অবিদ্যা-বিদ্যা: ৩৪



বন্ধন সৃষ্টিকারী কর্মের বিনাশ: জ্ঞান সাধারণত তিনটি স্তরের কর্মফলকে প্রভাবিত করে:

সঞ্চিয়মান কর্ম (Sanchiyamana Karma): যা বর্তমানে করা হচ্ছে। জ্ঞানীর কর্ম অহংকারমুক্ত হওয়ায় তা আর নতুন বন্ধন সৃষ্টি করে না।

সঞ্চিত কর্ম (Sanchita Karma): যা পূর্বের অসংখ্য জন্মে অর্জিত এবং বর্তমানে ভোগের জন্য অপেক্ষমাণ। এই কর্মের বৃহৎ অংশ জ্ঞান লাভ মাত্রই ভস্মীভূত হয়।

অবিনাশী ফল: জ্ঞান কেবল বন্ধন-সৃষ্টিকারী কর্মকে নষ্ট করে। প্রারব্ধ কর্ম (Prarabdha Karma)—অর্থাৎ, যে-কর্মের ফল ইতোমধ্যে ফলতে শুরু করেছে এবং যার কারণে দেহধারণ করা হয়েছে—তা ভোগ না করে শেষ হয় না। তবে সেই কর্মের ফল জ্ঞানীকে স্পর্শ করে না, কারণ তিনি তখন কেবল সাক্ষী বা দ্রষ্টা।

অদ্বৈত বেদান্ত এই শ্লোকটিকে জ্ঞানই মোক্ষের একমাত্র প্রত্যক্ষ সাধন—এই সিদ্ধান্তের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। যখন জীবাত্মা উপলব্ধি করে যে, "আমি ব্রহ্ম" (অহং ব্রহ্মাস্মি), তখন অজ্ঞান (যা কর্মের মূল) সম্পূর্ণরূপে দূর হয়। অজ্ঞান দূর হওয়ার ফলে তার সৃষ্ট কর্মফল আর আত্মার বন্ধনের কারণ হয় না। এই জ্ঞানাগ্নির দ্বারা কর্তৃত্বের অহংকার পুড়ে যায়, ফলে আর কোনো কর্মফল অবশিষ্ট থাকে না, এবং আত্মা মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করে।

জ্ঞানই মুক্তির প্রত্যক্ষ কারণ, কর্ম নয়। কর্মের কাজ কেবল মনকে প্রস্তুত করা, পাত্রতা তৈরি করা; কিন্তু মুক্তি ঘটে জ্ঞানের প্রকাশে, যখন আত্মা নিজের স্বরূপে জেগে ওঠে। এই অবস্থায় জ্ঞানী ব্যক্তি বাহ্যত কর্ম করেন, কিন্তু আসলে কিছুই করেন না। তাঁর জন্য কর্ম কেবল দেহের স্তরে ঘটে, চেতনার স্তরে নয়। তিনি কর্তা নন, সাক্ষীমাত্র।

এই কারণেই শঙ্করাচার্য জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়-বাদ (জ্ঞান ও কর্মের একত্রীকরণবাদ)-এর বিরোধিতা করেন। কারণ জ্ঞান ও কর্ম পরস্পরবিরোধী—জ্ঞান একত্বে স্থাপন করে, কর্ম দ্বৈততা ধরে রাখে। যেখানে একত্ববোধ আছে, সেখানে কর্মের উদ্দেশ্যই বিলীন। তাই বেদান্ত ঘোষণা করে—“মুক্তি কেবল বিদ্যায়; বিদ্যা-অন্ধকারে নয়। কর্ম জগৎকে বহন করে, কিন্তু জ্ঞান জগৎকে বিলীন করে।”

