তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়—“যথা ব্রহ্মাণ্ডে, তথা পিণ্ডে”, অর্থাৎ, যেমন বৃহৎ বিশ্ব (ব্রহ্মাণ্ড), তেমনি ক্ষুদ্র দেহ (পিণ্ড)। মানবদেহ তাই এক ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড (microcosm)—যেখানে পরম চেতনার সব গতি, ছন্দ ও শক্তি সূক্ষ্মভাবে নিহিত আছে। এই দেহে অসংখ্য সূক্ষ্ম শক্তিপথ বা নাড়ি (nāḍī) বিস্তৃত, যেগুলো কোনো শারীরিক রক্তনালী নয়, বরং প্রাণশক্তি (prāṇa)-র চলার সূক্ষ্ম পথ। এই নাড়িগুলির মধ্য দিয়ে চেতনার তরঙ্গ বা প্রাণস্পন্দন প্রবাহিত হয়, যা আমাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে একসূত্রে যুক্ত রাখে।
এই সূক্ষ্ম দেহের কেন্দ্রস্থলে, মেরুদণ্ড বরাবর অবস্থিত থাকে সাতটি প্রধান চক্র (cakra)—যেগুলি শক্তির কেন্দ্র বা কম্পনক্ষেত্র। এগুলি হলো:
১. মূলাধার (Mūlādhāra)—মেরুদণ্ডের গোড়ায়, স্থিতিশক্তির কেন্দ্র; এখানে কুণ্ডলিনী সুপ্ত থাকে।
২. স্বাধিষ্ঠান (Svādhiṣṭhāna)—প্রজননশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির কেন্দ্র।
৩. মণিপুর (Maṇipūra)—নাভিক্ষেত্রে অবস্থিত, আগুন ও রূপান্তরের শক্তি।
৪. অনাহত (Anāhata)—হৃদয়কেন্দ্র, প্রেম, করুণা ও সুরের স্পন্দন।
৫. বিশুদ্ধ (Viśuddha)—কণ্ঠে অবস্থিত, প্রকাশ ও বাক্শক্তির কেন্দ্র।
৬. আজ্ঞা (Ājñā)—ভ্রূমধ্যস্থানে, জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও মননশক্তির আসন।
৭. সহস্রার (Sahasrāra)—মস্তিষ্কের শীর্ষে, পরমচেতনার পূর্ণ ঐক্যের কেন্দ্র।
এই সাত চক্র কোনো শারীরিক অঙ্গ নয়, বরং চেতনার সাতটি স্তর, যেখানে নিম্ন থেকে উচ্চতর জাগরণ পর্যন্ত মানবসত্তার বিকাশ ঘটে।
এখন এই সূক্ষ্ম শরীরের মূলভাগে, অর্থাৎ মূলাধার চক্রে, অবস্থান করে কুণ্ডলিনী শক্তি (Kuṇḍalinī Śakti)। “কুণ্ডলিনী” শব্দটি এসেছে কুণ্ডল ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘সর্পিলভাবে কুণ্ডলিত’ বা ‘বৃত্তাকারে আবদ্ধ’। অর্থাৎ এটি সেই চেতনার শক্তি, যা নিদ্রিত অবস্থায় কুণ্ডলিত হয়ে থাকে। তাকে বলা হয় অব্যক্ত শক্তি (unmanifest energy)—যা এখনও প্রকাশিত নয়, কিন্তু সমগ্র চেতনার সম্ভাবনা ধারণ করে।
যখন সাধক যোগ, প্রণায়াম, মন্ত্র, ধ্যান বা গুরুকৃপা দ্বারা এই শক্তিকে জাগিয়ে তোলে, তখন কুণ্ডলিনী ধীরে ধীরে মেরুদণ্ড বরাবর উপরে উঠতে থাকে। এই শক্তির আরোহণকে বলা হয় ঊর্ধ্বগতি (Urdhva-gamana)। প্রতিটি চক্র ভেদ করে যখন কুণ্ডলিনী উপরে ওঠে, তখন সেই চক্রের সংশ্লিষ্ট চেতনার স্তরও জাগ্রত হয়—স্থূল প্রবৃত্তি থেকে সূক্ষ্ম জ্ঞান, ভয় থেকে প্রেম, সীমাবদ্ধতা থেকে ঐক্য—প্রতিটি ধাপে সাধক নিজের অস্তিত্বের উচ্চতর মাত্রা উপলব্ধি করে।
