিত শিবত্বকে অনুধাবন করা। এই উপলব্ধি কোনো একদিনের ঘটনা নয়; এটি সাধনা (Spiritual Discipline)-র ফল, যেখানে ধ্যান, স্বচেতনতা, ও প্রেম—এই তিনটি একত্রে কাজ করে।
এই দর্শনের মহান আচার্য উৎপলদেব (Utpaladeva) তাঁর ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞান (Īśvara Pratyabhijñā) গ্রন্থে এই তত্ত্বকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, আর তাঁর মহান শিষ্য অভিনবগুপ্ত (Abhinavagupta) তা তাঁর তন্ত্রালোক (Tantrāloka) ও পরা-ত্রিংশিকা-বিবরণ (Parātriṃśikā Vivaraṇa)-এ পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত করেছেন।
অভিনবগুপ্ত বলেন—শিবই চেতনা, আর জগৎ সেই চেতনারই প্রকাশ (আভাস–Ābhāsa)। অর্থাৎ, এই বিশ্ব কোনো বাহ্য বস্তু নয়, এটি চেতনারই প্রতিফলন, চেতনারই লীলা। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, কিন্তু সেই মুখ আয়নার বাইরে আর কোথাও নেই, তেমনি জগতও চেতনার বাইরের কিছু নয়; সে চেতনারই অভ্যন্তরীণ উদ্ভাস।
এই দর্শনে জগৎ মায়া নয়, কোনো বিভ্রম নয়; বরং চেতনারই আনন্দময় প্রকাশ (লীলা—Līlā)। শিবচেতনা নিজের আনন্দে নিজেকে অসংখ্য রূপে প্রকাশ করে—রূপ, বস্ত্ত, ভাবনা, অভিজ্ঞতা—সবই সেই এক চেতনার তরঙ্গ। তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনে মুক্তি মানে জগৎ ত্যাগ নয়, বরং জগতের মধ্যেই নিজের চেতনার ঐক্যকে চেনা—এই উপলব্ধিই “প্রত্যভিজ্ঞান” (Pratyabhijñā), অর্থাৎ পুনরায় নিজের স্বরূপকে চিনে ফেলা।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের এই ধারা বোঝাতে প্রথমে ধরতে হয় আচার্য উৎপলদেবকে, যিনি ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞান (Īśvara Pratyabhijñā)-এ মূল প্রস্তাবটি স্পষ্ট করেন: মুক্তি কোনো নতুন কিছু “পাওয়া” নয়, বরং স্মরণ—নিজেরই পরম স্বরূপকে পুনরায় চেনা। “প্রতি-অভি-জ্ঞা”—প্রত্যভিজ্ঞান—আক্ষরিক অর্থেই ‘পুনরায় জানা’। এখানে জ্ঞান মানে তথ্য নয়; জ্ঞান মানে আত্মস্বরূপের স্বীকৃতি। উৎপলদেব বলেন, আমরা আদিতে শিবচেতনা; অবিদ্যার আচ্ছাদনে তা ভুলে গেছি। শাস্ত্র, সাধনা ও কৃপায় যখন এই ভুলে যাওয়া ভাঙে, তখন যে-“আমি”—তার সীমা থাকে না; সে চেতনারই অপরিসীম দীপ্তি।
এই মূলসুরকে তাঁর প্রভূত শিষ্য অভিনবগুপ্ত দুই মহাগ্রন্থ—তন্ত্রালোক (Tantrāloka) ও পরা-ত্রিংশিকা-বিবরণ (Parātriṃśikā Vivaraṇa)—এ পরিপূর্ণ রূপে প্রসারিত করেন। তিনি দেখালেন: শিব কেবল নীরব, নিস্পন্দ কোনো পরম সত্তা নন; শিবই চেতনা (চিত্), আর সেই চেতনার স্বাধীন শক্তি (স্বাতন্ত্র্য-শক্তি, Svātantrya-śakti) আছে—যে-শক্তি নিজেকে প্রকাশ করে, রূপ দেয়, লীলা রচনা করে। এই আত্মপ্রকাশের ভাষা হিসেবে অভিনবগুপ্ত ব্যবহার করেন দুটি ধ্রুব ধারণা—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শ (Vimarśa)। প্রকাশ মানে চেতনার আলোকিত স্বরূপ—“আমি আছি”; বিমর্শ মানে সেই আলো নিজেরই দিকে ফিরে দেখা—“আমি জানি যে, আমি আছি।” এই আত্মদর্শনের স্পন্দনেই চেতনা রূপে রূপে উদ্ভাসিত হয়।