অর্থাৎ, কর্ম চক্রে-চলমান জীবনের গতি বজায় রাখে, আর জ্ঞান সেই চক্র থেকে মুক্তি দেয়। এইভাবে, “ন হি জ্ঞানের সন্নিধৌ কর্ম বিদ্যতে” বাক্যটি শুধু দার্শনিক ঘোষণা নয়; এটি আত্মমুক্তির মানচিত্র—যেখানে অবিদ্যার মৃত্যু মানেই কর্মের অবসান, আর কর্মের অবসান মানেই চিরচেতনার উদ্ভাস—যা অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।

এই জ্ঞানের তিন স্তম্ভ বা পর্যায় বেদান্তে নির্ধারিত হয়েছে—শ্রবণ (Śravaṇa), মনন (Manana) ও নিদিধ্যাসন (Nididhyāsana)।

শ্রবণ—অর্থাৎ, গুরুর কাছ থেকে শ্রুতি বা উপনিষদের বাণী শোনা এবং তার অর্থ বোঝা। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের চারটি প্রধান বাক্যকে মহাবাক্য বলা হয়। এই বাক্যগুলো ব্রহ্ম (পরম সত্য) এবং আত্মার (ব্যক্তিগত সত্তা) অভেদত্ব ঘোষণা করে। শ্রবণেই প্রথম বার শিষ্য শোনেন সেই চিরন্তন মহাবাক্যসমূহ—

১. প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম (Prajñānam Brahma), যার—অর্থ: চেতনা (জ্ঞান বা প্রজ্ঞা) নিজেই ব্রহ্ম; উৎস: ঐতরেয় উপনিষদ (৩.৩); তাৎপর্য: এটি ব্রহ্মের স্বরূপকে সংজ্ঞায়িত করে—ব্রহ্ম হলেন নিছক জ্ঞান বা শুদ্ধ চৈতন্য।

২. অহং ব্রহ্মাস্মি (Ahaṁ Brahmāsmi), যার—অর্থ: আমিই ব্রহ্ম; উৎস: বৃহদারণ্যক উপনিষদ (১.৪.১০); তাৎপর্য: এটি স্বানুভূতির ঘোষণা—জীবাত্মা যখন নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে, তখন সে ঘোষণা করে যে, সে ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন।

৩. তৎ ত্বম্ অসি (Tat Tvam Asi), যার—অর্থ: তুমিই সেই (ব্রহ্ম); উৎস: ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.৮.৭); তাৎপর্য: এটি গুরুর পক্ষ থেকে শিষ্যকে দেওয়া উপদেশের বাক্য—গুরু নির্দেশ করেন যে, শিষ্যের (জীবের) প্রকৃত স্বরূপ হলো সেই পরম সত্য (ব্রহ্ম)।

৪. অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম (Ayam Ātmā Brahma), যার—অর্থ: এই আত্মাই ব্রহ্ম; উৎস: মাণ্ডূক্য উপনিষদ (মন্ত্র ২); তাৎপর্য: এটি পরিচয়ের বাক্য, যা ঘোষণা করে, ব্যক্তিগত আত্মা এবং পরমাত্মা, মূলত এক ও অভিন্ন।

এই চারটি মহাবাক্যই বেদান্তের জ্ঞানের মর্মবাণী—সব ভেদ মুছে দিয়ে এক চিরচেতনা সত্যের ঘোষণা।

এরপর আসে মনন (Manana)—অর্থাৎ, যুক্তি ও তর্কের দ্বারা সমস্ত সন্দেহের অপসারণ। শ্রবণে শোনা সত্যটি এখানে বুদ্ধির আলোয় বিশ্লেষিত হয়, যাতে কোনো দ্বিধা অবশিষ্ট না থাকে। শঙ্কর বলেন, “যতক্ষণ সন্দেহ থাকে, ততক্ষণ জ্ঞান পরিণত হয় না।”