অবশেষে এই কুণ্ডলিনী শক্তি পৌঁছায় সর্বোচ্চ চক্রে—সহস্রার, যা পরমচেতনার আসন, প্রতীকীভাবে শিবচেতনা (Śiva-Caitanya)। এখানে ঘটে শক্তি ও শিবের মিলন (Śakti-Śiva Saṃyoga)—যেখানে ব্যক্তিগত চেতনা (জীবশক্তি বা Jīva-śakti) মহাজাগতিক চেতনার (পরাশক্তি বা Para-śakti) সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। এই মিলনই মুক্তি (Mokṣa)—যেখানে সীমিত আত্মসত্তা (Jīvātman) উপলব্ধি করে যে, সে আসলে সীমাহীন ব্রহ্মচেতনা (Paramātman) ছাড়া আর কিছু নয়।
এই মিলন কোনো বাহ্যিক বা শারীরিক ঘটনা নয়; এটি এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি—আত্মদর্শন (Self-Realization)—যেখানে বিভেদ মুছে যায়, দেহ, মন ও আত্মা এক হয়ে যায় চেতনার অনন্ত সমগ্রতায়। তখন দেহ আর কোনো বাধা নয়, বরং তা হয়ে ওঠে দেবালয় (Devalaya), যেখানে চেতনা নিজেকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করে।
তন্ত্রদর্শনের দৃষ্টিতে জগৎ ও শরীর কোনো মায়া নয়, কোনো অবিদ্যার সৃষ্টি নয়, বরং চেতনারই প্রকাশিত রূপ। অর্থাৎ, যা কিছু আমরা দেখি—দেহ, প্রকৃতি, মন, ভাবনা, ইন্দ্রিয়, এমনকি সময় ও স্থান—সবই সেই এক চেতনার স্পন্দন। এই চেতনা বা শিবচেতনা কোনো স্থির, নীরব, দূরবর্তী বাস্তব নয়; সে নিজেই শক্তি (Śakti) রূপে প্রকাশিত হয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করছে। তাই তন্ত্র বলে—“দেহে ঈশ্বর, জগতে শিব।”
শরীর ও জগৎ পরমচেতনার বিরোধী নয়, বরং তারই প্রতিফলন। যেমন আয়নায় প্রতিচ্ছবি আসল মুখটিকে আড়াল করে না, বরং সেই মুখকেই দৃশ্যমান করে তোলে—তেমনি দেহ ও বিশ্ব আসলে সেই এক চেতনার প্রতিফলনমাত্র। বেদান্ত যেখানে বলে—“জগৎ মায়া”, তন্ত্র সেখানে বলে—“জগৎ চৈতন্যের লীলা।” অর্থাৎ, বাস্তব জগৎ কোনো বিভ্রম নয়; এটি চেতনারই প্রকাশমান রূপ, যেখানে পরম সত্য নিজেকে প্রকাশ করছে।
যখন মানবচেতনা নিজের মধ্যে সুপ্ত শক্তিকে (কুণ্ডলিনী) জাগিয়ে তোলে, তখন সে উপলব্ধি করে যে, সে কেবল সীমাবদ্ধ দেহ বা মন নয়। সাধনার মাধ্যমে যখন এই কুণ্ডলিনী শক্তি ধীরে ধীরে উচ্চতর চেতনা-কেন্দ্রগুলিতে (চক্রে) উত্তীর্ণ হয়, তখন সাধক ধীরে ধীরে সমস্ত সীমাবদ্ধতা, ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও বিভেদকে অতিক্রম করে ফেলে। শেষপর্যায়ে সহস্রার চক্রে পৌঁছে সে উপলব্ধি করে—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি চেতনা নিজেই।”
এই উপলব্ধি মানে কেবল কোনো চিন্তাগত সিদ্ধান্ত নয়; এটি এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—যেখানে ব্যক্তি জানে যে, তার অস্তিত্ব দেহ বা মন দ্বারা নির্ধারিত নয়, বরং সে নিজেই সেই চিরন্তন চেতনা। তখন সে বুঝে ফেলে—শক্তি (জীবশক্তি) ও শিব (পরাশক্তি) আলাদা নয়; তারা একই চেতনার দুই দিক—একটি গতিশীল, অন্যটি স্থিত।