সেখান থেকেই আসে তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব “আভাস” (Ābhāsa)—জগৎ হলো চেতনার উদ্ভাস, প্রতিভাসিত রূপ। অভিনবগুপ্তের ভাষায়, “শিবই চেতনা, আর জগৎ সেই চেতনারই প্রকাশ (আভাস)”—অর্থাৎ, জগৎ কোনো বহিরাগত, শিববহির্ভূত বাস্তব নয়; আবার নিছক অবাস্তবও নয়। চেতনা বা শিব হলেন সেই পরম সত্তা, যিনি নিজেই সচেতন, নিজেই আলোকিত। তাঁর বাইরে আর কিছু নেই। কিন্তু এই চেতনা নিজের আনন্দে নিজেরই দিকে তাকান—যেমন কেউ আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। এখন, আপনি আয়নায় যে-মুখটি দেখেন, সেটি আলাদা কেউ নয়; সেটি আপনারই প্রতিফলন। তবু সেই প্রতিবিম্ব সম্পূর্ণ বাস্তব, কারণ আপনি সেটিকে সত্যিই দেখছেন।
ঠিক তেমনভাবেই জগৎও শিবচেতনার আয়নায় প্রতিফলিত রূপ। শিবচেতনা নিজের স্বরূপকে জানার আনন্দে নানা রূপে, নানা ভাবনায়, নানা রঙে ও অভিজ্ঞতায় নিজেকে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশই জগৎ, যা চেতনার বাইরে কিছু নয়; বরং চেতনারই উচ্ছ্বাস, তাঁর নিজেরই লীলা। অতএব, জগৎ মিথ্যা নয়, আবার চেতনা থেকে আলাদা কোনো বাস্তবও নয়। এটি চেতনার লীলারূপ প্রকাশ—যেখানে পরম চেতনা নিজেকে দেখছেন, নিজেকে জানছেন, নিজেকেই উপভোগ করছেন।
যেমন আপনি আয়নায় নিজের মুখ দেখে জানেন—এটি আমি, কিন্তু এটি আমারই প্রতিবিম্ব—তেমনি মুক্তদৃষ্টিতে দেখা মানুষ উপলব্ধি করেন, “এই জগৎ, এই জীবন, এই আমি—সবই এক চেতনার প্রকাশ।” তখন জগৎ আর বন্ধন নয়; এটি হয়ে ওঠে আত্মদর্শনের আনন্দময় ক্ষেত্র।
এখানে মায়া শব্দটি (অদ্বৈত বেদান্তে যেটি “পরম সত্য নয়” বোঝায়) কাশ্মীর শৈবে ভিন্ন অর্থ পায়: মায়া এখানে সীমাবদ্ধতার শক্তি—দৃষ্টিতে ভেদ ঘটায়, গোপন করে; কিন্তু জগৎকে ‘মিথ্যা’ করে না। ফলে জগৎ-প্রপঞ্চ অস্বীকারের বিষয় নয়, বরং অনুভব-রূপে আত্মস্বরূপ চিনে নেওয়ার ক্ষেত্র।
এই উদ্ভাস কীভাবে ঘটে—সেই ব্যাখ্যায় অভিনবগুপ্ত আনেন স্পন্দ (Spanda)-তত্ত্ব: চেতনা নিস্তব্ধ হলেও নিস্প্রভ নয়; তার অন্তরে এক সূক্ষ্ম কম্পন আছে। এই স্পন্দনেরই নাম শক্তি; এটি আবার ভাঙে ইচ্ছা-শক্তি (Icchā), জ্ঞান-শক্তি (Jñāna), ক্রিয়া-শক্তি (Kriyā)—চেতনার ইচ্ছা, জানা, ও রূপায়ণ। তিনটির অবিচ্ছিন্ন প্রবাহেই চেতনা জগৎকে আভাসিত করে: ইচ্ছা জাগে—আনন্দে আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা; জ্ঞান সেই আকাঙ্ক্ষাকে আত্মবোধে আলোকিত করে; ক্রিয়া সেই বোধকে রূপ দেয়। তাই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়—সবই চেতনার এক অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া।
এই প্রেক্ষাপটে কালিকা-তত্ত্ব বোঝা সহজ হয়: কালিকা হলেন সেই পরাশক্তি যিনি চিত্-শক্তি, আনন্দ-শক্তি, ইচ্ছা-শক্তি, জ্ঞান-শক্তি, ক্রিয়া-শক্তি—পাঁচ শক্তির সংহত রূপ। তন্ত্রালোক ও পরা-ত্রিংশিকা-বিবরণ-এ তিনি শিবের “হৃদয়”—শিবের নীরব আলোককে স্পন্দে-প্রকাশে রূপান্তর করেন। তাঁর আনন্দতাণ্ডব-এ জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস—সবই সমানভাবে চেতনার প্রকাশ; তাই মৃত্যুও অভিশাপ নয়—রূপের বিলয়, নতুন উদ্ভাসের দ্বার। এখানেই শ্মশান-প্রতীক: যেখানে নাম-রূপ-আসক্তির আবরণ দগ্ধ হয়, আর নগ্ন চেতনা দীপ্ত হয়ে ওঠে—এ এক আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, ভয় নয়, মুক্তি।