শেষ ধাপ নিদিধ্যাসন (Nididhyāsana)—অর্থাৎ, গভীর ধ্যান, যেখানে শ্রবণ ও মননে অর্জিত জ্ঞান অন্তরের অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়। এটি কেবল চিন্তা নয়—এক গভীর অভ্যন্তরীণ স্থিতি, যেখানে মন একেবারে নিবিষ্ট হয়ে যায় সেই উপলব্ধিতে—“আমি ব্রহ্ম।” তখন মহাবাক্যের অর্থ জীবন্ত হয়ে ওঠে—শ্রুতির শব্দ নয়, নিজের অস্তিত্বের অনুভূতি হয়ে জেগে ওঠে।

এভাবেই জ্ঞান-কাণ্ডের সাধক ক্রমে “শ্রবণ” থেকে “মনন” এবং “মনন” থেকে “নিদিধ্যাসন”-এর স্তরে ওঠে—যেখানে শোনা জ্ঞান পরিণত হয় প্রত্যক্ষ বোধে। তখন আর কোনো প্রমাণ, কোনো উপাসনা, কোনো ভাবনাও প্রয়োজন হয় না—কারণ তখনই উপলব্ধি ঘটে যে—“যে জানে, সে-ই সেই”—জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় একাকার।

এই উপলব্ধিই মুক্তি (Mokṣa)—যেখানে আর কোনো অর্জন নেই, কেবল আবরণ-ভঙ্গ—যা ছিল, তা-ই প্রকাশিত হয়। জ্ঞান ও কর্ম তখন আর পৃথক থাকে না—কর্ম জ্ঞানকে প্রস্তুত করে, আর জ্ঞান কর্মকে অতিক্রম করে নিয়ে যায়। মুক্তি সেই চূড়ান্ত অবস্থান, যেখানে জ্ঞানের আলোয় সকল কর্তব্য, সকল ভেদ, সকল অনুসন্ধান একত্রে লীন হয়ে যায় সেই এক অপরিবর্তনীয় চৈতন্যে।

যখন আত্মজ্ঞান কেবল বুদ্ধিগত ধারণা থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, তখন ঘটে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার (Brahma-Sākṣātkāra)—অর্থাৎ, ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এটি কোনো তর্ক, যুক্তি বা চিন্তা নয়; এটি এক সর্বব্যাপী, সর্বসমন্বিত চেতনার জাগরণ, যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনের বিভাজন বিলীন হয়। এই অবস্থায় সাধক জানেন—“আমি আত্মা, আমি ব্রহ্ম, আমি সেই এক চৈতন্য যা সব কিছুর সাক্ষী, কিন্তু কোনো কিছুর অংশ নয়।”

এই উপলব্ধিতে মানুষের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ বদলে যায়। যা আগে ভেদ ও সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ ছিল, এখন তা একতায় মিশে যায়। “কর্তা” ও “ভোক্তা”—এই দুটি ধারণা তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ কর্তা-ভাব আসে দেহাত্মবোধ থেকে, আর ভোক্তা-ভাব আসে সুখ-দুঃখের আসক্তি থেকে। জ্ঞানী জানেন, কর্ম ও ভোগ উভয়ই মায়ার স্তরে ঘটে—সাক্ষী চেতনা অপরিবর্তিত থাকে।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থার ইঙ্গিত দিয়েছেন—
“যঃ সর্বত্রানভিস্নেহঃ তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্‌।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্ঠি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।” (গীতা, ২.৫৭)

অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি সব কিছুর মধ্যে নিরাসক্ত, যে শুভ-অশুভ উভয়েরই সমভাবে সাক্ষী, সে স্থিতপ্রজ্ঞ—অপরিবর্তনীয় জ্ঞানের অধিকারী। এই শ্লোকটি স্থিতপ্রজ্ঞ (যিনি স্থিতধী বা স্থির বুদ্ধি লাভ করেছেন) ব্যক্তির লক্ষণ বর্ণনা করে। এটি কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মিলনভূমি:

আসক্তিহীনতা (অনভিস্নেহঃ): স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি জাগতিক বস্তু বা ফলের প্রতি আসক্ত হন না (ন সর্বত্রানভিস্নেহঃ)।