যখন এই দুই দিকের ঐক্য ঘটে—অর্থাৎ, যখন নিজের মধ্যে থাকা জীবশক্তি (সীমিত চেতনা) মহাজাগতিক পরশক্তির (অসীম চেতনা) সঙ্গে মিলিত হয়—তখন সমস্ত দ্বৈততা বিলীন হয়। এই অবস্থাকেই তন্ত্র বলে “নিত্য ঐক্য”—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে আর কোনো বিভেদ নেই, কোনো ‘আমি’ ও ‘তুমি’ নেই; কেবল এক অখণ্ড উপস্থিতি, এক সর্বব্যাপী সচেতনতা।
এই অবস্থাই চেতনার পরম মুক্তি (Paramamukti)—যেখানে চেতনা নিজের উৎসে ফিরে গিয়ে নিজের পূর্ণ স্বরূপে স্থিত হয়। এখানে মুক্তি কোনো মৃত্যুর পর প্রাপ্ত অবস্থা নয়, কোনো পৃথক জগৎ নয়, বরং জীবন্ত অবস্থাতেই উপলব্ধি—“আমিই সেই শিবচেতনা, আমি-ই শক্তি, আমি-ই সব।”
কাশ্মীর শৈব দর্শন—বিশেষত স্পন্দ (Spanda) ও প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā) শাখা এই প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে চেতনার স্পন্দন (Spanda) ও আত্ম-প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition)-এর মাধ্যমে। “চৈতন্যম্ আত্মা” (Śiva Sūtra, 1.1)—চেতনা নিজেই আত্মা—এই ঘোষণা তন্ত্রের মূলতত্ত্বেরই পুনরাবৃত্তি। সৃষ্টি মানে চেতনার নিজস্ব স্পন্দন, এবং মুক্তি মানে সেই স্পন্দনের নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন।
ক্রমপন্থা (Krama System)—চেতনার ধারাবাহিক উদ্ভাস: তন্ত্রের বহু শাখার মধ্যে Krama (ক্রম) হলো কাশ্মীর শৈবধর্মের একটি অদ্বৈত তান্ত্রিক ধারা, যা নবম-একাদশ শতকে বিকশিত হয়। এর আচার্যরা—এরক, জ্ঞাননেত্র, শম্ভুনাথ ও অভিনবগুপ্ত—এই তত্ত্বকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। Krama শব্দের আক্ষরিক অর্থ ধারাবাহিকতা, কিন্তু দর্শনে এটি চেতনার ক্রমিক বিকাশের প্রতীক। এখানে বলা হয়, চেতনা নিজেকে তিন প্রধান শক্তি রূপে প্রকাশ করে—ইচ্ছা (Icchā), জ্ঞান (Jñāna), ও ক্রিয়া (Kriyā)।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক্রমপন্থা (Krama Tradition)-এ ইচ্ছা (Icchā), জ্ঞান (Jñāna), ও ক্রিয়া (Kriyā)—এই তিন শক্তিকে বলা হয় চেতনার মৌলিক ত্রিধারা, বা শক্তিত্রয় (Śakti-traya)। এগুলো কোনো পৃথক শক্তি নয়, বরং এক চেতনার তিনটি স্বরূপিক দিক, যা চেতনার অভ্যন্তরীণ গতিকে প্রকাশ করে। দর্শনের সাহায্যে এই ত্রয়ীকে বুঝলে দেখা যায়—এদের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই সমগ্র সৃষ্টি ও তার পরম ঐক্যের উপলব্ধি ব্যাখ্যা করা যায়।