সমতা (শুভাশুভম্): তিনি শুভ ফল (সাফল্য) বা অশুভ ফল (ব্যর্থতা/দুঃখ) যা-ই লাভ করুন না কেন, তিনি সেগুলোকে সমানভাবে গ্রহণ করেন।

নিরাসক্তি: শ্লোকটির শেষাংশে বলা হয়েছে, তিনি অভিনন্দন করেন না এবং ঘৃণাও করেন না (নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি)।

এই শ্লোকটি বোঝায় যে, জ্ঞানী ব্যক্তি বা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি হলেন সে-ই, যিনি কর্ম করেন কিন্তু কর্মফলের ভালো-মন্দে কোনো প্রকার আবেগগত আসক্তি বা প্রতিক্রিয়া দেখান না, অর্থাৎ তিনি সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন।

এই জ্ঞানের ফল হলো জীবন্মুক্তি (Jīvanmukti)—অর্থাৎ, জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি। জ্ঞানী ব্যক্তি দেহে অবস্থান করলেও দেহাত্মবোধে আবদ্ধ থাকেন না। তিনি জানেন—“দেহ জন্মেছে, দেহ মরবে; কিন্তু আমি জন্মহীন, মৃত্যুহীন চৈতন্য।” তাঁর কাছে জগৎ স্বপ্নের মতো—দেখা যায়, অনুভব হয়, কিন্তু তাকে আর প্রতারণা করে না।

জীবন্মুক্ত অবস্থায় তিন প্রকার কর্মের ফল আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে।

প্রথমত, সঞ্চিত কর্ম (Saṃcita Karma)—অর্থাৎ বহু জন্মের সঞ্চিত কর্মফল—তা জ্ঞানাগ্নিতে পুড়ে যায়। উপনিষদে বলা হয়েছে,
“যথৈধাংসি সমিদ্ধো’গ্নিঃ ভস্মসাৎ কুরুতে’র্জুন।
তদ্বিদ্বান্‌ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।” (মুণ্ডক উপনিষদ, ২.২.৮)
অর্থাৎ, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাঠকে ভস্ম করে দেয়, তেমনি জ্ঞানের অগ্নি সমস্ত সঞ্চিত কর্মকে দগ্ধ করে।

দ্বিতীয়ত, আগামী কর্ম (Āgāmī Karma)—অর্থাৎ এই জন্মে নতুন করে যে-কর্মফল তৈরি হতে পারত—তা আর জন্ম নেয় না, কারণ জ্ঞানীর মধ্যে কর্তার ভাবই বিলীন হয়েছে। কর্তা না থাকলে ফলের ভোগীর অস্তিত্বও থাকে না।

তৃতীয়ত, প্রারব্ধ কর্ম (Prārabdha Karma)—অর্থাৎ, যে-কর্মফল ইতিমধ্যেই কার্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে এবং এই দেহের স্থায়িত্বে সাহায্য করছে—তা দেহ অবধি চলতে থাকে। যেমন ঘূর্ণায়মান চক্রে ছোড়া বর্শা কিছু দূর যাওয়ার পরই স্থির হয়, তেমনি জ্ঞানপ্রাপ্তির পর দেহধারণ কেবল পূর্বপ্রারব্ধের কারণে কিছু সময় চলে।

যখন এই প্রারব্ধও ক্ষয় হয়—অর্থাৎ, দেহ পতিত হয়—তখন ঘটে বিদেহমুক্তি (Videhamukti)। এটি মুক্তির চূড়ান্ত স্তর, যেখানে আর কোনো উপাধি বা কর্ম অবশিষ্ট থাকে না। তখন আত্মা সম্পূর্ণভাবে শুদ্ধ-ব্রহ্মে লীন হয়—না কর্তা, না ভোক্তা, না দেহ, না মন—শুধু বিশুদ্ধ চৈতন্য, অদ্বিতীয়, নির্লিপ্ত, স্বয়ং-প্রকাশ।