তন্ত্রশাস্ত্র ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এমন এক মহাশ্রোত, যেখানে দর্শন, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা একত্রে মিলিত হয়ে চেতনার পূর্ণতার এক বিজ্ঞান রচনা করেছে। এটি কোনো নিছক বিশ্বাসব্যবস্থা নয়, বরং এক প্রয়োগবাদী অধ্যাত্মবিদ্যা—যেখানে জ্ঞান (jñāna), ক্রিয়া (kriyā) এবং সাধনা (sādhana), এই তিনটি স্তম্ভের উপর সমগ্র চেতনার স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে। তন্ত্রের লক্ষ্য কেবল মুক্তি (mokṣa) নয়, বরং চেতনার প্রসারণ, অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার সীমা অতিক্রম করে মহাজাগতিক চেতনার সঙ্গে ঐক্য লাভ। “তন্ত্র” শব্দটি এসেছে “তন্” (বিস্তার করা) ও “ত্রৈ” (রক্ষা বা মুক্তি দেওয়া) ধাতু থেকে—অর্থাৎ, তন্ত্র সেই জ্ঞান যা চেতনার বিস্তারের মাধ্যমে মুক্তি ঘটায়।
তন্ত্র্যতে ইতি তন্ত্রম্ (তন্ত্র্যতে: যা প্রসারিত করে, বিস্তার করে, বা বিস্তৃত হয় (ক্রিয়ামূল:তন্, যার অর্থ 'ছড়িয়ে পড়া' বা 'প্রসারিত করা'); ইতি: এইরূপ; তন্ত্রম্: তন্ত্র (শাস্ত্র বা ব্যবস্থা))—ক্ষেমরাজ, স্পন্দ নির্ণয়, ১.১; অর্থাৎ, "যা বিস্তার করে (বা জ্ঞানকে প্রসারিত করে), তাই তন্ত্র।" এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, তন্ত্র কোনো সংকীর্ণ আচার-ভিত্তিক ব্যবস্থা নয়, বরং এটি চেতনার বিকাশের একটি পদ্ধতি।
তন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের সীমিত চেতনাকে (পিণ্ড বা জীবাত্মা)-কে মহাবিশ্বের পরম চেতনার (ব্রহ্মাণ্ড বা শিব)-এর সঙ্গে অভিন্ন রূপে প্রসারিত করা। এটি হলো সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি বা মোক্ষ লাভের পথ। তন্ত্র সেই শাস্ত্র বা জ্ঞানকে বোঝায়, যা সাধারণ মানুষের কাছে গোপন থাকা পরম সত্য সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান দেয় এবং সেটিকে প্রসারিত করে। এটি সেই প্রক্রিয়া, যা জীবাত্মাকে মায়া ও সীমিত ধারণার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে তার অন্তর্নিহিত অসীম স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya) উপলব্ধিতে সাহায্য করে। এই প্রসারিত জ্ঞান বা দৃষ্টিই ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়।
এই দৃষ্টিতে তন্ত্রের মৌল তত্ত্ব হলো: “যথা ব্রহ্মাণ্ডে তথা পিণ্ডে”—ব্রহ্মাণ্ড ও দেহ একে অপরের প্রতিবিম্ব। মানবদেহ কেবল জৈব সংগঠন নয়, এটি মহাজাগতিক শক্তির এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। মুক্তি কোনো দেহ-বর্জিত অবস্থা নয়; বরং দেহ, ইন্দ্রিয় ও প্রাণে নিহিত চেতনার জাগরণ। তাই তন্ত্র মায়াবাদী বেদান্তের মতো জগৎকে অস্বীকার করে না; এটি বলে—জগৎই শিব ও শক্তির লীলা, চেতনারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এখানে অদ্বৈত মানে নিষ্ক্রিয় নিস্তব্ধতা নয়, বরং এক গতিশীল ঐক্য, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের তিন ধারা সৃষ্টি করে।