গীতায় (৫.৮) শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থাকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন—
“নৈব কিঞ্চিত্ করমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্‌।
পশ্যন্ শ্রৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ন্ স্বপন্ শ্বসন্‌।।”
অর্থাৎ, সত্যজ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত কাজ করেও মনে করেন—“আমি কিছুই করছি না।” দেখা, শোনা, স্পর্শ, গমন—সবই দেহের স্তরে ঘটে; আত্মা কেবল দ্রষ্টা, সাক্ষী।

এই শ্লোকটি জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগের সমন্বয় সাধন করে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে বর্ণনা করে। এটি বিশেষভাবে কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ (Non-doership) নীতির ওপর জোর দেয়:

তত্ত্বজ্ঞানী (তত্ত্ববিত্) ও যোগযুক্ত: তত্ত্বজ্ঞানী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আত্মা এবং ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান লাভ করেছেন। তিনি যোগযুক্ত (যুক্তঃ) থাকেন, অর্থাৎ তাঁর বুদ্ধি কর্মফল এবং দ্বৈতভাবের প্রতি সমতা লাভ করেছে।

'আমি কিছুই করছি না' নীতি: জ্ঞানী ব্যক্তি দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, গন্ধ নেওয়া, খাওয়া, যাওয়া, ঘুমানো, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া—ইত্যাদি সকল কাজ করার সময়েও মনে করেন, "আমি কিছুই করছি না" (নৈব কিঞ্চিত্ করমি)।

প্রকৃতির কর্তৃত্ব: শ্লোকটির পরের অংশে বলা হয়েছে যে, জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন, তাঁর কাজসমূহ তাঁর আত্মা করছে না, বরং ইন্দ্রিয়গুলিই তাদের বিষয়বস্তুর মধ্যে কাজ করছে। তাঁর এই চেতনা থাকে যে, আত্মা কেবল সাক্ষী (Witness) মাত্র, আর সমস্ত কার্য প্রকৃতির গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ)-এর দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে—যেমনটি গীতার ৩.২৭ শ্লোকেও বলা হয়েছে।

এই শ্লোকটি বোঝায় যে, মুক্তি লাভকারী বা ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান না, বরং তিনি কর্ম করেন কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ করে, যা তাঁকে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত রাখে।

এই জীবনমুক্ত অবস্থা সেই তুরীয় চৈতন্যেরই জীবন্ত প্রতিফলন—যেখানে ব্যক্তি ও ব্রহ্ম একাকার। জ্ঞানীর কাছে জগৎ এখন আর বাস্তব নয়, কিন্তু তা মিথ্যা বলেও অস্বীকারযোগ্য নয়—এটি কেবল ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব, এক চিরন্তন লীলা।

যখন দেহ পড়ে, তখন যা ছিল আড়ালে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আত্মা ও ব্রহ্ম এক; কোনো বিভাজন নেই। এই অবস্থাই বিদেহমুক্তি, চূড়ান্ত লয়—যেখানে বলা যায় না, “জ্ঞানী আছেন” বা “নেই”, কারণ সেখানে আর কোনো দ্বিত্ব বা ব্যক্তিত্ব অবশিষ্ট থাকে না; থাকে কেবল সেই এক—অচল, অসীম, নির্বিকার ব্রহ্ম, যিনি সব অবস্থারও পরম সাক্ষী।

এভাবে, পঞ্চকোষের সিঁড়ি বেয়ে আত্মা-ব্রহ্ম-ঐক্য-জ্ঞান লাভই মানবজীবনের চরম পরিণতি। এটি কোনো দূরলক্ষ্য নয়, বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপে প্রত্যাবর্তন—যেখানে জানা যায়, “আমি কখনও দেহ ছিলাম না, কখনও পৃথক ছিলাম না; আমি চিরন্তন ব্রহ্ম, এক ও অভেদ”।