শিব ও শক্তি তন্ত্রের কেন্দ্রীয় নীতি। শিব হলেন বিশুদ্ধ চৈতন্য (cit), আর শক্তি সেই চৈতন্যের প্রকাশ (śakti), তার আত্মবিমর্শ বা vimarśa শক্তি। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক (১.৩৭)-এ বলেন: শিবঃ শক্ত্যা যুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুম্—"যদি শিব, শক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তবেই তিনি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন।" এটি শিব ও শক্তির অবিচ্ছেদ্য একত্বকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ, শিব শক্তি-সহ থাকলেই কার্যক্ষম হন। শক্তি ছাড়া শিব নীরব, যেমন আগুন ছাড়া দীপ্তি নেই। শক্তি হলেন সেই অনন্ত সম্ভাবনা, যিনি নীরব চেতনার মধ্যে আন্দোলন সৃষ্টি করেন, আর সেই আন্দোলনই বিশ্বরূপে বিকশিত হয়।
এই চেতনার প্রকাশ সবচেয়ে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয় মানবদেহে। তন্ত্র মতে, দেহ কোনো বন্ধন নয়, বরং মুক্তির মন্দির। মেরুদণ্ড বরাবর যে সাতটি শক্তিকেন্দ্র (চক্র) ও ৭২,০০০ নাড়ি প্রবাহিত, সেগুলিই হলো চেতনার সূক্ষ্ম স্রোত। দেহের গভীরে, মূলাধারে, নিদ্রিত অবস্থায় অবস্থান করে কুণ্ডলিনী শক্তি—যিনি জাগ্রত হলে সুষুম্না নাড়ী পথে ঊর্ধ্বগামী হয়ে সহস্রারে শিবের সঙ্গে মিলিত হন। এই মিলনই হলো যোগ—চেতনা ও শক্তির ঐক্য, ব্যক্তিসত্তা ও মহাজাগতিক সত্তার সংযোগ।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের স্পন্দ ও প্রত্যভিজ্ঞা শাখায় এই অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা হয় যথাক্রমে চেতনার স্পন্দন (spanda) ও স্ব-স্বীকৃতি (pratyabhijñā) হিসেবে। “চৈতন্যম্ আত্মা”—“চেতনা নিজেই আত্মা”—(শিবসূত্র, ১.১)—এই সূত্রটি এই দর্শনের ভিত্তি। সৃষ্টি মানে চেতনার নিজস্ব স্পন্দন, আর মুক্তি মানে সেই স্পন্দনের নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন।
এই তত্ত্বের আরও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কাশ্মীরের অদ্বৈত তান্ত্রিক ধারা ক্রমপন্থায় (Krama system)। নবম থেকে একাদশ শতাব্দীতে এই ধারা বিকশিত হয় এরক, জ্ঞাননেত্র, শম্ভুনাথ ও অভিনবগুপ্ত প্রমুখ আচার্যদের দ্বারা। Krama অর্থ ধারাবাহিকতা—চেতনার উদ্ভাসের ক্রম। এখানে বলা হয়, পরমচৈতন্য নিজের তিন রূপে প্রকাশিত হয়:
১. ইচ্ছা (Icchā)—“আমি সৃষ্টি করতে চাই।”
২. জ্ঞান (Jñāna)—“আমি জানি আমি কী সৃষ্টি করছি।”
৩. ক্রিয়া (Kriyā)—“আমি সৃষ্টিকে সম্পন্ন করছি।”